ভারতের মধ্য প্রদেশের কয়েকটি জেলায় হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভুয়া তথ্য প্রচারের ফলে ৫০-৬০ জন গ্রামবাসীর একটি দল গত সপ্তাহে দুজন নিরীহ মানুষকে মারধর করে। কিছুদিন আগেও ভারতের আসামের এক গ্রামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে নির্মমতার শিকার হন অভিজিত নাথ (৩০) ও নীলোৎপল দাস (২৯) নামে দুজন নিরপরাধ ব্যক্তি। হোয়াটসঅ্যাপে ছেলেধরা বলে খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে প্রাণ হারান তারা।
গত কয়েক মাসে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভারতে ছড়িয়ে পড়া শিশু অপহরণের গুজব গত বেশ কিছুদিনে ৭ জনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখন শিশু পাচারের পরিবর্তে খবর ছড়ানো হচ্ছে যে, কিছু মানুষকে নাকি হত্যা করে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে দিচ্ছে কিছু ব্যক্তি। এই ভুয়া খবর ছড়ানোর ফলে বিপদে পড়ছে কিছু সাধারণ মানুষ।
হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়ানো হিন্দিতে লিখিত বার্তাটির সারাংশ ছিল, ৫০০ জন লোক ভিক্ষুকের ছদ্মবেশ ধারণ করে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা মানুষকে হত্যা করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নিয়ে বিক্রি করে দেবে। এই বার্তাটি প্রাপকদেরকে বন্ধু ও পরিবারের কাছে ফরোয়ার্ড করার অনুরোধও জানানো হয়েছে। পুলিশ জানায়, বার্তাটি ভুয়া ছিল। পুলিশ কর্মকর্তারা কয়েকটি স্থানীয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যোগদান করে জানতে পেরেছেন, মূলত তিনজন ব্যক্তি এ ধরনের বার্তা পাঠাচ্ছে। ইতিমধ্যে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যেখানে এ ঘটনাটি ঘটেছে, সেই বালাঘাট জেলার পুলিশ প্রধান জয়দেবন এ কথা জানিয়েছেন।
এর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই দক্ষিণ ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে ৪০০ জন শিশু পাচারকারকারীর ভুয়া খবর ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে অন্য এক প্রদেশ থেকে আসা নির্মাণকর্মীকে ছেলেধরা সন্দেহে একদল লোক মারধর করে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাকে আক্রমণ করা হয়। এ বছর এ পর্যন্ত প্রচুর মানুষ হোয়াটসঅ্যাপের ভুয়া বার্তায় মারধরের শিকার হয়েছে।
হোয়াটসঅ্যাপের সবচেয়ে বড় বাজার
ভারতে প্রায় ২০ কোটিরও বেশি মানুষ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকার করে। এটি বিশ্বে হোয়াটসঅ্যাপের বৃহত্তম বাজার। মেসেজিং অ্যাপে প্রচারিত মিথ্যা সংবাদ এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের জন্য একটি নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেটি আবার ইতিমধ্যেই গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। এর সাথে এবার যুক্ত হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপের এই বিড়ম্বনা।
ভারতের মতো একটি দেশে শত শত কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ও সস্তায় ইন্টারনেট প্রাপ্যতার ফলে যেকোনো বার্তা তৎক্ষণাৎ ভাইরাল হয়ে যেতে পারে। এগুলো ব্যাপক হতাশা তৈরি এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। আবার হিন্দু সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। ২০১৭ সালে দেশটির ৮২২টি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে কমপক্ষে ১১১ জন মানুষ নিহত এবং ২,৩৮৪ জন আহত হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভুয়া বার্তার দ্বারা এই ঘটনাগুলোর কোনোটি ঘটেছে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
হোয়াটসঅ্যাপ জানিয়েছে, এটি মিডিয়া কভারেজের মাধ্যমে ভারতে সংঘটিত ঘটনার বিষয়ে অবগত রয়েছে। এক বিবৃতিতে জানানো হয়, “দুঃখজনকভাবে কিছু লোক ক্ষতিকারক ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য হোয়াটস্যাপ ব্যবহার করছে। আমরা আমাদের শিক্ষার প্রচেষ্টায় জোর দিচ্ছি যাতে মানুষ আমাদের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে জানতে পারে এবং কীভাবে ভুয়া সংবাদ ও প্রতারণাগুলো শনাক্ত করতে হয় তা জানতে পারে।“
হোয়াটসঅ্যাপ এছাড়া আরও কিছু পরিবর্তন বিবেচনা করবে। তবে কোম্পানিটি তার এনক্রিপশনে কোনো পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করছে না, যার ফলে প্রেরক এবং প্রাপক ব্যতীত বার্তাটি অন্য কেউ পড়তে পারে না। এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য অনুরোধ করা হলেও, ফেসবুকের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
দুজন জ্যেষ্ঠ ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, এই বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপের সাথে নয়াদিল্লি আলোচনা করেছে। কিন্তু এই বিষয়ে তাদের জনসম্মুখে আলোচনার অনুমতি নেই। হোয়াটসঅ্যাপ ভারতীয় সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্ভাব্য যোগাযোগের উপর মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে।
গোপনীয়তা সংক্রান্ত উদ্বেগ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজবের কারণে ঘটা এ সকল প্রীতিকর ঘটনা ভারত সরকারকে ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহে উদ্যোগী করে তুলতে পারে যেন তারা সহজেই অপরাধী চিহ্নিত করতে করে পারে। এটি অনেক সমালোচককেই উদ্বিগ্ন করে তুলছে। তারা আশঙ্কা করছেন, এই ক্ষমতা শুধু তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধেই নয়, অনেক কর্মী এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার একটি তথ্য সুরক্ষার আইন নিয়ে কাজ করছে, যা বিদেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানীয়ভাবে ভারতীয় ব্যবহারকারীদের তথ্য স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করতে বাধ্য করবে। ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের সহকারি প্রতিষ্ঠাতা অপার গুপ্ত বলেন, “গোপনীয়তা হ্রাসের প্রস্তাবিত আইন ও ভুয়া সংবাদের মধ্যে স্পষ্ট সংযোগ রয়েছে।“
জাতিসংঘের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ দূত ডেভিড কে বলেন, “মিথ্যা সংবাদ প্রচারের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞাগুলো প্রায়ই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সরকারের সমালোচনাকে সীমাবদ্ধ করার করার একটি প্রচেষ্টা।“
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সম্প্রতি আরও একটি বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে। এটিতে বলা হচ্ছে, মস্তিষ্কের ক্ষতিকারক মারাত্মক নিপাহ ভাইরাস শিলং শহরে পৌঁছেছে। এতে বাবা-মাদের উপদেশ দেওয়া হয় শিশুদের লিচু খাওয়া থেকে বিরত রাখতে। তবে ভারতের দক্ষিণে কেরালা রাজ্যের বাইরে এখনও নিপাহ ভাইরাসে আক্তান্ত হওয়ার কোনো নিশ্চিত ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
Featured Image Source: Quartz