উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে আধুনিক রাষ্ট্রের সূত্রপাত ঘটে এবং সমগ্র ইউরোপের গণতন্ত্রায়ন হয়। রাষ্ট্র এবং জনগণের সম্পর্ক নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হয়। রুশ বিপ্লবী মিখাইল বাকুনিন তার ‘গড অ্যান্ড দ্য স্টেট’ বইতে সমাজের নৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিপূর্ণতা কীভাবে আসে তা খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
বিপ্লবের জন্য রাশিয়ার সেনাবাহিনী ছেড়ে চলে আসা বাকুনিন ছিলেন আজন্ম বিপ্লবী। রুডলফ রকার বাকুনিনকে অভিহিত করেন আধুনিক নৈরাজ্যবাদ আন্দোলনের স্রষ্টা হিসেবে। নৈরাজ্যবাদীদের মতো বাকুনিনের মধ্যেও ছিল ‘সকল জবরদস্তিমূলক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে মুক্ত সমাজের আকাঙ্ক্ষা।’ নৈরাজ্যবাদীরা ব্যক্তির চেয়ে সমাজকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, ব্যতিক্রম ছিলেন না বাকুনিনও।
উদারনৈতিক তাত্ত্বিকরা যেদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ব্যক্তিকে সমাজের পূর্ববর্তী হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন, বাকুনিন তা অস্বীকার করে বলেছেন, ব্যক্তি মূলত সমাজেরই সৃষ্টি। ব্যক্তি যেহেতু সমাজের সৃষ্টি, সেহেতু ব্যক্তি তার ব্যক্তিস্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে সমাজের মধ্যে থেকেই। সমাজের বাইরে গিয়ে একা একা সে ব্যক্তিস্বাধীনতা উপভোগ করতে পারবে না। সমাজে তার মতো ব্যক্তিদের স্বীকৃতিদানের মাধ্যমেই সে নিজে চূড়ান্ত স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে। সমাজের একটি বিরাট অংশকে পদানত ও দাসত্বের মধ্যে রেখে নিজের স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব নয়। সমাজের বাদবাকি সকলের উপস্থিতিতে ও পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমেই ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়।
ব্যক্তিস্বাধীনতার মধ্যে বাকুনিন দুটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। একটি হলো: এই ব্যক্তিস্বাধীনতা সম্পূর্ণ সামাজিক, অপরটি হলো: এটি সম্পূর্ণ নেতিবাচক। নেতিবাচক এই অর্থে যে, এটি সকল ধরনের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রেরণা দেয়। এটি সকল কর্তৃত্বকে নাকচ করে দেয়। এই কর্তৃত্ব যেমন ধর্মের বা ঈশ্বরের স্বৈরশাসনের, ঠিক তেমনি মানুষের স্বৈরশাসনেরও। বাকুনিন যেমন চার্চকে বাতিল করে দিয়েছেন, তেমনি রাষ্ট্র বা স্টেটকেও বাতিল করে দিয়েছেন। বাকুনিনের মতে, রাষ্ট্র সে যে তন্ত্রই অনুসরণ করে চলুক না কেন, হোক সেটি গণতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র, তার কার্যাবলী সবসময় একরকমই থেকে যায়। খারাপ মানুষের জায়গায় ভালো মানুষ থাকলেও রাষ্ট্র শুধরে যায় না। রাষ্ট্র সর্বদা টিকে থাকে গণশোষণ এবং অল্প কিছু মানুষের বিশেষাধিকারের মাধ্যমে।
বাকুনিন ধর্মকে আক্রমণ করেছেন এই বলে যে, ধর্ম হচ্ছে হ্যালুসিনেশনের মতো, যার সাহায্যে জনগণকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা যায় এবং ক্ষমতাবানরা তাদের অবস্থান ধরে রাখে। হতভাগ্য মানুষেরা তাদের অধিকার না পেয়ে ঈশ্বরে বিশ্বাসের মাধ্যমে শান্তি খুঁজতে যায়। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস মানুষের চিন্তাশক্তিকে নষ্ট করে দেয়, ফলে মানুষের আসল মুক্তি ধর্মের মাধ্যমে আসতে পারে না। ভলতেয়ারের বাণী, ‘যদি কোনো ঈশ্বর না-ও থাকেন, তবে তাকে আবিষ্কার করা প্রয়োজন,’-কে সত্য প্রচার করতে রাজা, পুরোহিত, রাজনীতিবিদদের মতো ক্ষমতাবানরা জনগণের চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখে। তাই মানুষের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজন ধর্মবিশ্বাসের বিনাশ।
তার মতে- স্বাধীনতা সেটিই যার ফলে ব্যক্তি যেকোনো সময় যেকোনো সিদ্ধান্ত, সেটি যত ছোটই হোক না কেন, তা নিতে পারে। বাইবেলের অ্যাডাম ও ইভের ঘটনাকে উল্লেখ করে বাকুনিন বলেন, স্রষ্টা তাদেরকে গাছের ফল খেতে নিষেধ করে দিয়েছিল, কেবল প্রভুর ইচ্ছা ছাড়া জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে নিষেধের আর কোনো কারণ ছিল না। ঈশ্বরের কাছ থেকে এটি এক ভয়াবহ স্বেচ্ছাচার, আমাদের আদিপুরুষ সে কথা শুনলে আমাদেরকে আজও হয়তো দাস হিসেবে থাকতে হতো। মূলত তারা ঠিক কাজই করেছে, তাদের অবাধ্যতাই আমাদেরকে স্বাধীন করেছে, আমাদেরকে মুক্ত করেছে।
কেবল ধর্মই না, মানুষের তৈরি রাষ্ট্রও জনগণকে দাস বানিয়ে রাখে বলে বাকুনিন মত দিয়েছেন। মানুষ যতদিন পর্যন্ত প্রকৃতির নিয়ম জানত না, ততদিন সব আইন-কানুন ঠিক ছিল। বাকুনিন এজন্য রাষ্ট্রকে এক প্রয়োজনীয় অভিশাপ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতিকে সম্পূর্ণভাবে বোঝার পর মানুষ নিজের বোধকে কাজে লাগিয়েই প্রকৃতির সমস্ত নিয়ম মেনে চলতে পারে, এজন্য রাষ্ট্রের মতো বহিরাগত কর্তৃত্বের আর প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্র বিভিন্ন আইন-কানুন বানিয়ে জনগণকে শিকল পরিয়ে রাখে। বাকুনিনের মতে, রাষ্ট্র যখন ভালো কাজ করতে যায়, তখন সেটি খারাপ দিকেই মোড় নেয়, কারণ তখন মানুষ কোনো চাপে পড়ে ভালো কাজ করতে চায় না বা পারে না, বরং স্বতস্ফূর্তভাবেই তার মধ্যে ভালো কাজ করার তাগিদ চলে আসে। সে কাজ করে তার মধ্যে কাজ করার প্রেরণা আছে বলেই, কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকে বলেই। এছাড়াও, ব্যক্তির সমস্ত বস্তুগত, নৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির চাবিকাঠিও সমাজের মধ্যে লুকিয়ে আছে বলে মনে করেন বাকুনিন, কারণ ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল জমিনই হচ্ছে সমাজ।
ক্ষমতা এবং দুর্নীতি
বাকুনিন বর্তমান সমাজে বিদ্যমান রাষ্ট্র পরিচালনার প্রক্রিয়াকে প্রশ্ন করেছেন। তার মতে, সমাজ পরিচালনার ভার থাকা উচিত সাধু-সন্তদের হাতে অথবা সাধু-সন্তদের দ্বারা নির্বাচিত ব্যক্তির কাছে। কিন্তু সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সমাজে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকা উচিত কার হাতে? কে হবে আইনের প্রহরী এবং শৃঙ্খলার রক্ষক? বাকুনিনের মতে, সাধারণ মানুষের সর্বদাই কুচিন্তার দিকে স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে। যদি রাষ্ট্রকে ঠিকভাবে টিকিয়ে রাখতে হয়, তবে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও সদাচারী ব্যক্তিদের বাছাই করতে হবে, কিন্তু সর্বদা সমান সংখ্যক একই ধরনের বুদ্ধিমান ও সদাচারী মানুষ পাওয়া সম্ভব নয়। যদি ব্যক্তিরা সদাচার না হয়, তবে তারা ব্যক্তিস্বার্থের জন্য তার ক্ষমতাকে কাজে লাগাবে, অন্যদিকে সদাচার হলেও যদি বুদ্ধিমান না হয়, তবে সমাজকে ঠিকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হবে।
বাকুনিনের মতে, সমাজের রক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পেলেও এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে থাকলেও জানাশোনা মানুষও একপর্যায়ে গিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা একসময় সত্য খোঁজার আকাঙ্ক্ষা হারিয়ে ফেলে, তার বদলে তারা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে, যে কারণে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার ফলে মানুষের হৃদয় এবং মন দূষিত হয়ে পড়ে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সত্যজিৎ রায় পরিচালিত গণশত্রু (১৯৯০) চলচ্চিত্রের ড. অশোক গুপ্তের রাজনীতিবিদ ভাই নিশীথ গুপ্তের কথা, যিনি একইসাথে মিউনিসিপ্যালিটির প্রধান। মন্দিরের দূষিত পানি পান করে জনগণ অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকলেও মন্দিরটি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অন্যতম আয়ের উৎস হওয়ায় সেটি খোলা রাখেন তারা। সৎ ডাক্তার অশোক গুপ্ত তা প্রকাশ করতে চাইলেও তাকে বাধা দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। অর্থাৎ, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জানাশোনা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের স্বার্থের কারণে তারা জনগণকে বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞ করে রাখে। বাকুনিনের তত্ত্বের ‘দূষিত মনের প্রিভিলেজড ম্যান’-এর একটি আদর্শ উদাহরণ এই নীতিশ গুপ্ত।
রাষ্ট্রের মধ্যে থাকা আমলা বা জনগণকে চালিত করা ব্যক্তিদের এই বিশেষ সুবিধা পাওয়ার ফলে যখন তারা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে তখনই সমাজে পচন ধরে এবং সমাজের ক্রমাগত উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। যে কারণে বাকুনিন রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছেন। নৈরাজ্যবাদীদের দর্শনের মূলভিত্তি এটিই, যেটি তাদের মতে মানুষের স্বাধীনতার আসল পথ।
রাষ্ট্র সম্পর্কে বাকুনিনের সমাধান হচ্ছে, ‘রাষ্ট্রের সবচেয়ে যোগ্য ও সক্ষম লোকদের হাতে সর্বোচ্চ শাসন ক্ষমতা অর্পণ করার জন্য আগে সমাজের সকল নাগরিককে সুবুদ্ধি ও ন্যায়বোধের অধিকারী হতে হবে এবং তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে সবসময়। রাষ্ট্রের অধিকাংশ নাগরিকেরই এই সক্ষমতা আছে। এখন তাদের প্রয়োজন সামষ্টিক নৈতিক বিকাশ ও সংস্কৃতির সর্বোচ্চ পর্যায়, যেখানে সরকার এবং রাষ্ট্র একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। তাদের নিজেদের স্বাধীনতা ভোগ করার মতো জ্ঞান ও সততা তাদের মধ্যে আছে।’
বাকুনিনের এই তত্ত্বকে অবশ্য বেশিরভাগ তাত্ত্বিকই ইউটোপীয় ধারণা হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন। তাদের মতে, বাকুনিন মানুষের প্রতি বেশি ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। জাঁক দ্যুক্লোর মতে, ‘হতাশার মুহূর্তে লোকে যেসব কারণে ধর্মে সান্ত্বনা খুঁজতে যায়, সেই একই কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের সময়ে এ ধরনের নৈরাজ্যবাদী ইউটোপীয় ধারণার প্রসার বাড়ে।’