রুশ রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেদভেদেভ ২০০৯ সালে প্রদত্ত একটি ভাষণে বলেছিলেন, “রাশিয়ার মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার প্রয়োজন নেই, কারণ রাশিয়া প্রাকৃতিকভাবেই মুসলিম বিশ্বের অংশ।” কার্যত রুশ ফেডারেশনের সিংহভাগ অধিবাসী খ্রিস্টধর্মের ইস্টার্ন অর্থোডক্স ধারার অনুসারী, কিন্তু ইসলাম রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। রাশিয়ায় প্রায় ২ কোটি মুসলিম বসবাস করে, এবং দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৪% মুসলিম। রাশিয়ার ৮৫টি প্রশাসনিক বিভাগের মধ্যে ৭টি (ভোলগা–উরাল অঞ্চলে অবস্থিত তাতারস্তান ও বাশকোরতোস্তান এবং উত্তর ককেশাসে অবস্থিত চেচনিয়া, ইঙ্গুশেতিয়া, দাগেস্তান, কাবার্দিনো–বালকারিয়া ও কারাচাই–চের্কেশিয়া) মুসলিম–অধ্যুষিত। রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতেই প্রায় ১৫ লক্ষ মুসলিম বসবাস করে।
ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রের (যেমন: ব্রিটেন, ফ্রান্স বা জার্মানি) মুসলিমদের সঙ্গে রুশ মুসলিমদের পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মুসলিমরা প্রধানত অভিবাসী, অর্থাৎ অন্য কোনো মুসলিম রাষ্ট্র থেকে আগত। কিন্তু রুশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই মুসলিমরা রাশিয়ায় বসবাস করে আসছে। অবশ্য, ‘রুশ মুসলিম’ বলতে একক কোনো সম্প্রদায়কে বোঝায় না। রুশ মুসলিমরা নানাবিধ জাতি ও ধর্মীয় ধারা–উপধারায় বিভক্ত। রুশ মুসলিমদের মধ্যে রয়েছে সুন্নি, শিয়া এবং বিভিন্ন সুফি মতবাদের অনুসারী। অনুরূপভাবে, রুশ মুসলিমরা জাতিগতভাবে বহুধাবিভক্ত। তাদের মধ্যে রয়েছে তাতার, বাশকির, উজবেক, তাজিক, চেচেন, কাজাখ, ইঙ্গুশ, আভার, কিরগিজ, তুর্কমেন, লেজগিয়ান, আজারবাইজানি, নোগাই, লাক, তাবাসারান, কারাচাই, সার্কাশীয়, বালকার, উবিখ, কাবার্দিন, ক্রিমিয়ান তাতার এবং আরো নানা জাতির মানুষ।
রুশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী, জ্ঞান–বিজ্ঞান, শিল্প–সংস্কৃতি, ক্রীড়া প্রতিটি ক্ষেত্রে মুসলিমদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। এর পাশাপাশি রুশ রাষ্ট্রের ক্ষমতার কাঠামোতেও আনুপাতিক হারে রুশ মুসলিমদের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। ২০১৯ সালের ঈদুল আযহার (রুশ ভাষায় ‘কুরবান বাইরাম’) দিনে রুশ প্রতিষ্ঠান ‘বিজনেস অনলাইন’ রাশিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ১০০ জন মুসলিমের একটি তালিকা তৈরি করেছে, যে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন রুশ মুসলিম রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা, ক্রীড়াবিদ ও অন্যান্য পেশার মানুষ। চলুন, জেনে নেয়া যাক, বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রের শীর্ষ ১০ ক্ষমতাধর মুসলিম ব্যক্তিত্বের সম্পর্কে।
(১০) শামিল আলিয়াউৎদিনভ
শামিল রিফাত উলি আলিয়াউৎদিনভ একজন ধর্মতাত্ত্বিক, ইমাম এবং মুফতি। ১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি বর্তমান রাশিয়ার মস্কোয় একটি জাতিগত তাতার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মিসরের বিখ্যাত আল–আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন এবং ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি মস্কোর ‘মেমোরিয়াল মসজিদে’র ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সোভিয়েত মুসলিম সৈন্যদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে।
তদুপরি, আলিয়াউৎদিনভ ‘স্পিরিচুয়াল ডিরেক্টরেট অফ মুসলিমস অফ দ্য রাশান ফেডারেশন’–এর উলেমা কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট। এই প্রতিষ্ঠানটি রুশ মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি, এবং এটি হানাফি ও শাফিঈ মাজহাবের অনুসরণ করে থাকে। আলিয়াউৎদিনভকে রুশভাষী মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসলামি পণ্ডিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার ওয়েবসাইট umma.ru রুশ ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় ইসলাম সংক্রান্ত ওয়েবসাইট। তিনি বেশ কয়েকটি ইসলাম সংক্রান্ত বইয়ের রচয়িতা, এবং রুশ ও বিদেশি প্রচারমাধ্যম প্রায়ই ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব সংক্রান্ত নানা বিষয়ে তার সাক্ষাৎকার নিয়ে থাকে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং ছয় সন্তানের জনক।
(৯) মারাত খুনসুল্লিন
মারাত শাকিরঝান উলি খুনসুল্লিন রাশিয়ার একজন উপপ্রধানমন্ত্রী। ১৯৬৬ সালের ৯ আগস্ট বর্তমান রাশিয়ার কাজান শহরে একটি জাতিগত তাতার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘কাজান স্টেট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিক্স ইনস্টিটিউট’ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং ব্রিটেনের ‘ওপেন ইউনিভার্সিটি’ থেকে প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি রাশিয়ার তাতারস্তান প্রজাতন্ত্রের নির্মাণ, স্থাপত্য, আবাসন ও গণপূর্ত বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং এসময় তাতারস্তানকে রাশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চলে পরিণত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
২০১০ সালে তিনি মস্কোর নির্মাণ ও নগর উন্নয়ন বিষয়ক ডেপুটি মেয়র নিযুক্ত হন এবং ২০২০ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। এসময় মস্কো শহরের আধুনিকায়নে তিনি বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তাতারস্তান ও মস্কোয় তার প্রশাসনিক কৃতিত্বের জন্য ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তাকে রাশিয়ার নির্মাণ ও আঞ্চলিক উন্নয়ন বিষয়ক উপপ্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। রুশ সরকার রাশিয়ার হৃদভূমির বাইরে অবস্থিত প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর উন্নয়নের জন্য সম্প্রতি বিশেষভাবে সক্রিয় হয়েছে, এবং এজন্য তার এই পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জনক।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যখন এই তালিকাটি তৈরি করা হয়, তখনও খুনসুল্লিন রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হননি। এখন নতুন করে এই তালিকা তৈরি করা হলে তার অবস্থান যে আরো ওপরে চলে যাবে, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
(৮) সুলেইমান কেরিমভ
কেরিমরিন আবুসাইদান খভা সুলেইমান, যিনি তার রুশীকৃত ‘সুলেইমান কেরিমভ’ নামেই বেশি পরিচিত, একজন বিলিয়নেয়ার ব্যবসায়ী, সমাজসেবী ও রাজনীতিবিদ। ১৯৬৬ সালে বর্তমান রাশিয়ার দেরবেন্ত শহরে একটি জাতিগত লেজগিয়ান পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সোভিয়েত সেনাবাহিনীর একজন সৈনিক ছিলেন এবং ‘দাগেস্তান স্টেট ইউনিভার্সিটি’ থেকে ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টিং ও অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯০–এর দশকে যখন রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করা হয়, তখন তিনি দ্রুত একজন বড়মাপের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। কেরিমভ রুশ ব্যাঙ্ক ‘ফেদপ্রোমব্যাঙ্ক’ ও তেল কোম্পানি ‘নাফতা মস্কভা’র মালিক, এবং রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস কোম্পানি ‘গাজপ্রম’ ও ব্যাঙ্ক ‘সবেরব্যাঙ্কে’ তার শেয়ার রয়েছে।
২০০৭ সালে তিনি দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ‘সুলেইমান কেরিমভ ফাউন্ডেশন’ গঠন করেন। মস্কোয় অবস্থিত ইউরোপের বৃহত্তম মসজিদ ‘মস্কো ক্যাথেড্রাল মসজিদ’ নির্মাণের জন্য তিনি ১০০ মিলিয়ন (বা ১০ কোটি) মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছিলেন। কেরিমভ রুশ জাতীয়তাবাদী দল ‘এলডিপিআর’–এর সদস্য এবং বর্তমানে তিনি রুশ আইনসভার উচ্চকক্ষ ‘ফেডারেশন কাউন্সিলে’ দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেরিমভকে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং তার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বর্তমানে কেরিমভ বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে ৫৬তম এবং তার সম্পত্তির পরিমাণ ২১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জনক।
(৭) তালগাৎ তাঝউদ্দিন
তালগাৎ সাফা উলি তাঝউদ্দিন রাশিয়ার শায়খ আল–ইসলাম (প্রধান ধর্মীয় নেতা) ও প্রধান মুফতি। ১৯৪৮ সালের ১২ অক্টোবর বর্তমান রাশিয়ার কাজান শহরে একটি জাতিগত তাতার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বর্তমান উজবেকিস্তানের ‘মীর–ই–আরব মাদ্রাসা’ এবং মিসরের ‘আল–আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে’ অধ্যয়ন করেছেন। ১৯৯২ সাল থেকে তিনি ‘সেন্ট্রাল স্পিরিচুয়াল ডিরেক্টরেট অফ মুসলিমস’–এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এটি রুশ মুসলিমদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় সংগঠন। একই সঙ্গে তিনি ইউনেস্কো, ওআইসি, ইউরোপিয়ান লিগ অফ মুসলিমস এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মুসলিম সংগঠনে রুশ মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং পাঁচ সন্তানের জনক।
তাঝউদ্দিনের রাজনৈতিক অবস্থান বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি নিজেকে তাতার হিসেবে নয়, বরং ‘বুলগার’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। (উল্লেখ্য, বর্তমান তাতারস্তানের ভূমিতে বুলগাররা বসবাস করত, যারা মোঙ্গল আক্রমণে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমান তাতার জাতি বুলগার ও মোঙ্গলদের সংমিশ্রণ) তাঝউদ্দিন রাশিয়ায় সমকামিতার প্রসারের বিরোধিতা করেছেন এবং রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টান নেতাদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে এটির বিরোধিতা করেছেন। তদুপরি, তাঝউদ্দিন একজন রুশ সম্প্রসারণবাদী। তিনি সিরিয়ায় রুশ সামরিক হস্তক্ষেপের কট্টর সমর্থক ছিলেন, এবং রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনকে বলেছিলেন, “ক্রিমিয়াতে আমরা যেটা করেছি, আমাদের হয়ত সেটা সিরিয়া আর ইসরায়েলে করা উচিত। রাশিয়া মক্কা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হোক!”
(৬) আলিশের উসমনভ
আলিশের বুরহনোভিচ উসমনভ একজন বিলিয়নেয়ার ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী। ১৯৫৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বর্তমান উজবেকিস্তানের চুস্ত শহরে একটি জাতিগত উজবেক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘মস্কো স্টেট ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স’–এ আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন। ১৯৯০–এর দশকে তিনি রাশিয়ায় মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তনের সুযোগে বড় একজন ব্যবসায়ীতে পরিণত হন। বর্তমানে তিনি বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের মধ্যে ৮৩তম, এবং তার সম্পত্তির পরিমাণ ১৩.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
উসমনভ রুশ টেলিকম কোম্পানি ‘মেগাফোন’, ইন্টারনেট কোম্পানি ‘মেইল.রু’ এবং সংবাদপত্র ‘কমেরসান্ত’–এর মালিক, এবং বৈশ্বিক কোম্পানি ‘ইউএসএম হোল্ডিংস’–এর প্রতিষ্ঠাতা। বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গেও তিনি যুক্ত, এবং বর্তমানে তিনি ‘আন্তর্জাতিক ফেন্সিং ফেডারেশনে’র প্রেসিডেন্ট। তিনি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত, এবং বর্তমানে চলমান কোভিড–১৯ মহামারী মোকাবেলায় তিনি প্রচুর অর্থ দান করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং এক সন্তানের জনক।
(৫) রমজান কাদিরভ
কদর আখমাত–খান্ত রমজান, যিনি রুশীকৃত ‘রমজান কাদিরভ’ নামেই পরিচিত, একজন রাজনীতিবিদ ও আধা–সামরিক কর্মকর্তা। ১৯৭৬ সালের ৫ অক্টোবর বর্তমান রাশিয়ার আখমাত–ইয়ুর্ত গ্রামে একটি জাতিগত চেচেন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আখমাদ কাদিরভ ছিলেন চেচনিয়ার প্রধান মুফতি। কাদিরভ তার পিতার সঙ্গে প্রথম চেচেন যুদ্ধে (১৯৯৪–১৯৯৬) রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ (১৯৯৯–২০০৯) শুরু হলে কাদিরভ পরিবার রুশ সরকারের পক্ষে যোগদান করে এবং আখমাদ কাদিরভ চেচনিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হন। ২০০৪ সালে আখমাদ কাদিরভ চেচেন মিলিট্যান্টদের হাতে নিহত হলে রমজান কাদিরভ চেচনিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপ্রধান নিযুক্ত হন। রাজনৈতিকভাবে কাদিরভ রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
কাদিরভ বর্তমানে চেচনিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান এবং রুশ ন্যাশনাল গার্ডের একজন মেজর জেনারেল। তার নিজস্ব একটি সশস্ত্রবাহিনী রয়েছে, যেটি ‘কাদিরভৎসি’ নামে পরিচিত এবং আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ ন্যাশনাল গার্ডের অংশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত চেচনিয়ার পুনর্গঠনে কাদিরভ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি চেচনিয়ায় আংশিক ইসলামি আইনের প্রবর্তন করেছেন, কিন্তু তিনি চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘোর বিরোধী। আন্তর্জাতিক মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘দায়েশ’ কাদিরভকে কেউ খুন করতে পারলে তাকে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পুরস্কার দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। মার্কিন সরকার কাদিরভের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, এবং প্রত্যুত্তরে কাদিরভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, যদিও উভয় নিষেধাজ্ঞাই কার্যত প্রতীকী। ব্যক্তিগত জীবনে কাদিরভ বিবাহিত এবং বারো সন্তানের জনক।
(৪) রুস্তম মিন্নিখানভ
রুস্তম নুরগালি উলি মিন্নিখানভ বর্তমানে তাতারস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান। ১৯৫৭ সালের ১ মার্চ বর্তমান রাশিয়ার নোভি আরিশ গ্রামে একটি জাতিগত তাতার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘কাজান এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট’ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং–এ স্নাতক এবং ‘কারেসপন্ডেন্স ইনস্টিটিউট অফ সোভিয়েত ট্রেড’ থেকে পণ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি তাতারস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০১০ সালে তাতারস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।
তাতারস্তান রাশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি, এবং এজন্য প্রজাতন্ত্রটির রাষ্ট্রপ্রধানরা রাশিয়ার অন্যান্য প্রশাসনিক অঞ্চলের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর। মিন্নিখানভ তাতারস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার অধীনে তাতারস্তান রাশিয়ার শীর্ষ প্রযুক্তি কেন্দ্রগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখলের পর তিনি রুশ সরকার ও ক্রিমিয়ান তাতারদের মধ্যে মধ্যস্থতা করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক।
(৩) খাবিব নুরমাগোমেদভ
খাবিব আব্দুলমানাপোভিচ নুরমাগোমেদভ একজন মিক্সড মার্শাল আর্ট ফাইটার। ১৯৮৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বর্তমান রাশিয়ার সিলদি গ্রামে একটি জাতিগত আভার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘প্লেখানভ রাশান ইউনিভার্সিটি অফ ইকোনমিক্স’–এ অধ্যয়ন করছেন। তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মিক্সড মার্শাল আর্ট ফাইটারদের মধ্যে একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ইউএফসি লাইটওয়েট চ্যাম্পিয়ন ছিলেন এবং ২৯টি ম্যাচের প্রতিটিতেই জয়যুক্ত হয়েছেন। ২০২০ সালে অপরাজিত অবস্থায় তিনি মিক্সড মার্শাল আর্ট থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
নুরমাগোমেদভ ইউএফসি লাইটওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনকারী প্রথম মুসলিম। তাকে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মুসলিম ক্রীড়াবিদদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে আড়াই কোটির বেশি অনুসারী রয়েছে, এবং এদিক থেকে তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় ইনস্টাগ্রাম সেলিব্রিটি। নুরমাগোমেদভ একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে পরিচিত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জনক।
(২) মিন্তিমের শাইমিয়েভ
মিন্তিমের শারিপ উলি শাইমিয়েভ ছিলেন তাতারস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান। ১৯৩৭ সালের ২০ জানুয়ারি বর্তমান রাশিয়ার আনিয়াকোভো গ্রামে একটি জাতিগত তাতার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘কাজান এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউটে’ কৃষি প্রকৌশল বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন। তিনি তাতার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি তাতারস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন এবং তার শাসনামলে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটে তাতারস্তান স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
২০০১ সালে তিনি এবং মস্কোর মেয়র ইউরি লুঝকভ মিলে ‘ইউনাইটেড রাশিয়া’ দল গঠন করেন, যেটি এখন রাশিয়ার ক্ষমতাসীন দল। ২০১০ সালে তিনি তাতারস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান, কিন্তু উপদেষ্টা হিসেবে তাতারস্তান সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। তাতারস্তানের জনসাধারণের মধ্যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক।
(১) রাভিল গাইনুৎদিন
রাভিল ইসমাগিল উলি গাইনুৎদিন একজন ধর্মতাত্ত্বিক, ইমাম ও মুফতি। ১৯৫৯ সালের ২৫ আগস্ট বর্তমান রাশিয়ার শালি গ্রামে একটি জাতিগত তাতার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বর্তমান উজবেকিস্তানের ‘মীর–ই–আরব মাদ্রাসা’য় অধ্যয়ন করেছেন। ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি রাশিয়ার গ্র্যান্ড মুফতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে তিনি ‘স্পিরিচুয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ মুসলিমস অফ দ্য রাশান ফেডারেশন’–এর সভাপতি এবং রুশ মুফতি কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট। এর পাশাপাশি তিনি ‘মস্কো ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’র একজন প্রফেসর হিসেবেও কর্মরত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক।
গাইনুৎদিনকে রুশ মুসলিমদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্রেমলিনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, এবং রুশ মুসলিমদের মধ্যে তার প্রভাব ব্যাপক। তিনি খ্রিস্টান ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সমঝোতা ও শান্তি স্থাপনের পক্ষপাতী। তার মতে, স্লাভ ও তুর্কি জাতিগুলো সম্মিলিতভাবে রাশিয়া গঠন করেছে, এবং এজন্য তিনি স্লাভ–তুর্কি মৈত্রী গঠনের প্রস্তাব করেছেন।
সামগ্রিকভাবে, রুশ রাষ্ট্রকাঠামোয় মুসলিমরা আনুপাতিক হারে যথেষ্ট প্রভাব ও ক্ষমতার অধিকারী। যেহেতু রুশ খ্রিস্টানদের মধ্যে জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে এবং রুশ মুসলিমদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে রুশ রাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রভাব আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রে কী ধরনের সামাজিক–রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটতে পারে, সেটি একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়।