অধ্যায় ১
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জিনিসটা কী?
কিছু প্রধান ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। ২০১৯ সালে, হংকংয়ের নাগরিকরা নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকারের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে কয়েক মাস ধরে একটি গণআন্দোলন চালান। সে বছরের সেপ্টেম্বরেই, প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে আশু পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে দুনিয়া জুড়ে ডাকা একটা বৈশ্বিক ধর্মঘটে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। ২০১৬ সালে, ব্রিটেনের জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছেড়ে বেরিয়ে আসার পক্ষে ভোট দেন, এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে বিশ্ব আর্থিক সংকট (জিএফসি) বিশ্ব অর্থনীতিতে তাণ্ডব চালিয়েছিল। এর সাত বছর আগে আল কায়েদার জঙ্গিরা যুক্তরাষ্ট্রে হামলা করেছিল, যার ধারাবাহিকতায় বিশ্ব জুড়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিতে প্রতিবাদীরা বার্লিন দেয়াল ভেঙে ফেলার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার দীর্ঘ ‘স্নায়ু যুদ্ধের’ ইতি ঘটানোয় সহায়তা করেন। ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘ (ইউএন) মানবাধিকার বিষয়ক চুক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি চুক্তি গ্রহণ করে নেয়, এগুলো হচ্ছে: ‘নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার’ বিষয়ক এবং ‘সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, ও সামাজিক অধিকার’ বিষয়ক নিয়মপত্র। ১৯৫৫ সালে চীন, মিসর, ও ভারতের মতো নবগঠিত উত্তর-উপনিবেশিক স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো সাম্রাজ্যের অবসান ঘটানো এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক সমতার ভিত্তিতে একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা কায়েমের জন্য লড়াই করার উদ্দেশ্যে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ে মিলিত হন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের আধিপত্যশীল ঘটনাগুলো হচ্ছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৩০য়ের দশকের মহামন্দা, ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আর ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করার পেছনে যে প্রত্যাশা কাজ করেছিল, সেটি হলো, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও শাসনপ্রণালি মানবাধিকার রক্ষা করবে, বিশ্ব অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করবে, এবং যুদ্ধবিগ্রহের ফিরে আসাটা রুখে দেবে।
এই সব ঘটনাই বৃহত্তর অর্থে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বলয়ভুক্ত। কিন্তু তাই যদি হয়, তাহলে কিছু প্রশ্ন ওঠে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জিনিসটা কী? এত বিচিত্র সব ঘটনা কীভাবে এর ছত্রছায়ায় এলো? আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পণ্ডিতরা ঐতিহ্যগতভাবে বিভিন্ন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যকার বহিঃস্থ সম্পর্কে জোর দিয়ে এর জবাব খুঁজেছেন। যার মধ্যে পড়ে যুদ্ধ, বাণিজ্য বিষয়ক দরকষাকষি, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশগত চুক্তি ইত্যাদি। এগুলো এখনো পর্যালোচনাত্মক অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু রয়ে গেছে। যা হোক, এই আলোকপাতের সীমাবদ্ধতাগুলো সহজেই চোখে পড়ে। সব গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সীমিত নয়: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা, শেষ বিচারে, রাষ্ট্রীয় আর অরাষ্ট্রীয় কর্তাদের মধ্যে সংঘটিত হয়। সব গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতি বহিঃস্থ না: ব্রেক্সিট আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি আমাদেরকে দেখায়, গুরুত্বপূর্ণ অভ্যন্তরীণ ঘটনাসমূহ কীভাবে একটি একক রাষ্ট্রের সীমান্তগুলো ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক যদি কেবলই সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপার হয়, তাহলে আমাদের বিষয়বস্তু খুবই সীমিত হয়ে পড়বে; কারণ আজকের দিনের বৈশ্বিক সার্বভৌম রাষ্ট্রব্যবস্থার পূর্ণ আবির্ভাব ঘটেছে স্রেফ ১৯৪৫-পরবর্তী বিউপনিবেশায়নের মধ্য দিয়েই। এর আগে সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে ছিল। প্রধানত ইউরোপ আর দুই আমেরিকা মহাদেশে। কিন্তু, আমরা যেমনটা অচিরেই দেখব, সেই সময় দুনিয়ার অধিকাংশ জায়গা সাম্রাজ্যিক শাসনের অধীনস্ত ছিল।
এই সবকিছু আমলে নিয়ে কতিপয় পণ্ডিত বলেছেন, আমাদের উচিত ‘বিশ্ব রাজনীতির’ বৃহত্তর বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামানো। তাদের দাবি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাবলির যে সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য, তাকে জায়গা করে দেয়ার জন্য ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের’ ধারণাটি একটু বেশিই সংকীর্ণ। কিন্তু এটা আবার অনেকদূর চলে যায়। রাজনীতির মানে যদি হয় ক্ষমতার লড়াই, বা কে কী কোথায় ও কীভাবে পায় তার হিসাবনিকাশ; রাজনীতি যদি জন ও ব্যক্তিগত দুই পরিসরকেই ঘিরে রাখে, আর এটি যদি হয় সকল মানবিক কর্মকাণ্ডের একটি সংজ্ঞামূলক বৈশিষ্ট্য — যা কিছু বলা হয়ে থাকে রাজনীতির ব্যাপারে — তাহলে বিশ্ব রাজনীতির আলোচ্যসূচি সম্ভাবনার দিক দিয়ে সীমাহীন। এহেন রাজনীতির বর্ণনা আমরা কোথায় শুরু করব, আর এর শেষটাই বা হবে কোথায়?
এই অতি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি একটা ভিন্ন পথ নিয়েছে। মহান ফরাসি ঐতিহাসিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পণ্ডিত রেয়মন্ড অ্যারোন লিখেছেন,
“বাস্তবে ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের’ কোন সীমান্ত এলাকা নেই। অন্যান্য সামাজিক ঘটনা থেকে তা বস্তুগতভাবে বিচ্ছিন্ন নয়, বিচ্ছিন্ন করাও যাবে না।”
তিনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো, ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্ক’ এমন একটি ধারণা যা পণ্ডিত, অনুশীলনকারীগণ, ভাষ্যকারবৃন্দ, ও আমজনতা সামাজিক জীবনের একটি সুনির্দিষ্ট এলাকাকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য দৈনন্দিনভাবে ব্যবহার করে থাকেন। তারা এই এলাকাটি কল্পনা করেন ও নিজেদের তৎপরতার ভেতর দিয়ে নির্মাণ করে থাকেন। তো, আন্তর্জাতিকের প্রথাগত কল্পনা যদি হয় অতি সংকীর্ণ, আর বিশ্ব রাজনীতি অতি বিস্তৃত, তাহলে আমাদের আলোকপাত কী হওয়া উচিৎ? এই ছোট্ট বইটিতে আমি একটি বড় দাবি করেছি। সেটি হলো, আমাদের উচিৎ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বৈশ্বিক বিন্যাস এবং মানুষ ও প্রকৃতির ওপর এহেন বিন্যাস যে প্রভাব ফেলছে, তার ওপর আলো ফেলা।
রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হচ্ছে বৈধ রাজনৈতিক ক্ষমতা। এটি তেমন ক্ষমতা যা ন্যায়সঙ্গত বিবেচিত হয়। এটি হচ্ছে সেই ধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতা, রেনেসাঁর আদিপর্বের শিল্পী আমব্রোজিও লরেনজেত্তি যা তার মশহুর সিয়েনিজ ফ্রেসকোতে ভালো সরকারের রূপ (ছবি ১) হিসাবে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। লরেনজেত্তি দেখিয়েছেন যে, বৈধ শাসকের পুরুষ আকারটি নাগরিকদের সাথে অচ্ছেদ্য। তিনি আরো দেখিয়েছেন, পুরুষটিকে ঘিরে আছে বেশ কয়েকটি নারী আকার, যারা ন্যায়বিচার, ঐক্য, উদারতা, মিতাচার, শান্তি, দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার মতো নাগরিক মূল্যবোধগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। ফ্রেসকোটির নিচে লিখেছেন লরেনজেত্তি, এমন একজন শাসক ‘কখনোই তার চারপাশে বসে থাকা মূল্যবোধগুলোর ঝকঝকে মুখ থেকে চোখ সরান না’ (স্টার্নে উদ্ধৃত)। বলাই বাহুল্য, এটা রাজনৈতিক ক্ষমতার একটা পুরোপুরি লিঙ্গায়িত উদাহরণ (তৃতীয় অধ্যায়ে আমি এই পয়েন্টে ফিরে আসব)। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ফ্রেসকোটি একটা সুনির্দিষ্টভাবে নিখুঁত চিত্র তুলে ধরে, আর তা হলো রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সাথে স্বৈরতন্ত্রের পার্থক্য। স্বৈরতন্ত্র হলো এমন এক ধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতা যা জুলুম-নিপীড়নের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে। এই চতুর্দশ শতাব্দীর ফ্রেসকোগুলো চিত্তাকর্ষক মনে হয়। তা কেবল এই কারণেই নয় যে, এগুলো আমাদেরকে বৈধ ক্ষমতা হিসাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের প্রকৃতিটা বুঝতে সহায়তা করে; বরং এই কারণেও যে, লরেনজেত্তি এগুলোকে বৈধতা প্রদানের দিকে একটা পদক্ষেপ হিসাবে এঁকেছেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা মাত্রই বিধিসম্মত নয়, নিপীড়নমূলক আধিপত্য হরহামেশাই চোখে পড়ে। কিন্তু লরেনজেত্তির শিল্পকর্মটি ক্ষমতাকে বৈধতা দেয়ার, আধিপত্যকে রাজনৈতিক কর্তৃত্বে রূপান্তরিত করার, চিরায়ত তাড়নাই ধারণ করে।
রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কীভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে তা মানব সমাজকে এবং — যে ব্যাপারে আমরা ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠছি —তারা যেখানে বাস করে সেই প্রাকৃতিক পরিবেশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর কথা ভাবেন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে বিন্যস্ত করার আধিপত্যশীল উপায়ের প্রতিনিধিত্ব করে এরা। এগুলো হচ্ছে কেন্দ্রীয়ভাবে বৈধ রাজনৈতিক ক্ষমতা। যা অনেকগুলো স্বতন্ত্র ও ভূখণ্ডের সীমায় আবদ্ধ ছোট ছোট ইউনিট নিয়ে গড়ে উঠেছে। এগুলো যা কিছুর ওপর প্রভাব ফেলে তার মধ্যে আছে ব্যক্তি অধিকার (কিছু রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী, অন্যগুলো গণতন্ত্রী), অর্থনীতি পরিচালনা (কিছু রাষ্ট্রে হুকুমদারির অর্থনীতি চলে, অন্যগুলো অপেক্ষাকৃত উদার), স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবা প্রদান (কিছু রাষ্ট্র তহবিলপ্রাপ্ত কল্যাণমূলক ব্যবস্থা আছে, অন্যগুলোয় নেই), সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়গুলোর বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তীমূলকতা (কিছু রাষ্ট্র বহুসাংস্কৃতিক, অন্যগুলো প্রবলভাবে জাতীয়তাবাদী), এবং প্রকৃতির সুরক্ষা বা শোষণ (কিছু রাষ্ট্র অন্যগুলোর চেয়ে ‘সবুজতর’)। সেইসাথে সমান গুরুত্বপূর্ণভাবে, দুনিয়াকে প্রায় ২০০টা স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রে ভাগ করাটা আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধবিগ্রহ থেকে শরণার্থী সংকট পর্যন্ত নানারকম নিজস্ব বিকারের জন্ম দিয়েছে। একই সময়ে, এহেন সমস্যাগুলো সমাধানে মানবজাতির যে সামর্থ্য, তার ওপর বাস্তব সীমা আরোপ করেছে।
ইতিহাস জুড়ে রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে বিন্যস্ত করার অভিজ্ঞতাটা মানুষ সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে লাভ করেছে স্থানীয় পর্যায়ে। নিজেদের গ্রামে, গোষ্ঠীতে, পৌরসভায়, উপনিবেশে, নগররাষ্ট্রে, প্রদেশে, ও জাতিরাষ্ট্রে। কিন্তু এই স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলো সাধারণত বৃহত্তর আঞ্চলিক, সাম্রাজ্যিক, আন্তঃরাষ্ট্রীয়, বহুজাতিক, ও জাতিঅতিগ রাজনৈতিক কর্তৃত্বের রূপরেখায় প্রোথিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আদিবাসী আমেরিকান গোষ্ঠীগুলো প্রায়শই বৃহত্তর কনফেডারেসিসমূহের অংশ ছিল। যেমন ইরোকোয়াজ লিগ। মোহক, ওনেইদা, ওনোনদাগা, কায়ুগা, ও সেনেকা জাতিদের নিয়ে এটি গঠিত হয়েছিল। সমরূপভাবে, উনবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত, যদিও জাপান, কোরিয়া, ও ভিয়েতনামে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থা ছিল, তাদের রাজবংশ ও সাম্রাজ্যিক এলাকা ভাগ করা ছিল, একই সময়ে তারা চীনের বৃহত্তর সামন্ত ব্যবস্থার অংশ ছিল। এই বন্দোবস্তের অংশ হিসাবে তারা চীনের সম্রাটদের খাজনা পরিশোধ করত। আজকে, সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলো আইনত স্বাধীন, তবে তারা একটি বৈশ্বিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রোথিত। যে ব্যবস্থার সদস্যদের একেকজনের রাজনৈতিক চর্চা, প্রতিষ্ঠান, আর সম্মুখীন হওয়া চ্যালেঞ্জ একেকরকম। আমি যখন রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ‘বৈশ্বিক’ বিন্যাসের ওপর আলো ফেলার ডাক দেই, তখন এইসব বৃহত্তর রূপরেখার কথাই বোঝাই। তা সেগুলো পৃথিবীর সীমায় থাকুক আর না থাকুক। বস্তুত, আজকের সার্বভৌম রাষ্ট্রব্যবস্থাটিই হয়তো একমাত্র সত্যিকার অর্থে বৈশ্বিক একটি উদাহরণ।
রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে বিন্যস্ত করার এই সাম্প্রতিক পদ্ধতি দুটি কারণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। প্রথমত, পদ্ধতিটি অভিনব। দীর্ঘকাল থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থীদের এমন একটি দুনিয়া কল্পনা করতে শেখানো হয়েছে, যা অনেকগুলো সার্বভৌম রাষ্ট্রে বিন্যস্ত হয়ে আছে। তাদেরকে বিষয়টির চিরায়ত সত্যের পাঠ নিতে শেখানো হয়েছে। পড়তে শেখানো হয়েছে ‘পুনরাবৃত্তির’ প্রতি এর ঝোঁকটা, নেতৃস্থানীয় ইংরেজ স্কুল তাত্ত্বিক মার্টিন ওয়াইট যেমনটা পর্যবেক্ষণ করেছেন। যদিও, একটু আগেই আমরা যেমনটা দেখেছি, ১৯৭০এর দশকের আগ পর্যন্ত দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্রের বাসিন্দা ছিল, তারা সাধারণভাবে নানান সাম্রাজ্যে বসবাস করেছেন। পুরো পৃথিবী জুড়ে যে সার্বভৌম রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে, যা একদমই নতুন একটা জিনিস। শুধু তা-ই নয়, এই বিকাশটাও খুবই নতুন। এটি এর উৎস, গতিশীলতা, পরিণতি এবং সম্ভাব্য রূপান্তর প্রসঙ্গে অনেক কৌতূহলউদ্দীপক প্রশ্ন উত্থাপন করে। ব্যবস্থাটির অভিনবত্ব যে প্রশ্নগুলোকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তোলে। দ্বিতীয়ত, কর্তৃত্বের বর্তমান বৈশ্বিক রূপরেখা অত্যন্ত জটিল। রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে নিছকই অনেকগুলো সার্বভৌম রাষ্ট্রে ভাগ করা হয়নি। নানান জাতিঅতিগ গোষ্ঠী (যেমন ইইউ), আন্তর্জাতিক সংগঠন (যেমন জাতিসংঘ), ও বহুজাতিক কর্তাও (যেমন বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো) রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বিনিয়োজিত হয়ে আছে। তদুপরি, সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি প্রায়ই এই ‘বহিঃস্থ’ কর্তৃপক্ষগুলো দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারের অফিসের (ইউএনএইচসিআর) মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শরণার্থীদের সাথে রাষ্ট্রের আচরণের বিষয়ে প্রতিবেদন করার ক্ষমতা রাষ্ট্র নিজেই সংস্থাগুলোকে দিয়েছে। এই ক্ষমতা প্রায়ই জাতীয় সরকারগুলোর নীতি ও আচরণের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। স্থানীয় ও বহুজাতিক সক্রিয়তাবাদীদের শক্তিশালী করে তোলে।
রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বৈশ্বিক বিন্যাসকে আমাদের অনুসন্ধানের কেন্দ্রে স্থাপন করাটা বিশ্লেষণাত্মক ও নৈতিক দুই ধরণের প্রশ্নই আহবান করে। বিশ্লেষণের জায়গা থেকে, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কীভাবে একটি সুনির্দিষ্ট উপায়ে বিন্যস্ত হলো সেই প্রশ্ন তুলতে পারি। আমরা এর রাজনৈতিক গতিশীলতা ও পরিণতি (সহিংসতা থেকে মানবীয়তা) তদন্ত করে দেখতে পারি। যেসব শক্তি কাজ করে চলেছে এর বিবর্তন ও রূপান্তরের পেছনে আমরা সেগুলোও খতিয়ে দেখতে পারি। আমরা এই প্রশ্নও উত্থাপন করতে পারি যে, কীভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিভিন্ন বন্দোবস্তকে তুলনা করা যায়, আর সময়ের সাথে একটা আরেকটায় রূপান্তরিতই বা হলো কীভাবে (উদাহরণস্বরূপ, আজকের বৈশ্বিক রাষ্ট্রব্যবস্থাটি কীভাবে চীনা, ইউরোপীয়, মুঘল, ও ওসমানি সাম্রাজ্যগুলোর পতন থেকে উঠে এসেছে)। আর, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, আমরা জিজ্ঞেস করতে পারি রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে বিন্যস্ত করার বড় আকারের প্রকল্পগুলো কীভাবে সময় সময় শুধু মানুষের ভালো থাকাটাই যে সম্ভবপর করে তুলল তাই নয়, কীভাবে একইসাথে উঁচুনিচু ভাগাভাগি আর বহিঃষ্কারমূলকতারও নানান বর্গ উৎপাদন করল সেটিও। এসব বর্গের মধ্যে রয়েছে বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম, যৌনতা, জাতি, ও আরো অনেককিছু।
এই অতি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এই ধরণের বিশ্লেষণাত্মক প্রশ্নগুলোর ওপর মনোনিবেশ করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিন্যাসের ওপর আলো ফেলাটা সহজাতভাবেই কিছু নৈতিক প্রশ্ন তোলে। এহেন কর্তৃত্ব যদি ন্যায়সঙ্গত ক্ষমতা হয়, তাহলে সেই ক্ষমতা যা কিছু সরবরাহ করে চলেছে — যে ন্যায়বিচার সে প্রদান করে, যেসব অধিকার সে রক্ষা করে, যে নৈতিকতা সে উর্দ্ধে তুলে ধরে — তা সবসময়ই অংশত সেসবের ব্যাপারে ঐতিহাসিক বিতর্ক আর সংগ্রামের একটা ফসল। সমসাময়িক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কেন্দ্রে যে বিতর্কগুলো আছে: সার্বভৌম কর্তৃত্বের সীমাগুলো কী, মানবাধিকার কখন রক্ষা করতে হবে, গণহারে খুন হয়ে যাওয়া থেকে কোনো জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেয়ার দায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আছে কিনা, বৈষম্য হ্রাস করা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শাসনের একটা লক্ষ্য হতে পারে কিনা, জলবায়ু সংক্রান্ত জরুরি অবস্থার বিষয়টা দেখার ব্যাপারে আমাদের কী কী বাধ্যবাধকতা আছে, আর কোন অধিকারটা বেশি মৌলিক, আশ্রয় পাওয়ার অধিকার নাকি জাতীয় সীমান্তগুলো রক্ষা করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থীরা যে এহেন প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়ার চেষ্টা করবে, তা শুধু যথোপযুক্তই নয়; আমরা যদি আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে কথা বলতে চাই, তবে তা অপরিহার্যও বটে।
পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে, আমি রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বৈশ্বিক বিন্যাসের আতশকাচের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে পরিচিত করে তুলব। দ্বিতীয় অধ্যায় এহেন বিন্যাসকে আরো কাছ থেকে খতিয়ে দেখবে এবং সবচে প্রভাবশালী ঐতিহাসিক রূপগুলোর একটা সারসংক্ষেপ পেশ করবে। যার মধ্যে আছে পরায়ত্তশাসন (সামন্তযুগের ইওরোপের কথা ভাবুন), সাম্রাজ্য (মুঘল থেকে ব্রিটিশ), এবং সার্বভৌমত্ব (এর উৎকর্ষের শিখরে, সম্ভবত, আজকের বৈশ্বিক ব্যবস্থা)। আমার লক্ষ্য দুটো। প্রথমত, আমি প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতি ও গুরুত্বের ওপর জোর দিতে চাই। বৃহত্তর অর্থে যার মানে হলো নিয়ম, প্রথা, আর চর্চার আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থাসমূহ। সার্বভৌমত্বের অন্তর্নিহিত প্রথা থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শাসন করা নিয়মগুলো এর অন্তর্ভুক্ত। এহেন প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তারা রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিন্যাসে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমার দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে আজকের সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর বৈশ্বিক ব্যবস্থাটিকে একটি বৃহত্তর ধারণাগত ও ঐতিহাসিক কাঠামোয় স্থাপিত করা। এটিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে শৃঙ্খলা আনয়নের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তথাপি সম্পূর্ণ অনন্য, উপায় হিসাবে দেখতে পাঠকদের উৎসাহিত করা।
তৃতীয় অধ্যায় একটা তত্ত্বগত মোড় নিয়েছে। আপনি হয়তো শুনে থাকবেন তত্ত্ব হচ্ছে একটা বিদ্যায়তনিক বিলাসিতা। চার্লস ডিকেন্সের স্কুলশিক্ষক টমাস গ্রাডগ্রিন্ড যেমনটা জোর দিয়ে বলেছিলেন,
“আমরা যা চাই, তা হচ্ছে কেবলই তথ্য, তথ্য ছাড়া আর কিছুই নয়, বাকি সবকিছু আগাছা জ্ঞান করে ফেলে দাও।”
যাহোক, বাস্তবে তত্ত্ব হচ্ছে বোঝাপড়ার একটা অপরিহার্য মিত্র। তত্ত্বমুক্ত অনুসন্ধানের চিন্তাটা হচ্ছে একটা অসহায়ক অতিকথা। আমাদেরকে জটিলতার মানে বুঝতে সাহায্য করে, তত্ত্বগুলো এহেন সংগঠিত অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনকি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সবচেয়ে ‘তথ্যনিষ্ঠ’ বিবরণগুলোও এ ধরনের অনুমানসমূহকে প্রতিফলিত করে। লেখকেরা কোন তথ্যগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন তা অবহিত করে: মহান নেতাদের ব্যক্তিত্ব ও পছন্দ, সেই সময়ের চিন্তা বা সংস্কৃতি, বস্তুগত ক্ষমতার বিতরণ, পুঁজিবাদের ভূমিকা ইত্যাদি। আমরা যে এ ধরনের অনুমান ব্যবহার করার ক্ষেত্রে চিন্তাশীল ও পদ্ধতিগত হবো, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্র হিসেবে তা-ই আমাদের পক্ষে মানানসই। আর সেটি করার প্রধান উপায় হলো অনুমানগুলোকে বিন্যস্ত করে তত্ত্বে রূপ দেয়া। এই কাজে সহায়তা করার জন্য আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিদ্যমান তত্ত্বগুলোর মধ্যে প্রধান তত্ত্বগুলোর সাথে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেব। যার ব্যাপ্তি বাস্তববাদ থেকে নারীবাদ পর্যন্ত। যাহোক, এ তত্ত্বগুলোকে সচরাচর যেভাবে পাঠ করা হয়, আমার পাঠ তারচেয়ে আলাদা। তত্ত্বগুলোকে ‘বিশ্লেষণমূলক’ ও ‘নীতিবিচারমূলক’, কিংবা ‘মূলধারা’ ও ‘পর্যালোচনাত্মক’, ইত্যাদি বর্গে ভাগ করে দেখার রীতি রয়েছে। আমি রীতিটির বিরোধী। ভাগাভাগির বিরুদ্ধে আমি বরঞ্চ যে যুক্তি দিতে চাই, সেটি হচ্ছে, রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় ও বৈশ্বিকভাগে বিতরণ করা হয়, এবং তার পরিণতিই বা কী, সবগুলো তত্ত্বই তার সাথে কেন্দ্রীয়ভাবে জড়িত।
ক্ষমতাশালী সামাজিক শক্তিগুলো সময়ের সাথে একদিকে যেমন রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বড় মাপের বিন্যাসটিকে গড়ন দিয়েছে, অন্যদিকে খোদ বিন্যাসটিই এই শক্তিগুলোকেও গড়েপিটে নিয়েছে। চতুর্থ থেকে সপ্তম অধ্যায় এই শক্তিগুলোর মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ কটিকে খতিয়ে দেখবে। এগুলো হলো যুদ্ধ, অর্থনীতি, অধিকার, ও সংস্কৃতি। ইতিহাস জুড়েই, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের কাঠামো ও চর্চাসমূহ যুদ্ধ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কীভাবে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয়, জার্মান, ও ওসমানি সাম্রাজ্যগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল তার কথাটাই চিন্তা করে দেখুন। চতুর্থ অধ্যায় যুদ্ধকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত সহিংসতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। সেইসাথে পরীক্ষা করে দেখেছে যে, এহেন সহিংসতার স্থানান্তরিত হতে থাকা নকশাগুলো কীভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিভিন্ন রূপের জন্ম দিয়েছিল, এহেন কর্তৃত্বের একটা প্রধান শনাক্তকারী চিহ্ন হিসেবে কাজ করেছিল, এবং রাজনৈতিক ও বৈধ নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার বনে গেছিল।
পঞ্চম অধ্যায় অর্থনীতি আর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিন্যাসের সম্পর্কটির ওপর নজর দিয়েছে। এই যুক্তি প্রদর্শন করেছে যে, তারা পরস্পরনির্ভর। বিবেচনা করে দেখেছে তিনটি স্থানান্তরিত হতে থাকা শর্ত। এগুলো হলো বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পরিবর্তন, প্রযুক্তিক্ষেত্রে বিপ্লব, এবং অর্থনৈতিক সম্পদগুলোর বৈশ্বিক বিতরণে স্থানান্তরণ। এরপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিন্যাসের প্রধান বিকাশগুলো পরীক্ষা করে দেখেছে। সেইসাথে পরীক্ষা করে দেখেছে যে, কীভাবে এগুলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলোকে প্রভাবিত করেছে।
রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সকল বন্দোবস্তই অধিকারকে সংজ্ঞায়িত ও বন্টন করে। সমসাময়িক রাষ্ট্রগুলো নাগরিকদের নির্দিষ্ট কিছু অধিকার দেয়। একইসাথে বেনাগরিকদেরকে এই অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত করে। বেনাগরিকের উদাহরণস্বরূপ বলা যায় শরণার্থীদের কথা। সমরূপভাবে, সাম্রাজ্যগুলোতে, সাম্রাজ্যিক রাষ্ট্রের নাগরিকেরা ভোগ করতেন একগুচ্ছ অধিকার, আর উপনিবেশিক প্রজাদের কপালে জুটত ভিন্নরকম, অপেক্ষাকৃত কম, সুযোগসুবিধা। ১৯৪৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক চুক্তিগুলো সকল মানুষের জন্য অধিকারসমূহকে বিধিবদ্ধ করেছে। যুগপৎভাবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতি ও সংস্থাগুলো ক্ষমতা প্রদান করেছে আর রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌম অধিকারকে সীমিত করেছে। এই প্রতিটি ক্ষেত্রে, অধিকারের প্রকৃতি ও বন্টন রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সুযোগ ও সীমাকে প্রভাবিত করেছে। ষষ্ঠ অধ্যায় অধিকারের রাজনীতির দুটো দিক পরীক্ষা করে দেখেছে। এক, আজকের বৈশ্বিক সার্বভৌম রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যুদয়ে ব্যক্তি অধিকার কী ভূমিকা রেখেছে। আর দুই, মানবাধিকারের স্থানীয় লড়াইগুলো, যা বহুজাতিক মানবাধিকার আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত, কীভাবে সার্বভৌম কর্তৃত্বকে পুনঃসংজ্ঞায়িত ও সীমিত করতে চেয়েছে।
শেষ যে প্রভাবকটি আমরা বিবেচনা করে দেখেছি, সেটি হচ্ছে সংস্কৃতি। পশ্চিমের বাইরে বৃহৎ শক্তির যে উত্থান, বিশেষত চীনের, সংস্কৃতি কীভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বৈশ্বিক বিন্যাসকে প্রভাবিত করে সে ব্যাপারে তা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। অনেকে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন, যেহেতু পশ্চিমা সাংস্কৃতিক প্রভাব কমে আসছে, আধুনিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাটির পতন ঘটবে। এর বিপরীতে যারা যুক্তি প্রদর্শন করেছেন, তাদের মত হচ্ছে, উদার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো নানান দেশ ও জাতির সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সপ্তম অধ্যায় একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বড় মাপের রূপরেখাগুলো একজাতীয় সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে বিবর্তিত হয়নি। বিবর্তিত হয়েছে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতে। আর যে রূপ তারা নিয়েছে — যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, উঁচুনিচু ভাগাভাগি ব্যবস্থা বানিয়েছে, আর অধিকার বিলি করেছে — তা এই বৈচিত্র্যকে শাসন করার বাধ্যবাধকতা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
বৈধ রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাসকে গড়ন দেয়া প্রতিযোগিতা ও লড়াইয়ের ওপর আলোকপাত করে, এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্বের যে বড় মাপের বন্দোবস্ত অধিকতর স্থানীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করে তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যয়ন সরাসরি বৈশ্বিক সামাজিক ও জৈবিক জীবনের মৌলিক রাজনৈতিক শর্তগুলোর সম্মুখীন হয়। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সবচেয়ে আকর্ষনীয় (ও তর্কসাপেক্ষে সবচে গুরুত্বপূর্ণ) রূপ। আর এই অতি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পাঠকদেরকে তাদের বিশ্বটাকে, এবং যেসব গভীর চ্যালেঞ্জের মুখে তা পড়েছে সেগুলোকে, এই অনন্য ও দীপান্বিত করে তোলা আতশকাচের ভেতর দিয়ে দেখার দাওয়াত দেয়।