ক্ষমতায়নের এই বিশ্বে আপাতদৃষ্টিতে সবস্থানেই পুরুষের জয়জয়কার। যেদিকেই তাকানো যায়, সেদিকেই যেন ফুটে ওঠে পুরুষতন্ত্রের প্রভাব। তবে কালাতিক্রমে পিছিয়ে নেই নারীরাও। রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক কার্যক্রমসহ সমাজের সকল ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ আজ প্রবলভাবে বিদ্যমান। ক্ষমতার দিক থেকেও অনেক এগিয়ে গেছে নারীরা। দৃশ্যমানতা এবং অর্থনৈতিক প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে প্রতি বছর বিশ্বের ক্ষমতাধর ১০০ জন নারীর তালিকা প্রকাশ করে জনপ্রিয় সাময়িকী ফোর্বস। ফোর্বসের দৃষ্টিতে ২০১৬ সালের ক্ষমতাধর শীর্ষ দশ নারীকে নিয়ে আমাদের আজকের এই আয়োজন।
১. এঙ্গেলা ম্যারকেল
এঙ্গেলা ম্যারকেল; নামটা সবার কাছেই কম বেশি পরিচিত। ২০০৫ সালের ফেডারেল নির্বাচনের মাধ্যমে প্রথম নারী হিসেবে জার্মানির সর্বোচ্চ আসন পেয়ে এঙ্গেলা ম্যারকেল নিযুক্ত হন চ্যান্সেলর হিসেবে। এরপর ২০০৭ সালে দ্বিতীয় নারী হিসেবে ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।
১৯৫৪ সালে জন্ম নেওয়া ম্যারকেলের রাজনীতিতে অভিষেক হয় ১৯৯০ সালে। বর্তমানে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন এঙ্গেলা। বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও অভিবাসনের প্রশ্নে তার মতামত গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়। বিগত কয়েক বছর অনুমোদন রেটিং ওঠা-নামা করলেও বর্তমানে বেশ ভাল অবস্থানে আছেন তিন বার হওয়া এই জার্মান চ্যান্সেলর। এসবের বাইরেও দু দু’বার তিনি ফোর্বস ম্যাগজিনেরই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্বের তালিকায় দ্বিতীয়তে ছিলেন; যা কিনা যেকোনো নারীর জন্যই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর আসন।
গত বছর সিরিয়াসহ বেশ কয়েকটি ইস্যুতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আবারো ফোর্বসের দৃষ্টিতে ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় তার অবস্থানই সর্বপ্রথমে। তার তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে জার্মানিতে তার সমর্থকরা তাকে ‘মাম্মি’ বলেও সম্বোধন করে থাকে।
২. হিলারি ক্লিনটন
‘হিলারি ক্লিনটন’ রাজনৈতিক মহলের বহুল আলোচিত এক ব্যক্তিত্ব। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ও ফার্স্ট লেডি ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলেও সেবার মনোনয়ন পেয়েছিলেন বারাক ওবামা। এতে করে সে সময়ই ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট প্রার্থীর মনোনয়ন সম্পর্কে সবাই নিশ্চিত হয়।
এই ধারা অনুযায়ী ২০১৬ নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের হয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন। কাগজে-কলমে সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট হবার তালিকায় এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত হেরে যান ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। তবে ফলাফল যা-ই হোক না কেন, প্রভাব বিস্তারের দিকে দিয়ে তিনি ২০১৬ সাল অবধি ছিলেন বিশ্বের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর নারী। তবে ডেমোক্রেট এই রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে রিপাবলিকানদের হাত ধরেই। ১৯৬৮ সালে তিনি যোগ দেন ডেমোক্রেটে। তার পরিচয় হয় বিল ক্লিনটনের সাথে এবং তাদের বিয়ে হয় ১৯৭৫ এ।
১৯৯৩ থেকে ২০০১ পর্যন্ত হিলারি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি। এ সময় লিঙ্গ সমতা ও স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার নিয়ে কাজ করেন তিনি। এছাড়াও গত তিন দশক ধরে ক্ষমতা ও প্রশাসনের কেন্দ্রে আছেন সাবেক এই মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব।
৩. জ্যানেট ইয়েলেন
মার্কিন অর্থনীতিবিদ জ্যানেট ইয়েলেন ইতিহাসের প্রথম নারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারপার্সনের পদে অধিষ্ঠিত হন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মনোনয়নের পর মার্কিন সিনেটের অনুমোদনের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। এর আগে ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত একই প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারপার্সন এবং সান ফ্রান্সিস্কোর ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন জ্যানেট।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির এ শিক্ষক কাজ করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবেও। বিশ্ব অর্থনীতির হর্তাকর্তা প্রতিষ্ঠানের এ প্রধান নির্বাহী তাই গত চার বছর ধরেই আছেন শীর্ষ ক্ষমতাধর নারীর প্রথম তিন জনের তালিকায়। এছাড়াও নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ স্বামী জর্জ অ্যাকারলফের স্ত্রী হিসেবেও পরিচিতি আছে তার।
৪. মেলিন্ডা গেটস
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে জন্ম নেয়া মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ ভাষায় পড়াশুনা শেষ করে ১৯৮৭ সালে নিজ যোগ্যতায় যোগ দেন সফটওয়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটে। কাজ করেন মাইক্রোসফট বব, মাইক্রোসফট এনকার্টা, এক্সপিডিয়া সহ আরও বেশ কয়েকটি প্রকল্পে।পরবর্তী সময়ে ১৯৯৪ সালে মেলিন্ডা বিয়ে করেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসকে। ১৯৯৮ সালে তারা গঠন করেন ‘বিল এন্ড মেন্ডিলা ফাউন্ডেশন’। এ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তাদের দানকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ জন্য অবশ্য দেশে-বিদেশে অনেক সম্মাননাও পেয়েছেন তিনি। দেশপ্রেমিক ও দানবীর এ নারী ফোর্বসের তালিকায় রয়েছেন চার নম্বরে।
৫. মেরি ব্যারা
১৮ বছর বয়সেই মার্কিন গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরসের হয়ে কাজে হাতেখড়ি হয় মেরি ব্যারার। তখন কাজ করতেন শিক্ষার্থী হিসেবে। এরপর কাজ করতে থাকেন নানা ক্ষেত্রে, বাড়তে থাকে অভিজ্ঞতা এবং সেই সাথে দক্ষতাও। কালের আবর্তে হয়ে যান জেনারেল মোটরসের প্রথম নারী প্রধান নির্বাহী। দায়িত্ব পাবার পর পরই বেশ জটিল পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হয় তাকে। তবে তা শক্ত হাতেই মোকাবেলা করেন তিনি। ফরচুনের চোখে মেরি ২০১৬ সালের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী হলেও ফোর্বসের তালিকায় তার অবস্থান পাঁচে।
৬. ক্রিস্টিন ল্যাগার্ডে
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ফ্রেঞ্চ আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ক্রিস্টিন ল্যাগার্ডে ফোর্বসের তালিকায় বিশ্বের ষষ্ঠ ক্ষমতাধর নারী। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন বিভিন্ন দেশের মুদ্রামান হ্রাস-বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান অর্থাৎ ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে। এর আগে তিনি ফ্রেঞ্চ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
জি-৮ এর প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী হয়ে তিনি সেখানকার অর্থনৈতিক গতিকে ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি বেশ সুনামও কুড়িয়েছেন। তার ফলাফল হিসেবে ২০০৯ সালে ব্যবসা ও অর্থনীতি ভিত্তিক বিখ্যাত দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইম তাকে ইউরো জোনের সেরা অর্থনীতিবিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে প্রথম মেয়াদে ২০১১-২০১৬ পর্যন্ত ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করার পর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২০১৬ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে পদটির জন্য মনোনীত হন এই ফ্রেঞ্চ নারী।
৭. শেরিল স্যান্ডবার্গ
ফেসবুক, বর্তমান বিশ্বের আলোচিত ও বহুল ব্যবহৃত নামগুলোর মধ্যে একটি। আমরা সকলেই ফেসবুকের অধিকর্তা হিসেবে মার্ক জাকারবার্গকেই চিনি, কেননা তিনিই ফেসবুকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তবে যার নাম কম জানি, তিনি হচ্ছেন ফেসবুকের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি- শেরিল স্যান্ডবার্গ। বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই ছাত্রী ছোটবেলা থেকেই ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী। কর্মজীবনেও রেখেছেন মেধার ছাপ, কাজ করেছেন গুগলের সহ-সভাপতি হিসেবে। ফেসবুকে তার বাৎসরিক বেতন ১৫.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রায় ১.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পত্তির অধিকারিণী শেরিল স্যান্ডবার্গ ফোর্বসের চোখে আছেন সাতে।
৮. সুজান ওজিকি
জনপ্রিয় ভিডিও সাইটের কথা বললে সবার আগে আমাদের মাথায় আসে ইউটিউবের নাম। প্রতিদিন ব্যবহার করা এই ইউটিউবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হচ্ছেন সুজান ওজিকি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য নিয়ে অধ্যয়ন করা শেষ হলে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অধ্যয়ন করেন তিনি। গুগলের শুরুর দিকটায় তিনি ছিলেন এর প্রথম মার্কেটিং ম্যানেজার। তারই পরামর্শে গুগল বোর্ড ইউটিউবের মালিকানা কিনে নেয়। পরবর্তীতে গুগলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম সুজান ওজিকি হন ইউটিউবের প্রধান নির্বাহী। ফোর্বসের তালিকায় আট নাম্বারে আছেন বিজ্ঞাপনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যক্তি।
৯. মেগ হুইটমেন
মেগ হুইটমেন একজন মার্কিন ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। প্রিন্সটন ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গ্র্যাজুয়েট ওয়াল্ট ডিজনির একজন নির্বাহী হিসেবে প্রায় ১০ বছর কাজ করেছেন। এছাড়া হ্যাসব্রো, ড্রিমওয়ার্ক পিকচার্সের মতো নাম করা প্রতিষ্ঠানের হয়েও কাজ করেছেন, দিয়েছেন অনেক কিছু।
বর্তমানে প্রযুক্তিপণ্য নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিউলেট-প্যাকার্ড কোম্পানির প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ২০০৯ সালে রিপালিকান এই রাজনীতিবিদ ক্যালিফোর্নিয়ায় নির্বাচন করেন। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে প্রচার-প্রচারণা করলেও ডেমোক্রেটিক প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন এই মার্কিন ধনকুবের। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দাতা হিসেবে পরিচিত তিনি মেগ হুইটমেন ফোর্বসের তালিকায় আছেন নয় নাম্বারে।
১০. আনা প্যাট্রিসিয়া
স্প্যানিশ ব্যাংকার আনা প্যাট্রিসিয়া বোটিন ১৯৬০ সালে স্পেনের বোটিন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার কর্মজীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি কাজ করেছেন বিভিন্ন ব্যাংকের হয়ে। ২০১৪ সালে স্প্যানিশ শেয়ার বাজারে নিয়ন্ত্রণকারী ব্যাংক স্যানট্যানডারের চেয়ারপার্সন হিসেবে মনোনীত হন। মজার ব্যাপার হলো তিনি বোটন পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের সদস্য হিসেবে এই পদ গ্রহণ করেছেন। এবং তার আগের তিন প্রজন্মের কেউ না কেউ এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারপার্সনের পদে অধিষ্ঠিত ছিল।
তিনি মাঝে কিছু দিন কাজ করেছেন কোকাকোলা কোম্পানির ডিরেক্টর হিসেবে। এর আগে ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের স্যানট্যানডার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নিযুক্ত ছিলেন এই ব্যাংকার। ২০১৪ সালে বিবিসি রেডিওর এক জরিপে তিনি ছিলেন যুক্তরাজ্যের তৃতীয় ক্ষমতাধর নারী এবং ফোর্বসের তালিকায় ২০১৬ সালে তার অবস্থান দশম।
তথ্যসূত্র