কাগজের টাকার সাথে প্রত্যেকটি মানুষের আলাদা একটি সখ্যতা আছে। ছোটবেলা থেকে কাগজের টাকার প্রতি সবার আলাদা আগ্রহ এবং মায়া জন্মে যায়। ঈদের সময়কার নতুন কাগজের টাকা, ব্যাংক থেকে নতুন চকচকে কাগজের নোট উৎসাহ ভরে নিয়ে আসা ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে মানুষ জড়িত। এমনকি কোনো কিছু কেনাকাটার পর যখন নতুন নোট বের করে দেয়া হয়, তখন যাকে টাকাটি দেয়া হচ্ছে তার জন্যও সেটা হয়ে যায় অনেক বড় কিছু। এসমস্ত অনুভূতি আসলে যুক্তি দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। সবটাই আবেগ। আবার নতুন টাকার একটি আলাদা মিষ্টি গন্ধও আছে। কোনো না কোনো সময় প্রত্যেকেই এই অনুভূতির ভিতর দিয়ে গেছে। নিত্যদিন এই কাগজের টাকা আমাদের একমাত্র ভরসা। সকালে কাজে যাওয়া থেকে শুরু করে সন্ধায় বাসায় আসার পর পর্যন্ত, বাসা থেকে বাজার, বাসা থেকে কোথাও ঘুরতে যাওয়া– যেকোনো কিছুতেই একমাত্র অবলম্বন এই কাগজের টাকা।
কিন্তু এখন আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগায় কাগজের এই ব্যবহার একটুখানি কমে গিয়ে ইলেক্ট্রনিক কার্ডের (ক্রেডিট এবং ডেবিট কার্ড) ব্যবহার বেড়ে গেছে। এখন আর কাউকে কষ্ট করে টাকা সঙ্গে নিতে হয় না। কোনো কিছু কেনাকাটার পর এই কার্ড ব্যবহার করলেই আপনার ব্যাংক একাউন্ট থেকে দাম কেটে নেয়া হবে। আবার বিভিন্ন ব্যাংক তাদের গ্রাহকদেরকে কার্ড ব্যবহার করার জন্য অনেক বেশি উৎসাহ দেয়, বিভিন্ন অফার দেয়, আবার বিভিন্ন ভাউচারের ব্যবস্থাও থাকে। যে কারণে প্রতিনিয়ত এই কার্ড গ্রাহক বেড়েই চলেছে।
আর ব্যাংক এমনটা করবেই না কেন? কাগজের নোট তৈরি করার খরচ অনেক। কাগজের খরচ, কালির খরচ, টাকার নিরাপত্তার জন্য এর ভিতরে যে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া হয় সেগুলোর খরচ, টাকার আমদানি ইত্যাদি আরও নানা রকম খরচের ভিতর দিয়ে একে যেতে হয়। এসব করতে করতে যে পরিমাণ সময় এবং টাকা (!) খরচ হয় তার থেকে ইলেক্ট্রনিক এবং কম্পিউটারের মাধ্যমে অনেক সহজেই লেনদেন করা যায় এবং এই লেনদেন অনেক দ্রুত এবং ঝামেলামুক্ত হয়। গণিত এবং তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলে এই লেনদেন কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে আদান প্রদান করা যায়।
বিভিন্ন ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের কম্পিউটার একাউন্ট এবং ডিজিটাল আদানপ্রদান করাকে নিরীক্ষণ করে থাকে, যাতে গ্রাহকদের কোনো সমস্যার মধ্যে দিয়ে না যেতে হয়। কার্ড যুগের পর এখন শুরু হয়েছে ক্রিপ্টোকারেন্সির যুগ। এটাও পুরোপুরি কম্পিউটার নির্ভর। কিন্তু এর মাধ্যমে লেনদেন হয় আরও দ্রুত। ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে যেভাবে লেনদেন করা হয় তার একটি হিসাব যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে থাকে, অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বক্ষণ অন্যান্য ব্যাংকের লেনদেনকে নজরে রাখে। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে একজন ব্যক্তির টাকা-পয়সার হিসেবের উপর কেন্দ্র নজর রাখতে পারবে না। সে ইচ্ছামতো যত খুশি লেনদেন করতে পারবে।
এখন যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের থেকে অনুমতি নিয়ে কর (Tax) কর্তন করে লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়, ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে এতসব প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় না। একজন গ্রাহক পয়সা দিয়ে নিজস্ব ক্রিপ্টো কিনে নিলেই এই লেনদেন নিজে থেকেই সম্পন্ন করতে পারবে। যদিও এই লেনদেনের একটি হিসাব ব্লকচেইনে রাখা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো অনেক দেশেই ক্রিপ্টোকারেন্সি অবৈধ। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারের জন্য যে ব্লকচেইন দরকার পড়ে, সেটা প্রযুক্তির দিক দিয়ে এত বেশি উন্নত এবং এটার আরও উন্নয়ন করতে যেসব কাজ হচ্ছে তাতে ব্যাংকিং খাত ইচ্ছা করলে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার না করলেও ব্লকচেইন ব্যবহার করতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নিজ দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির উপর নজর রেখে গ্রাহকদের সুবিধার্থে এবং আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য হলেও ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে লেনদেনের মাধ্যম শুরু করা উচিত।
বিটকয়েন আবিষ্কারের পর ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি সবার আগ্রহ আকাশসম হয়ে যায়। অনেক প্রযুক্তিবিদ এবং অর্থনীতিবিদ বলছেন, ইন্টারনেট যেমন মিডিয়া জগতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, ঠিক তেমনি অর্থশাস্ত্র এবং অর্থনীতিতে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে। এর ব্যবহার এত সুদূরপ্রসারীভাবে হচ্ছে যে ভবিষ্যতে হয়তো কাগজের টাকার আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। অন্তত গবেষণা সেটাই বলছে। এশিয়ান টাইমস থেকে জানা যায়, লন্ডনের বিখ্যাত ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকরা একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। সেখানে তাদের এমনটাই দাবি। তাদের গবেষণাপত্র Cryptocurrencies: Overcoming Barriers to Trust and Adoption এ এমন সংবাদই উঠে এসেছে। তাদের এই গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে যে, কাগজের টাকা যে ধরনের কাজ করে থাকে, ক্রিপ্টোকারেন্সি নিজেও সেই ধরনের কাজ করতে সক্ষম।
টাকার যে একটা মূল্য আছে যেটা মানুষের কাছে ধরে রাখতে হয়, সেরকম ক্রিপ্টোকারেন্সির বেলাতেও সত্য। এছাড়া আরও কিছু জায়গায় ক্রিপ্টোগুলো নিজেদের প্রমাণ করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যেমন- কেনাকাটা এবং আমদানি-রপ্তানির জন্য আমরা টাকাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করি। কিন্তু ক্রিপ্টোকারেন্সি এসব ক্ষেত্রে কতটুকু দক্ষতার সাথে কাজ করবে সেটা এখন দেখার বিষয়। বিটকয়েনসহ অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সিকে ব্যবহার্য করতে হলে এগুলোর প্রয়োগের নিয়ম-নীতি, প্রবিধান, গ্রাহকদের জন্য এবং বিভিন্ন কোম্পানির ব্যবহারের স্বার্থে এসব কারেন্সি ব্যবহারের নকশা ইত্যাদি ক্ষেত্রে আরও কিছু কাজ করা বাকি। প্রযুক্তির যেভাবে উন্নতি হচ্ছে, তাতে এসব বিষয় সমাধান করে ফেলতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না। কারণ বিভিন্ন দেশে বিটকয়েনের মতো কারেন্সি সিস্টেমের কার্যকারিতা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে এখন যে টাকা ব্যবহার করা হয় তা কিন্তু একদিনে আসেনি। প্রথমে পণ্যদ্রব্যের মাধ্যমে লেনদেন শুরু হয়, এরপর আসে কয়েন, তারপর আসে কাগজের নোট, এরপর কার্ড দিয়ে লেনদেন শুরু হয়। বর্তমান সময়ে মোবাইল ওয়ালেটের মাধ্যমে টাকাকে স্পর্শ না করেই লেনদেন করা যাচ্ছে। এবং এখানে সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে এই ক্রিপ্টোকারেন্সি। তবে বিভিন্ন সময়ে টাকার বাহ্যিক রূপের পরিবর্তন হলেও লেনদেন করার জন্য টাকার যে গুণ থাকা চাই সেটা কিন্তু অপরিবর্তিত আছে।
উপরের আলোচনা থেকে কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার যে, যদি আমরা ক্রিপ্টোকারেন্সিকে লেনদেনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে দেখতে চাই তাহলে কয়েকটি বিষয় আগে ঠিক করে নিতে হবে। প্রথমত, টাকার পরিমাপের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সির একটি পরিমাপ ঠিক করতে হবে, সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি আসলে কী- সেই বিষয়ে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে, ক্রিপ্টোকে কী কী কাজে ব্যবহার করা হবে সেটা ঠিক করতে হবে, সারাবিশ্বে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এখনও কাজ করা বাকি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে একটি সমঝোতায় আসতে হবে যেন ক্রিপ্টোর দ্রুত লেনদেন করার জন্য যে প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছে শুধু সেটুকু যেন ব্যবহার করা যায়। ক্রিপ্টো ব্যবহারের গোপনীয়তা নিয়ে আরও অনেক কাজ করতে হবে। তবে এটা মেনে নিতেই হবে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অংশগ্রহণ ছাড়া ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার মানুষ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হিতে বিপরীত ঘটনা বয়ে আনতে পারে।
যেভাবে বিভিন্ন দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে তাতে করে আগামী এক যুগের মধ্যে হয়তো টাকার অস্তিত্ব আমরা আর না-ও দেখতে পারি। নতুন এই লেনদেনের মাধ্যমকে উন্নত দেশ সাদরে স্বাগত জানিয়েছে। এরকমটি হলে কেনাকাটা, জমি এবং সম্পদ বণ্টন ও জমা পদ্ধতি, ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এখন বাকিটা দেখার বিষয় যে কীভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি কাগজের টাকার পুরোটা অংশ দখল করে নেয়।
ফিচার ইমেজ সোর্স: financial tribune