মানব সভ্যতার বিকাশ ও ইতিহাস সম্পর্কে আমরা একটি কাঠামোগত ধারণা লাভ করলেও অনেক সত্য রয়ে গেছে অজানা। কালের বিবর্তনে অনেক ঘটনাই হারিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতা থেকে। সেই হারিয়ে যাওয়া সত্যকে জানার তাগিদ থেকে, আবার অনেক সময় কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে বা দুর্ঘটনাবশতই পৃথিবীর নানাপ্রান্তের মানুষ আবিষ্কার করেছে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, যা আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে নতুন সব তথ্য জানতে সাহায্য করেছে। বছরব্যাপী আবিষ্কৃত এরূপ নানা নিদর্শনের মধ্যে আর্কিওলজি ম্যাগাজিনের নির্বাচনে ২০১৯ সালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ১০টি আবিষ্কার সম্পর্কে লেখা হলো এখানে।
পুরোনো রাজ্যের সমাধি (ওল্ড কিংডমস টম্ব), সাক্কারা, মিশর
চেক ইন্সটিটিউটের মিশরীয় পুরাতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা করা একটি দল ৫ম রাজবংশের ফেরাউন জেদেকার ইয়েসির ( আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৩৮১-২৩৫৩) সমাধিস্তম্ভ অনুসন্ধানের সময় একজন উচ্চপদস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির চিত্রিত সমাধি খুঁজে পেয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ মোহাম্মদ মেগাহেদের নেতৃত্বে দলটি মাটির নিচের একটি সংকীর্ণ টানেলে অনুসন্ধান চালানোর সময় হায়ারোগ্লিফিক অঙ্কিত কিছু কক্ষ খুজে পায়। এই লেখাগুলো থেকে জানা যায়, কক্ষের ভেতর খুইয়ি নামে একজনকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল, যার উপাধিসমূহের মধ্যে রয়েছে ‘রাজার সহায়ক’, ‘রাজবাড়ির সহচর বা সঙ্গী’ এবং ‘রাজপ্রাসাদে অবস্থানকারীদের উপদর্শক’।
হায়ারোগ্লিফিকের পাশাপাশি এই কক্ষগুলোতে বিভিন্ন ছবি আঁকা রয়েছে যার রঙ প্রায় ৪ হাজার তিনশ বছর পরেও যথেষ্ট উজ্জ্বল রয়েছে। ছবিগুলোর একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে খুইয়ি এর প্রতিমূর্তি যেখানে তাকে খাবার, পানীয় ও অন্যান্য বস্তুর সামনে বসে থাকতে দেখা যায় যা তাকে মৃত্যুর পর সমৃদ্ধির সাথে থাকতে সাহায্য করবে। মেগাহেদের ভাষ্যনুযায়ী পুরাতন রাজবংশীয় কবরগুলোতে মৃতদের নিজের ছবি থাকার ব্যাপারটি অভাবনীয়, কারণ তা সাধারণত দেখা যায়না। এই উৎকৃষ্ট মানের ছবিগুলোর পাশাপাশি জেদেকারের পিরামিডের কাছেই কবরের অবস্থান, কবরের নকশার সাথে ৫ম রাজবংশীয় আরেকজন ফেরাউনের মিল প্রমাণ করে যে, তৎকালীন রাজসভায় খুইয়ি উচ্চমর্যাদায় আসীন ছিলেন।
মায়ানদের ভূগর্ভস্থ অঞ্চল (মায়া সাবটেরানিয়ান ওয়ার্ল্ড), চিচেন ইৎজা, মেক্সিকো
মায়ানগরী চিচেন ইৎজার কেন্দ্রের পাশেই একটি গুহা অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের একটি দল আকস্মিকভাবে মাটির নিচে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত জিনিসপত্রে পূর্ণ কয়েকটি কক্ষ খুজে পায় যা সতেরোশো শতাব্দীর পূর্বে এই শহর পত্তনের ধারণাকে জোরালো করে। মায়ানদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী মাটির নিচে জগতের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই কক্ষগুলো বানানো হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ প্রথম ডাবড বালামকু বা চিতাবাঘ দেবতার নামে পরিচিত এই গুহা আবিষ্কার করেন যা ঐ সময়ে সিল মেরে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মেক্সিকোর নৃবিজ্ঞান ও ইতিহাস বিষয়ক জাতীয় ইন্সটিটিউটের গুলিয়েরমো দে আণ্ডা এবং লস এঞ্জেলস এর ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি এর জেমস ব্র্যাণ্ডি এর নেতৃত্বে দলটি ভূগর্ভস্থ নদী জরিপের সময় বহুদিন অবহেলায় পড়ে থাকা এই গুহাটি দেখতে পায় ও তা খোলার ব্যবস্থা করে। এই গুহার সংকীর্ণ রাস্তা দিয়ে চলবার পর তারা প্রায় ৭টি ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের কক্ষ খুজে পায় যেখানে বৃষ্টির দেবতা লালক এর ছবি আঁকা ধূপ জ্বালানোর পাত্রের পাশাপাশি হাতে তৈরি সিরামিকের আরো ১৭০টি ব্যবহার্য বস্তু ছিল। ব্র্যাডির মতানুযায়ী, বালামকু এর এই কক্ষগুলো আমাদের মায়াসভ্যতায় ভূগর্ভস্থ জগতের প্রতি বিশাসের দিক সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে যদিও অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ এই ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দে চিচেন ইৎজা আক্রমণের মাধ্যমে মায়ানগরীর পতন যেই বহিশত্রুরা ত্বরান্বিত করেছিল, ধারণা করা হয় প্রাচীনকালে তারাই এই গুহা ধ্বংস করে। এই গুহা সম্পর্কে আরো গবেষণা আমাদের চিচেন ইৎজা এর পতন সম্পর্কে আরো ভালোভাবে জানতে সাহায্য করবে।
নিওলিথিক কীর্তিস্তম্ভের ভোজসমূহ (নিওলিথিক হেঞ্জ ফিস্টস), উইল্টশায়ার, ইংল্যাণ্ড
ব্রিটেনের নিওলিথিকরা উৎসব উদযাপনের জন্য তাদের তীর্থস্থানগুলোতে যাওয়ার সময় উৎসবে খাওয়ার মতোন শূকর সাথে নিতো এবং কয়েকশ মাইল পাড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌছাতো। একটি প্রাণী শিশুকালে যে খাবার খায় তার রাসায়নিক উপাদান ঐ প্রাণীর দাঁত ও হাড়ে থেকে যায়, যা পরবর্তীতে বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, প্রাণীটি গৃহপালিত ছিল নাকি বন্য। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড ম্যাডউইক ডারিংটন ওয়ালসহ ব্রিটেনের চারটি দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল থেকে খুজে পাওয়া চার হাজার বছর আগের শূকরের হাড় পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, উৎসবে ব্যবহৃত শূকরের অনেকগুলিই বর্তমান স্কটল্যাণ্ড এবং উত্তর পশ্চিম ইংল্যাণ্ড এর মতো দূরবর্তী অঞ্চল থেকে নিয়ে আসা হতো। এর থেকে বোঝা যায় সেই সময়ের সমাজব্যবস্থা আমাদের ধারণার তুলনায় বেশি সংঘবদ্ধ ও সচল ছিলো এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও কীর্তিস্তম্ভের কথা দূরদূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। সেসময়ের অধিবাসীরাও অত্যন্ত ভক্তির সাথে এসব নিয়ম মেনে চলতো যার মধ্যে একটি ছিল ভোজে নিজেদের পালিত শূকর দান করা। সারা ব্রিটেন থেকে মানুষ এসব অনুষ্ঠানে যোগ দিতো ও ভোজে অংশগ্রহণ করতো। দলগত পরিচয় গঠনের ক্ষেত্রে এটি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ধাপ।
আধুনিক আপেলের উদ্ভব (অন দ্য অরিজিন অফ এপেলস), টুজুসাই, কাজাকিস্তান
একটি বন্য ফল থেকে গৃহস্থ পণ্য হিসেবে আপেলের রূপান্তর এবং অন্যান্য ঘাসজাতীয় শস্য থেকে এর রূপান্তরের পার্থক্য সম্পর্কে জানতে বিজ্ঞানীরা আরো একধাপ এগিয়েছেন ধান, গম এর মতোন ঘাসজাতীয় শস্য এর সাথে মানুষের প্রথমে পরিচিতি হয় বন্য শস্য হিসেবে। স্বপরাগায়ন করা বার্ষিক এই শস্যগুলো পাকলে বীজ মাটিতে পড়ে যেতো যা থেকে পরবর্তীতে আপনা আপনি নতুন শস্য জন্মাত। প্রায় ১২ হাজার বছরের চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ প্রথমে শস্যগুলো উৎপাদন করতে শুরু করে এবং একে গৃহস্থ পণ্যে পরিণত করে। কিন্তু আপেল এর তুলনায় ভিন্ন, একে পরাগায়ন এর জন্য অন্যান্য প্রাণীদের ওপর নির্ভর করতে হয়।
ফসিল রেকর্ড অনুযায়ী, প্রায় ১১.৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে ইউরোপ ও এশিয়া অঞ্চলে আপেল গাছের উদ্ভব হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১৬০ এর নিওলিথিক যুগের বাসস্থান থেকেও আপেলার নমুনা পাওয়া গেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা কাজাকিস্তানের তিয়ান শান পাহাড়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের আপেলের বীজ খুজে পেয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই স্থানেই আধুনিক আপেল গাছের উদ্ভব হয়েছিল। ম্যাক্স প্ল্যাংক ইন্সটিটিউটের মানবিতিহাস সম্পর্কিত বিজ্ঞানের একজন উদ্ভিদ বিষয়ক প্রত্নতত্ত্ববিদ রবার্ট স্পেসলার নিত্যপণ্য হিসেবে আপেলের ব্যবহারের ইতিহাস জানার জন্য পুরোনো আপেলের ফসিলকে পরীক্ষ নিরীক্ষার মাধ্যমে বর্তমান আপেলের জাতগুলোর সাথে তুলনা করেন। তার ধারণা অনুযায়ী বুনো আপেল গাছ এর প্রথম খোজ পাওয়া মানবেরা পরাগায়নে প্রভাবক হিসেবে কাজ করা বর্তমানে বিলুপ্ত প্রজাতিদের জায়গায় দখল করে এবং এর ভৌগোলিক বিস্তৃতিকে সহজ করে দেয়। এছাড়া এর মাধ্যমে মানুষ আর প্রাচীনকালের হাতিদের খাদ্য উৎস খোজবার ক্ষেত্রে মিল খুজে পাওয়া যায়।
মেডিভাল ফিমেল স্ক্রাইব, ডালহাইম, জার্মানী
মধ্যযুগীয় ইউরোপ সমাজে আল্ট্রামেরিন নামক এক উজ্জ্বল বিশুদ্ধ নীল রঙের এতোই চাহিদা ছিল যে মাঝে মাঝে এর দাম সোনার তুলনায় ও বেশি হতো। এই রংটি বানানো হতো লাপিস লাজুলি নামক এক একপ্রকার খনিজ থেকে যা সেসময় শুধু আফগানিস্তান থেকেই আহরণ করা হতো। তাই একদল গবেষক যখন জার্মানীর ধর্মীয় আশ্রমে এগারোশ/বারোশ শতাব্দীতে সমাহিত এক মইলার কঙ্কালের দাঁতের খাঁজে আল্ট্রামেরিন দ্বারা তৈরিকৃত প্লাক দেখতে পান তখন তারা যথেষ্ট অবাক হন। হার্ভার্ড ইন্সটিটিউটের আণবিক প্রত্নতত্ত্ববিদ ক্রিস্টিনা ওয়ারিনারজানান যে, এতো প্রাচীন সময়ে স্রোতযুক্ত নদীবিহীন এলাকার একজন মহিলার কাছে এতো দামি খণিজ পাওয়াটা সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার।
গবেষকরা ধারণা করছেন যে, ঐ মহিলা সম্ভবত একজন লিপিকার ছিলেন যিনি ধর্মীয় পাণ্ডুলিপি লিখতে নির্দিষ্ট রঙের ব্যবহার করতেন। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, পূর্ব মধ্যযুগীয় সময়ে হয়তো আরো মহিলা লিপিকার ছিলেন কিন্তু তাদের সম্পর্কে জানা যায়নি কারণ তারা কখনোই লেখার নিচে স্বাক্ষর করতেন না। ওয়ারিনার আরো বলেন তাদের কাছে এমন কিছু পাণ্ডুলিপি আছে যা ঐ সময়ের মহিলা লিপিকারদের তৈরিকৃত। তবে এমন লিপিকার সংখ্যায় কতোজন ছিলেন সে সম্পর্কে পুরোপুরি জানা যায়নি।
নিউ গোল্ডেন হাউস রুম, রোম, ইতালি
প্রত্নতত্ত্ববিদরা একটি খিলানযুক্ত দালানের ছাদের ফাটল পরীক্ষা করে রোমের অগ্নিকাণ্ডের পর ৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট নিরোর তৈরিকৃত প্রমোদ প্রাসাদ ‘ডমাস অরা’ বা ‘সোনালী প্রাসাদ’ খুজে পেয়েছেন। নিরোর মূর্খতা হিসেবে মনে করা এই প্রাসাদকে পরবর্তীতে কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে লুকিয়ে ফেলা হয় এবং এর উপরে জনসাধারণের জন্য একটি পার্ক নির্মাণ করা হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীতে দুর্ঘটনার মাধ্যমে আবিষ্কৃত এই প্রাসাদ এরপর থেকেই পুনঃ পুনঃ অন্বেষণ, খনন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্থান হয়ে দাড়িয়েছে। এমন এক প্রজেক্টের কাজের সময় গবেষকরা ছবি আঁকা প্রাচীর দ্বারা আবদ্ধ নতুন কক্ষ খুজে পান। ইতালীর ঐতিহাসিক সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আলেক্সাণ্ডার ডি আলেসিও বলেন ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়া এমন একটি কক্ষ খুজে পাওয়া ছিল তাদের জন্য আবেগপূর্ণ ঘটনা। প্রাচীরের ওপর ‘স্ফিংস এর কক্ষ’ লেখাটির পাশাপাশি সেন্টর, স্ফিংস ও অন্যান্য পৌরাণিক প্রাণি, বাঁশির মতোন বাদ্যযন্ত্র ও অলংকার দিয়ে সাজানো গাছ এর ছবি আঁকা ছিল।
পেরুভিয়ার গণ বলিদান, পাম্পা লা ক্রুজ, পেরু
পাম্পা লা ক্রুজ এর উপকূলবর্তী এলাকায় খুজে পাওয়া দুইশ তিরিশটির বেশি শিশু ও প্রায় চারশটি লামার শরীরের অংশবিশেষ ও অন্যান্য প্রমাণ থেকে ধারণা করা যাচ্ছে যে, এরা ছিল মূলত তিনটি গণ বলিদান এর শিকার। ঐ এলাকার প্রথম শিশু ও পশু বলিদান এর ঘটনাটি ঘটেছিল ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দ এর কাছাকাছি সময়ে। প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী এল নিনো এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে বাঁচতে স্থানীয় চিমু জনগণ দেবতাদের খুশি করার উদ্দেশ্যে এই বলিদানের আয়োজন করেছিল। তবে ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিদ গ্যাব্রিয়েল প্রিয়েতো মনে করেন বলিদানের মূল কারণ রাজনৈতিক। তিনি বলেন যেসময় এই বলিদান সংঘটিত হয় তখন চিমু জনগণ ল্যাম্বেকুই এলাকা জয় করছিল তাই বিজয় উৎসব পালনের জন্য যদি ল্যাম্বেকুই এর জনগণকে বলি দেওয়া হয়ে থাকে তবে ব্যাপারটা আশ্চর্যের বিষয় হবেনা। আরেক ধারণা অনুযায়ী চিমু জনগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা তায়কানামো এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য বলিদানের আয়োজন হয়েছিল। তিনি আনুমানিক ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে সাগর পাড়ি দিয়ে পাম্পা লা ক্রুজ অবতরণ করেন এবং দক্ষিণে হেটে চিমু নগরীর রাজধানী চানচান এ ঘাটি গাড়েন।
উঁচু পাহাড়ে ডেনিসোভানদের বাসস্থান, সাইহি, চায়না
আজ থেকে ৪০ বছর পূর্বে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী সমুদ্র উচ্চতা থেকে ১০ হাজার ফিট উপরে তিব্বতীয় মালভূমির বাইশ্যা ক্রাস্ট গুহায় একটি মুখের হাড় খুজে পান। প্রোটিন এবং দাঁত পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় যে এটি ছিল ১.৬ লাখ বছর পুরোনো মানব গোত্রীভুক্ত দেসিনোভান নামক হোমিনিড প্রাণীর মুখের হাড়। বাইশিয়্যা ক্রাস্ট গুহা থেকে প্রায় ১৭৫০ মাইল উত্তর পশ্চিমে, সমুদ্র উচ্চতা থেকে মাত্র ২৩০০ ফিট উচুতে অবস্থিত দক্ষিণ সাইবেরিয়ার ডেসিনোভা গুহা থেকে প্রাপ্ত অল্প এবং ভগ্নপ্রায় কিছু নমুনা থেকেই এতোদিন এই প্রাচীন দুর্লভ মানবদের সম্পর্কে জানা যেতো। ল্যাংবার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডংজু ঝ্যাং বলেন এথেকে বোঝা যায় যে, ডেসিনোভানদের বাসস্থান আমাদের ধারণার থেকেও বেশি বিস্তৃত ও উঁচু এলাকা পর্যন্ত ছিল।
ডেসিনোভানদের পূর্ববর্তী নমুনাসমূহের জিনগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে এমন এক মিউটেশনের খোজ পাওয়া গিয়েছিল যা এই মানবদের কম অক্সিজেনযুক্ত উঁচু এলাকায় টিকতে সাহায্য করতো। বর্তমান তিব্বতীয় অধিবাসীদের মাঝেও এমন পরিব্যক্তি লক্ষ করা গিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে যে, ডেসিনোভানদের সম্পর্কিত জ্ঞান বর্তমান অধিবাসীদের মধ্যে পরিব্যক্তি এর উদ্ভব সম্পর্কে জানতে আমাদের সাহায্য করবে।
রুপালি ড্রাগনের সমাধি, আরখানগাই, মঙ্গোলিয়া
উত্তর মঙ্গোলিয়ার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে প্রত্নতত্ত্ববিদরা জিয়াংনু প্রদেশের সম্ভ্রান্ত বংশীয় দুই ব্যক্তির দৃষ্টিনন্দন সমাধি খুজে পেয়েছেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ শতাব্দী থেকে ১০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ব এশিয়ার একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করা এই নোমাডিক মানুষেরা প্রায়ই চায়নার হান রাজবংশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতো। এই আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে হান জনগোষ্ঠী দুর্গ গড়ে তোলে যা পরবর্তীতে গ্রেট ওয়ালের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। উলানবাটোর ইউনিভার্সিটি এবং হেনানের প্রাদেশিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্ব ইনটিটিউট এর সদস্যরা এই সমাধিতে ব্যয়বহুল কিছু পণ্য খুজে পায়। বড় সমাধিটিতে একটি কাঠের বাক্সে রুপার আংটি, জেড পাথরের বেল্টের হুক এবং একটি রুপালি ড্রাগনের মূর্তি পাওয়া যায় যা আগে একটি পাত্রের হাতল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ছোট সমাধিটিতে ঘোড়ার গাড়ির অংশ, ১৫টি ঘোড়ার মাথা এবং ১৯টি অলঙ্কার পাওয়া যায় যার প্রত্যেকটিতে ইউনিকর্ণ দেবতার ছবি আঁকা ছিল। এছাড়া জিয়াংনু সমাধিসমূহের মধ্যে এই সমাধি থেকেই প্রথম জেড পাথর খচিত তলোয়ার পাওয়া যায়।
নর্মানদের মুদ্রাভাণ্ডার, চিউ ভ্যালি, ইংল্যাণ্ড
যোদ্ধা উইলিয়াম (রাজত্বকাল ১০৬৬-১০৮৭) ১০৬৬ সালের ১৪ অক্টোবর হেস্টিংস এর যুদ্ধে নর্মানে রাজত্ব করা ইংল্যাণ্ডের শেষ ইঙ্গ-স্যাক্সন হ্যারল্ড গডউইনসনকে পরাজিত করেন। ব্রিটিশ জাদুঘর গবেষকদের মতে দক্ষিণপশ্চিম ইংল্যাণ্ডের চিউ ভ্যালিতে একটি মুদ্রাভাণ্ডারে একই এলাকায় একসময়ে দুজন রাজার নামাঙ্কিত প্রায় ২৫০০টি রুপার মুদ্রা নর্মান বিজয়ের পূর্ববর্তী সময়ে ঐ এলাকার রাজনৈতিক দ্বন্দকেই ফুটিয়ে তোলে। মুদ্রাভাণ্ডারে খুজে পাওয়া মুদ্রার ১২৩৬ টি ছাপা হয়েছিল দক্ষিণপূর্ব ইংল্যাণ্ডে হ্যারল্ডের মুখাঙ্কিত করে, যা আক্রমণের আশঙ্কাসত্ত্বেও হ্যারল্ডের প্রতি ঐ এলাকার মানুষের আনুগত্যকে প্রকাশ করে। বাকি ১৩১০ টি মুদ্রা ছাপা হয়েছিল উইলিয়ামের বড়দিনের রাজ্যভিষেক এর পর যা থেকে বোঝা যায় জনসাধারণ ততোদিনে উইলিয়াম শাসন সম্পর্কে অবহিত হয়েছিল। এর মধ্যে একটি অভাবনীয় ঘটনা দেখা যায় এক মুদ্রা প্রস্তুতকারক এর কাজে। নতুন রাজার আগমনের পর নতুন মুদ্রা ছাপানোর খরচ কমাতে হ্যারল্ড এর মৃত্যুর পরপর ও নতুন রাজার অভিষেকের পূর্বেই তিনি মুদ্রার একপাশে হ্যারল্ড ও অন্যপাশে উইলিয়াম এর ছবি ছাপিয়েছিলেন। গবেষকরা মনে করেন মুদ্রামানের দিক দিয়ে হ্যারল্ডের মুদ্রার দামই ছিল বেশি। তাই একটি কয়েন দিয়েই প্রায় ৫০০ টি ভেড়া কেনা যেত।
‘বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন’ বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-