কিরগিজস্তান মধ্য এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। ১৯৯১ সালের ৩১ আগস্ট প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে রাষ্ট্রটি স্বাধীনতা লাভ করে, অর্থাৎ স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র (nation–state) হিসেবে কিরগিজস্তানের বয়স মাত্র সাড়ে ২৮ বছর। পার্বত্য ভূমিতে অবস্থিত রাষ্ট্রটির আনুষ্ঠানিক নাম কিরগিজ প্রজাতন্ত্র (Кыргыз Республикасы, ‘কিরগিজ রেসপুবলিকাসি’)। কিরগিজস্তান একটি এককেন্দ্রিক সংসদীয় প্রজাতন্ত্র। মধ্য এশিয়ার ৫টি প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রের মধ্যে একমাত্র কিরগিজস্তানেই কার্যত একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিরাজমান নয়।
পার্বত্য রাষ্ট্র কিরগিজস্তানে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ খুব কম। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই রাষ্ট্রটি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিপ্লব, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, দুর্নীতি এবং জাতিগত সংঘাতে জর্জরিত। রাষ্ট্রটির উত্তর ও দক্ষিণাংশের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং রাষ্ট্রটির ক্ষমতার কেন্দ্রও প্রকৃতপক্ষে দুটি– একটি রাজধানী বিশকেক, যেটি কিরগিজস্তানের বৃহত্তম শহর; ক্ষমতার অন্য কেন্দ্রটি হচ্ছে ওশ ও জালালাবাদ শহরদ্বয়ের মধ্যবর্তী করিডোর।
অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে কিরগিজস্তানের ভাগ্যাকাশে এক ড্রাগনের আবির্ভাব ঘটেছে– চৈনিক ড্রাগন। কিরগিজ জাতীয়তাবাদীদের আশঙ্কা, বৃহৎ চৈনিক ড্রাগন ক্ষুদ্র কিরগিজ তুষার চিতাকে (Snow Leopard) গিলে খাবে! উল্লেখ্য, তুষার চিতা বা স্নো লেপার্ড কিরগিজস্তানের জাতীয় প্রাণী এবং প্রাণীটিকে কিরগিজ যোদ্ধাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
কিরগিজস্তানের পূর্বদিকে চীন অবস্থিত, বা আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, চীনের জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। চীনের সঙ্গে কিরগিজস্তানের সীমান্তের দৈর্ঘ্য ১,০৬৩ কি.মি.। কিরগিজস্তানের তুলনায় চীন কেন একটি দৈত্যাকৃতির ড্রাগন সেটি সহজেই অনুমেয়, কিন্তু তারপরও রাষ্ট্র দুটির মধ্যে একটি তুলনা দেখে নেয়া যাক।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে চীনের অস্তিত্ব রয়েছে প্রায় ৩,০০০ বছর ধরে, অন্যদিকে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কিরগিজস্তানের বয়স ৩০ বছরও পূর্ণ হয়নি। আয়তনে বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম রাষ্ট্র চীনের আয়তন ৯৫,৯৬,৯৬১ বর্গ কি.মি, অন্যদিকে কিরগিজস্তানের আয়তন মাত্র ১,৯৯,৯৫১ বর্গ কি.মি। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র চীনের জনসংখ্যা ২০১৮ সালের হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১৪২ কোটি ৭৬ লক্ষ, অন্যদিকে কিরগিজস্তানের জনসংখ্যা ২০১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী মাত্র ৬৪ লক্ষ, যা চীনের জনসংখ্যার ০.৪৪% মাত্র! চীনে ১২টি শহর রয়েছে, যাদের জনসংখ্যা কিরগিজস্তানের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি! চীনের অর্থনীতি বিশ্বের ২য় বৃহত্তম, আর কিরগিজস্তানের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে ১৪২তম!
সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে চীন ও কিরগিজস্তানের মধ্যে অসামঞ্জস্য আরো ভয়াবহভাবে প্রকট। ২০২০ সালের গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, চীনের সশস্ত্রবাহিনীতে রয়েছে মোট ২১ লক্ষ ৮৩ হাজার সৈন্য, আর কিরগিজস্তানের সশস্ত্রবাহিনীতে রয়েছে মাত্র ১১ হাজার সৈন্য! চীনের সেনাবাহিনীতে রয়েছে ৩,৫০০টি ট্যাঙ্ক ও ৩৩,০০০টি সাঁজোয়া যান, অন্যদিকে, কিরগিজস্তানের সেনাবাহিনীতে রয়েছে মাত্র ১৫০টি ট্যাঙ্ক ও ৩৮৫টি সাঁজোয়া যান! চীনের বিমানবাহিনীতে রয়েছে ৩,২১০টি বিমান ও হেলিকপ্টার, আর কিরগিজস্তানের বিমানবাহিনীতে রয়েছে মাত্র ৫টি হেলিকপ্টার! চীনের নৌবাহিনীর সঙ্গে তুলনা দেয়া নিষ্প্রয়োজন, কারণ স্থলবেষ্টিত কিরগিজস্তানের নৌবাহিনী নেই।
সর্বোপরি, চীনের সামরিক বাজেট ২৩,৭০০ কোটি (বা ২৩৭ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার, আর কিরগিজস্তানের সামরিক বাজেট ২ কোটি (বা ২০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার! অর্থাৎ, কিরগিজস্তানের তুলনায় চীনের সামরিক ব্যয় ১১,৮৫০ গুণ বেশি!
বস্তুত, চীন যদি কিরগিজস্তানকে আক্রমণ করে, কোনো বহিঃশক্তির সহায়তা ছাড়া বিশকেকের পক্ষে একদিনের বেশি টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বর্তমান যুগে কোনো রাষ্ট্রের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে সেটিকে সরাসরি দখল করে রাখা ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় কঠিন। তাছাড়া, ১৯৭৯ সালের চীন–ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর চীন অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি। আর কিরগিজস্তানের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীন কেনই বা যুদ্ধে নামবে, যদি যুদ্ধ না করেই সবকিছু পাওয়া যায়?
বস্তুত যুদ্ধ বা রাজনীতি নয়, অর্থনীতির মাধ্যমে চীন কিরগিজস্তান (এবং সমগ্র মধ্য এশিয়ার) ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। এই উদ্দেশ্যে চীন কিরগিজস্তানের অর্থনীতিকে চীনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং বহুলাংশে সফলও হয়েছে। কারণ, বেইজিং ভালো করেই জানে, একটি রাষ্ট্রের ওপর অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলে রাষ্ট্রটির রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার হাতে চলে আসবে।
চীন ও কিরগিজস্তানের মধ্যে যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো আলোচনা করলেই চীন কীভাবে কিরগিজস্তানের ওপর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে সেটা বুঝতে পারা যাবে।
প্রথমত, কিরগিজস্তানের অর্থনীতি ক্রমশ চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। চীন কিরগিজস্তানের আমদানির বৃহত্তম উৎস এবং কিরগিজস্তানের মোট আমদানির প্রায় এক–তৃতীয়াংশ (৩৩.৪%) আসে চীন থেকে। কিন্তু এর বিপরীতে চীন কিরগিজস্তান থেকে খুব কম পণ্য আমদানি করে; কিরগিজস্তান যেসব রাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করে সেই তালিকায় চীনের অবস্থান শীর্ষ পাঁচের মধ্যে নেই। অর্থাৎ, চীন ও কিরগিজস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে চীনের অনুকূলে (এবং কিরগিজস্তানের প্রতিকূলে)।
কিরগিজস্তানের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৮১৬ কোটি (বা ৮.১৬ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার, যার ৪১% চীন থেকে নেয়া। উল্লেখ্য, কিরগিজস্তানের মোট জাতীয় উৎপাদনের (Gross Domestic Product, GDP) পরিমাণই ৮২৬ কোটি (বা ৮.২৬ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার! চীনের ইমপোর্ট–এক্সপোর্ট ব্যাঙ্কের কাছে ২০০৯ সালে কিরগিজস্তানের ঋণের পরিমাণ ছিল ৯০ লক্ষ (বা ৯ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার, আর মাত্র ১০ বছরে এই ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭০ কোটি (বা ১.৭ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারে!
কিরগিজ বিশ্লেষক ও জনসাধারণের আশঙ্কা, চীন যেভাবে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও কেনিয়াকে ‘ঋণের ফাঁদে’ (debt trap) আটকে ফেলেছে, কিরগিজস্তানকে একইভাবে ঋণের ফাঁদে ফেলবে এবং অন্যায় সুবিধা আদায় করে নেবে।
সর্বোপরি, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই (Belt and Road Initiative, BRI) প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কিরগিজস্তান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিআরআই প্রকল্পে যে ৬টি করিডোর সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার একটি হচ্ছে চীন–মধ্য এশিয়া–পশ্চিম এশিয়া করিডোর, যেটি চীনকে সড়ক ও রেলপথে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এই করিডোরটি কিরগিজস্তানসহ মধ্য এশিয়ার প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর মধ্য দিয়ে ইরান হয়ে তুরস্কে গিয়ে শেষ হবে। বিআরআই প্রকল্পের অংশ হিসেবে চীন কিরগিজস্তানে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে এবং বর্তমানে কিরগিজস্তানে শীর্ষ বিনিয়োগকারী রাষ্ট্র হচ্ছে চীন। কিরগিজস্তানের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে চীন এ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে প্রায় ২২০ কোটি (বা ২.২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার, যা কিরগিজস্তানের বাৎসরিক বাজেটের প্রায় এক–তৃতীয়াংশ।
দ্বিতীয়ত, কিরগিজস্তানের অবকাঠামো খাতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করলেও চীনা প্রযুক্তি ও লোকবল ব্যবহার করে নির্মিত অবকাঠামোর গুণগত মান নিম্ন। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালে বিশকেক শহরের সোভিয়েত আমলে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সংস্কার করার জরুরি প্রয়োজন দেখা দেয়। রুশ কোম্পানি ‘ইন্তের আরএও’ (Интер РАО) এবং চীনা কোম্পানি টিবিইএ (TBEA) উভয়েই এই কাজটি পাওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। রুশ কোম্পানিটি বিশকেকে একটি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দেয় এবং এজন্য ৫১ কোটি ৮০ লক্ষ (বা ৫১৮ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার প্রয়োজন বলে জানায়। অন্যদিকে, চীনা কোম্পানিটি ৩৮ কোটি ৬০ লক্ষ (বা ৩৮৬ মিলিয়ন) মার্কিন ডলারে পুরাতন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সংস্কার করে দেবে বলে জানায়।
চীনা কোম্পানিটি তুলনামূলক সস্তায় কাজটি করে দেবে বলে কিছু কিরগিজ বিশেষজ্ঞ কাজটি চীনা কোম্পানিটিকে দেয়ার প্রস্তাব করেন। অন্যদিকে, চীনা কোম্পানিটির বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু রুশ কোম্পানিটি এই কাজে অভিজ্ঞ বিধায় অন্য একদল কিরগিজ বিশেষজ্ঞ কাজটি রুশ কোম্পানিটিকেই দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু চীনা সরকারের প্রবল চাপের মুখে বিশকেক এই কাজটি চীনা কোম্পানিটিকে দিতে বাধ্য হয়। ফলাফল? বিদ্যুৎকেন্দ্র সংস্কারের জন্য যে ৩৮ কোটি ৬০ লক্ষ মার্কিন ডলারের প্রয়োজন, সেটি কিরগিজস্তানকে চীন থেকেই ঋণ নিতে হয়, সুদসহ যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৭ কোটি (বা ৪৭০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলারে! তদুপরি, সংস্কারের এক বছরের মাথায় ২০১৮ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়ে এবং শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও কম তাপমাত্রার মধ্যে বিশকেক শহরের অধিবাসীরা বিদ্যুৎ ও তাপবিহীন হয়ে পড়ে।
রুশ কোম্পানিটি বিশকেকে নতুন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে দিতে চেয়েছিল। কিরগিজস্তানকে ঋণ দেয়ার পরিবর্তে তারা নিজেদের অর্থে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি তৈরি করতে চেয়েছিল, বিনিময়ে তারা চেয়েছিল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির আংশিক মালিকানা ও বছরপ্রতি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে প্রাপ্য রাজস্বের অংশবিশেষ। সামগ্রিক বিবেচনায় এটি ছিল কিরগিজস্তানের জন্য বেশি সুবিধাজনক। তাহলে বিশকেক কেন চীনা কোম্পানিকে কাজটি দিল?
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়ার পর কিরগিজস্তানের সরকার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সাপার ইসাকভ–সহ বেশ কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। ইসাকভের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি চীনা সরকারের চাপে কোম্পানিটিকে কাজটি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। একটি রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশি একটি রাষ্ট্রের নির্দেশ মেনে নিতে বাধ্য হন, তখন সেই রাষ্ট্রে বিদেশি রাষ্ট্রটির প্রভাব কীরকম সেটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
তৃতীয়ত, কিরগিজস্তানে চীন যেসব প্রকল্প নিয়েছে, সেই প্রকল্পগুলোতে স্থানীয় কিরগিজদের কাজ না দিয়ে চীনাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কিরগিজ জনগণ এই বিষয়টিকে মোটেই ভালোভাবে দেখছে না।
চতুর্থত, কিরগিজস্তানে বিভিন্ন চীনা প্রকল্পে কাজের জন্য এবং অন্যান্য কারণে বহু সংখ্যক চীনা নাগরিক বসতি স্থাপন করছে। ২০১৮ সালেই প্রায় ৩০ হাজার চীনা কিরগিজস্তানে এসেছে। এদের মধ্যে অনেকেই স্থানীয় কিরগিজ মেয়েদের বিয়ে করছে। কিরগিজদের ধারণা, চীনারা কিরগিজস্তানকে শান্তিপূর্ণভাবে একটি উপনিবেশে পরিণত করতে চায় এবং কিরগিজ মেয়েদের বিয়ের মাধ্যমে তারা কিরগিজ নাগরিকত্ব পেতে চায়। তাছাড়া মুসলিম কিরগিজ মেয়েদের অমুসলিম চীনা ছেলেরা বিয়ে করছে, এই ব্যাপারটিকেও কিরগিজ জনসাধারণের একাংশ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে।
চীনা সরকার কিরগিজস্তানে বেশ কয়েকটি ‘কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করেছে, যার উদ্দেশ্য কিরগিজদের মধ্যে চীনপন্থী মনোভাব সৃষ্টি করা। তদুপরি, ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর কিরগিজস্তানের বিভিন্ন শহরে চীনারা তাদের জাতীয় দিবস সাড়ম্বরে উদযাপন করেছে। এগুলোকে কিরগিজ জনসাধারণ বিবেচনা করছে কিরগিজস্তান চীনা সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদের অংশ।
কিরগিজস্তান সরকার বিষয়টির স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে সচেতন এবং এজন্য কিরগিজস্তানে বসবাসরত জাতিগত চীনার সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে কত সে বিষয়ে তারা কোনো তথ্য প্রকাশ করে না। কিন্তু কিরগিজদের মধ্যে চীনাবিরোধী মনোভাব ক্রমেই প্রবল হচ্ছে।
পঞ্চমত, কিরগিজস্তানের সঙ্গে চীনের সীমান্ত সমস্যা ছিল। কিরগিজস্তান যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, তখন কিরগিজস্তানের ভূমি দখল করার মতো সাহস চীনের ছিল না। কিন্তু স্বাধীন কিরগিজস্তানের সামরিক বাহিনী অত্যন্ত দুর্বল, ফলে ১৯৯০-এর দশকে কিরগিজস্তান চীনের নিকট সীমান্তবর্তী ১,২৫০ কি.মি. ভূমি হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছে। কিরগিজ জাতীয়তাবাদীরা এই সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধী ছিল এবং তাদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে চীন কিরগিজস্তানের আরো ভূমি গ্রাস করে নিতে পারে।
ষষ্ঠত, চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে প্রায় ২ লক্ষ জাতিগত কিরগিজ বসবাস করে এবং এদের সঙ্গে কিরগিজস্তানের কিরগিজদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। চীন ২০১৭ সাল থেকে জিনজিয়াং অঞ্চলের যে প্রায় ১৫ লক্ষ মুসলিমকে তথাকথিত ‘পুনঃশিক্ষা কেন্দ্র’গুলোতে (re-education camps) মানবেতর অবস্থায় বন্দি করে রেখেছে, তাদের মধ্যে কমপক্ষে ২২ হাজার জাতিগত কিরগিজ রয়েছে। এদের অধিকাংশই চীনের নাগরিক হলেও এদের মধ্যে বেশ কিছু কিরগিজস্তানের নাগরিকও ছিল। ফলে কিরগিজস্তানের জনসাধারণ চীনের ওপর ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে এবং চীনবিরোধী প্রতিবাদ মিছিল করেছে।
কিরগিজস্তানের সরকার জিনজিয়াং ইস্যুতে মৌনতা অবলম্বন করেছে (বা করতে বাধ্য হয়েছে)। কিরগিজ জনগণের ব্যাপক প্রতিবাদ সত্ত্বেও কিরগিজ সরকার এ ব্যাপারে চীনকে নিন্দা করা থেকে বিরত থেকেছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে কিরগিজস্তানের রাষ্ট্রপতি সুরুনবে জিনবেকভ জানান, তারা ‘কূটনীতি’র মাধ্যমে বন্দি কিরগিজ নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন এবং চীনের ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে’ হস্তক্ষেপ করতে তারা অপারগ।
সপ্তমত, ২০১৮ সালের জুনে কিরগিজস্তান চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে ‘ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্বে’র (comprehensive strategic partnership) পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এর ফলে কিরগিজস্তান ও চীনের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং চীনা সৈন্যরা কিরগিজস্তানের মাটিতে কিরগিজ সৈন্যদের সঙ্গে সামরিক মহড়াও করেছে।
সর্বোপরি, কিরগিজদের সঙ্গে চীনাদের জাতিগত, ধর্মগত বা সাংস্কৃতিক কোনো সামঞ্জস্য নেই, বরং কিরগিজ ও চীনাদের মধ্যে ঐতিহাসিক জাতিগত শত্রুতার সম্পর্ক বিদ্যমান। কিরগিজদের জাতীয় মহাকাব্য ‘মানাসের মহাকাব্যে’ (Манас дастаны, ‘মানাস দাস্তানি’) কল্পিত কিরগিজ মহাবীর মানাস যেসব শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, তাদের একটি হলো চীন। উল্লেখ্য, ‘মানাস মহাকাব্য’ বিশ্বের ৩য় বৃহত্তম মহাকাব্য।
সোভিয়েত শাসনামলে মস্কো চীনা–সোভিয়েত দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে কিরগিজদের চীনাবিরোধী মনোভাবকে তীব্র করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল এবং তার প্রভাব কিরগিজদের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে। সোভিয়েত–পরবর্তী কালে কিরগিজস্তানের দুর্বল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক অবস্থান কিরগিজদের চীনাবিরোধী মনোভাবকে বিন্দুমাত্র প্রশমিত করেনি, বরং আরো তীব্র করেছে।
কিরগিজস্তানের সরকার চীনের প্রচ্ছন্ন সাম্রাজ্যবাদ এবং বেইজিং–এর ওপর নির্ভরশীল হওয়ার পরিণতি সম্পর্কে সচেতন। চীনের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখতে বিশকেক মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। উল্লেখ্য, কিরগিজস্তান মস্কো–নিয়ন্ত্রিত ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের কমনওয়েলথ’ (Көз каранды эмес мамлекеттердин шериктештиги, ‘কেজ কারান্দি জ্মেস মামলেকেত্তের্দিন শেরিক্তেশ্তগি’), ‘ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন’ (Евразиялык экономикалык биримдик, ‘ইভ্রাজিয়ালিক ইকোনোমিকালিক বিরিমদিক’) এবং ‘যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা’র (Жамааттык коопсуздук жөнүндө келишим уюму, ‘ঝামাত্তিক কুপুজদিক ঝোনিন্দো কেলিশিম উইমু’) সদস্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত সতর্ক।
কিরগিজ জনসাধারণের মধ্যে চীনাবিরোধী মনোভাব অবশ্য ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে কিরগিজস্তানের বিভিন্ন শহরে চীনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। কিরগিজরা চীনাদেরকে কিরগিজস্তানের কাজ করার অনুমতিপত্র প্রদান বন্ধ, চীনের নিকট কিরগিজস্তানের ঋণ হ্রাস এবং কিরগিজ মেয়েদের সঙ্গে চীনাদের বিয়ে নিষিদ্ধ করার দাবি জানায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিরগিজ পুলিশ বহুসংখ্যক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে কিরগিজস্তানের পূর্বাঞ্চলের নারিন শহরে চীন সাড়ে ২৭ কোটি (বা ২৭৫ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার ব্যয়ে একটি সরবরাহ কেন্দ্র (logistics center) নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় অধিবাসীদের প্রবল প্রতিবাদের কারণে কিরগিজস্তানের সরকার প্রকল্পটি বাতিল করতে বাধ্য হয়। ভবিষ্যতে কিরগিজস্তানে এ ধরনের চীনাবিরোধী বিক্ষোভ আরো জোরালো হবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। কিন্তু চীনের বিপুল অর্থনৈতিক প্রভাবের মুখে অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল কিরগিজস্তান তার সার্বভৌমত্ব কতদিন এবং কতটুকু রক্ষা করতে পারবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।