Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কোরিয়ান ওয়েভ: যেভাবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি

সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ

১৯৭০-এর দশকে, গণমাধ্যমের প্রধানতম উপাদান হিসেবে রেডিওর পাশাপাশি যখন টিভির উত্থান ঘটছে, ঠিক সেই সময়টায় উদ্ভব ঘটেছিল সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্বেরও। এই তত্ত্ব দাবি করত, বিশ্বের উন্নত দেশগুলো গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে তাদের সংস্কৃতি জোর করে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের মানুষদের উপর। এই দাবির মূল ভিত্তি ছিল এই যে, উন্নত দেশগুলোই মনোপলির মাধ্যমে বিশ্বের অধিকাংশ বৃহত্তম গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করত। নিজস্ব সংস্কৃতির অতি-উপস্থাপনের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের অনুকরণপ্রিয় মানুষকে প্রভাবিত করা সহজ ছিল তাদের পক্ষে।

আজকের দিনে এসেও কিন্তু এই বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক নয়, বরং ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। কেননা, যদি আপনারা বিশ্বের প্রধানতম গণমাধ্যমগুলোর দিকে তাকান, সেগুলোর বেশিরভাগই কিন্তু মনোপলির মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু মিডিয়া হাউজের অধীনে রয়েছে, এবং একটুও বিস্ময়কর নয় যে, সেগুলো মূলত যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিকই। হলিউড, ডিজনি, এমটিভি, সিএনএন, গুগল, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতো বিশ্বের অধিকাংশ গণমাধ্যমের দখল ওই যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই। এছাড়া যুক্তরাজ্যের বিবিসি, রয়টার্স কিংবা ফ্রান্সের এএফপি, এগুলো সবও কিন্তু ওই পশ্চিমা বিশ্বেই ঘোরাফেরা করছে।

সে কারণেই লন্ডনে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অভ ওয়েস্ট মিনস্টারের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিষয়ের অধ্যাপক দায়া কিষান থুসু তার ২০০৭ সালে প্রকাশিত Media on the Move বইয়ে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে প্রকাশিত বা প্রচারিত এসব গণমাধ্যমের প্রবাহকে Dominant Flow বা প্রভাবশালী প্রবাহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এবং এর মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্বেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, এখনো পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বরাবরি এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র; Image Source: Dang Ngoc Trinh

বিরুদ্ধ প্রবাহ

কিন্তু এর ব্যতিক্রম কি কিছুই নেই? গণমাধ্যমের প্রবাহ কি কেবল পশ্চিম থেকে পূর্বেই ধাবিত হয়, কখনোই পূর্ব থেকে পশ্চিমে ধাবিত হয় না? নিশ্চয়ই হয়। সেটিকে থুসু আখ্যায়িত করেছেন Contra-flow বা বিরুদ্ধ প্রবাহ হিসেবে। প্রভাবশালী গণমাধ্যমের স্রোতের বিপরীতে গিয়ে পূর্ব বিশ্বের কিছু গণমাধ্যম পশ্চিমা বিশ্বে ছড়ি ঘোরায় বলেই এমন নামকরণ। এ ধরনের কিছু বিরুদ্ধ প্রবাহের গণমাধ্যম হিসেবে আমরা নাম করতে পারি বলিউড, জি নেটওয়ার্ক কিংবা আল জাজিরার

তবে এগুলো যে পশ্চিমা বিশ্বে গিয়ে সার্বজনীন রূপ লাভ করেছে, সে দাবি করার সময় বোধহয় এখনো আসেনি। কেননা বলিউডের ব্যাপক জনপ্রিয়তা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডার মতো দেশগুলোতে আছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কারণ ওইসব দেশে প্রচুর ভারতীয় প্রবাসী থাকে। চীনের স্থানীয়দের মাঝে বলিউড ইতিমধ্যেই বেশ বড়সড় বাজার তৈরি করে ফেলেছে বটে, কিন্তু ইউরোপ বা আমেরিকায় এখনো তা পুরোপুরি হয়েছে বলা সম্ভব নয়। একই কথা ভারতীয় টিভি নেটওয়ার্ক জি টিভির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিংবা আল জাজিরাও পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছেই বেশি জনপ্রিয়। ইউরোপ-আমেরিকার স্থানীয় কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা এখনো বিবিসি-সিএনএন বাদ দিয়ে আল জাজিরায় মত্ত হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রেও দারুণ বিখ্যাত শাহরুখ খান; Image Source: Netflix

কোরিয়ান ওয়েভ

তাহলে এশিয়ার এমন কোন দেশের সংস্কৃতি রয়েছে যেটি এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের স্থানীয়দের মাঝেও আলোড়ন তুলতে ও তাদের মন জিতে নিতে সক্ষম হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে যে কয়টি নাম আসবে, তাদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হলো কোরিয়ান সংস্কৃতি। কেন এ দাবি করছি, তা ব্যাখ্যা করতে আমরা উদাহরণ হিসেবে দেখাতে পারি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চিত্র, যেহেতু এই দুইটি দেশকে পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুইটি দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে বেড়েছে জাপানি ও কোরিয়ান ভাষা শিক্ষার প্রবণতা; Image Source: The Modern Language Association of America

সম্প্রতি এই পরিসংখ্যানটি প্রকাশ করেছে Modern Language Association of America. তারা দেখাতে চেয়েছে যে ২০০৬ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিদেশী ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের হার কেমন ছিল। এবং যেমনটি আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই দশ বছর সময়কালের মধ্যে আমেরিকান শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেবল দুইটি ভাষা শিক্ষার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি হলো জাপানি, অপরটি কোরিয়ান। বিশেষ করে ২০০৯-১৩ সময়কালের মধ্যে কোরিয়ান ভাষা শিক্ষার প্রতি আগ্রহটা ছিল চোখে পড়ার মতো। এ সময়ে কোরিয়ান ভাষা শিক্ষা কোর্সে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল পুরো ৪৫.১ শতাংশ। ২০১৩-১৬ সময়কালেও এ আগ্রহ কমেনি, বরং তখন কোরিয়ান ভাষা শিক্ষা কোর্সে শিক্ষার্থী বেড়েছিল আরো ১৩.৭ শতাংশ।

হঠাৎ করে আমেরিকানদের মাঝে কোরিয়ান ভাষা শিক্ষার প্রতি এমন আগ্রহ কেন, সে প্রশ্নের উত্তর জানার আগে আমরা নজর ফেরাতে পারি যুক্তরাজ্যের দিকে। গত গ্রীষ্মে লন্ডনে চিত্র প্রদর্শনী করেছিলেন কোরিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পী লি বুল। চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসে লন্ডনে জাঁকজমক পূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে মিউজিক ও ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। মে মাসেই ওয়েলসে পালিত হয়েছে প্রথমবারের মতো কোরিয়ান দিবস, এবং এমন একটি দিবস আগামী বছর পালিত হবে ম্যানচেস্টারেও। যুক্তরাজ্যের যেকোনো শহরে গেলেই বর্তমানে চোখে পড়বে কোরিয়ান রেস্টুরেন্টও।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে কোরিয়ান ভাষা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ থেকে শুরু করে কোরিয়ান শিল্প-সংস্কৃতির প্রচার কিংবা কোরিয়াকে আলাদা করে এত বেশি সম্মান প্রদর্শন, এর পেছনে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় অবদান কোরিয়ান ওয়েভের। এবং এক্ষেত্রে কোরিয়া বলতে কিন্তু আমরা দক্ষিণ কোরিয়াকেই বোঝাচ্ছি, উত্তর কোরিয়া নয়। দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বৈশ্বিক উত্তরের উন্নত ও ধনী দেশগুলোর মানুষের আগ্রহেরই জানান দেয় উপরের দুইটি দৃশ্যপট।

দক্ষিণ কোরিয়া চেয়েছে কোমল ক্ষমতা দিয়ে বিশ্বজয় করতে; Image Source: Li Feng/China Daily

কোমল ক্ষমতা দিয়ে বিশ্বজয়

প্রভাবশালী মাধ্যম প্রবাহের বিরুদ্ধ স্রোতে গিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ান সংস্কৃতি যে এত বড় ঢেউ তুলে ফেলল, তা কোনোভাবেই দুর্ঘটনা বা কাকতালীয় ঘটনা নয়। ১৯৫০-এর দশকে কোরীয় যুদ্ধের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া। উত্তর কোরিয়ার প্রতিক্রিয়া হয়তো একদমই ভিন্ন ছিল, কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া খুব ভালো করেই জানত যে, অর্থনীতি বা সামরিক শক্তির মাধ্যমে তাদের পক্ষে পশ্চিমা বিশ্বকে টেক্কা দেয়া সম্ভব হবে না। তাই তারা তাদের প্রধান হাতিয়ার করতে চেয়েছিল Soft Power বা কোমল ক্ষমতাকে

কোমল ক্ষমতার মূল কথা হলো, “Attract and co-opt, rather than coerce,” অর্থাৎ কাউকে জোর করে বা বাধ্য করে নয়, তারা চেয়েছিল আকর্ষণ ও সহযোজনের মাধ্যমে অন্যের মন জয় করতে। আর আধুনিক যুগে এমন আকর্ষণ-সহযোজন তো প্রধানত সংস্কৃতির মাধ্যমেই সম্ভব। তাই দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান রসদও ছিল ওই সংস্কৃতি।

প্রথম কোরিয়ান ওয়েভ

প্রথম কোরিয়ান ওয়েভের সূচনা, এবং এই নামকরণের উদ্ভব, দুই-ই ঘটেছিল ১৯৯০-এর দশকে। ওই সময়ে গোটা এশিয়ার মতো দক্ষিণ কোরিয়াও যখন গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কিম দায়ে জং একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জাতীয় নীতি হাতে নেন যে, সংস্কৃতির উপর প্রধান আলোকপাত করতে হবে, এবং সংস্কৃতিই দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

কোরিয়ান ওয়েভ স্থানীয়ভাবে পরিচিত Hallyu নামে; Image Source: Korea.net

কিম দায়ে জংয়ের সেই নীতি তখন অনেকটাই সফল হয়েছিল। সঙ্গীত, টেলিভিশন সিরিজ এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় সংস্কৃতি ক্রমশই ব্যাপ্ত হতে থাকে পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এবং ভিয়েতনাম, চীন, তাইওয়ান, জাপান ও হংকং-এর মতো প্রায় কাছাকাছি সংস্কৃতি সমৃদ্ধ দেশগুলোতে। ১৯৯২ সালে দক্ষিণ কোরিয়া চীনের সাথে একটি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, যার ফলে ১৫০ মিলিয়ন চীনা নাগরিক দেখতে ও শুনতে শুরু করে কোরিয়ান টিভি ড্রামা এবং পপ মিউজিক। সেটিই ছিল প্রথম দৃষ্টান্ত যখন দক্ষিণ কোরিয়ানরা তাদের সংস্কৃতির ব্যাপকতা উপলব্ধি করেছিল।

নিজেদের দেশে কোরিয়ান সংস্কৃতির এই অসাধারণ জনপ্রিয়তা দেখে ১৯৯৮ সালে একটি চীনা পত্রিকা একে একটি বিশেষ পরিভাষায় সংজ্ঞায়িত করে, যার নাম Hallyu, অর্থাৎ কোরিয়ান ওয়েভ। নামটি পছন্দ হয় দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়েরও। পরের বছর তারা একটি মিউজিক সিডি প্রকাশ করে Hallyu—Song From Korea শিরোনামে। আর এভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে যায় Hallyu বা কোরিয়ান ওয়েভ কথাটি।

দ্বিতীয় কোরিয়ান ওয়েভ

দ্বিতীয় কোরিয়ান ওয়েভটি আসে ২০১২ সালে। সাইয়ের সেই গ্যাংনাম স্টাইলের কথা কার না মনে আছে! ইউটিউবে ঝড় তোলা সেই গানসহ আরো অসংখ্য কে-পপের আকস্মিক উত্থান কোরিয়ান ওয়েভকে নিয়ে যায় আরো বড় ও বিস্তৃত গ্লোবাল অডিয়েন্সের কাছে। এবার এমনকি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকাতেও দক্ষিণ কোরিয়ান সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা গড়ে ওঠে। ওই ২০১২ সালেই কে-পপ প্রবেশ করে ইউএস বিলবোর্ডের টপ-১০০ এবং অফিশিয়াল ইউকে টপ ৪০ সিঙ্গেলস চার্টে।

কোরিয়ান সংস্কৃতির প্রতি এই উন্মাদনা কেবল কে-পপের সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে খাদ্য, চলচ্চিত্র, টিভি ড্রামা, ভাষা, সাহিত্য, অনলাইন গেমস, অ্যানিমেশন, প্রযুক্তি, ফ্যাশন, কসমেটিক্স এমনকি কোরিয়ান ঐতিহ্যবাহী জীবনাচরণেও।

কোরিয়ান ব্যান্ড বিটিএস; Image Source: Getty Images

কেন কোরিয়ান সংস্কৃতি এত জনপ্রিয়?

কোরিয়ান সংস্কৃতির জনপ্রিয়তার কারণ তাদের কনটেন্ট। কোরিয়ান সংস্কৃতির প্রায় সকল উপাদানেই একটা আড়ম্বরপূর্ণ, চটকদার ব্যাপার বিদ্যমান, যা সহজেই সাধারণ দর্শককে বিমোহিত করে ফেলে। যেমন ধরুন গানের বিষয়টি। কোরিয়ান গানের কথা বা লিরিক হয়তো খুব গভীর বা অর্থপূর্ণ থাকে না। কিন্তু গানগুলোর সুর ও লয় যেমন খুবই ছন্দময়, তেমনই সেগুলোর সাথে নাচের কোরিওগ্রাফিও সমান আকর্ষণীয় ও মজাদার। তাই সাময়িক বিনোদনের মাধ্যমে মনকে চাঙ্গা করে তুলতে এসব গানের কোনো তুলনা হয় না।

আবার কোরিয়ান সোপ অপেরাগুলোও খুব বেশি আলো ঝলমলে। বাজেটের কোনো কমতি রাখা হয় না সেগুলো বানাতে। কোরিয়ান ড্রামার একেকটি এপিসোড বানাতেই ব্যয় হয় গড়ে দুই লক্ষাধিক মার্কিন ডলার করে। হিস্টোরিক্যাল ড্রামা হলে কখনো কখনো বাজেট এর দ্বিগুণও হয়ে যায়। অর্থাৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে এক চিলতেও কার্পণ্য করে না তারা। শেষ পর্যন্ত যে ফলাফলটা পর্দায় দেখা যায়, তা চুম্বকের মতো আকৃষ্ট করে সৌন্দর্যপিপাসু দর্শককে।

কে-ড্রামায় বরাবরই থাকে একটা জাঁকজমকপূর্ণ ব্যাপার; Image Source: Netflix

দর্শকের সৌন্দর্য পিপাসা আরো মেটাতে পারে যে জিনিসটি, তা হলো কোরিয়ান অভিনেতাদের চেহারা। বিশ্বের অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিতে কেবল নারী অভিনেতাদের চেহারাকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু কোরিয়ান ড্রামা বা চলচ্চিত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ পুরুষ অভিনেতারাও। তাদেরকে বলা হয় ফুলবালক। একদম নিখুঁত চেহারার সেই অভিনেতাদের পর্দা উপস্থিতিও বিশ্বব্যাপী নারী দর্শকদের কাছে কোরিয়ান ড্রামা বা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে আরেকটি বড় হাতিয়ার।

প্রযুক্তির ভূমিকা

প্রযুক্তি যে বিশ্বব্যাপী আন্তঃরাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানে বিশেষ ভূমিকা রাখে, সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এবং এর একটি বাস্তবধর্মী প্রতিফলন ঘটেছে কোরিয়ান ওয়েভের ক্ষেত্রে। কোরিয়া সাংস্কৃতিকভাবে যতই সমৃদ্ধ হোক না কেন, প্রযুক্তিগত দিক থেকেও যদি তারা সমান সফল না হতো, তাহলে কোরিয়ান ওয়েভ আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছাত না।

সেই যে ১৯৯০-এর দশকে প্রথম কোরিয়ান ওয়েভ ঘটেছিল, তার কারণ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই ছিল যথেষ্ট উন্নত। তাই তারা বিভিন্ন প্রযুক্তি, বিশেষ করে স্যাটেলাইটকে কাজে লাগিয়ে তাদের সংস্কৃতির যথাযথ রপ্তানি করতে পেরেছে।

আর প্রযুক্তির ভূমিকা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে দ্বিতীয় কোরিয়ান ওয়েভের ক্ষেত্রে। ইউটিউব যদি না থাকত, গ্যাংনাম স্টাইল কি একটি গ্লোবাল ফেনোমেননে পরিণত হতে পারত? পারত না। আবার কোরিয়ার বিভিন্ন পণ্য যেমন পোশাক, কসমেটিক্স, খেলনা এগুলো যে নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বাইরেও প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি করেছে, তার কারণ উইচ্যাটের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। উইচ্যাটের মাধ্যমেই কোরিয়ান পণ্য সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে চীনে।

এদিকে নেটফ্লিক্স, আইফ্লিক্সের মতো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর কারণেই কোরিয়ান চলচ্চিত্র ও ড্রামা সিরিজগুলো বৈশ্বিক দর্শকের হাতের নাগালে পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালের কোরিয়ান-আমেরিকান চলচ্চিত্র ওকজা নেটফ্লিক্সে আসার পর কোরিয়ান চলচ্চিত্রের প্রতি পশ্চিমা দর্শকদের বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল, যার সূত্র ধরে এখন নেটফ্লিক্সে প্রচারিত হচ্ছে বেশ কিছু কোরিয়ান অরিজিনাল ড্রামা। এগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য কে-ড্রামারও বিশাল ভক্তগোষ্ঠী তৈরি হয়ে গেছে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই।

বিশ্বজয় করেছে দক্ষিণ কোরিয়ান অনলাইন গেমগুলোও; Image Source: PUBG Corporation

ভিডিও গেমিং শিল্পেও কোরিয়া যে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশে পরিণত হয়েছে, তা-ও তো প্রযুক্তির আশীর্বাদেই। দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ভিডিও গেমের বাজার। তাছাড়া বর্তমানে গোটা বিশ্ব বুঁদ হয়ে আছে পাবজিসহ আরো অনেক কোরিয়ান ভিডিও গেমে, যার অধিকাংশই অনলাইনভিত্তিক।

কোরিয়ান ওয়েভের প্রভাব

একটি দেশ যখন তার সংস্কৃতির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করে, তার বিভিন্ন ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবও দেশটিতে পড়ে। তবে কোরিয়ান ওয়েভের ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার উপর ইতিবাচক প্রভাবই পড়েছে বেশি।

প্রথম প্রভাবটি অবশ্যই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে। গণমাধ্যমই বিশ্বের কাছে দেশটির সবচেয়ে বড় পরিসরে প্রতিনিধিত্ব করছে, তাই দেশটির অনেক মানুষ এখন পেশা হিসেবে এই সেক্টরকেই সবচেয়ে লাভজনক বলে মনে করছে।

আবার বাইরের দেশের কাছে দক্ষিণ কোরিয়ার ভাবমূর্তিও প্রভাবিত হচ্ছে কোরিয়ান ওয়েভের মাধ্যমে। ২০১২ সালে বিবিসির এক জরিপ থেকে জানা যায়, ইতিপূর্বে রাশিয়া, চীন, ভারত ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাপারে সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ‘কিঞ্চিত নেতিবাচক’। কিন্তু বর্তমানে তা ‘সাধারণত ইতিবাচক’-এ পরিণত হয়েছে।

ইতিবাচক হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার ভাবমূর্তি; Image Source: Getty Images

অর্থনীতিতেও পড়ছে ব্যাপক প্রভাব। সার্বিকভাবে কোরিয়ান ওয়েভের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি কতটুকু লাভবান হচ্ছে, তা হয়তো নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে আমরা একটি উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি শুধু কোরিয়ান ব্যান্ড বিটিএসের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি কতটুকু লাভবান হচ্ছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে হিউন্দাই রিসার্চ ইনস্টিটিউট এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বিটিএসের মাধ্যমে প্রতি বছর দেশটির অর্থনৈতিক মূল্যমান তৈরি হচ্ছে ৩.৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার করে, এবং সেই সাথে প্রতি বছর আরও যোগ হচ্ছে ১.২৬ বিলিয়ন অতিরিক্ত মূল্যমান। আর একদম সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন বলছে, বিটিএসের অর্থনৈতিক প্রভাব এই মুহূর্তে আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৯ বিলিয়ন ডলারে। ধারণা করা হচ্ছে মোট ১০ বছর সময়কালে বিটিএসের অর্থনৈতিক প্রভাব পৌঁছে যাবে ৪৯.৮ বিলিয়ন ডলারে।

এছাড়া কোরিয়ান ওয়েভের ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার পর্যটন শিল্পও মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯৬ সালে দেশটিতে মাসিক পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ লাখের মতো, যা বর্তমানে ১৫ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বেশ অনেক কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠছে দক্ষিণ কোরিয়া ভ্রমণে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। কোরিয়ান ফুটবলার সন হিউং মিন যখন জোড়া গোলের সুবাদে নিশ্চিত করেন এ বছরের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে টটেনহ্যাম হটস্পারের উত্তরণ, সাথে সাথে কয়েক হাজার স্পার্স ভক্ত তাদের গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে নিশ্চিত করে ফেলে দক্ষিণ কোরিয়ার নাম।

আর সবশেষ উত্তর কোরিয়ার সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্কেও প্রভাবক ভূমিকা পালন করছে কোরিয়ান ওয়েভ। দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোহ মু-হিউন আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে, কোরিয়ান ওয়েভের মাধ্যমে হয়তো দুই কোরিয়াকে আবারো একত্র করা সম্ভব হবে। কিন্তু তার এই আশায় জল ঢেলে দেয় উত্তর কোরিয়ার প্রশাসন। দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে তারা নিজ দেশের জনগণের জন্য ক্ষতিকর বলে অভিহিত করে, এবং বিভিন্ন দক্ষিণ কোরিয়ান গণমাধ্যম ও অনুষ্ঠানকে নিষিদ্ধও করে।

তবে উত্তর কোরিয়ার সাধারণ মানুষের মনে কিন্তু ইতিবাচক দাগই কেটেছে কোরিয়ান ওয়েভ। উত্তর কোরিয়ার সরকার দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্কে যেসব নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে থাকে, কোরিয়ান ওয়েভ দ্বারা প্রভাবিত উত্তর কোরিয়ার সাধারণ মানুষ সেগুলোকে নাকচ করে দিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে আসার দৃষ্টান্তও রয়েছে অনেক। সর্বোপরি, কোরিয়ান ওয়েভের প্রভাবে উত্তর কোরিয়ার মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি।

বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/

This article is in Bengali language. It is about how Korean Wave made South Korean culture worldwide popular. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © YouTube

Related Articles