২০১৯ সালে টেক্সাসের এল পাসো এলাকায় ঘটে যায় মর্মান্তিক এক ঘটনা। সেখানকার ওয়ালমার্ট স্টোরের কাছে এক শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী গুলি চালিয়ে প্রায় বাইশজন মানুষকে হত্যা করে। এর পাশাপাশি তার পরিকল্পিত আক্রমণে আহত হয় আরও ছাব্বিশজন। এই ঘটনার পর পুলিশ সেই লোককে গ্রেফতার করে। তদন্তের সময় সে স্বীকারোক্তি দেয়, মূলত এল পাসোয় অবস্থানরত মেক্সিকান বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের লক্ষ্য করেই সে হামলা চালায়। পুলিশ পরবর্তীতে তদন্তে দেখতে পায়, ন্যাক্কারজনক আক্রমণের মাত্র বিশ মিনিট আগে সেই লোকটি একটি ওয়েবসাইটে অভিবাসীবিরোধী, বর্ণবাদী মন্তব্য ছড়িয়ে দিয়েছিল। যে ওয়েবসাইটের সে মন্তব্য ছড়িয়েছিল, সেই ওয়েবসাইটটি আমেরিকার অন্যান্য শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় ছিল। বিশেষজ্ঞরা এই ঘটনাকে গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী আক্রমণ হিসেবে অভিহিত করেন।
আমেরিকার উইসকনসিনে ২০১২ সালে ঘটে যায় আরেক ন্যাক্কারজনক ঘটনা। শিখদের ধর্মীয় রীতিনীতি পালন ও প্রার্থনার ঘর গুরুদুয়ারায় আক্রমণ চালানো হয়। সেই আক্রমণে মারা যায় ছয় শিখ ব্যক্তি, আহত হয় আরও তিনজন। একজন বন্দুকধারী প্রার্থনারত শিখদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। ঘটনাস্থলে মার্কিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করলে তাদের উপরেও আক্রমণ চালাতে উদ্যত হয় সেই বন্দুকধারী। পরে তদন্তে পুলিশ দেখতে অয়ায়, আক্রমণকারীর চিন্তাভাবনার সাথে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের সম্পর্ক রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সে এমন এক গানের ব্যান্ডের সাথে যুক্ত ছিল, যে ব্যান্ড বিভিন্ন বর্ণবাদী গান প্রচার করতো। এই ঘটনার পর উইসকনসিনের শিখ ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিরা তো বটেই, পুরো আমেরিকার শিখ ধর্মাবলম্বীদের এক অজানা আতঙ্ক গ্রাস করে। এই আক্রমণের পরের বছরগুলোতে নিহত শিখ ধর্মাবলম্বীদের স্মরণে স্থানীয় শত শত মানুষ বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে মিলিত হতো সেই গুরুদুয়ারায়।
২০১৬ সালের নির্বাচনের কথা আমরা সবাই জানি। এই নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আগের যেকোনো নির্বাচনের তুলনায় বেশি ভূমিকা রেখেছিল। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের এক বড় অংশ ছিল স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ও বর্ণবাদী গোষ্ঠীর লোকজন। নির্বাচনের প্রাক্বালে এই গোষ্ঠীর লোকেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট ঘরানার মানুষের বিরুদ্ধে ইচ্ছামতো বর্ণবাদী ও ঘৃণামিশ্রিত মন্তব্য ছড়ায়।
উপরের প্রতিটি ঘটনার পেছনে হামলাকারীদের মধ্যে কিন্তু মিল লক্ষ্য করা যায়। তারা যাদের উপর হামলা চালিয়েছে, তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক ধারণা তাদের মাথায় আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। প্রথম ঘটনায় টেক্সাসের এল পাসোয় যে হামলাকারী গুলি চালিয়েছিল, সে ছিল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী। তার চোখে এল পাসোর মেক্সিকান বংশোদ্ভূতরা ছিল বাইরে থেকে আসা মানুষ, যারা স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। দ্বিতীয় ঘটনায় উইসকনসিনে শিখদের ধর্মীয় উপাসনালয় গুরুদুয়ারায় যে ব্যক্তি হামলা চালিয়েছিল, সে-ও ছিল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী। তারও আক্রমণের পূর্বে মনে হয়েছিল- শিখ ধর্মাবলম্বীরা তার মাতৃভূমিতে তার জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শেষের ঘটনায় যে নির্বাচনের সময় বর্ণবাদী গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের লক্ষ্যে যারা ছিল, তাদের উদ্দেশ্য করে বিষোদগার করেছিল।
ইংরেজিতে ‘হেইট ক্রাইম’ বলতে সেসব অপরাধকে নির্দেশ করা হয়, যেসবের সাথে জড়িত অপরাধীরা ভিকটিমের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক ধারণা পোষণ করেন। ভিকটিমের ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, কিংবা কোনো শারীরিক অক্ষমতার জন্য অপরাধীর মনে ক্ষোভ তৈরি হয়, যে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ভিকটিমের উপর হামলার মধ্য দিয়ে। এই যে অপরাধীর মনে ক্ষোভ জন্মায়, এর পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ থাকে না, বরং বিভিন্ন বর্ণবাদী চিন্তাভাবনা জড়িত থাকে। একজন মানুষ শুধু কোনো ধর্মাবলম্বী, কিংবা আঞ্চলিক দিক থেকে সংখ্যালঘু হওয়া, কিংবা শারীরিকভাবে কোনো অক্ষমতার কারণে যখন কোনো অন্যায় আক্রমণের শিকার হন, তখন সেটাকে ‘হেইট ক্রাইম’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিকটিম কোনো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সদস্য হয়ে থাকেন, এবং হেইট ক্রাইমের মতো ঘটনাগুলো সেই জনগোষ্ঠীর অন্যান্য সদস্যের মধ্যেও আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এই ঘটনাগুলোর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আরও ভয়াবহ; ভিকটিম তো বটেই, তার পুরো সম্প্রদায়কে মানসিকভাবে একঘরে করে ফেলতে পারে।
আমেরিকায় ‘হেইট ক্রাইম’ এর ঘটনাগুলো তদন্তের দায়িত্বে থাকা এফবিআই বছরের পর বছর ধরে এই ধরনের অপরাধের পেছনে অপরাধীর বর্ণবাদী চিন্তাভাবনাকে দায়ী করে আসছে। কিন্তু এ ধরনের অপরাধের পেছনে আরও অনেকগুলো বিষয় জড়িত আছে, যেগুলো নিয়ে গবেষণাও হয়েছে। একটি গবেষণায় সমাজবিজ্ঞানী জ্যাক ম্যাকডেভিট ও জ্যাক লেভিন দেখিয়েছেন, মূলত চারটি কারণ হেইট ক্রাইমের মতো অপরাধ সংঘটনের পেছনে দায়ী। যেমন–
১) জীবনে একটু উত্তেজনার জন্য অপরাধীরা এ ধরনের অপরাধ ঘটায়। তারা বিভিন্ন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখিয়েছেন, প্রায় ৬৬% শতাংশ অপরাধী তাদের একঘেয়ে জীবনে একটু উত্তেজনা নিয়ে আসার জন্য হেইট ক্রাইমে জড়ায়। তাদের মনে এই ধারণা জন্মে- যেহেতু তার অপরাধের ভিকটিমরা সংখ্যালঘু, বা এমন কোনো বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে রয়েছে যেটি সে পছন্দ করে না, তাই সে তাদের উপর আক্রমণ চালাতে পারবে।
২) প্রায় ২৫ শতাংশ অপরাধী মনে করে, কোনো নির্দিষ্ট জাতির, ধর্মের, লিঙ্গের বা লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষেরা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, বা দাঁড়িয়েছে। ফলে তারা নিজেদের রক্ষার এক ভ্রান্ত তাড়না উপলব্ধি করে, এবং যাদের মনে হয় তাদের অস্ত্বিত্বের জন্য হুমকি, তাদের উপর হামলা চালায়। এ ধরনের অপরাধকে ‘ডিফেন্সিভ হেইট ক্রাইম’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
৩) অনেক সময় দেখা যায়, কোনো অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তি কোনো বিশেষ জাতিগোষ্ঠী সদস্য, বা কোনো বিশেষ ধর্মের অনুসারী। তখন সেই সমাজের সংখ্যাগুরু মানুষেরা পূর্ববর্তী অপরাধের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সেই বিশেষ জাতিগোষ্ঠী কিংবা বিশেষ ধর্মের অনুসারীদের উপর হামলা চালিয়েছে।
৪) মাত্র ১% ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, পেশাদার অপরাধীরা একেবারে সুপরিকল্পিতভাবে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষের উপর পক্ষপাতিত্বমূলক ধারণা থাকার কারণে হামলা চালিয়ে বসে। শুধু হামলা চালিয়েই তারা ক্ষান্ত হয় না, নিয়মিত বিভিন্ন বর্ণবাদী মন্তব্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়, এবং এভাবে নিজেদের হামলার বৈধতা দেয়ার চেষ্টা চালায়।
হেইট ক্রাইমের বিরুদ্ধে দেশভেদে বিভিন্ন শাস্তি রয়েছে। কিন্তু এসব শাস্তি অপরাধের মাত্রা কতটুকু কমাতে পেরেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, কঠোর আইন থাকার পরও আমেরিকায় ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে হেইট ক্রাইমের মাত্রা বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণের নিয়ন্ত্রণ ঘটাতে পারে, কিন্তু অপরাধীর যে মনস্তত্ব- তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। হেইট ক্রাইম সংঘটনের আগে অপরাধীরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে চাপ অনুভব করেন। তারপরও আইনের সফল প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে এ ধরনের অপরাধ কমিয়ে আনা অসম্ভব না।