আবহাওয়া ও ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের মানুষের খাবারের ভিন্নতা রয়েছে। ঠিক তেমনি ভিন্নতা রয়েছে মুসলিমদের মধ্যে ইফতার আয়োজনেও। বাংলাদেশের ছোলা-মুড়ির মতো বিভিন্ন দেশে রয়েছে ইফতারে খাবারের বৈচিত্র্য। চলুন জেনে নেওয়া যাক বিভিন্ন দেশে ইফতারের টেবিলে কোন খাবারগুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়।
বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ইফতার সামগ্রীতে থাকে একাধিক ভিন্ন ভিন্ন খাবার। বৈচিত্র্যময় এই খাবারগুলোর মধ্যে বিখ্যাত হলো ছোলা, মুড়ি, খেজুর, পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, জিলাপি, হালিম, চিড়া ভেজানো, বুন্দিয়া ইত্যাদি।
এর বাইরেও ইফতার সামগ্রীতে লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় খাবার। যেমন- ফিশ কাবাব, মাংসের কিমা, সমুচা, মসলা দিয়ে তৈরি পরোটা, বিভিন্ন ধরনের ফল ইত্যাদি।
বাংলাদেশের ইফতারের কথা উঠলেই প্রথমে চলে আসে চকবাজারের কথা। চকবাজার মানেই লোভনীয় খাবারের পসরা। মুঘল আমল থেকে ইফতারের জন্য বিখ্যাত এই বাজার। এখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন বাহারি ইফতার। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইফতার সামগ্রী কেনার জন্য ভিড় করেন ক্রেতারা।
মূলত চকবাজারের শাহী মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ইফতার সামগ্রীর দোকানগুলো। এখানকার খাবারগুলোর মধ্যে বিখ্যাত হলো ‘বড় বাপের পোলায় খায়’, সুতি কাবাব, জালি কাবাব, টিকা কাবাব, শাকপুটি, আস্ত মুরগির কাবাব, শামি কাবাব, চিকেন কাঠি, মোল্লার হালিম, নূরানী লাচ্ছি, পেস্তা বাদামের শরবত, লাবাং, শাহী জিলাপি ইত্যাদি
সৌদি আরব
মুসলমানদের তীর্থস্থান বলা হয় সৌদি আরবকে। মুসলিম সংস্কৃতির পীঠস্থানও সৌদি আরব। দেশটির ইফতার সামগ্রী বেশ বৈচিত্র্যময়। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও আনন্দ উদ্দীপনার মাধ্যমে রমজান মাস পালন করে সেখানকার মুসলমানেরা।
সৌদি আরবের ইফতার আয়োজন বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। সৌদি আরবের লোকেরা পুষ্টিকর খাবারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সেখানে ইফতারে যে খাবারগুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো উন্নত মানের খেজুর, বিভিন্ন ধরনের স্যুপ, ভিমতো (আঙ্গুর রসের শরবত), তামিজ (একধরনের রুটি), বোরাক (মাংসের পিঠা), মানডি (ভাত ও মুরগির মাংসের সমন্বয়ে তৈরি এক ধরনের খাবার) লাবাণ ইত্যাদি।
এছাড়া ‘খাবসা’ নামক একটি খাবার সৌদি আরবে বেশ জনপ্রিয়। খাবসা সাধারণত মুরগি কিংবা ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি করা হয়। ইফতারের টেবিলে খাবসার গুরুত্ব থাকে সবচেয়ে বেশি।
আরব আমিরাত
আরব বিশ্বের দেশ হওয়ায় আরব আমিরাতের ইফতার সামগ্রীর সৌদি আরবের সাথে বেশ মিল রয়েছে। এছাড়া আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ইফতার সামগ্রীর বেশ মিল দেখা যায়। আরব আমিরাতের লোকজন ইফতারে একটু ভারি খাবার খেতে পছন্দ করেন। তাদের ইফতার সামগ্রীতে খেজুর এবং দুধ অবশ্যই থাকবে।
‘হারিরা‘ নামক একপ্রকার খাবার দুবাইয়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। হারিরা তৈরি হয় ভেড়ার মাংস ও মসুরের ডালের সমন্বয়ে। এছাড়া ‘মালকুফ’ (মাংস ও ভেজিটেবল রোল) বেশ জনপ্রিয়। ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি ‘ওউজি’, কউশা মাহসি (মাছ দিয়ে তৈরি একধরনের খাবার) দুবাইয়ের ইফতার আয়োজনে বেশ গুরুত্ব পায়।
মিষ্টান্ন হিসেবে দুবাইয়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ‘কুনাফেহ’। আরব আমিরাতে কুনাফেহ ছাড়া ইফতার কল্পনাও করা যায় না। কুনাফেহ চীজ সহকারে তৈরি একধরনের পেস্ট্রি।
ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়া সবচেয়ে বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ। দেশটির মানুষজন খাবারের ক্ষেত্রে বেশ সচেতন। তাদের খাবারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা মসলা ছাড়া খাবার বেশি পছন্দ করে। ইফতার সামগ্রীর ক্ষেত্রেও ঠিক একই রীতি দেখা যায়।
ইন্দোনেশিয়ার ইফতারের টেবিলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় ফল এবং ফলের জুস। বিভিন্ন ধরনের ফলের রস, ডাবের পানি এগুলো ইফতার টেবিলে থাকবেই। পাশাপাশি থাকে যেকোনো ধরনের পরিজ।
‘মেন্দোয়ান‘ নামক একটি খাবার ইন্দোনেশিয়ার ইফতারে বেশ জনপ্রিয়। মেন্দোয়ান কিছুটা আমাদের দেশের পিঁয়াজুর মতো। একটু ভারী খাবার হিসেবে থাকে সেতো পাং কং (সামুদ্রিক মাছ দিয়ে তৈরি খাদ্য), পাকাথ (একধরনের সবজি), সাতে সুসু (গরুর মাংস দ্বারা তৈরি), কিস্যাক (সিদ্ধ চাল দ্বারা তৈরি খাবার) ইত্যাদি।
তুরস্ক
চালচলনে ইউরোপীয় তুর্কি মুসলিমরা রমজান মাস পালন করে বেশ আনন্দ-উদ্দীপনার সাথে। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্তরসূরীদের ইফতারের আয়োজন অনেকটা রাজকীয়।
তুর্কিদের ইফতারের টেবিল থাকে বর্ণিল সাজে সজ্জিত। বিখ্যাত খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে পাইড (বিখ্যাত রুটি) মেজুত জাতের খেজুর, বিভিন্ন রঙের জলপাই, পনির, পাস্তিরমাহ (মসলা দিয়ে রান্না করা গরুর মাংস) সসেজ, ফলমূল, সবজি ইত্যাদি।
তুর্কিরা ইফতারে মধু পান করতে পছন্দ করে। এটা তাদের সংস্কৃতি না হলেও অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের পানীয় তো থাকবেই। সব মিলিয়ে তুর্কিদের ইফতার আয়োজনটা বেশ বর্ণাঢ্য।
মিশর
দেশটিতে বেশ ধুমধামের সাথেই পালিত হয় রমজান মাস। অলিতে গলিতে দোকানিরা বসে যায় ইফতারের পসরা সাজিয়ে। সাধারণত খেজুর মুখে দিয়েই রোজা শেষ করে মিশরের মুসলমানরা। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের বাহারি খাবার তো রয়েছেই।
প্রধান প্রধান ইফতার সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে কোনাফা ও কাতায়েফ (আটা, মধু, বাদাম ও কিসমিসের সমন্বয়ে তৈরি কেক জাতীয় খাদ্য বিশেষ), ককটেল খুশাফ, মলোকিয়া, খেজুর ইত্যাদি।
ইফতারের টেবিলে মিশরের বিখ্যাত একটি পানীয় হচ্ছে ‘কামার আল দিনান্দ আরাসি’। শুকনা আখরোট সারাদিন পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর এর সাথে মধু মিশিয়ে তৈরি করা হয় কামার আল দিনান্দ আরাসি।
‘খাবোস রমজান’ নামক একধরনের রুটি মিশরে বেশ জনপ্রিয়। এটি কিছুটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির হয়ে থাকে। মিশরীয়রা বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে একসাথে ইফতার করতে পছন্দ করেন।
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ায় সাধারণত শুকনো খাবার বা খেজুর দিয়ে মুসলমানেরা রোজা ভাঙে। এছাড়া দেশীয় কিছু বিখ্যাত ইফতার আইটেম তো থাকবেই।
মালয়েশিয়ার লোকদের একটি স্থানীয় ইফতারে আইটেমের নাম হচ্ছে ‘বারবুকা পুয়াসা‘। এটা আখের রস এবং সোয়াবিনের দুধ দ্বারা তৈরি একধরনের বিশেষ মিষ্টান্ন সামগ্রী। এছাড়া মালয়েশিয়ার ইফতারে থাকে নাসি আয়াম, পপিয়া বানাস, আয়াম পেরিক, লেমাক লাঞ্জা ইত্যাদি। সাথে বিভিন্ন স্থানীয় খবর তো আছেই।
মালয়েশিয়ায় মসজিদ থেকে রোজাদারদের ‘বুবুর ল্যাম্বাক’ নামক একটি খাবার বিনামূল্যে দেওয়া হয়। চাউল, মাংস, নারিকেলের দুধ, ঘি ইত্যাদি দিয়ে বুবুর ল্যাম্ব্যাক তৈরি করা হয়। প্রায় পাঁচ দশক আগে কুয়ালালামপুর কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে এই খাবারটি বিতরণের প্রচলন শুরু হয়।
ইরান
ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য এবং আনন্দ উদ্দীপনার মাধ্যমে রমজান মাস পালন করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শিয়া অধ্যুষিত মুসলিম দেশটি। ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানের ইফতার সামগ্রীতে ফলমূল এবং মিষ্টান্ন সামগ্রী একটু বেশি গুরুত্ব পায়।
দেশটিতে ইফতার সামগ্রীতে ফল হিসেবে খেজুর, আপেল, চেরি, আখরোট, তরমুজ, তেলেবি, আঙ্গুর, কলা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া মিষ্টান্ন সামগ্রীর মধ্যে মধু, পনির, দুধ, রুটি, চা উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া ইরানের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী জিলাপি। যদিও এই জিলাপির স্বাদ আমাদের দেশের জিলাপির মতো নয়। ইরানের ‘শোলে জার্দ’ নামক একটি খাবার বেশ জনপ্রিয়। চিনি, ছোট চাল, আর জাফরান দিয়ে এই খাবারটি রান্না করা হয়।
ইরানের ১২ ইমামের একজন হচ্ছেন ইমাম রেজা (আঃ)। ইমাম রেজা (আঃ) এর মাজার কমপ্লেক্সের পাশে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। এই ইফতার মাহফিলটিতে প্রায় তিন লাখ লোক অংশগ্রহণ করেন।
পাকিস্তান
মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে পাকিস্তানে রমজান মাস পালন করা হয় বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে। ইফতারের টেবিল সাজাতে থাকে হরেক রকমের খাবার।
রুটি এবং মাংস পাকিস্তানীদের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। রমজান মাসে ইফতারের ক্ষেত্রেও এ খাবারটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া ইফতারের টেবিল সাজাতে আরও গুরুত্ব পায় টিক্কা সমুচা, ব্রেড রোল, চিকেন রোল, তান্দুরি কাটলেট, নুডুলস কাবাব, সুফিয়ানী বিরিয়ানি, গোলাপী কাবাব ইত্যাদি।
মিষ্টান্ন হিসেবে বিভিন্ন খাবার স্থান পায় সেদেশের ইফতার টেবিলে। যেমন- বিভিন্ন ধরনের ফলমূল, সালাদ, করাচি ফালুদা ইত্যাদি। ঝাল জাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে নিমকি, সমুচা পরোটা ইত্যাদি।
ভারত
প্রায় ১৯ কোটি মুসলমানের বাস ভারতে। ভারতের ইফতার বাজারে এখনও মুঘলদের প্রভাব স্পষ্ট। সেখানকার মুসলমানরা সাধারণত ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে ইফতার করতে পছন্দ করে। এখনও অনেকের মধ্যে মুঘল ঐতিহ্য বজায় রাখতে দেখা যায়।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ইফতারের বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন- হায়দ্রাবাদে ইফতার হিসেবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হালিম। তামিলনাড়ু ও কেরালায় ‘কাঞ্জি’ ছাড়া যেন ইফতার জমেই না। এটি তৈরি হয় ভাত, খাসির মাংস, মসলা ও সবজি দিয়ে।
ভারতের ইফতার সামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পনীর যুক্ত খেজুর, ডালের কাবাব, বটি কাবাব, খাসির মগজ এর কাটলেট, চিকেন শর্মা, কিমা সমুচা, খাসির লেগ রোস্ট, লাহোরি মাটন ইত্যাদি লোভনীয় খাবার। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্যুপ, পরোটা, রুটি, তরকারি ইফতারের টেবিলে বেশ গুরুত্ব পায়।