এশিয়ার শেয়ার বাজারে প্রভাব ফেলছে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের দ্রব্যগুলোর উপর যেদিন ৬০ বিলিয়ন ডলারের টারিফ আরোপ করার ঘোষণা দেন সেদিন থেকেই এই দুই দেশের মধ্যে একটি বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। চীনের দিক থেকে প্রথম দিকে তেমন কোন সাড়া পাওয়া না গেলেও বিশ্লেষকদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরণের আচরণের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে বড় রকমের ঝামেলার সৃষ্টি হতে পারে। দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব কতটুকু ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসবে সেটা নিয়ে যখন মানুষ ভাবতে ব্যস্ত তখন শুধুমাত্র ঘোষণার পর পরই এশিয়ার শেয়ার বাজারে বেশ কিছু নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্র ধরে জাপানের নিক্কেই ২২৫ এর সূচক ৪.৫%, সাংহাই কম্পোজিটের সূচক ৩.৬% এবং হংকং এর হেং সেং সূচক ২.৫% করে কমে গিয়েছে।

এছাড়া স্টিল শিল্পেও এর প্রভাব পড়ছে যেটা আবাসন প্রকল্পগুলোতে ইদানিং অনেক বেশী পরিমাণে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া সাংহাই এর সি এস আই ৩০০ তাদের ২.৮৬% হারিয়েছে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের কসপির শেয়ার ৩.৩৭% শতাংশ করে কমে গিয়েছে। কিন্তু ইউরোপে আবার ঠিক উলটো অবস্থা বিরাজ করছে। তাদের শেয়ার বাজার মোটামটি ভালো অবস্থায় আছে বলে জানা যায়। চীনের তরফ থেকে বড় কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন এখনও এই বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের দ্রব্যগুলোর উপর যেদিন ৬০ বিলিয়ন ডলারের টারিফ আরোপ করার ঘোষণা দেন সেদিন থেকেই এই দুই দেশের মধ্যে একটি বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়; Source: bbc.com

যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে World Trade Organization (WTO) তে একটি অভিযোগ জারি করে। যেখানে বলা হয়েছে, চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠনের নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের করা অভিযোগে বলা হয়েছে, চীন তাদের বিদেশী পেটেন্টের অংশীদারদের অস্বীকার করেছে। ফলে চীনের ওপর বিদেশী প্রযুক্তি ব্যবহারে বিরোধিতা করার অভিযোগ আনা হয়। যুক্তরাষ্ট্র আরও অভিযোগ করেছে যে, চীন তাদের দেশে রপ্তানি হওয়া পণ্যদ্রব্যের উপর এমন কিছু বিধিনিষেধ এবং চুক্তি আরোপ করেছে যেটা বাণিজ্য সংস্থার নিয়মের বাইরে এবং এরকম বিধি-নিষেধ বিদেশী প্রযুক্তির রপ্তানির জন্য উপযোগী নয়।

যদিও চীন থেকে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা কোনো বাণিজ্যিক যুদ্ধে যেতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্রের এমন ঘোষণার পর তারা আদৌ ভয় পাচ্ছে না। চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা আসা করছে যে যুক্তরাষ্ট্র এই দুই দেশের অর্থনীতিকে চাপের মুখে ফেলবে না এবং দুই দেশের মধ্যে যে একটা বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক আছে সেটা তারা বজায় রাখবে। যদিও চীন ১২৮টি এমন কিছু দ্রব্য তালিকা তৈরি করে রেখেছে যেগুলো ব্যবহার করে তারা প্রতিশোধমূলক (Retaliation) ব্যবস্থা নিতে পারে।

চীন থেকে বলা হয়েছে তারা কোন বাণিজ্যিক যুদ্ধে যেতে চায় না; Source: the gurdian © Getty Images

CMC Markets UK এর বাজার বিশেষজ্ঞ ডেভিড মেডন জানিয়েছেন যে,

ইকুইটি বা সম-সুদের বাজারের বেশীর ভাগই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ঘোষণার সকালের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায় কারণ বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলো যে বড় ধরণের কোন বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছেব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব পছন্দ করে না, তারা শুধু খুঁজে বেড়ায় কোথায় বিনিয়োগ করলে তারা সম্পদ তৈরি করতে পারবে এবং বিনিয়োগ করার স্থানটি যথেষ্ট নিরাপদ কিনা।”    

তবে যুক্তরাষ্ট্রের আমলাদের কাছ থেকে বিবৃতি এসেছে যে, তারা জানে চীন এই টারিফ আরোপের কারণে প্রতিশোধ নিতে পারে কিন্তু সেইদিকে এগোলে চীনের আরও বেশী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। তবে অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এই টারিফ আরোপ বাস্তবায়ন করলে ব্যবহারকারীদের চড়া মূল্যে তাদের পণ্য কিনতে হবে। আর যদি চীন প্রতিশোধ নিতে চায় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি এবং বিমান শিল্পে বড় ধরণের প্রভাব পড়তে পারে।

চীনের আরও বেশী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী যদি তারা প্রতিশোধমূলক কোন পদক্ষেপ নিতে চায়; Source: KDow.com

কারণ পাল্টা জবাব দেওয়ার মতো চীনের হাতেও বেশ কিছু অস্ত্র আছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের শস্য-ফসলের সবচেয়ে বড় খরিদ্দার হচ্ছে চীন। চীন সেখান থেকে সয়াবিন এবং ভুট্টা জাতীয় খাদ্য কিনে থাকে। এখন চীনও যুক্তরাষ্ট্রের মতো এসবের উপর অতিরিক্ত ট্যাক্স চাপিয়ে দিতেই পারে এবং তাদের নিজেদের জন্য এসব খাদ্যশস্য ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা থেকে আমদানি করতে পারে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন ভুট্টা, শূকরের মাংস ইত্যাদিও আমদানি করে থাকে। আমেরিকা থেকে প্রতি বছর যেসব দ্রব্য বাইরের দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয় তার মধ্যে তৃতীয় বড় খরিদ্দার হচ্ছে চীন।

চীনের তরফ থেকে যেরকম আচরণ সবাই আসা করেছিল চীন তার তুলনায় অনেক ভদ্রভাবে আচরণ করছে; Source: thegurdian.com © Shizuo Kambayashi/AP

বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের ধারণা চীন হয়তো তাদের প্রতিশোধ ট্রাম্পকে সমর্থন করে এমন অঞ্চলগুলোকে লক্ষ্য করেই নিবে। তারা যদি এরকমটি করে তাহলে এটা ভেবে নেওয়া যায় যে, তাদের নিজেদের দিক থেকে প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল। কারণ চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এমনিতেই প্রযুক্তি নিয়ে একটি প্রতিযোগিতা অনেকদিন ধরেই লেগে আছে। অনেক বিশেষজ্ঞ এটাও মনে করেন যে, চীন এখন তাদের সামরিক ক্ষেত্রেও আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি প্রয়োগ করছে যাতে তারা বিদেশী যেকোনো হস্তক্ষেপের মোকাবেলা করতে পারে। Asian Trade Center, Singapore এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ডেবরা এল্মস মনে করেন যে চীন যে,

১২৮টি পণ্য দ্রব্যের তালিকা তৈরি করেছে, এই তালিকার প্রস্তুতি এক বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছিলোবাণিজ্য শিল্পে এটি একটি জঘন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে যদি চীন তাদের দেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাণিজ্য সংঘগুলোর জন্য সেই দেশে ব্যবসা করা কঠিন করে তোলে”  

ট্রাম্পের এমন ঘোষণার পেছনে যুক্তি ছিল যে, চীন সহ আরও কিছু রাষ্ট্রের পণ্যের উপর টারিফ আরোপ করলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের বাণিজ্য ঘাটতি অনেকাংশে কমে যাবে। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এই ধারণা ভুল। দুই দেশের সম্পর্ক যদি আগের মতোই চলতে দেওয়া হয় তাহলেই কেবল বাণিজ্য ক্ষেত্রে দুই দেশেরই সুস্থিতি বজায় থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে জানা গিয়েছে যে চীনের কর্মকর্তাদের সাথে তাদের শান্তিপূর্ণ আলোচনা হয়েছে এবং তারা একটি সুন্দর সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে; Source: cnbc.com Jonathan Ernst/Reuters

তবে এটা ঠিক যে চীনের তরফ থেকে যেমন আচরণ সবাই আসা করেছিল চীন তার তুলনায় অনেক ভদ্রভাবে আচরণ করছে। চীনের এমন ঠাণ্ডা মেজাজে অবস্থান নেওয়ার কারণে অনেকের ধারণা যে, চীন দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি সামাল দিতে চাচ্ছে। কারণ যদি দুই দেশের মধ্যে বড় ধরণের বাণিজ্য যুদ্ধ হয় তাহলে অর্থনৈতিক বাজারে ক্ষতি ছাড়াও কালো বাজারিদের ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে ওঠার আশঙ্কাও রয়েছে। কিন্তু কি হবে সেটা সময় আসলেই বোঝা যাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে জানা গিয়েছে যে, চীনের কর্মকর্তাদের সাথে তাদের শান্তিপূর্ণ আলোচনা হয়েছে এবং তারা একটি সুন্দর সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

ফিচার ইমেজ সোর্সঃ washington post

Related Articles

Exit mobile version