২০২০ সালের ৯ আগস্ট পূর্ব ইউরোপের জাতিগত স্লাভিক–অধ্যুষিত রাষ্ট্র বেলারুশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং নির্বাচনে বেলারুশের ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কো প্রায় ৮০% ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সভেৎলানা তিখানোভস্কায়া এই নির্বাচনে প্রায় ১০% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন, কিন্তু তিনি সরকারিভাবে ঘোষিত ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। নির্বাচনের দুই মাস আগে থেকেই বেলারুশের রাজধানী মিনস্ক ও অন্যান্য শহরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছে এবং নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর বিক্ষোভকারীরা এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে বেলারুশীয় নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ আরম্ভ হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত এই সংঘাতে ৩০ জন নিরাপত্তারক্ষী ও ৫০ জন বিক্ষোভকারী আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রাথমিক দৃষ্টিতে বেলারুশের নির্বাচন–পূর্ব ও নির্বাচনোত্তর সরকারবিরোধী বিক্ষোভকে বেলারুশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক ইতিহাস ও ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বিষয়টি এতটা সরল বলে মনে হয় না। বেলারুশ একটি প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্র এবং ইতোপূর্বে বেলারুশসহ প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য রাষ্ট্রে ঠিক একইরকম বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেগুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিক্ষোভকারীদের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন ছিল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিক্ষোভ সফল হয়ে রাষ্ট্রগুলোতে পশ্চিমাপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ধরনের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও বিক্ষোভের ফলে সরকারের পতনের ঘটনাকে গণমাধ্যমে ‘রঙিন বিপ্লব’ (Colour Revolution) নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্র রাষ্ট্রসমূহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে প্রবল ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিল, যেটি ইতিহাসে ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ নামে পরিচিতি অর্জন করেছে। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে সোভিয়েত বলয়ের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সোভিয়েত বলয়ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর ভেতরে ও বাইরে সকল ধরনের সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করা, সোভিয়েত বলয়ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সরকারসমূহের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানোর মধ্য দিয়ে তাদের ‘বৈধতা’কে প্রশ্নের সম্মুখীন করা এবং এই রাষ্ট্রগুলোর সরকারবিরোধীদের সশস্ত্র বা নিরস্ত্র যেকোনো পন্থায় ক্ষমতা দখলের জন্য উৎসাহিত করা। ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানিতে, ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে, ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় এবং ১৯৮০ সালে পোল্যান্ডে অনুরূপ পশ্চিমা–সমর্থিত সরকারবিরোধী বিদ্রোহ/বিক্ষোভ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোর হস্তক্ষেপে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু ১৯৮৯–১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সোভিয়েত বলয়ভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রে কমিউনিজমের পতন ঘটে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে তদস্থলে ১৫টি স্বাধীন ও প্রায়শ পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।
১৯৯০–এর দশক ছিল রাশিয়ার জন্য একটি অত্যন্ত বিপর্যয়কর সময়। দ্রুতগতিতে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে গিয়ে রাশিয়ার পশ্চিমাপন্থী সরকার রুশ রাষ্ট্র ও জনসাধারণের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। রাশিয়ার শিল্প উৎপাদন অর্ধেকের বেশি হ্রাস পায়, মুদ্রাস্ফীতি অত্যন্ত চরম রূপ ধারণ করে, কোটি কোটি রুশ নাগরিক দারিদ্রসীমার নিচে পতিত হয় এবং এর ফলে রাশিয়ার জনসংখ্যা, সামরিক সামর্থ্য ও বৈশ্বিক প্রভাব ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার এই বিপর্যয়ের সময় রাশিয়াকে উল্লেখযোগ্য কোনো সহায়তা প্রদান থেকে বিরত থাকে এবং তাদের ধারণা ছিল যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত রাশিয়া ক্রমে তৃতীয় বিশ্বের একটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। রাশিয়ার নিকটবর্তী প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোকে পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা শুরু করে এবং এর মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে ঘেরাও করে রাখার প্রক্রিয়া শুরু করে। শুধু তাই নয়, উত্তর ককেশাস, ভোলগা–উরাল ও অন্যান্য অঞ্চলে অবস্থিত জাতিগতভাবে অ-রুশ প্রজাতন্ত্রগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থন প্রদান করে এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডেলিন অলব্রাইট প্রকাশ্যে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ সুবিশাল সাইবেরিয়ায় মার্কিন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।
১৯৯৯ সালে কসোভো সঙ্কটকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (North Atlantic Treaty Organization, ‘NATO’) রুশ শান্তি প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই রাশিয়ার মিত্ররাষ্ট্র প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার ওপর বিমান হামলা আরম্ভ করলে স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রথম গুরুতর রুশ–পশ্চিমা সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। এরপর থেকে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের অবনতি শুরু হয় এবং ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাশিয়ার পশ্চিমাপন্থী রাষ্ট্রপতি বোরিস ইয়েলৎসিন আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেন। তদস্থলে অধিষ্ঠিত হন রুশ আভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফএসবি’র প্রাক্তন পরিচালক ভ্লাদিমির পুতিন। পুতিন রুশ পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পশ্চিমা–অভিমুখী নীতি থেকে সরে এসে একটি স্বতন্ত্র নীতি গ্রহণ করেন।
ফলশ্রুতিতে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর চাপ জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং রাশিয়ার প্রতিবেশী ও মিত্র রাষ্ট্রগুলো থেকে রুশপন্থী সরকারগুলোকে উৎখাত করার জন্য সরকারবিরোধী দলগুলোকে সক্রিয় সমর্থন দিতে শুরু করে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে তারা প্রকাশ্যে এসব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে এবং রাষ্ট্রগুলোতে ‘রঙিন বিপ্লব’ আরম্ভ হয়। ২০০০ সালে প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ায় ‘বুলডোজার বিপ্লব’ সংঘটিত হয় এবং রাষ্ট্রটির রুশপন্থী রাষ্ট্রপতি স্লোবোদান মিলোসেভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০০৩ সালে জর্জিয়ায় ‘গোলাপি বিপ্লব’ সংঘটিত হয় এবং রুশপন্থী রাষ্ট্রপতি এদুয়ার্দ শেভার্দনাদজে ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০০৪ সালে জর্জিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থনপ্রাপ্ত একটি ‘বিপ্লবে’র ফলে জর্জিয়ার অন্তর্গত মুসলিম–অধ্যুষিত আদজারা স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রের রুশপন্থী রাষ্ট্রপ্রধান আসলান আবাশিদজে ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০০৪ সালে ইউক্রেনে ‘কমলা বিপ্লব’ সংঘটিত হয় এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজয়ী ভিক্তর ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করে পশ্চিমাপন্থী ভিক্তর ইউশ্চেঙ্কো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ২০০৫ সালে কিরগিজস্তানে ‘টিউলিপ বিপ্লব’ সংঘটিত হয় এবং রুশপন্থী রাষ্ট্রপতি আসকার আকায়েভ ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০০৯ সালে মলদোভায় ‘আঙুর বিপ্লব’ সংঘটিত হয় এবং রুশপন্থী রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির ভরোনিন পরবর্তী নির্বাচনে পরাজিত হন। ২০১৩–২০১৪ সালে ইউক্রেনে ‘ইউরোমাইদান বিপ্লব’ সংঘটিত হয় এবং রুশপন্থী রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে আর্মেনিয়ায় ‘মখমল বিপ্লব’ সংঘটিত হয় এবং রুশপন্থী প্রধানমন্ত্রী সার্ঝ সার্গসিয়ান ক্ষমতাচ্যুত হন।
আর্মেনিয়া ছাড়া উপরে বর্ণিত প্রতিটি ক্ষেত্রে ‘রঙিন বিপ্লব’ সংঘটিত হওয়ার পর রাষ্ট্রগুলো রুশ বলয় থেকে দূরে সরে গেছে এবং পশ্চিমা বিশ্বের নিকটবর্তী হয়েছে। আর্মেনিয়ার ক্ষেত্রে এটি ঘটেনি, কারণ আর্মেনিয়ার ওপর তুরস্ক পরিপূর্ণ অবরোধ আরোপ করে রেখেছে এবং আজারবাইজানের সঙ্গে আর্মেনিয়ার দ্বন্দ্বের কোনো নিষ্পত্তি হয়নি, তাই রাশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা ছিন্ন করা আর্মেনিয়ার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
রাশিয়া এই রঙিন বিপ্লবগুলোকে কীভাবে গ্রহণ করেছে? মোটেও ভালোভাবে না। রুশ প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের রঙিন বিপ্লব মূলত রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বের সার্বিক যুদ্ধের একটি অংশ মাত্র। স্বভাবতই রাশিয়া পাল্টা আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০০৮ সালে জর্জিয়ার পশ্চিমাপন্থী সরকার রাষ্ট্রটির জাতিগত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত দুইটি বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল দক্ষিণ ওসেতিয়া ও আবখাজিয়ায় আক্রমণ শুরু করলে এবং তাতে ঐ অঞ্চলে মোতায়েনকৃত কিছু রুশ শান্তিরক্ষী হতাহত হলে রাশিয়া জর্জিয়া আক্রমণ করে, এবং উক্ত অঞ্চল দুইটিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৯ সালে রাশিয়ার প্রবল অর্থনৈতিক চাপের মুখে কিরগিজস্তানের পশ্চিমাপন্থী সরকার রাষ্ট্রটিতে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় এবং ২০১০ সালে সরকারটির পতন ঘটে একটি রুশপন্থী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠতি হয়। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেয় এবং পূর্ব ইউক্রেনে দনেৎস্ক ও লুগানস্ক নামে দুইটি বিচ্ছিন্নতাবাদী রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে। ২০১৬ সালে মলদোভার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রুশপন্থী রাজনীতিবিদ ইগর দোদোন বিজয়ী হয়েছেন এবং তার অধীনে রাষ্ট্রটি পশ্চিমাপন্থী নীতি থেকে সরে এসেছে।
শুধু রাশিয়ার মিত্ররাষ্ট্রগুলোতে নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অভ্যন্তরেও বিভিন্ন পশ্চিমাপন্থী বিরোধী দলকে সমর্থন প্রদান করেছে এবং ২০১১–২০১৩ সালে রাশিয়ায় সংঘটিত সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে। প্রত্যুত্তরে রাশিয়া ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে, যার ফলে মার্কিন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বেলারুশের সাম্প্রতিক সরকারবিরোধী আন্দোলনকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ও ‘অভ্যন্তরীণ’ ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বেলারুশকে প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বেলারুশ রুশ–নেতৃত্বাধীন ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের কমনওয়েলথ’ (Commonwealth of Independent States, ‘CIS’), ‘ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন’ (Eurasian Economic Union, ‘EEU’) ও ‘যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা’র (Collective Security Treaty Organization, ‘CSTO’) সদস্য এবং ১৯৯৯ সাল থেকে রাশিয়ার সঙ্গে ‘ইউনিয়ন স্টেট’ রাষ্ট্রের অন্তর্গত।
ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ার জন্য বেলারুশের গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ রাশিয়ার ইউরোপীয় সীমান্তে একমাত্র বেলারুশই পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ নয়। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী অন্যান্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো হয় ন্যাটোর সদস্য (পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া, এস্তোনিয়া ও নরওয়ে) নয়ত পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্কে আবদ্ধ (ইউক্রেন ও ফিনল্যান্ড)।
এমতাবস্থায় বেলারুশ যদি পশ্চিমা বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে রাশিয়া ইউরোপীয় সীমান্তে পুরোপুরিভাবে শত্রুবেষ্টিত হয়ে পড়বে এবং পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে কোনো ‘বাফার’ বা ‘নিরপেক্ষ অঞ্চল’ থাকবে না। উল্লেখ্য, ১৮১২ সালে নেপোলিয়নের ফ্রান্স এবং ১৯৪১ সালে হিটলারের জার্মানি বেলারুশের মধ্য দিয়েই রাশিয়া আক্রমণ করেছিল।
বেলারুশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কো প্রাক্তন সোভিয়েত বাইলোরাশিয়া প্রজাতন্ত্রের আইনসভার একজন সদস্য ছিলেন এবং তিনি ছিলেন বাইলোরাশিয়ার একমাত্র সদস্য, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে তিনি বেলারুশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং তখন থেকে বেলারুশের শাসনক্ষমতা তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে। ১৯৯৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত টানা ৬টি নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হয়েছেন, কিন্তু পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের মতে, এগুলোর মধ্যে প্রথম নির্বাচনটি ছাড়া বাকি প্রতিটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। পশ্চিমা গণমাধ্যমে লুকাশেঙ্কোকে ‘ইউরোপের সর্বশেষ একনায়ক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
লুকাশেঙ্কো ক্ষমতা লাভের প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৯০–এর দশকে তিনি রাশিয়া বা ইউক্রেনের মতো বেলারুশের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতিকে দ্রুতগতিতে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে অস্বীকৃতি জানান এবং এর ফলে বেলারুশ অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বেলারুশের রাষ্ট্রায়ত্ত অর্থনীতিকে ‘অদক্ষ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং রাষ্ট্রটিতে অর্থনৈতিক স্থবিরতা দেখা দিয়েছে বলে মনে করা হয়। প্রায় ২৬ বছরব্যাপী শাসনকালে লুকাশেঙ্কো রাজনৈতিক বিরোধীদের কঠোর হাতে দমন করেছেন। সাম্প্রতিক কোভিড–১৯ মহামারীকে তিনি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে অস্বীকার করেছেন, যদিও বেলারুশের ব্যতিক্রমধর্মী মহামারী মোকাবেলার কারণে যে অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় বেলারুশের মহামারী পরিস্থিতির বেশি অবনতি ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। কিন্তু এসব কারণে বেলারুশের জনসাধারণের একটি অংশ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছে।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে লুকাশেঙ্কো প্রাথমিকভাবে রুশপন্থী অবস্থান গ্রহণ করলেও সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। বেলারুশকে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করা অথবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুরূপ একটি রুশ–বেলারুশীয় ইউনিয়ন গঠনের রুশ প্রস্তাব বেলারুশ প্রত্যাখ্যান করেছে। ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার তীব্র দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও বেলারুশ ইউক্রেনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর লুকাশেঙ্কো বেলারুশীয় জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছেন এবং প্রথমবারের মতো রুশ ভাষার পরিবর্তে বেলারুশীয় ভাষায় ভাষণ প্রদান করেছেন। ১৯৯৫ সালে রাশিয়া ও বেলারুশের মধ্যেকার সীমান্ত বিলুপ্ত করা হয়েছিল, কিন্তু লুকাশেঙ্কো ২০১৬–২০১৭ সালে পুনরায় সীমান্ত স্থাপন করেছেন, যার প্রত্যুত্তরে রাশিয়াও অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তদুপরি, সীমান্ত নিয়েও রাশিয়া ও বেলারুশের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। বেলারুশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৪৮% রাশিয়ার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রুশ প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য নিয়েও রাশিয়ার সঙ্গে বেলারুশের বিরোধ দেখা দিয়েছে।
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গেও বেলারুশ সম্প্রতি সুসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছে। লুকাশেঙ্কোর এই প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে বেলারুশ ‘রাশিয়ার মিত্র রাষ্ট্র’ থেকে ‘রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সেতুস্বরূপ রাষ্ট্রে’ পরিণত হতে ইচ্ছুক বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। ২০১৯ সালের অক্টোবরে বেলারুশে আন্না বোগাচেভা নামক এক রুশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ২০১৬ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করার হুমকি দেয়া হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেলারুশীয় সরকার তাকে ছেড়ে দেয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বেলারুশ সফর করেন এবং উভয় পক্ষ সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২০২০ সালের মে মাসে বেলারুশে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হলে লুকাশেঙ্কো এজন্য রাশিয়াকে দায়ী করেন এবং জুনে বেলারুশীয় নিরাপত্তারক্ষীরা ৩৩ জন রুশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত রুশদেরকে বেলারুশীয় সরকার মার্সেনারি হিসেবে অভিহিত করে এবং দাবি করে যে, রুশ সরকার বেলারুশীয় সরকারকে উৎখাত করার জন্য ২০০ জন মার্সেনারিকে প্রেরণ করেছে। রাশিয়া এই অভিযোগ অস্বীকার করে এবং দাবি করে যে, উক্ত রুশ নাগরিকরা তুরস্ক যাওয়ার পথে বেলারুশে যাত্রাবিরতি করেছিল। বিশ্লেষকদের ধারণা, গ্রেপ্তারকৃত রুশ মার্সেনারিরা বেলারুশ হয়ে আফ্রিকার কোনো রাষ্ট্রে যাচ্ছিল এবং তাদেরকে গ্রেপ্তার করে লুকাশেঙ্কো নির্বাচনের পূর্বে নিজের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির চেষ্টা করেছেন মাত্র।
২০২০ সালের ৫ মে বেলারুশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়। জনপ্রিয় ব্যাঙ্কার ভিক্তর বাবারিকো এবং ইউটিউব ভিডিও নির্মাতা সের্গেই তিখানোভস্কি এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন, কিন্তু বিভিন্ন অভিযোগে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর ফলে তাদের সমর্থকরা সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে এবং গ্রেপ্তারকৃত তিখানোভস্কির স্ত্রী সভেৎলানা তিখানোভস্কায়া নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হন। মে থেকে আগস্টের মধ্যে বেলারুশীয় নিরাপত্তারক্ষীরা প্রায় ১,৩০০ বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে, জুনে ৩৩ জন রুশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করে এবং জুলাইয়ে কয়েকজন মার্কিন নাগরিককেও গ্রেপ্তার করে। এই পরিস্থিতির মধ্যে ৯ আগস্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং লুকাশেঙ্কোকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তিখানোভস্কায়া একটি সংবাদ সম্মেলনে এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজেকে বিজয়ী বলে দাবি করেন।
এমতাবস্থায় বেলারুশ জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং সরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। ১/২ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয় এবং প্রায় ৩,০০০ বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। লুকাশেঙ্কো বিক্ষোভকারীদের ‘বিদেশিদের দ্বারা পরিচালিত ভেড়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, বেলারুশে তিনি কোনো ‘মাইদান’ হতে দেবেন না। অন্যদিকে, বিক্ষোভকারীরা লুকাশেঙ্কোকে ‘আরশোলা’ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং এই বিক্ষোভকে ‘চপ্পল বিপ্লব’ (Slipper Revolution) হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, পোল্যান্ড, জার্মানি, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া ও কানাডা বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে এবং ৯ আগস্টের নির্বাচনকে ‘অস্বচ্ছ’ বলে দাবি করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিখানোভস্কায়া রাশিয়ার সঙ্গে বেলারুশের অঙ্গীভূত হওয়ার বিরোধিতা করেছেন এবং পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। স্বভাবতই নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থে পশ্চিমা বিশ্ব বেলারুশে একটি ‘রঙিন বিপ্লব’ ঘটানোর জন্য উৎসাহী।
অন্যদিকে, লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে বিরোধ সত্ত্বেও রাশিয়া লুকাশেঙ্কোর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে, কারণ বেলারুশের বর্তমান পরিস্থিতিতে লুকাশেঙ্কোর পতন ঘটলে সেটি হবে রাশিয়ার জন্য একটি ভূরাজনৈতিক পরাজয়। লুকাশেঙ্কোও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রয়াস পেয়েছেন এবং নির্বাচনের সময় গ্রেপ্তারকৃত তিনজন রুশ সাংবাদিককে ছেড়ে দিয়েছেন। রাশিয়ার পাশাপাশি আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, হাঙ্গেরি ও মলদোভাও লুকাশেঙ্কোর প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে। চীন সম্প্রতি মিনস্কে একটি বৃহৎ শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রকল্প হাতে পেয়েছে, এজন্য চীনও লুকাশেঙ্কোর পক্ষ অবলম্বন করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বেলারুশে একটি পশ্চিমা–সমর্থিত ‘রঙিন বিপ্লব’ চলমান। বিক্ষোভকারীরা এখন পর্যন্ত হাল ছাড়তে নারাজ, অন্যদিকে, লুকাশেঙ্কো বেলারুশে কোনো ধরনের রঙিন বিপ্লব হতে না দিতে বদ্ধপরিকর। এমতাবস্থায় বেলারুশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে সেটি আন্দাজ করা কঠিন। কিন্তু লুকাশেঙ্কো যদি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে সমর্থ হন, সেক্ষেত্রে বেলারুশের রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সেতুবন্ধন হওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে রাষ্ট্রটি পুনরায় রুশ বলয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। অন্যদিকে, লুকাশেঙ্কোর পতন ঘটলে রাশিয়া ইউরোপীয় সীমান্তে পুরোপুরিভাবে শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়বে।