![](https://assets.roar.media/assets/uNpRJP909TfBb6LD_K__AP20220118251-scaled.jpg?w=1200)
(পর্ব-১ এর পর থেকে)
কয়েকজন সৈনিকের সাথে আমি পিসকিতে গেলাম। আমি সেখানে এমন কাউকে খুঁজছিলাম, যে আক্রমণটা নিজের চোখে দেখেছে। পিসকিকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন আগেকার কোনো যুদ্ধের দৃশ্যের তৈলচিত্র। বিধ্বস্ত ভবনগুলো যেন আরো বিধ্বস্ত হয়ে আছে। বিস্ফোরণের ফলে ভবনগুলোতে সৃষ্টি হওয়া গর্তগুলো থেকে চারা অঙ্কুরিত হয়ে বের হয়ে আছে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, ১৯৪৩ সালের ইস্টার্ন ফ্রন্টের যুদ্ধপরবর্তী সময়ের দৃশ্য দেখছি। এই যুদ্ধ যে বর্তমান সময়ের, তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন রাস্তায় পড়ে থাকা অবিস্ফোরিত রকেটের পাখনাগুলো। তবে সত্যি বলতে কী, এগুলোও দেখে মনে হচ্ছিল কয়েক দশকের পুরনো।
এরকম পরিস্থিতির মাঝেও আমি একটা বাড়ি খুঁজে পেলাম, যেটা দেখে মনে হলো এখানে মানুষজনের বসতি আছে। বাড়ির ছাদ ভেঙে পড়ে গেছে। কিন্তু বেড়ার পাশে একটা বাইসাইকেল হেলান দিয়ে রাখা। কেটে রাখা কাঠগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে সাম্প্রতিককালের। বিড়ালের গোঙানির আওয়াজও আসছে। আমি বাড়ির মানুষদের ডাকলে ভেতর থেকে মাতাল গলার চিৎকার ভেসে আসলো। বারান্দায় দেখা মিলল খালি গায়ের প্রায় দন্তবিহীন এক লোকের। তার প্যান্টের ফিতা কোমড়ের কাছে কোনোরকম ঝুলছিল। লোমশ বুকের মাঝে গলায় ঝুলানো ক্রুশটি বার বার ধাক্কা খাচ্ছিল।
“আমি যখন রাস্তায় ছিলাম, তখন একটা বিধ্বস্ত গাড়ি চোখে পড়ে”, তিনি বললেন। “আমি ফিরে আসার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তখনই হতচ্ছাড়া রকেটটা আমাকে আঘাত করল।”
![](https://assets.roar.media/assets/gvsRpWVmVIahvbVH_000_98G2LA.jpg)
ইউরি আমাকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে তার গল্প বলতে থাকলেন। তিনি স্বীকার করলেন রকেটটা তাকে আসলে আঘাত করেনি। কিন্তু এতটাই কাছে এসেছিল যে তিনি বাইক থেকে পড়ে যান। যদিও এটাও সত্য যে ইউরি তখন নেশাগ্রস্ত ছিলেন। তিনি বললেন, তিনি তখন পুনরায় বাইক চালু করে হেডকোয়ার্টারের দিকে যান। “আমি সেখানকার সৈনিকদের গিয়ে বললাম, ‘আপনারা দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আপনাদের লোককে উদ্ধার করুন। সে সেখানে শুয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করছে।’”
আমি ইউরির কাছ থেকে তিনি কী দেখেছেন তা জানতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি এর চেয়ে যুদ্ধের সময়ে পিসকিতে জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারে বেশি কথা বলার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তিনি জানান, তার এতদিনে অবসরে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাকে গৃহস্থালি কাজে এখানে-সেখানে যেতে হয়। তিনি ছিলেন একজন জেলে। কিন্তু নদীর অবস্থান ফ্রন্টের দিকে হওয়ায় সেখানে মাছ ধরা এখন খুব বিপজ্জনক। অবশ্য এখন তার কাছ থেকে মাছ কেনার মতো কোনো মানুষও নেই সেখানে।
রান্নাঘর থেকে তার চেয়ে বয়সে ১৮ বছরের ছোট স্ত্রী মাশা মাঝে মাঝে চিৎকার করে কথার মাঝে কথা বলছিলেন। মাশা একটা টুলে বসে আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিলেন। ইউরিও পাল্টা চিৎকার করে জবাব দিচ্ছিলেন। তারা একসাথে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন। মাশা ইউরির চেয়ে তুলনামূলক সংযত থাকলেও তা খুব বেশি ছিল না।
![](https://assets.roar.media/assets/3vHAM81RHyTCyhps_23mag-Ukraine-16-superJumbo.jpg)
তারা একত্রিত হন যুদ্ধের শুরুর দিকে, যখন পিসকির মানুষরা বেজমেন্টগুলোকে বোমা শেল্টারে রূপান্তরিত করে সেখানে থাকতেন। অবশেষে বেজমেন্টগুলোও রকেটের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের প্রতিবেশিরা প্রায় আট লক্ষ ইউক্রেনীয়র সাথে বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়। ইউরি আর মাশা থেকে যান। মাশা বলেন, তারাও চলে যাওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করতেন। কিন্তু কোথায় যাবেন তারা? তাদের অর্থ কোথায়? বাড়ির ছাদটাও মেরামত করার সামর্থ্য নেই তাদের।
তিনি বলেন, “সব ধ্বংস হয়ে গেছে। এটা (ছাদ) দিয়ে পানি পড়ছে। আমরা পালিয়েই বা কী করতে পারতাম?”
কোম্পানি হেডকোয়ার্টারটা ছিল বোমাবিধ্বস্ত সোভিয়েত আমলের এক অ্যাপার্টমেন্ট ভবন। সেখানে ট্রাকটা তখনো জ্বলন্ত অবস্থায় ছিল। একদল সেনা কার্ড খেলছিলেন। এক প্রেস কর্মকর্তা ছবি তুলছিলেন। তিনি কয়েক গজ দূরে থাকা ধোঁয়া ওঠা ধ্বংসাবশেষের ছবি তুলছিলেন না। বরং একটা টেবিলের হাতার ওপর বসা এক সৈন্যের ছবি তুলছিলেন। তার সাথে ছিল ক্র্যাঙ্ক চালিত একটা অ্যান্টিক ফিল্ড টেলিফোন।
আমি সত্যিই অবাক হয়ে ভাবছিলাম কোনো সিনেমার শ্যুটিং হচ্ছে কিনা। পরে নিশ্চিত হলাম ফোনটা আসলে অ্যান্টিক না। যদি হয়েও থাকে, সেটা এখনো কাজ করছে। সেনাবাহিনী যখন জানতে পারে, শত্রুপক্ষের কাছে রাশিয়ান উন্নত প্রযুক্তির নজরদারি ব্যবস্থা আছে, তখন থেকে তারা পুরাতন টেলিফোন ব্যবহার শুরু করে। আমি দেখতে পাই কাঠের আর পিতলের বাক্স থেকে ফ্রন্টের দিকে বের হয়ে আসা কালো তার।
প্রেস কর্মকর্তা সৈনিককে নির্দেশনা দিলেন, “ক্র্যাঙ্ক করো, তারপর কথা বলো।” সৈনিক ব্যক্তিটি বিশ্বাসযোগ্য অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন যেন কোনো রেডিওম্যান স্ট্যালিনগ্রাদের ফ্রন্টে জরুরি কোনো ফোন করছেন।
![](https://assets.roar.media/assets/DxhkeyqtqVysTWTU_np_file_134337.jpeg)
যুদ্ধের সেনারা আহত হয়ে মারা যাচ্ছেন। কিন্তু আমার কাছে ইয়ারোস্লাভের কমরেডদের দেখে মনে হচ্ছিল তারা আহত হওয়ার ধাপ পার করে অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছেন। কোনো সহিংসতা ঘটলে সবকিছু যেভাবে স্থবির হয়ে পড়ে, ট্রাকের ওপর আক্রমণের ফলে সেরকম কিছু দেখা গেল না। এখানকার সময় মনে হচ্ছিল অনেক আগে থেকেই স্থবির হয়ে আছে।
গত মাসে (ডিসেম্বর ২০২১) রাশিয়া দোনবাসের পাশে থাকা ইউক্রেন সীমান্তে সেনা জড়ো করা শুরু করে। পুতিন এ প্রসঙ্গে বলেন, তিনি ইউক্রেনের উসকানির প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। তিনি রাশিয়ার সীমান্তের কাছে মিসাইল জড়ো করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন। ইউক্রেনে ন্যাটোর মিসাইল অনেক আগে থেকেই আছে। পুতিন নির্দিষ্ট করে কোনো সময়ের উল্লেখ করেননি। অবশ্য তিনি গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো জাভেলিন অ্যান্টি মিসাইল ট্যাঙ্কের কথা মনে করে থাকতে পারেন। এরকম মিসাইল আমেরিকা যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীতে দিয়ে আসছে। পুতিনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সার্গেই শোইগু দাবি করেন রাশিয়ার কাছে প্রমাণ আছে আমেরিকান ভাড়াটে সেনারা দোনবাসে ট্যাঙ্কে করে রাসায়নিক অস্ত্র সরবরাহ করছে। ন্যাটো সতর্ক করে দিয়েছে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ডের “চড়া মূল্য দিতে হবে।” বাইডেন প্রশাসন থেকেও নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
![](https://assets.roar.media/assets/2cIiBNWlFXy9b5lc_2809501-2001561827.jpg)
কূটনীতিক আর সাংবাদিকরা সম্ভাব্য আক্রমণ নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তাদের আশঙ্কা আরো বেড়ে যায় যখন জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে কাজাখস্তানে আন্দোলন দমন করার জন্য রাশিয়া সেনা পাঠায়। তবে ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিনের হুমকি-ধামকি নতুন কিছু নয়। এটা যুদ্ধের শুরু থেকে দোনবাসে রাশিয়ার ধারাবাহিক আক্রমণের কেবল সর্বশেষ সংযোজন। এটা ইউক্রেন ও এই অঞ্চলের যেকোনো স্থানে রাশিয়ার হাইব্রিড যুদ্ধের কৌশলের একটি অংশ। তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের পাশাপাশি সামরিক আগ্রাসনও চালাচ্ছে। একইসাথে ইউক্রেনে ২০১৪ সাল থেকে সাইবার যুদ্ধ আর গুজব ছড়ানোর কৌশল নিয়ে কাজ করছে।
কিন্তু দোনবাসের যুদ্ধ আরেকটি দিক দিয়েও হাইব্রিড যুদ্ধ। এটা একইসাথে বহিঃশত্রুর আক্রমণ, আবার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনও। এখানে আক্রমণাত্মক শত্রুর অনুপ্রবেশের পাশাপাশি গৃহযুদ্ধও বিরাজ করছে। ডিপিআর ও এলপিআরের বিদ্রোহ এতদিন ধরে স্থায়ী হওয়ার কারণ হচ্ছে এটা ইউক্রেনীয় সমাজ ব্যবস্থার দুর্বলতা উন্মোচন করে দিয়েছে। এটা আঞ্চলিক যুদ্ধ হলেও এর সম্মুখ সমর পুনরুজ্জীবিত করে তুলেছে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্বকে।
(পরবর্তী অংশ পর্ব ৩-এ)