ভারতীয় উপমহাদেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ইউরোপ-আমেরিকার প্রতি রয়েছে প্রবল আকর্ষণ। উন্নত দেশগুলোতে তাদের স্থায়ীভাবে আবাসন গড়ার প্রচেষ্টাও চোখে পড়ার মতো। এর কারণ শুধুমাত্র অগ্রণী নাগরিক সুবিধা আর অত্যাধুনিক জীবনমানই নয়। বরং সুন্দর পরিবেশ, দূষণমুক্ত প্রকৃতি ও মনোরম আবাসিক এলাকাগুলোও রুচিশীলদের আকৃষ্ট করে।
এশিয়া মহাদেশের চীন, জাপান, সিঙ্গাপুরে মতো দেশগুলো যথেষ্ট আধুনিক হলেও বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ভারতের নাগরিক জীবনে এখনো ইউরোপীয় ধাঁচের উন্নয়ন আসেনি। তা এই দেশগুলোর গ্রামাঞ্চল দেখলেই বোঝা যায়।
তাই কখনো যদি এশিয়ার সবচাইতে পরিষ্কার গ্রামের নাম প্রকাশ করা হয়, তবে নিশ্চয়ই সেটা ভারতীয় উপমহাদেশের কোথাও হবে না, এমনটাই ভাবছেন তো? ভাবাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জেনে অবাক হবেন, এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম মাওলিন্নঙ-এর অবস্থান ভারতেই।
এশিয়ার অন্যান্য উন্নত দেশের পরিকল্পিত গ্রামগুলো ছাপিয়ে মেঘালয় রাজ্যের ছোট্ট মাওলিন্নঙ কী করে সবচেয়ে পরিষ্কার হওয়ার তকমা পেল? সেই বিষয়েই জানানো হবে আজকের এ লেখায়।
মাওলিন্নঙ
মেঘালয়ের রাজধানী থেকে প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত মাওলিন্নঙ। ছোট্ট এই গ্রামটি ভারতের আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মাঝে অন্যতম। প্রতিদিন এখানে দেশি-বিদেশী বহু দর্শনার্থী আসেন, বিশেষ করে বর্ষার মৌসুমে মাওলিন্নঙ হয়ে ওঠে প্রকৃতিপ্রেমীদের মিলনমেলা।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রামটি কয়েক বছর আগেও ছিল অখ্যাত। মূলত আলোচনায় আসে ২০০৩ সালের পর, ভ্রমণ ম্যাগাজিন ‘ডিসকভারি ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে, যেখানে মাওলিন্নঙকে এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এরপর ২০০৫ সালে, ভারতের সর্বাধিক পরিচ্ছন্ন গ্রামের স্বীকৃতি পায় এ গ্রাম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য খ্যাতি হঠাৎ করে এলেও তাদের এ পথচলা শুরু আরো অনেক আগে। সচেতনতা, শিক্ষা আর দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলেই গ্রামটি আজ ভারতবর্ষের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।
এই গ্রামের একটি শিশু ঘুম থেকে উঠে প্রথমে নিজের ঘর ও বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার করে, তারপর স্কুলে যায়। নিজ নিজ দায়িত্বে রাস্তাঘাটের ময়লা সাফাই করার কাজে অংশ নেয় স্থানীয় সকলেই। কোথাও কোনো আবর্জনা পড়ে থাকলে যে কারো চোখে পড়া মাত্রই তা তুলে নিয়ে যথাস্থানে ফেলে আসে।
রাস্তার মোড়ে মোড়ে আছে বাঁশের তৈরি ডাস্টবিন যেন পথচারীরা হেঁটে যাওয়ার সময় যেখানে সেখানে ময়লা না ফেলে। এরপরেও কেউ ইচ্ছে করে কিছু নোংরা করলে তাকে পেতে হয় কঠিন শাস্তি। আর পর্যটকরা আইনভঙ্গ করলে জরিমানা করা হয় তাদেরও, সেই অর্থ আবার ব্যয় হয় পরিচ্ছন্নতার কাজেই। ডাস্টবিনের ময়লা ও প্রতিদিনের জমানো আবর্জনা দিয়ে তৈরি করা হয় জৈব সার। সেখানকার গ্রামবাসীরা গাছ লাগাতে ভালোবাসে, ফলে নিজেদের তৈরি সার কাজে লাগে শখের বৃক্ষরোপণে। এতে আবর্জনা থেকে দূষণ তো হয়ই না, বরং তা পরিবেশ রক্ষার কাজে লাগে।
মাওলিন্নঙ গ্রামে ধূমপান একেবারে নিষিদ্ধ। সেই সাথে নেই কোনো প্লাস্টিকের ব্যাবহার। গ্রামবাসীরা যেমন পরিচ্ছন্নতার ব্যপারে গুরুত্ব দেয়, তেমনি পরিবেশ রক্ষার দিকেও সচেতনতার কোনো অন্ত নেই তাদের। শুধু কি তা-ই? শিক্ষাদীক্ষায়ও এ গ্রামের বাসিন্দারা গোটা ভারতে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে চলেছে। ২০১৫ সালে বিজনেস ইনসাইডার কর্তৃক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাওলিন্নঙে স্বাক্ষরতার হার শতভাগ।
আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শতভাগ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। ভারতের প্রেক্ষাপটে একরকম অভাবনীয় ব্যাপার। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান বলে, ভারতের গ্রামগুলোতে এখনো শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ যথাযথ স্যানিটেশনের আওতায় নেই। কিন্তু মাওলিন্নঙে বাড়ি বানানোর আগে তৈরি করা হয় শৌচাগার।
যদিও এ গ্রাম মেঘালয়ের পাহাড়ঘেরা এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত, তবুও সুশৃঙ্খল নিয়ম আর সদিচ্ছার কারণেই তারা হতে পেরেছে গোটা ভারতবর্ষের কাছে অনুকরণীয়। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও তা ঘোষণা দিয়ে বলেছেন। এমনকি ২০১৬ সালে মাওলিন্নঙকে আদর্শ হিসেবে সামনে রেখে ‘ক্লিন ইন্ডিয়া প্রোগ্রাম’ ক্যাম্পেইনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে পুরো ভারত জুড়ে।
মাওলিন্নঙের সমাজ-সংস্কৃতি
২০১৯ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, মাওলিন্নঙ গ্রামের মোট অধিবাসী ৬০০ জন; রয়েছে ৯৫টির মতো পরিবার। তাদের সকলেই জাতিগতভাবে খাসিয়া, তবে ধর্মীয়ভাবে খ্রিষ্টান।
খাসিয়া সমাজে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। তাদের পরিবারপ্রধান হন একজন নারী। সন্তানদের নামের শেষে যুক্ত থাকে মায়ের উপাধি, মায়ের পরিচয়েই বড় হয় তারা। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রেও মেয়েদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। মাওলিন্নঙ গ্রামেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না। বিয়ের পর বর চলে আসে কনের বাড়িতে। অবশ্য এ প্রথায় স্বামীকে কটাক্ষ করে ‘ঘরজামাই’ বলা হয় না, তাদের সমাজে এটিই স্বাভাবিক নিয়ম।বিয়ের পর নারীর বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় মাতৃবাস।
মাওলিন্নঙয়ের অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। কেউ কেউ অবশ্য বর্ষার মৌসুমে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী বনে যায়, কারণ তখন থাকে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। তাই বছরের এ সময়ে বেচাকেনাটাও হয় বেশ ভালোই। বর্ষা ছাড়াও মেঘালয় রাজ্যের বিভিন্ন আঞ্চলিক উৎসব উপলক্ষে দর্শনার্থীদের কম-বেশি আনাগোনা লেগে থাকে। আর মেঘালয় ঘুরতে গেলে অধিকাংশ পর্যটকই মাওলিন্নঙ গ্রামে ঘুরে আসে; এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম বলে কথা!
মাওলিন্নঙের দর্শনীয় স্থানগুলো
বেশিরভাগ পর্যটকই আসেন ছোট্ট এই গ্রামের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা একবার স্বচক্ষে অবলোকন করতে। পুরো ভারতবর্ষ কিংবা মেঘালয় রাজ্যের তুলনায় মাওলিন্নঙে অনেক বেশি দর্শনীয় স্থান নেই ঠিক, তবে পাহাড়ের গা ঘেঁষা এই জায়গাটি প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক দুর্দান্ত প্যাকেজ। স্থানীয়রা এ গ্রাম সম্পর্কে বলেন, ‘ঈশ্বরের বাগান’। তাই মাওলিন্নঙে ঘুরতে গেলে হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। মনোমুগ্ধকর আর বিশেষ কিছু দেখার মতো জায়গাও আছে সেখানে।
প্রথমেই বলতে হবে, জীবন্ত গাছের শেকড় দিয়ে তৈরি সেতুর কথা। নদীর দু’পাশে ছড়িয়ে থাকা রাবার গাছের শেকড়গুলো একসাথে জুড়ে দিয়ে তারপর লম্বা সময় ধরে পরিচর্যা করে বানানো একেকটি সেতু, যেগুলো আজও টিকে আছে প্রকৃতির অপার বিস্ময় হয়ে। বর্তমানেও পুরনো পদ্ধতি অনুসারে জীবন্ত শেকড় দিয়ে সেতু গড়ছে মেঘালয়ের খাসিয়ারা।
তবে এ কাজ যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। একটি সেতু সম্পূর্ণ চলাচলের উপযোগী হতে ১৫ বছরেরও বেশি সময় লাগে। মেঘালয় রাজ্যে বর্তমানে এরকম ১১টি সেতু রয়েছে, যার মধ্যে মাওনলিন্নঙের পাশেও রয়েছে একটি। ইতোমধ্যেই এই সেতুগুলোকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে ইউনেস্কো। তাই এ গ্রামে ঘুরতে গেলে প্রকৃতির উপাদান কাজে লাগিয়ে মানুষের তৈরি এমন শিল্পকর্ম দেখতে ভোলে না কেউই।
এ গ্রামের আরও একটি আকর্ষণীয় স্থান হলো ‘স্কাই ভিউ পয়েন্ট’। বাঁশ দিয়ে তৈরি ৮৫ ফুট উঁচু এ টাওয়ারে উঠলে পুরো গ্রামের এক চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। আর তাছাড়া গ্রামটি যেহেতু ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে, তাই এখান থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায় দুই দেশের পাহাড়সমূহের এক অসাধারণ মিলনমেলা। এছাড়াও খাসিয়া আদিবাসীর বৈচিত্র্যময় জীবন, তাদের খাবার, সংস্কৃতি, শতবর্ষ পুরনো এপিফ্যানি চার্চ, মেঘালয়ের মেঘছোঁয়া পাহাড় বিমোহিত করে ঘুরতে আসা পর্যটকদের। সবকিছু মিলিয়ে ছোট্ট গ্রামটি যেমন ভারতবাসীর কাছে অনুপ্রেরণার নাম, তেমনি দেশি-বিদেশী ভ্রমণপিপাসুদের কাছেও এক বহুল কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য।
পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় চ্যালেঞ্জ
দক্ষিণ এশিয়াতে এমন অনেক গ্রাম রয়েছে, যেগুলো মাওলিন্নঙের মতোই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গোছানো। তবে ভারতে এরকম আর একটিও গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঠিক এ কারণেই মাওলিন্নঙ ভারতবর্ষের কাছে পরিচ্ছন্নতার এক অনন্য নিদর্শন। কিন্তু, ভারতীয়রা কি আদৌও তাদের এই রত্নতুল্য গ্রামটি রক্ষার ব্যাপারে সচেতন? উত্তর হলো, একদমই না। মাওলিন্নঙে ঘুরতে গেলেই এর প্রমাণ মিলবে।
প্লাস্টিক, ধূমপান, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পর্যটকরা এসবের তোয়াক্কা করে না। প্লাস্টিকের বোতল, সিগারেটের প্যাকেটসহ বিভিন্ন ময়লা রাস্থার আশেপাশে পড়ে থাকতে দেখা যায়। যদিও গ্রামের চারপাশে রয়েছে অসংখ্য ডাস্টবিন, কিন্তু দর্শনার্থীরা যেন অনেকটা শখ করেই নোংরা করেন।
যদিও অপরিচ্ছন্নতার দায়ে কিছু দর্শনার্থীর কাছ থেকে জরিমানা সংগ্রহ করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কারো যদি স্থানীয়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে পরিবেশ নোংরা করার ইচ্ছে থাকে, তবে তা কোনোভাবেই আটকানো যায় না। মাওলিন্নঙে ঘুরতে আসা বিদেশী পর্যটকদের সংখ্যা কম। পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, বিহারের মতো পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো থেকেই আসে অধিকাংশ দর্শনার্থী। বেশিরভাগ সময় বিদেশীরা আইন মানলেও দেশীয় পর্যটকরা তা মানে না।
এছাড়াও স্থানীয়ভাবে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ হলেও গ্রামটির দোকানগুলোতে রয়েছে প্যাকেটজাত চিপসের মতো অগণিত পণ্য। এসব পণ্য থাকে প্লাস্টিকেরই প্যাকেটে।
মাওলিন্নঙের অধিবাসীরা তাদের গ্রামকে ‘স্বর্গরাজ্য’ খেতাব দিয়েছিল। একসময় এর সুনাম ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এর ফলে অনুপ্রাণিত হয়ে মাওলিন্নঙের মতো আরও একটি গ্রাম গড়ে ওঠেনি, বরং দিনে দিনে জনসমাগম বাড়তে থাকায় আজ মাওলিন্নঙই হুমকির মুখে। এভাবে চলতে থাকলে স্থানীয়রা খুব বেশিদিন ‘ঈশ্বরের বাগান’ খ্যাত এই গ্রামের সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারবে না।