Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আমাজন ধ্বংসের পায়তারা: শতাব্দীর প্রাচীন শত্রুতা ভুলে একই কাতারে আদিবাসীরা

ব্রাজিলের ব্যস্ততম একটি শহর সাও পাওলো। দুপুর গড়াতেই সেখানকার আকাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে গেলো। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ায় ঘরে ফিরতে শুরু করে আতঙ্কিত মানুষজন। কিন্তু ধোঁয়ার উৎপত্তি যেখানে সেটা সাও পাওলো থেকে ২,৭০০ কিলোমিটার দক্ষিণে, আমাজন বনে!

এই ঘটনার পরপরই বিশ্ব মিডিয়ার নজরে আসে পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন পুড়ছে। কিন্তু এটাই প্রথম নয়, আমাজনে এর আগেও বহুবার আগুন লেগেছে। এটা নিশ্চয়ই বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। মূলত আমাজনকে ঘিরে যে ষড়যন্ত্র, সেটা বহু প্রাচীন। আর এটা বুঝতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে আরও আগে। যখন থেকে বহু আদিবাসী গোষ্ঠীর আবাসস্থল এই বন ভিনদেশীদের নজরে এসেছিল।

১৫০০ সালের ২২ এপ্রিল, একদল পর্তুগিজ অভিযাত্রিক আমাজন উপকূলে নোঙর ফেলে। বিস্তীর্ণ বনভূমি আর কাঠের লোভে আমেরিকান উপনিবেশের বিষাক্ত নিঃশ্বাস আমাজনে এসে পড়ে। আমেরিকানরা নিজেদের কাঠের যোগান দিতে গিয়ে গাছ কাটতে শুরু করে। এছাড়াও ‘ব্রাসিলউড’ নামের গাছ থেকে মূল্যবান লাল রং সংগ্রহ করা শুরু করে তারা। এই রং ইউরোপে পাঠানো শুরু করলে ইউরোপ থেকেও অভিযাত্রী দল এখানে আসার পথ চিনে নেয়। যে ব্রাসিলউডের প্রাচুর্যের কারণে ব্রাসিল নামক দেশটির নামকরণ, অতিমাত্রায় কেটে ফেলার কারণে এই গাছটি বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত।

ব্রাসিলউড আজ বিলুপ্তির পথে; Image Source: mauro halpen/flickr

শুরুর দিকে স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে চুক্তি করে ইউরোপিয়ানরা, কাঠের বদলে ইউরোপিয়ান পণ্যসামগ্রী পেত আদিবাসীরা। কিন্তু কাঠ আর লাল রংয়ের চাহিদা বেড়ে গেলে মুনাফার লোভ বাড়তে থাকে উপনিবেশের ব্যবসায়ীদের মাঝে। তাই এবার তারা আরও লোক নিয়োগ করে বেশি করে গাছ কাটার জন্য। কিন্তু আদিবাসী জনগণ বুঝতে পারে, তাদের আবাসভূমি শত্রুর হাতে পড়ে গেছে। যে গাছ দিয়ে তারা বাড়ি বানাত, তাদের খাদ্যের যোগান দিত, তা আজ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। ইউরোপিয়ানরা স্থানীয়দের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাদের উপর চড়াও হয়। এতদিন বিনিময়ের মাধ্যমে সব আদানপ্রদান হলেও এবার স্থানীয়দের একরকম জোর করে গাছ কাটতে বাধ্য করা হয়। এর মধ্য দিয়েই মূলত আদিবাসীরা ইউরোপিয়ানদের দাসে পরিণত হয়

আদিবাসীরা সংখ্যায় কম হওয়ায় কাঠের যোগান বাড়াতে আফ্রিকা থেকেও দাসদের এনে কাজে লাগাতে শুরু করে ইউরোপিয়ানরা। এভাবে যখন কোনো এলাকা খালি হয়ে যেত, সেখানে চিনির উৎপাদন শুরু করত তারা।
উপনিবেশের ব্যবসায়ীরা যেসব পণ্য উৎপাদন করত, সেগুলো পরিবহনের জন্য রুটের প্রয়োজন ছিল। ‘মাতা আটলান্টা’ ছিল তাদের ব্যবসার পরিবহন রুট। এই ট্রপিক্যাল বনের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহনের কারণে তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছিল। তাই তারা এই বন কেটে সেখান দিয়ে পথ তৈরি করে নেয়। পথ তৈরির ছুতোয় গত ৫০০ বছরে সেখানকার প্রায় ৯২ শতাংশ গাছ কেটে ফেলা হয়। স্থানীয় আদিবাসীদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাদের সাংস্কৃতিক চিহ্ন মুছে ফেলা হয় এবং এখানকার জীব-বৈচিত্র্যের প্রায় পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যায়।

 বহু আদিবাসী গোষ্ঠী আজ বিলুপ্ত; Image Source: independent.co.uk

উনিশ শতকের প্রায় পুরোটা সময় জুড়ে ব্রিটিশরা আমাজনের আরও বনাঞ্চল ধ্বংস করে। সেখানে তারা রাবার উৎপাদন শুরু করে, যার জন্য আদিবাসীদের জোর করে রাবার উৎপাদনের কাজে নিয়োগ করা হয়। আমেরিকান গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘ফোর্ড’ এর কর্ণধার হেনরি ফোর্ড ১৯২৮ সালে আমাজনের গহীনে একটি পরিত্যক্ত রাবার বাগান খুঁজে পান। তিনি সেখানে পুনরায় রাবার উৎপাদনের কাজ শুরু করেন। তার কোম্পানির গাড়িতে ব্যবহারের জন্য প্রচুর রাবারের প্রয়োজন ছিল। একসময় জায়গাটির নাম হয়ে যায় ‘ফোর্ড’। কিন্তু কয়েক বছর চালু থাকার পর ১৯৩৪ সালে জায়গাটিকে আবার পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।

বিংশ শতাব্দী শেষ হতে না হতেই আমাজনের আদিবাসীদের প্রায় ৮৫ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। শত শত বছর ধরে চলমান বন ধ্বংস, বন্যপ্রাণীদের বিলুপ্তি আর আদিবাসীদের উপর নির্যাতনের মূল কারণ ছিল সেখানকার কাঠের চাহিদা, পতিত জমিতে রাবার আর শস্য চাষ। কিন্তু একটা সময়ে এসে এখনও বনভূমি সমান তালে ধ্বংস করা হচ্ছে ভিন্ন এক উদ্দেশ্য। বিশ্বের মাংস চাহিদার বড় একটি অংশ পূরণ করে ব্রাজিল। আর মাংসের উৎস এসব গবাদিপশুর লালন-পালনের জন্য প্রয়োজন প্রচুর জায়গার। এছাড়াও অবৈধ অনেক স্বর্ণখনি গড়ে উঠেছে আমাজনের গহীনে। নতুন সব ইন্ডাস্ট্রি আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। তাই আজও আমাজন বন মানুষের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।

আমাজনের গহীনে অবৈধ খনি; Image Source: thenation.com

কথায় আছে, দেয়ালে যখন পিঠ লেগে যায় তখন কাপুরুষও হিংস্র হয়ে ওঠে। এমনটাই ঘটতে শুরু করেছে আমাজনের বনে। স্থানীয় আদিবাসীরা এখানে শত শত বছর ধরে নির্যাতনের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। তাছাড়া নিজেদের ভেতর জাতিগত সংঘাত তো রয়েছেই। তাদের বৃহৎ একটি অংশের আজ কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এখনো যারা আছে তারা কিছুটা হলেও সভ্যতার আলো পেয়েছে। এখন তারা বুঝতে পেরেছে, এতগুলো শতাব্দী তারা কেবল নিজেদের সঙ্গে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলায় কাটিয়েছে। তারা কখনোই এক হতে পারেনি বলে উপনিবেশের লোকজন তাদের যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করেছে। তাই তাদের অস্তিত্ব আজ সমুদ্রে পানির শেষ বিন্দুটির মতো। এখনই কিছু করা না গেলে সেই বিন্দুটুকুও সূর্য শুষে নেবে।আমাজনের আদিবাসীদের ভেতর বৃহৎ একটি গোষ্ঠীর নাম ‘কায়াপোস’। আমাজন নদের অববাহিকা জুড়ে তাদের বসবাস। এখানকার একজন নেতা মুদিজিরে কায়াপো এর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান সাংবাদিকরা। তার মতে,

 “বহুকাল ধরে আমরা নিজেদের শত্রু ভেবে নিজেরাই লড়াই করে এসেছি। কিন্তু আমরা জানতামও না আসলে কীসের জন্য লড়ছি আমরা!  কিন্তু এখন আমরা আর শত্রু নই। আমাদের শত্রুরা চিহ্নিত, ব্রাজিল সরকার আর এখানে জোর করে বাস করতে আসা লোকজনই আমাদের শত্রু।”

‘কায়াপোস’ এবং ‘পানারা’ আমাজনের দুইটি বৃহৎ আদিবাসী গোষ্ঠী। শত বছর ধরে চলমান লড়াইয়ে তারা কেবল আপনজনদেরই হারিয়েছে। সাদা চামড়ার লোকজনদের তারা কখনো শত্রু ভাবার সুযোগটুকুও পায়নি। ওই নেতার মতে, “এখন সময় এসেছে নিজেদের সকল শত্রুতা ভুলে সাদাদের দিকে নজর দেওয়ার।”

পৃথিবীর ফুসফুস পুড়ছে; Image Source: independent.co.uk

বলা হয়ে থাকে, আমাজন পৃথিবীর অক্সিজেন চাহিদার ২০ শতাংশ সরবরাহ করে থাকে। এটার সাথে সাথে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে যে এত সতর্কবার্তা, আমাজন সেটাকেও কিছুটা প্রশমিত করার চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু সাম্প্রতিক যে তথ্য-উপাত্ত আমাদের সামনে আসছে সেগুলো ভয়াবহ। পরিবেশবিদরা যতই বলুক ব্রাজিল বনহীন হয়ে পড়ছে, কিন্তু সরকারের তাতে কোনো সাড়া আছে বলে মনে হয় না। কারণ ব্রাজিলের টালমাটাল অর্থনীতির প্রাণ ফিরিয়ে আনতে মরিয়া সেখানকার সরকার। আর তাতে আমাজনকে দেখা হচ্ছে বলির পাঠা হিসেবে। কারণ ইন্ডাস্ট্রি, চাষাবাদ এবং বিশ্ববাজারে মাংসের যোগান দিতে হলে প্রয়োজন পতিত জমি। আর সেটা পাওয়া যাবে কেবল গাছ কাটলেই।

নির্বাচনে জয়লাভের সময় প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর যতটা জনপ্রিয়তা ছিল, এখন সেটা কমতে শুরু করেছে। তাকে হয়তো আরেকবার স্মরণ করা দরকার ব্রাজিলের নির্বাচনের ১৫ শতাংশ ভোট পড়ে আদিবাসীদের আঙুলের ছাপে। তাদেরকে ক্ষেপিয়ে দিলে ভোটব্যাঙ্কে যে টানাপোড়ন শুরু হবে সেটা হয়তো তিনি জানেন। তাই আগুন লাগার পর সেখানকার আগুন নেভানোর কাজে সরকারের যে প্রচেষ্টা, সেটা খুব একটা কাজে আসেনি তার জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো; Image Source: reuters.com

আমাজনকে ঘিরে উপনিবেশ গড়ার সংস্কৃতি কম করে হলেও ১৩ হাজার বছরের পুরনো। এখানকার এমন কিছু জায়গা আছে যারা সভ্যতার আলো এখন পর্যন্ত পায়নি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের কাছে আলাদীনের চেরাগের মতোই। কিন্তু তারা যখন তাদের প্রতিবেশীদের কাছে জানতে পারবে, তাদের আবাসস্থল নিয়ে কী মহা পরিকল্পনা চালাচ্ছে সবাই; তখন তারা এটাতে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে?

আদিবাসীরা যখন এক হতে শুরু করেছে প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো কথা দিয়েছেন, তিনি আমাজনকে রক্ষার প্রস্তাব জাতিসংঘে তুলে ধরবেন। কিন্তু এতে তারা কতটুকু আশ্বস্ত হয়েছে সেটা এখন দেখার বিষয়। তবে এটা সত্য যে, আদিবাসীদের আর ভুলভাল বুঝিয়ে রাখা যাবে না। তারা ইতোমধ্যে একটি প্রবাদ মেনে চলতে শুরু করেছে, ‘সংখ্যাই শক্তি’। এতদিন ধরে বিভক্ত বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী রাজনীতির গুটির চালে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। তাদের হাতে রয়েছে আমাজন, আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের কপালে তাই একটু হলেও ভাঁজ পড়েছে। এখন দেখার বিষয় আদিবাসীদের এই এক হওয়ার মাধ্যমে আমাজন টিকে যেতে পারে কি না।

প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘বিশ্ব’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

This article is about recent amazon fire  making native tribes to uniting them against the government.

Necessary sources are hyperlinked in the article.

Featured Image: independent.co.uk

Related Articles