Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাম্প্রতিক ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বের অন্তর্নিহিত কারণ || শেষ পর্ব

[২য় পর্ব পড়ুন]

২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ নভেম্বরের মধ্যে সংঘটিত আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে তুর্কি–সমর্থিত আজারবাইজানের নিকট আর্মেনিয়া ও আর্মেনীয়–সমর্থিত আর্তসাখ পরাজিত হয় এবং যুদ্ধের সময় ও ১০ নভেম্বর রুশ মধ্যস্থতায় সম্পাদিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির ফলে আর্তসাখ–নিয়ন্ত্রিত ৭টি আজারবাইজানি জেলা ও শুশা শহরসহ নাগর্নো–কারাবাখ অঞ্চলের অংশবিশেষ আজারবাইজানের হস্তগত হয়। যুদ্ধ চলাকালে আজারবাইজানি সৈন্যরা ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের নিকটবর্তী আর্তসাখ–নিয়ন্ত্রিত অংশ অধিকার করে এবং এর ফলে ইরান ও আর্তসাখের মধ্যে সরাসরি স্থল সংযোগ বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে গোরিস–কাপান সড়কের বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র অংশ আজারবাইজানি নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে।

গোরিস ও কাপান দক্ষিণ আর্মেনিয়ার দুটি শহর এবং শহর দুইটিকে যুক্তকারী সড়কটির অংশবিশেষ আজারবাইজানি ভূখণ্ডে অবস্থিত। ২০২০ সালের যুদ্ধের আগে উক্ত ভূখণ্ড আর্তসাখের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল, কিন্তু যুদ্ধের সময় এটি আজারবাইজানি নিয়ন্ত্রণাধীনে আসে এবং ২০২১ সালের প্রথমার্ধে আজারবাইজানি কর্তৃপক্ষ উক্ত সড়কটির আজারবাইজানি–নিয়ন্ত্রিত অংশগুলোতে নিজস্ব পতাকা ও সীমান্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। ২০২১ সালের আগস্টের প্রথমদিকে আজারবাইজানি সরকার আজারবাইজানে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত আব্বাস মুসাভিকে তলব করে এবং আর্তসাখে ‘অবৈধভাবে’ ইরানি ট্রাকবহরের প্রবেশের প্রতিবাদ জানিয়ে একটি নোট প্রদান করে। আগস্টের শেষদিকে সড়কটির আজারবাইজানি–নিয়ন্ত্রিত অংশ প্রায় দুই দিন বন্ধ ছিল। উল্লেখ্য, এই সড়কের মাধ্যমে ইরান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে বাণিজ্য চলে এবং ইরানি ট্রাকবহর এই সড়ক ব্যবহার করে আর্মেনিয়ায় (ও আর্তসাখে) প্রবেশ করে।

২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আর্মেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি সার্ভিস’ এবং স্থানীয় প্রচারমাধ্যম জানায় যে, আজারবাইজানি পুলিশ গোরিস–কাপান সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী ইরানি গাড়িগুলোর তল্লাশি নিচ্ছে এবং তাদের কাছ থেকে ব্যাপক হারে শুল্ক আদায় করছে। একই দিনে আজারবাইজানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায় যে, তারা রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও আর্তসাখে মোতায়েনকৃত রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনী বরাবর চিঠি প্রেরণ করেছে এবং আর্তসাখে তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রের যানবাহন যেন প্রবেশ করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করার জন্য তাদের আহ্বান জানিয়েছে।

১৩ সেপ্টেম্বর আজারবাইজানি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এলশাদ হাজিয়েভ ‘বিবিসি আজারবাইজানি’র কাছে এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করেন এবং একই দিনে আজারবাইজানি ‘রাষ্ট্রীয় শুল্ক কমিটি’ জানায় যে, গোরিস–কাপান সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী বিদেশি যানবাহনগুলোর কাছ থেকে তারা শুল্ক আদায় করছে। ইরানি গাড়িচালকদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, এই সড়ক দিয়ে যাওয়া ও আসার জন্য আজারবাইজানিরা তাদের কাছ থেকে ২৪০-২৬০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত শুল্ক আদায় করতে শুরু করেছে, এবং এটি তাদের ব্যবসার জন্য ক্ষতিকর। উল্লেখ্য, আজারবাইজানিরা কেবল আজারবাইজানে প্রবেশকারী ইরানি গাড়িগুলোর কাছ থেকেই শুল্ক আদায় করছিল, আর্মেনীয় বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের গাড়ির কাছ থেকে অনুরূপ শুল্ক আদায় করছিল না।

মানচিত্রে আর্মেনিয়া এবং ইরানি–আর্মেনীয় সীমান্ত; Source: Wikimedia Commons

১৩ সেপ্টেম্বর আজারবাইজানি সীমান্তরক্ষীরা দুইজন ইরানি ট্রাকচালককে (বারজেগার হাঘি জাফর গজনফর এবং নোরুজি শাহরুদ হায়দার) গ্রেপ্তার করে এবং আজারবাইজানি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এহসান জাহিদভ জানান যে, আর্মেনিয়া থেকে আর্তসাখে প্রবেশের কারণে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরেই আজারবাইজান আর্মেনিয়া থেকে আর্তসাখে প্রবেশ করাকে আজারবাইজানের সীমান্ত লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইরানি নাগরিকদের মুক্তি প্রদান ও এই বিষয়ে আজারবাইজানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক আয়োজনের দাবি জানায়। এরপর আজারবাইজানে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত আব্বাস মুসাভি আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতির পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সিনিয়র উপদেষ্টা হিকমেত হাজিয়েভ ও অন্যান্য আজারবাইজানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু এরপরেও আজারবাইজানি সরকার ইরানি ট্রাকচালকদের মুক্তি প্রদান করেনি।

উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বরে আজারবাইজানের বাকুতে একটি তুর্কি–পাকিস্তানি–আজারবাইজানি ত্রিপক্ষীয় স্পেশাল ফোর্স মহড়া, লাচিন ও নাখচিভানে দুইটি তুর্কি–আজারবাইজানি যৌথ সামরিক মহড়া এবং কাস্পিয়ান সাগরে আজারবাইজানি জলসীমায় একটি তুর্কি–আজারবাইজানি যৌথ নৌ কমান্ডো মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। আজারবাইজান কর্তৃক ইরানি ট্রাকচালকদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি এই মহড়াগুলো ইরানি সরকারকে ক্ষিপ্ত করে এবং ২১ সেপ্টেম্বর ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের নিকটবর্তী অঞ্চলে ইরানি সশস্ত্রবাহিনী একটি মহড়ার আয়োজন করে।

পাল্টাপাল্টি সামরিক মহড়ার পাশাপাশি ইরানি ও আজারবাইজানি রাজনীতিবিদরা যথাক্রমে আজারবাইজান ও ইরান সম্পর্কে তিক্ত মন্তব্য করতে শুরু করেন। রক্ষণশীল আজারবাইজানি রাজনৈতিক দল ‘আজারবাইজান দেমোক্রাৎ পার্তিয়াসি’র সভাপতি সারদার জালালোলু মন্তব্য করেন যে, ইরান আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে আজারবাইজানের বিজয় নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং এজন্য আজারবাইজানকে হুমকি প্রদানের উদ্দেশ্যে আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে মহড়ার আয়োজন করেছে। তিনি আরো মন্তব্য করেন যে, ইরান আজারবাইজানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তেহরানে পৌঁছে যাবে!

অন্যদিকে, ইরানি আইনসভার জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির অন্যতম সদস্য ফাদা–হোসেইন মালেকি মন্তব্য করেন যে, আজারবাইজানের উচিত তাদের ‘সন্দেহজনক’ কার্যক্রম বন্ধ করা এবং ইরান ও আর্মেনিয়ার মধ্যেকার বাণিজ্যিক সম্পর্কে বিঘ্ন সৃষ্টি থেকে বিরত থাকা। তিনি আজারবাইজানে তুর্কি ও পাকিস্তানি কার্যক্রম ইরানের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য তুরস্ক ও পাকিস্তানকে আহ্বান জানান। ইরানি আইনপ্রণেতা আহমাদ মাদেরি মন্তব্য করেন যে, কিছু আজারবাইজানি আইনপ্রণেতা তাদের ‘আকার ও সামর্থ্যে’র চেয়ে বড় বক্তব্য দিচ্ছেন এবং তাদের উচিত ইরানের নীরবতাকে ‘মহত্ত্বের লক্ষণ’ হিসেবে বিবেচনা করে ইরানের সঙ্গে সুপ্রতিবেশীসুলভ নীতি অনুসরণ করা, অন্যথায় ‘হাতকে দেহের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত করা হবে’। এক্ষেত্রে তিনি দেহ বলতে ইরানকে ও হাত বলতে আজারবাইজানকে বুঝিয়েছেন এবং তার এই বক্তব্যকে ইরান কর্তৃক আজারবাইজানকে দখল করে নেয়ার হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়।

মানচিত্রে আজারবাইজান এবং ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্ত; Source: Wikimedia Commons

তদুপরি, ইরানি আইনপ্রণেতা মোহাম্মাদ রেজা আহমাদি সাঙ্গারি মন্তব্য করেন যে, ‘তুর্কি মাদকে’র মাধ্যমে কারাবাখে অর্জিত বিজয়ের ফলে বাকুর নেতাদের ‘মতিভ্রম’ ঘটেছে। তিনি আরো মন্তব্য করেন যে, “তোমাদের ছোট্ট দেশের বয়স আমাদের কনিষ্ঠতম আইনপ্রণেতার বয়সের চেয়ে কম” এবং ইরানের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে নিজেদের ‘অপমানিত’ করা আজারবাইজানি আইনপ্রণেতাদের পক্ষে শোভনীয় নয়।

২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির–আব্দোল্লাহিয়ান ও আজারবাইজানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেয়হুন বায়রামভ বৈঠক করেন এবং বৈঠকের পর আমির–আব্দোল্লাহিয়ান মন্তব্য করেন যে, তৃতীয় একটি পক্ষ ইরানি–আজারবাইজানি সম্পর্কে হস্তক্ষেপ করছে। ইরানি জনসাধারণ ইসরায়েলকে এই ‘তৃতীয় পক্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করে, যেহেতু ইসরায়েল ও আজারবাইজানের মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে।

২৭ সেপ্টেম্বর আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ তুর্কি রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ‘আনাদোলু এজেন্সি’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে অনুষ্ঠিত ইরানি মহড়া প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে, প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব সীমানার মধ্যে মহড়ার আয়োজন করার স্বাধীনতা রয়েছে, কিন্তু ইরান কেন ঠিক সেই সময়ে এবং আজারবাইজানের সীমান্তেই মহড়া করছে, সেই সম্পর্কে আজারবাইজানি জনসাধারণ প্রশ্ন করছে। তিনি আরো প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, যখন আর্মেনীয়রা জাব্রাইল, ফিজুলি ও জাঙ্গিলান নিয়ন্ত্রণ করছিল, তখন এরকম মহড়ার আয়োজন করা হয়নি কেন? এই প্রসঙ্গে ২৮ সেপ্টেম্বর ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাঈদ খাতিবজাদেহ মন্তব্য করেন যে, ইরানের অভ্যন্তরে মহড়ার আয়োজন ইরানের ‘সার্বভৌম’ বিষয় এবং ইরান তাদের সীমান্তে ইসরায়েলের উপস্থিতি সহ্য করবে না।

২৯ সেপ্টেম্বর ইরানি ‘ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী’র গ্রাউন্ড ফোর্সের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মাদ পাকপুর মন্তব্য করেন যে, ইরান তার প্রতিবেশীদের ‘জায়নবাদী জান্তা’র (ইসরায়েলের) ঘাঁটিতে পরিণত হওয়া সহ্য করবে না এবং প্রতিবেশী দেশগুলো ইরানের সামরিক মহড়ার কারণ সম্পর্কে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে ভালোভাবে অবগত আছে। উল্লেখ্য, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পাকপুর তার মন্তব্যে আজারবাইজানের নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু তার মন্তব্য আজারবাইজানের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল বলেই বিবেচনা করা হয়।

ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে অনুষ্ঠিত ইরানি ‘ফাতেহান–এ–খায়বার’ মহড়ার একটি দৃশ্য; Source: Iranian Army/Anadolu Agency

ইতোমধ্যে আজারবাইজানের একটি সামরিক সমাধিক্ষেত্রে কিছুসংখ্যক আজারবাইজানি নারী ইসরায়েল ও ইহুদিদের কঠোর সমালোচনা করেন এবং এর ফলে আজারবাইজানি পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করে। এই প্রসঙ্গে ২৯ সেপ্টেম্বর প্রখ্যাত আজারবাইজানি সাংবাদিক খাদিজা ইসমাইল একটি ফেসবুক পোস্টে আজারবাইজানি পুলিশের উক্ত পদক্ষেপের নিন্দা জানান, কিন্তু একইসঙ্গে যোগ করেন যে, শহিদদের (আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধে নিহত আজারবাইজানি সৈন্যদের) পরিবারের সদস্যদের নির্দেশ দেয়া উচিত যে, তারা যেন তাদের সন্তানদের কবরগুলোকে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মক্ষেত্রে পরিণত না করেন।

৩০ সেপ্টেম্বর ইরানি সশস্ত্রবাহিনীর গ্রাউন্ড ফোর্সের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিওমার্স হায়দারি জানান যে, ইরানিরা ১ অক্টোবর থেকে ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে ইতিপূর্বে চলমান মহড়াটির দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করবে। মহড়াটির দ্বিতীয় পর্যায়ের নামকরণ করা হয় ‘ফাতেহান–এ–খায়বার’ বা ‘খায়বারের বিজয়ীগণ’। উল্লেখ্য, ৬২৮ সালে মুসলিমরা খায়বারে (বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত) সংঘটিত একটি যুদ্ধে ইহুদিদের পরাজিত করে এবং সেই যুদ্ধের নামানুসারে এই ইরানি মহড়ার নামকরণ করা হয়। একই দিন ইরানি ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশ্লেষক হোসেইন দালিরিয়ান মন্তব্য করেন যে, ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হলে ইরান আজারবাইজানকে লক্ষ্য করে ১,০০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র ছুঁড়ে তাদের ১,০০০টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। তিনি আরো যোগ করেন যে, এই যুদ্ধ একদিনেই শেষ হয়ে যাবে এবং আজারবাইজানি কর্মকর্তাদের ‘দম্ভ’কে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই।

ইরান কর্তৃক উক্ত মহড়ার আয়োজনের পর প্রথমে আজারবাইজানি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকে, কিন্তু আজারবাইজানি সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রচারমাধ্যমগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ, আজারবাইজানি ইংরেজিভাষী অনলাইন প্রচারমাধ্যম ‘আজেরি টাইমস’ এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করে যে, ইরান যদি আজারবাইজানের ওপর আক্রমণ চালায়, তাহলে পরাশক্তিরা ইরানের ওপর আক্রমণ চালানোর সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যাবে এবং ইরান এই ব্যাপারটি ভালো করেই জানে। ১ অক্টোবর আজারবাইজানি ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবী আলতায় গোয়ুশভ ইসরায়েলি–আজারবাইজানি সম্পর্ককে সমর্থন করে একটি ফেসবুক পোস্টে মত প্রকাশ করেন এবং মন্তব্য করেন যে, ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন আজারবাইজানের সঙ্গে ভালো হওয়া অল্প কিছু ঘটনার মধ্যে একটি।

একই দিনে ‘জাতীয়তাবাদী যুব সংস্থা’ নামক একটি আজারবাইজানি সংগঠনের ৪ জন সদস্য বাকুতে অবস্থিত ইরানি দূতাবাসের সামনে ইরানি জাতীয় পতাকার অবমাননা করে এবং এই ঘটনার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা লাভ করে। আজারবাইজানি পুলিশ তাদেরকে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১০০ আজারবাইজানি মানাত (বা প্রায় ৬০ মার্কিন ডলার) জরিমানা আদায় করে। মুশফিগ ভালিয়েভ নামক উক্ত চারজনের মধ্যে একজন আজারবাইজানি অনলাইন প্রচারমাধ্যম ‘এনিউজ.আজ’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন যে, আজারবাইজানিদের প্রতি ইরানের অবমাননার কারণে তারা এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

ইরানি ‘ফাতেহান–এ–খায়বার’ মহড়ার প্রত্যুত্তরে আজারবাইজানের নাখচিভানে অনুষ্ঠিত তুর্কি–আজারবাইজানি ‘আনশেকেবল ব্রাদারহুড’ যৌথ মহড়ার একটি দৃশ্য; Source: Anadolu Agency/Daily Sabah

৩ অক্টোবর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেই তার টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে করা একটি টুইটে উত্তর–পশ্চিম ইরানে ইরানি সামরিক মহড়া আয়োজনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বক্তব্য প্রদান করেন এবং মন্তব্য করেন যে, “যারা নিজেদের ভাইদের জন্য কুয়া খোঁড়ে তারা নিজেরাই কুয়ার মধ্যে পড়ে যায়!” প্রত্যুত্তরে আজারবাইজানি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মী ও ব্লগার বখতিয়ার হাজিয়েভ একটি ফেসবুক পোস্টে অভিযোগ করেন যে, খামেনেই খোলাখুলিভাবে টুইটারে আজারবাইজানকে হুমকি দিচ্ছেন! ৪ অক্টোবর আজারবাইজানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লায়লা আব্দুল্লায়েভা মন্তব্য করেন যে, ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের নিকট ইসরায়েলের উপস্থিতি সংক্রান্ত ইরানি অভিযোগ সম্পূর্ণ ‘ভিত্তিহীন’।

৫ অক্টোবর আজারবাইজানি সরকার প্রথম বারের মতো আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে ইরানি সামরিক মহড়ার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের নিকটবর্তী জাব্রাইল জেলা সফরকালে মন্তব্য করেন যে, আজারবাইজানে ইসরায়েলি সামরিক উপস্থিতি থাকার কোনো প্রমাণ নেই এবং অবশ্যই আজারবাইজানি জাতির বিরুদ্ধে আনীত এরকম ‘ভিত্তিহীন’ অভিযোগের জবাব দেয়া হবে। অবশ্য আজারবাইজানে ইসরায়েলি উপস্থিতির কথা অস্বীকার করলেও আলিয়েভ সেখানে একটি ইসরায়েলি–নির্মিত ‘হারোপ’ আত্মঘাতী ড্রোনের সঙ্গে নিজের ছবি তোলেন, যেটি আজারবাইজানে ইসরায়েলি প্রভাবের প্রতিই ইঙ্গিত বহন করে।

একই দিনে আজারবাইজানের নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রে (আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন) তুর্কি ও আজারবাইজানি সৈন্যরা ‘আনশেকেবল ব্রাদারহুড’ নামক একটি যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করে। উভয়পক্ষের সশস্ত্রবাহিনীর মেকানাইজড ও কমান্ডো ইউনিট, যুদ্ধবিমান এবং ড্রোন এই মহড়ায় অংশ নেয়। নাখচিভানের সঙ্গে ইরানের সীমান্ত রয়েছে এবং এই মহড়াটিকে ইরান কর্তৃক ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্তের কাছে আয়োজিত সামরিক মহড়ার প্রত্যুত্তর হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আজারবাইজানি প্রচারমাধ্যমের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, নাখচিভানে তুর্কি–আজারবাইজানি মহড়া শুরুর পরপরই ইরান আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে নাখচিভানে যাতায়াতকারী সামরিক বিমানগুলোর জন্য নিজের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়।

একই দিনে আজারবাইজানি সরকার বাকুতে অবস্থিত হুসেইনিয়া মসজিদ এবং বাকুতে ইরানি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খামেনেইয়ের প্রতিনিধি সাইয়্যেদ আলী আকবর ওজাঘনেজাদের কার্যালয় বন্ধ করে দেয়। আজারবাইজানি প্রচারমাধ্যমের বক্তব্য অনুযায়ী, এই ঘটনার পর ওজাঘনেজাদ ইরানে প্রত্যাবর্তন করেন। আজারবাইজানি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, কোভিড–১৯ মহামারীর বিস্তার রোধের উদ্দেশ্যে উক্ত মসজিদ ও কার্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে, কিন্তু বিশ্লেষকরা ধারণা করেন যে, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ (বামে) এবং ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির–আব্দোল্লাহিয়ান (ডানে); Source: AFP/Daily Sabah

৬ অক্টোবর ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির–আব্দোল্লাহিয়ান রাশিয়া সফর করেন এবং রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে বৈঠক করেন। স্বাভাবিকভাবেই উক্ত বৈঠকে চলমান ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্ব সম্পর্কে রুশ ও ইরানিদের মধ্যে মতবিনিময় হয়। মস্কোয় সংবাদ সম্মেলনে আমির–আব্দোল্লাহিয়ান মন্তব্য করেন যে, ককেশাস অঞ্চলে ইসরায়েলের উপস্থিতি ইরানের জন্য উদ্বেগজনক এবং ইরান এতদঞ্চলে ‘জায়নবাদী’ ও ‘সন্ত্রাসবাদী’দের উপস্থিতি কিংবা ভূরাজনৈতিক বা মানচিত্রগত পরিবর্তন সহ্য করবে না। একই দিনে আজারবাইজানি সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘সেন্টার অফ অ্যানালাইসিস অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সে’র বিশ্লেষক এসমিরা জাফারোভা তুর্কি টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ‘এনিউজ’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন যে, আজারবাইজান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং কোনো রাষ্ট্র যদি তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করে বা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে, সেক্ষেত্রে আজারবাইজানের আনুপাতিকভাবে জবাব দেয়ার অধিকার রয়েছে।

উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত ইরানি–আজারবাইজানি কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে আজারবাইজানি সরকার কার্যত আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করেছিল এবং কেবল আজারবাইজানের বিরুদ্ধে আনীত ইরানি অভিযোগগুলোর জবাব দিচ্ছিল। কিন্তু এরপর থেকে ইরানিরা অপেক্ষাকৃত নীরবতা অবলম্বন করে। অন্যদিকে, আজারবাইজানিরা ইরানের বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত আক্রমণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করে এবং আজারবাইজানি রাজনীতিবিদরা ইরানের কঠোর সমালোচনা করতে আরম্ভ করেন।

৯ অক্টোবর আজারবাইজানি সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সামরিক সংবাদ বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘ক্যালিবার.আজ’–এ একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় এবং এটিতে ইরানের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ আনা হয়। উক্ত ভিডিওতে দাবি করা হয় যে, ২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের সময় ইরানি সৈন্যরা আজারবাইজানি ভূখণ্ডে একটি সংক্ষিপ্ত ও সীমিত মাত্রার আক্রমণ চালিয়েছিল এবং এর ফলে ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে একটি গুরুতর সামরিক ও কূটনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু সেসময় উভয় পক্ষ ঘটনাটিকে গোপন রাখে। উক্ত প্রতিবেদনের দাবি অনুযায়ী, যুদ্ধের সময় ইরানি গোয়েন্দা সংস্থা ইরানি–আজারবাইজানি সীমান্ত থেকে আজারবাইজানি সৈন্যদের চলাচল পর্যবেক্ষণ করছিল এবং এসব তথ্য আর্মেনীয়দের জানিয়ে দিচ্ছিল। তদুপরি, উক্ত ভিডিওতে বেশ কয়েকবার ইঙ্গিত প্রদান করা হয় যে, ইরানি আজারবাইজানিরা ইরানের বিরুদ্ধে একটি ‘ফিফথ কলাম’ বা বিশ্বাসঘাতক শ্রেণি হিসেবে কাজ করবে।

উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনটির সত্যতা যাচাইয়ের কোনো উপায় নেই, কারণ সেটিতে এসব দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি এবং কোনো তথ্যসূত্রও উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু উক্ত প্রতিবেদনটি আজারবাইজানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর ফলে আজারবাইজানি জনসাধারণের মধ্যে ইতোমধ্যেই তীব্র হয়ে ওঠা ইরানিবিরোধী মনোভাব আরো তীব্র হয়। আজারবাইজানি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রসঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকে, কিন্তু ১২ অক্টোবর আজারবাইজানি আইনপ্রণেতা ফাজিল মুস্তাফা এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে, আজারবাইজানের উচিত আন্তর্জাতিক আদালতে ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা এবং ইরানের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা।

মানচিত্রে আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন নাখচিভান। নাখচিভান মূলত ইরানি ও আর্মেনীয় ভূখণ্ড দ্বারা পরিবেষ্টিত, অবশ্য তুরস্কের সঙ্গে নাখচিভানের একটি ক্ষুদ্র সীমান্ত রয়েছে; Source: Panonian/Wikimedia Commons

আরেক আজারবাইজানি আইনপ্রণেতা জাহিদ ওরুজ অভিযোগ করেন যে, ২৫টির বেশি ইরানি ব্যাঙ্ক এবং ৪০০টির বেশি ইরানি কোম্পানি ইরানের ওপর আরোপিত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর উদ্দেশ্যে কয়েক দশক ধরে আর্তসাখের ভূখণ্ড ব্যবহার করছে। অপর একজন আজারবাইজানি আইনপ্রণেতা জাভিদ ওসমানভ অভিযোগ করেছেন যে, বাকুতে ইরানি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনেইয়ের প্রতিনিধি ওজাঘনেজাদ আজারবাইজানে একটি ‘গুপ্তচর নেটওয়ার্ক’ পরিচালনা করেছেন এবং আজারবাইজান তাদের ঐতিহাসিক ভূখণ্ডে ইরানের ‘ধ্বংসযজ্ঞ’কে বিশ্বের সামনে প্রকাশ করছে।

১৩ অক্টোবর ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির–আব্দোল্লাহিয়ান ও আজারবাইজানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বায়রামভের মধ্যে একটি ফোনালাপ অনুষ্ঠিত হয় এবং উভয় পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সঙ্কট নিরসনের ইচ্ছা ব্যক্ত করে। এর মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে প্রশমিত করার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু কার্যত এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। ১৬ অক্টোবর ‘কমনওয়েলথ অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটসে’র রাষ্ট্রপ্রধান পরিষদের ভিডিও অধিবেশনে আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ অভিযোগ করেন যে, বিগত ৩০ বছর ধরে আর্মেনিয়া ইরানি মদদে ‘দখলকৃত’ আজারবাইজানি ভূখণ্ড ব্যবহার করে ইউরোপে মাদকদ্রব্য পাচার করেছে।

১৯ অক্টোবর আজারবাইজানি অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘দোভলাৎ তাহলুকাসিজলিক খিদমাতি’ আজারবাইজানি শিয়া ধর্মীয় নেতা ইলগার ইব্রাহিমোলুকে গ্রেপ্তার করে। ইব্রাহিমোলু ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাকুর প্রধান জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন এবং বর্তমানে তিনি আজারবাইজানি ধর্মীয় সংবাদ বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘দেয়েরলের.অর্গ’–এর সম্পাদক ও ‘সেন্টার ফর দ্য ডিফেন্স অফ ফ্রিডম অফ রেলিজিয়ন অ্যান্ড কনশায়েন্স’ নামক এনজিওর প্রধান। তিনি খোলাখুলিভাবে ইরানিপন্থী এবং চলমান ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করেছেন, এজন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। উল্লেখ্য, আজারবাইজানি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার আজারবাইজানি শিয়াদের ধার্মিক অংশকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে এবং আজারবাইজানের বর্তমান রাজনৈতিক বন্দিদের সিংহভাগকেই ধর্মীয় কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ইব্রাহিমোলুর গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে প্রখ্যাত আজারবাইজানি সাংবাদিক রাউফ মিরগাদিরভ মন্তব্য করেছেন যে, একজন শিয়া ধর্মীয় নেতা হিসেবে ইব্রাহিমোলু ইরানিপন্থী বক্তব্য দিয়েছেন বটে, কিন্তু আজারবাইজানের রাষ্ট্রীয় প্রধান ধর্মীয় নেতা ‘শায়খ–উল–ইসলাম’ আল্লাহশুকুর পাশাজাদে এর চেয়ে অনেক বেশি ইরানিপন্থী বক্তব্য রেখেছেন। একপর্যায়ে তিনি তার ইরানি ‘সহকর্মী’দের প্রতি সমর্থন প্রদানের উদ্দেশ্যে পশ্চিমা বিশ্বের বিরুদ্ধে প্রায় ‘জিহাদ’ ঘোষণা করে ফেলেছিলেন, কিন্তু তাকে কেউ কিছুই বলেনি।

আজারবাইজানি শিয়া ধর্মীয় নেতা ইলগার ইব্রাহিমোলু (কেন্দ্রে) আজারবাইজানি সৈন্যদের সঙ্গে ছবি তুলছেন। ইব্রাহিমোলুকে তার ইরানিপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল; Source: Ilgar Ibrahimoglu/Facebook via Eurasianet

সেদিন আজারবাইজানি গোয়েন্দা পুলিশ ইব্রাহিমোলুর পাশাপাশি ‘আজারবাইজানি ধর্মীয় নেতাদের সভা’ ও ধর্মবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘মায়দে.আজ’–এর ৪ জন সদস্যকেও (সারদার বাবায়েভ, জালাল শাফিয়েভ, গাদির মাম্মাদভ এবং তামকিন জাফারভ) গ্রেপ্তার করে। ইব্রাহিমোলুকে কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হয় এবং ২৬ অক্টোবর শাফিয়েভ, মাম্মাদভ ও জাফারভকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু বাবায়েভকে মুক্তি দেয়া হয়নি। বাবায়েভকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আজারবাইজানি বিশ্লেষক ও প্রাক্তন বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদ জারদুশত আলীজাদেহ আজারবাইজানি সংবাদ সংস্থা ‘তুরান’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে, এই গ্রেপ্তারগুলো চলমান ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এবং বেছে বেছে ইরানিপন্থী ব্যক্তিদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আজারবাইজানি মানবাধিকার কর্মী আনার মাম্মাদলি আজারবাইজানি সরকারের এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানান এবং মন্তব্য করেন যে, একই যুক্তিতে সুন্নি ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সৌদি আরব, তুরস্ক, কাতার ও পাকিস্তানের যোগসূত্র এবং খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

২১ অক্টোবর আজারবাইজানি সরকার বিগত সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তারকৃত দুই ইরানি ট্রাকচালককে মুক্তি প্রদান করে এবং ইরানি সরকার তাদের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। এর মধ্য দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বের তাৎক্ষণিক কারণ অপসারিত হয়। কিন্তু ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব চলতে থাকে এবং এক্ষেত্রে তুরস্ক ভূমিকা পালন করে। সেদিন একজন সাংবাদিক ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্ব সম্পর্কে তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানকে প্রশ্ন করলে তিনি মন্তব্য করেন, ইরান তাদের নিজস্ব আজারবাইজানি জনসংখ্যার প্রতি ভয়ের কারণে আজারবাইজানকে আঘাত করার মতো অবস্থানে নেই। এর মধ্য দিয়ে তিনি ইঙ্গিত করেন যে, ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে দ্বন্দ্বে ইরানি আজারবাইজানিরা ইরানের বিরুদ্ধে আজারবাইজানকে সমর্থন করবে।

ইরানি ‘সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে’র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল আলী শামখানি ইরানকে ‘সংখ্যালঘুদের স্বর্গ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে ইরানি আজারবাইজানিদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাকে নাকচ করেছেন; Source: Reuters/Al Arabiya News

প্রত্যুত্তরে ইরানি ‘সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে’র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল আলী শামখানি তার টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে টুইট করেন যে, “সেই সরকারই সংখ্যালঘুদের ভয় করে যারা তলোয়ার এবং বৈষম্য নিয়ে তাদের মুখোমুখি হয়।” এর মধ্য দিয়ে তিনি তুরস্কে কয়েক দশক ধরে চলমান তুর্কি–কুর্দি সংঘাতের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। উক্ত টুইটে শামখানি ইরানকে ‘সংখ্যালঘুদের স্বর্গ’ হিসেবে অভিহিত করেন।

২৩ অক্টোবর আজারবাইজানি সরকার আজারবাইজানে সক্রিয় ইরানি টেলিভিশন চ্যানেল ‘সাহার টিভি’ এবং ৬টি ইরানিপন্থী আজারবাইজানি ওয়েবসাইট (দেয়েরলের, মায়দে, আহলিবেয়ৎ, এহলিবেৎ, শিয়া এবং ইসলামিনসেসি) বন্ধ করে দেয়। ২৫ অক্টোবর আজারবাইজানি গোয়েন্দা পুলিশ শিয়া ধর্মতাত্ত্বিক ও বাকুতে অবস্থিত হাজি জাভাদ মসজিদের প্রাক্তন ইমাম আহলিমান রুস্তামভকে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ইরানি সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইংরেজিভাষী পত্রিকা ‘তেহরান টাইমস’ আজারবাইজানের এসব পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে। এদিকে ২৮ অক্টোবর ইরান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং ইরান আজারবাইজানি–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড এড়িয়ে আর্মেনিয়ার সঙ্গে সংযোগ রক্ষার জন্য নতুন একটি সড়কপথ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

বস্তুত ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বের এখনো অবসান ঘটেনি। উভয়পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে কঠোর বক্তব্য প্রদান কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রেখেছে, কিন্তু উভয়ের মধ্যে প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে। বিশেষত আজারবাইজানি সরকার আজারবাইজানের অভ্যন্তরে ইরানি প্রভাব হ্রাস করার জন্য বিশেষভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে এবং আজারবাইজানে ইরানি প্রভাব বিস্তারের মূল মাধ্যম তথা শিয়া ধর্মীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আঘাত হানছে। ধারণা করা যায়, ইরানের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য আজারবাইজান তুরস্ক, ইসরায়েল ও পাকিস্তানের মতো ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার করবে। অবশ্য ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে বিস্তৃত অর্থনৈতিক সংযোগ বিদ্যমান, এবং বাকু বা তেহরান কেউই সরাসরি একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে আগ্রহী নয়। এজন্য ইরানি–আজারবাইজানি দ্বন্দ্ব পূর্ণাঙ্গ সামরিক সংঘাতে রূপ নেবে, এরকম সম্ভাবনা সীমিত।

Related Articles