(১ম পর্ব পড়ুন)
২০০৯ সালের মে মাসে তুর্কি আইনসভা ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে তদানীন্তন তুর্কি যোগাযোগমন্ত্রী (পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী) বিনালি ইলদিরিম কৃষ্ণসাগর ও মার্মারা সাগরকে সংযুক্ত করার জন্য বসফরাস প্রণালীর বিকল্প একটি জলপথ তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। এটি ছিল ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্প সম্পর্কে তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল একেপির কোনো নেতার প্রথম বক্তব্য। কিন্তু সেসময় ইলদিরিমের বক্তব্য বিশেষ প্রচারণা লাভ করেনি। ধারণা করা হয়, তুর্কি সরকার এর আগে থেকেই গোপনে ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্প সম্পর্কে অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছিল।
২০১০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তুর্কি সাংবাদিক ও লেখক হিনজাল উলুচ তুর্কি সরকারপন্থী দৈনিক পত্রিকা ‘সাবাহ’–এ ‘প্রধানমন্ত্রীর একটি উদ্ভট প্রকল্প’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন। সম্পাদকীয়তে উলুচ তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী রেজেপ এরদোয়ানের সঙ্গে তার একটি ফোনালাপের কথা উল্লেখ করে জানান যে, এরদোয়ান তাকে ইস্তাম্বুলের ব্যাপারে একটি অতি উদ্ভট প্রকল্পের কথা বলেছেন। এই সম্পাদকীয় থেকেই ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পটি ‘উদ্ভট প্রকল্প’ (তুর্কি: Çılgın Proje) হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে। এই সম্পাদকীয়টিতে অবশ্য উলুচ ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেননি। কিন্তু পরবর্তীতে তুরস্কে উক্ত প্রকল্পটি যে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি করে, সেটির পশ্চাতে উলুচের নাটকীয় এই সম্পাদকীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২০১১ সালে অনুষ্ঠিত তুর্কি সাধারণ নির্বাচনের আগে ২৭ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনি র্যালিতে তদানীন্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী এরদোয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেন। উক্ত খালটি বসফরাস প্রণালীর সমান্তরালে নির্মিত হবে এবং এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে ইস্তাম্বুলে নতুন সমুদ্রবন্দর, সেতু, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা ও কৃত্রিম হ্রদ নির্মিত হবে। এরদোয়ান নিজেই এই প্রকল্পকে ‘উদ্ভট প্রকল্প’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং ঘোষণা করেন যে, ২০২৩ সালে তুর্কি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পূর্তির সময়ে উক্ত খালটি উদ্বোধন করা হবে। তিনি এই প্রকল্পকে পানামা ও সুয়েজ খাল খনন প্রকল্পের চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে অভিহিত করেন। অবশ্য সেসময় তুরস্কের বিরোধী দলগুলো এরদোয়ানের বক্তব্যকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেনি। তুরস্কের প্রধান বিরোধী দল ‘জুমহুরিয়েত হালক পার্তিসি’র (তুর্কি: Cumhuriyet Halk Partisi, ‘CHP’) প্রেসিডেন্ট কেমাল কিলিচদারোলু সেসময় ব্যঙ্গাত্মকভাবে মন্তব্য করেন, “এই জাতির উদ্ভট লোকের না, চিন্তা করতে পারে এরকম লোকের প্রয়োজন।”
যদিও এরদোয়ান ঘোষণা দিয়েছিলেন, দুই বছরব্যাপী সম্ভাব্যতা অধ্যয়নের (feasibility studies) পর ইস্তাম্বুল খালের নির্মাণ কাজ শুরু হবে, কার্যত এখন পর্যন্ত খালটির নির্মাণকাজ আরম্ভ হয়নি। ২০১১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তুর্কি সরকার উক্ত প্রকল্পটি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে। ২০১৮ সালে তুর্কি যোগাযোগ মন্ত্রণালয় উক্ত খাল ইস্তাম্বুলের কোন অংশে নির্মিত হবে, সেটি ঘোষণা করে। তাদের বক্তব্য অনুসারে, খালটি মার্মারা সাগরের নিকটবর্তী কুচুকচেকমেজে হ্রদ অতিক্রম করবে এবং আভজিলার ও বাশাকশেহির জেলাদ্বয়ের মধ্য দিয়ে ইস্তাম্বুলের উত্তরে অবস্থিত আর্নাভুৎকয় জেলা হয়ে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত পৌঁছাবে। খালটির ৭ কি.মি. কুচুকচেকমেজে হ্রদের মধ্য দিয়ে, ৩.১ কি.মি. আভজিলারের মধ্য দিয়ে, ৬.৫ কি.মি. বাশাকশেহিরের মধ্য দিয়ে এবং ২৮.৬ কি.মি. আর্নাভুৎকয়ের মধ্য দিয়ে যাবে।
২০২১ সালের জুনে এরদোয়ান সালিজদেরে সেতুর উদ্বোধন করেন। ইস্তাম্বুল খাল নির্মিত হলে এই সেতুর অবস্থান হবে খালের ওপরে। আট লেনবিশিষ্ট এবং ৮৪০ মিটার দীর্ঘ এই সড়ক সেতুটি উত্তর মার্মারা রাজপথের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এই সেতুকে তুর্কি সরকার ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের প্রথম অবকাঠামো হিসেবে বর্ণনা করেছে। এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এরদোয়ান জানান, পরবর্তী ছয় বছরের মধ্যে ইস্তাম্বুল খাল নির্মিত হবে এবং এর নির্মাণকাজে ব্যয় হবে প্রায় ১৫০০ কোটি (বা ১৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার।
উল্লেখ্য, উত্তর মার্মারা রাজপথ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইস্তাম্বুলে নির্মিত অন্যান্য অবকাঠামোর (যেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দর ও তৃতীয় বসফরাস সেতু) সঙ্গেও সংযুক্ত। সালিজদেরে সেতুও উক্ত রাজপথের সঙ্গে যুক্ত হবে বিধায় ইস্তাম্বুলের ‘সিএইচপি’ দলীয় মেয়র একরেম ইমামোলু ধারণা করছেন, প্রকৃতপক্ষে এই সেতুটি ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের অংশ নয়, বরং তুর্কি সরকার ইস্তাম্বুলে যে যাতায়াত সংক্রান্ত অবকাঠামো নির্মাণের প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছে, সেটির অংশ। ইমামোলুর বক্তব্য সঠিক কিনা, সেটি অবশ্য নিশ্চিত নয়। কিন্তু তার বক্তব্যকে যদি সঠিক হিসেবে ধরে নেয়া হয়, সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণের কাজ এখনো আরম্ভ হয়নি।
অবশ্য উক্ত প্রকল্পের কাজ শুরু হোক আর না হোক, ইস্তাম্বুল খাল নির্মাণের সম্ভাবনা ইতোমধ্যেই তুরস্কের অভ্যন্তরে ও বাইরে তীব্র আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। খালটির নির্মাণ আদৌ সম্ভব কিনা সেটি থেকে শুরু করে খালটি নির্মাণের ফলে বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে কোন ধরনের প্রভাব পড়বে, সবকিছু নিয়েই বিভিন্ন ধরনের জল্পনাকল্পনা চলছে।
তুর্কি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি
তুর্কি সরকার প্রথম থেকেই ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে আসছে। তাদের ভাষ্যমতে, বসফরাস প্রণালীতে নৌযান চলাচলের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সংকীর্ণ এই প্রণালীটিতে এত বিরাট সংখ্যক নৌযানের (বিশেষত তেলবাহী ট্যাঙ্কারের) উপস্থিতি দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে। তদুপরি, প্রণালীটিতে যানজটের কারণে বহু জাহাজকে আটকা পড়তে হয় এবং সেগুলো সমুদ্রে দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। এজন্য বসফরাসের বিকল্প একটি জলপথ সৃষ্টি হলে একদিকে বসফরাস প্রণালীর ওপর থেকে চাপ কমবে এবং সেখান যানজট সৃষ্টি ও দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পাবে, অন্যদিকে এতদঞ্চলে নৌ বাণিজ্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। ২০২১ সালের জুনে সালিজদেরে সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এরদোয়ান দাবি করেছেন, নতুন এই জলপথ বসফরাস প্রণালীর তুলনায় ৩০ গুণ বেশি নিরাপদ হবে এবং বিকল্প পথ সৃষ্টির ফলে বসফরাসে যানজটের পরিমাণ ৯০% হ্রাস পাবে!
অবশ্য অর্থনৈতিক লাভের পাশাপাশি তুর্কি সরকার এই মেগাপ্রকল্পকে জাতীয় গৌরবের বিষয়বস্তু হিসেবেও উপস্থাপন করেছে। এরদোয়ানের ভাষ্যমতে, উক্ত খালটি তুর্কি জাতির ‘গর্বের উৎস’ হবে এবং অন্যান্য জাতির ঈর্ষার উদ্রেক করবে। বস্তুত ২০০২ সালে একেপির ক্ষমতায় আরোহণের পর থেকেই তুর্কি সরকার বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করেছে। যেমন: ইস্তাম্বুলে তারা বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ নির্মাণ করেছে। বসফরাস প্রণালীর ওপরে তারা একটি নতুন সেতু নির্মাণ করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে ইস্তাম্বুলের এশীয় ও ইউরোপীয় অংশ সংযোগ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা ইস্তাম্বুলে একটি নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ করেছে, যেটি এখন বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবন্দর। এই ধরনের মেগাপ্রকল্পগুলোকে তুর্কি সরকার (এবং একেপি) জনসাধারণের মধ্যে নিজেদের সমর্থন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করেছে। ইস্তাম্বুল খালও অনুরূপ একটি প্রকল্প, যেটি নির্মাণের (বা নির্মাণের প্রচারণার) মধ্য দিয়ে তুর্কি সরকার নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে আগ্রহী।
কিন্তু তুর্কি সরকারের আনুষ্ঠানিক ভাষ্যে ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও ফলাফল সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায় না, কারণ এই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব, অর্থনৈতিক কার্যকারিতা, ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য ও অন্যান্য দিক নিয়ে যেসব বিতর্ক রয়েছে, তুর্কি সরকারের আনুষ্ঠানিক ভাষ্যে সেগুলোকে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, কিংবা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
পরিবেশগত প্রভাব
তুর্কি পরিবেশবিদরা ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের সম্ভাব্য পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং প্রকল্পটিকে পরিবেশগত দিক থেকে বিপর্যয়কর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এক্ষেত্রে তারা কয়েকটি দিক বিশেষ গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন।
প্রথমত, খালটি নির্মিত হবে এমন একটি জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে, যেটি সুপেয় পানির উৎস এবং সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ইস্তাম্বুলের পানি সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত। উল্লেখ্য, ইস্তাম্বুলের ৪০% পানি আসে শহরটির ইউরোপীয় অংশ থেকে, যেখানে এই খালটি নির্মিত হবে। পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, ইস্তাম্বুল খাল নির্মাণের ফলে ইস্তাম্বুলের দুটি জলাধার ধ্বংস হয়ে যাবে এবং ইস্তাম্বুল ও পূর্ব থ্রেস অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ দূষিত হয়ে পড়বে। এর ফলে ইস্তাম্বুলে সুপেয় পানি সরবরাহে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে এবং সেক্ষেত্রে এই সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় থাকবে না। এজন্য ইস্তাম্বুলের মেয়র ইমামোলু ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের ঘোর বিরোধী।
দ্বিতীয়ত, পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, ইস্তাম্বুল খাল কৃষ্ণসাগর ও মার্মারা সাগরের মধ্যবর্তী পানির প্রবাহের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলতে পারে। বেশ কিছু পরিবেশবিদের ধারণা, উক্ত খালের মাধ্যমে কৃষ্ণসাগরের দূষিত পানি ভূমধ্যসাগরে প্রবাহিত হবে এবং এর মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরে নতুন একটি পরিবেশগত সঙ্কটের সৃষ্টি করবে।
তৃতীয়ত, সম্প্রতি মার্মারা সাগরে সামুদ্রিক শ্লেষ্মা (sea-snot) ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে উক্ত সাগরটি এবং সামগ্রিকভাবে তুর্কি সামুদ্রিক পরিবেশ গুরুতর হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। তুর্কি পরিবেশবিদদের ধারণা, ইস্তাম্বুল খাল (যেটি হবে একটি কৃত্রিম জলপথ) নির্মাণের ফলে মার্মারা সাগর আরো দূষিত হয়ে পড়বে এবং এর ফলে তুর্কি সামুদ্রিক পরিবেশের আরো অবনতি ঘটবে।
তুর্কি ‘চেম্বার অফ আরবান প্ল্যানার্সে’র ভাইস–প্রেসিডেন্ট পিনার গিরিৎলিওলুর ভাষ্যমতে, ইস্তাম্বুল খালের মাধ্যমে কৃষ্ণসাগর ও মার্মারা সাগরের পানির সংমিশ্রণ ঘটবে এবং এর ফলে ইতোমধ্যেই হুমকির সম্মুখীন হয়ে থাকা ইস্তাম্বুলের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও তুর্কি সামুদ্রিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া, পরিবেশবিদরা আরো আশঙ্কা করছেন যে, এই খাল খননের ফলে ইস্তাম্বুলে ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু তুর্কি সরকার পরিবেশবিদদের বক্তব্যকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে না। তুর্কি সরকারের ভাষ্যমতে, ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পটি পরিবেশগতভাবে সম্পূর্ণ টেকসই। শুধু তা-ই নয়, তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান উক্ত প্রকল্পকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব প্রকল্প’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, নতুন এই সামুদ্রিক জলপথটির নির্মাণের ফলে মার্মারা সাগরের বাস্তুতন্ত্র (ecosystem) লাভবান হবে। অর্থাৎ, খালটির পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে তুর্কি সরকার ও পরিবেশবিদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মতপার্থক্য বিদ্যমান।
অর্থনৈতিক কার্যকারিতা
ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পের অর্থনৈতিক কার্যকারিতা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য – খালটির নির্মাণব্যয়ের উৎস এবং উক্ত খাল থেকে লব্ধ অর্থনৈতিক সুযোগ–সুবিধা। যথারীতি এক্ষেত্রেও তুর্কি সরকার ও সরকার–সমর্থকদের সঙ্গে অন্যান্যদের ব্যাপক মতপার্থক্য রয়েছে।
তুর্কি সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রকল্পটির অর্থায়ন করা হবে ‘বিল্ড-অপারেট-ট্রান্সফার’ পদ্ধতিতে, অর্থাৎ তুর্কি সরকার কোনো কোম্পানিকে উক্ত খাল নির্মাণের দায়িত্ব প্রদান করবে এবং উক্ত কোম্পানি খালটি নির্মাণের পর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খালটি পরিচালনা করবে। এরপর উক্ত খালকে তুর্কি সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের ভাষ্য অনুযায়ী, যেভাবে ওসমান গাজী সেতু নির্মাণের অর্থায়ন করা হয়েছিল, সেভাবেই ইস্তাম্বুল খাল নির্মাণের অর্থায়ন করা হবে। উল্লেখ্য, ওসমান গাজী সেতু ইজমির উপসাগরের ওপরে অবস্থিত এবং সড়কপথের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরীয় শহরটির সঙ্গে সংযুক্ত।
কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ওসমান গাজী সেতু তুর্কি সরকারের জন্য লাভজনক হয়নি। তুর্কি সরকার বেশকিছু ইতিবাচক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে উক্ত সেতু নির্মাণের প্রকল্পটি চালু করেছিল এবং ‘ওতোয়োল ইয়ারিরিম এ. এস.’ নামক একটি কোম্পানিকে এই প্রকল্পের দায়িত্ব প্রদান করেছিল। তাদের ধারণা ছিল, কোম্পানিটি উক্ত সেতুতে চলাচলকারী যানবাহনগুলো থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক আদায় করতে সক্ষম হবে। কিন্তু কোম্পানিটির আদায়কৃত শুল্কের পরিমাণ ছিল নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম এবং এজন্য ২০২০ সালে তুর্কি সরকার উক্ত কোম্পানিকে ৩০০ কোটিরও (বা ৩ বিলিয়ন) বেশি তুর্কি লিরা বা ২ কোটি ৮০ লক্ষ (বা ২৮ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার প্রদান করতে বাধ্য হয়। বিশ্লেষকদের ধারণা, ইস্তাম্বুল খাল প্রকল্পও অনুরূপভাবে তুর্কি সরকারের জন্য একটি অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
তদুপরি, তুর্কি সরকার ইস্তাম্বুল খাল থেকে আয় করতে পারবে কিনা, সেটি নির্ভর করবে উক্ত খালে নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে ‘মনথ্রো কনভেনশনে’র শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে কিনা, সেটির ওপরে। যদি খালটির ক্ষেত্রে উক্ত কনভেনশনের শর্তাবলি প্রযোজ্য হয়, সেক্ষেত্রে তুর্কি সরকার উক্ত খাল দিয়ে যাতায়াতকারী নৌযানগুলোর কাছ থেকে শুল্ক আদায় করতে পারবে না (যেমনটা বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীদ্বয়ের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে)। এক্ষেত্রে তুর্কি সরকার খালটির দ্বারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে না। অন্যদিকে, যদি খালটির ক্ষেত্রে উক্ত কনভেনশনের শর্তাবলি প্রযোজ্য না হয়, সেক্ষেত্রে তুর্কি সরকার উক্ত খাল দিয়ে যাতায়াতকারী নৌযানগুলোর কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ শুল্ক আদায় করতে পারবে। সেক্ষেত্রে তুর্কি সরকারের ব্যাপক অর্থনৈতিক লাভ হবে। কিন্তু খালটি নির্মিত হওয়ার পর সেটির ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে কিনা, এটি নিয়েও তুরস্কের অভ্যন্তরে নানা ধরনের বিতর্ক রয়েছে।
তুর্কি সরকার এক্ষেত্রে সতর্ক কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বক্তব্য প্রদান করেছে। প্রাক্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিমের ভাষ্যমতে, ইস্তাম্বুল খালের ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের শর্তাবলি প্রযোজ্য হবে না। তুর্কি সরকারের সমর্থকরা (এবং একই সঙ্গে তুর্কি সরকারের বিরোধীরা) এই বক্তব্যকে বিশ্বাস করে। অন্যদিকে, তুর্কি সরকার কর্তৃক প্রকাশিত অন্তত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, খালটির ক্ষেত্রে মনথ্রো কনভেনশনের নীতিমালা প্রযোজ্য হবে।
এই পরিস্থিতিতে যদি ধরে নেয়া হয় যে, খালটি মনথ্রো কনভেনশনের আওতার বাইরে থাকবে, সেক্ষেত্রে তুর্কি সরকার কেবল তখনই উক্ত খাল থেকে লাভবান হতে পারবে, যখন খালটি দিয়ে বিপুল সংখ্যক নৌযান চলাচল করবে। তুর্কি সরকারি কর্মকর্তারা এই বিষয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী। সম্প্রতি ‘সিএনএন তুর্ক’কে প্রদত্ত একটি বিবৃতিতে তুর্কি পরিবহন ও অবকাঠামো বিষয়ক মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন যে, অবশ্যই খালটির মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক নৌযান চলাচল করবে এবং তুরস্ক এই ধরনের অর্থনৈতিক মডেল প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি!
কিন্তু এই বিষয় নিয়েও তুরস্কের অভ্যন্তরে ও বাইরে বিতর্ক রয়েছে। তুর্কি পরিবহন ও অবকাঠামো বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৬ সাল নাগাদ ইস্তাম্বুল খাল দিয়ে বছরে ৫৪,৯০০টি নৌযান যাতায়াত করবে এবং ২০৩৯ সাল নাগাদ সংখ্যাটি বেড়ে ৬৮,০০০–এ উন্নীত হবে। কিন্তু এই অঞ্চলে পাইপলাইনের মাধ্যমে হাইড্রোকার্বন সরবরাহের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং একই সঙ্গে কিছু রাষ্ট্র জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর থেকে তাদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে ফেলছে। এর ফলে বসফরাস প্রণালী দিয়ে নৌযান চলাচলের হার হ্রাস পেয়েছে। এক প্রতিবেদন অনুসারে, বিগত দশকে বসফরাস প্রণালী দিয়ে চলাচলকারী নৌযানের সংখ্যা ৫৩,০০০ থেকে ৩৮,০০০–এ নেমে এসেছে। এমতাবস্থায় বসফরাস প্রণালীর একটি বিকল্প জলপথ সৃষ্টি করলেই যে সেটি দিয়ে বিপুল সংখ্যক নৌযান চলাচল করবে, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। আর ইস্তাম্বুল খাল দিয়ে যদি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নৌযান চলাচল না করে, সেক্ষেত্রে প্রকল্পটি থেকে তুর্কি সরকার কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক লাভ পাবে না।
তদুপরি, ইস্তাম্বুল খালের সঙ্গে মনথ্রো কনভেনশনের কোনো যোগসূত্র না থাকলে সেক্ষেত্রে নৌযানগুলো যে নতুন এই জলপথ ব্যবহার করতে আগ্রহী হবেই, সেটির কোনো নিশ্চয়তা নেই। বসফরাস প্রণালীতে নৌযান চলাচল যেহেতু শুল্কমুক্ত, সেহেতু বহু নৌযানই বিকল্প পথে গিয়ে তাদের ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে চাইবে না। এই পরিস্থিতিতে তুর্কি সরকার ইস্তাম্বুল খাল ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক নৌযানকে আগ্রহী করে তুলতে পারবে কিনা, সেটি দেখার বিষয়।