দক্ষিণ আমেরিকার আয়তনে সবচেয়ে বড় এবং সম্পদের প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ দেশ ব্রাজিল। ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার, ফুটবল, পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় কার্নিভাল, অ্যামাজন রেইন ফরেস্ট, বিশ্বের সবচেয়ে বড় কফি উৎপাদনকারী দেশ, দুনিয়া মাতানো অনন্য সুন্দরী মডেল; অনেক কারণেই ব্রাজিল আমাদের কাছে পরিচিত। আরেকটি কারণে ব্রাজিল বিশ্বের অন্য অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে আর তা হলো দুর্নীতি। অর্থনীতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ব্রাজিলের দুর্নীতি।
কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে যখন, ২০১৪ সালে শুরু হওয়া ছোট্ট একটি মানি লন্ডারিং ঘটনার তদন্তে ব্রাজিলের সাবেক ৫ প্রেসিডেন্ট, প্রতি ৩ জনের মধ্যে ১ জন কেবিনেট মন্ত্রী এবং প্রতি ৩ জনের ১ জন সিনেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশ যেমন পেরু, কলাম্বিয়া, ডমিনিকান রিপাবলিক, কিউবা, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, এল-সালভাদর, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, আর্জেন্টিনা, পানামা এসব দেশে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে।
এসবের শুরুটা ছিল খুবই সাধারণ। যেখানে ব্রাজিলের পুলিশ একটি মানি লন্ড্রারিং চক্রকে উন্মুক্ত করতে চাচ্ছিলো। যেখানে বিভিন্ন ছোট ছোট ব্যবসা যেমন গ্যাস স্টেশন – যেগুলো সাধারণত কার ওয়াশের জন্য ব্যবহৃত হয় সেগুলোকে ব্যবহার করে কালো টাকা পাচার করা হচ্ছিল। অনেকদিন ধরেই পুলিশ তাদের গতিবিধি নজরে রাখছিল, ফোন ট্যাপ করছিল। যার ফল হিসেবেই আলবার্তো ইউসেফ নামের একজন অর্থ পাচারকারী ধরা পড়ে।
মূলত ব্রাজিলের দুর্নীতিপূর্ণ রাজনৈতিক সাম্রাজ্যের পতন এখান থেকেই। আলবার্তো ইউসুফ ব্রাজিলের কোর্টের কাছে আবেদন নিষ্পত্তির জন্য একটি চুক্তিতে আসে যার পরিবর্তে তিনি এই ঘটনার সাথে জড়িত সকলের নাম প্রকাশ করবেন বলে কথা দেন। তিনি বলেন, তিনি কোনো পেশাদার অর্থ পাচারকারী নন বরং ব্রাজিলের সরকারি তেল কোম্পানি ‘পেট্রোব্রাস’ এর এক্সিকিউটিভের হয়ে এই কর্মকান্ড পরিচালনা করছিলেন। যার মাধ্যমে পরবর্তীতে এর দুইজন কার্যনির্বাহী পরিচালক গ্রেফতার হন।
এখান থেকেই পুলিশ ধারণা করে যে, তারা যা মাথায় নিয়ে তদন্ত শুরু করেছিলেন ঘটনার গভীরতা আসলে তার থেকে অনেক বিশাল। বলে রাখা ভালো, পেট্রোব্রাস হলো বিশ্বের প্রথম ২০টি পেট্রোলিয়াম কোম্পানির একটি যার ব্রাজিল থেকে শুরু করে পুরো লাতিন আমেরিকায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে।
তদন্তে এও বেরিয়ে আসে যে, পেট্রোব্রাস শুধুমাত্র একটি পেট্রোলিয়াম কোম্পানিই নয়, বরং এর ভেতরে তারা বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মকে বড় অংকের ঘুষের বিনিময়ে কন্ট্রাক্ট দেয়, বিভিন্ন অপরাধ যেমন মানি লন্ডারিংকে উদ্বুদ্ধ করা। এমনকি ব্রাজিল সরকারের অনেক বড় একটি অংশকে নিয়ন্ত্রণও করে পেট্রোব্রাস। ঘটনার শুরু হয়, যখন ব্রাজিল সরকার রাজধানী রিও ডি জেনিরোর সীমান্তে ইটাবোরাই শহরে ‘কম্পারিশ’ নামের ব্রাজিলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এনার্জি প্রজেক্ট নির্মাণ কাজ হাতে নেয়। যার জন্য পেট্রোব্রাস বিভিন্ন কোম্পানির (ইনফ্রাস্ট্রাকচার) কাছ থেকে টেন্ডারের আহ্বান করে।
সাধারণত কোম্পানিগুলো যেভাবে নিলামের মাধ্যমে কাজ নেয়, এটা ছিল তার থেকে একেবারেই ভিন্ন। এখানে কোম্পানিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে তদন্ত করার বদলে নিজেদের মধ্যে একটি চুক্তিতে আসে যে, তারা পালাবদল করে সরকারের একেকটি কাজ হাতে নিবে। এভাবে কাজ পাওয়ার জন্য তারা পেট্রোব্রাস ও অন্যান্য অংশীদার এবং রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারক পর্যন্ত যখন যেখানে প্রয়োজন হয়েছে ঘুষের টাকা পৌঁছে দিয়েছিল।
শুধু টাকা আদান-প্রদানের মাধ্যমেই নয়, দামি গাড়ি, রোলেক্স ঘড়ি, মূল্যবান ওয়াইন, হেলিকপ্টার, বিলাসবহুল জাহাজ – বিভিন্ন উপঢৌকনের মাধ্যমে ঘুষ দেয়া হতো। এছাড়া বিশাল অংকের টাকা সুইস ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছিল আর বাকি টাকা এই ছোট ছোট গ্যাস স্টেশনের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দেয়া হতো। দুর্নীতির মাত্রা এমন চরমে পৌঁছে গিয়েছিল যে, যে প্রজেক্টের বাজেট ধরা হয়েছিল ৬ বিলিয়ন ডলার, কাজ শুরুর দুই বছরের মাথায় তার পেছনে ব্রাজিল সরকার ১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে ফেলে।
অপারেশন কার ওয়াশ অনেক দিক থেকেই ব্রাজিলের গণতন্ত্র এবং ন্যায়-বিচার পুনরুদ্ধারের প্রতি একটি বিশাল মাইলফলক। এটি একটি সফল তদন্ত ছিল যার মাধ্যমে ব্রাজিল সরকার এবং বড় বড় কর্পোরেশনগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে আসে। যার ফলস্বরূপ, ব্রাজিলের বিপুল জনপ্রিয় কমিউনিস্ট নেতা এবং দুইবারের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দ্য সিলভাকে (যিনি লুলা নামে অধিক পরিচিত) ১২ বছরের সাজা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। তার পরপরই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট দিলমা রউসেফকে অপসারিত করা হয় এবং তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মিশেল টেমারকে অন্য একটি মামলায় দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।
এক কথায়, ব্রাজিলের পুরো সরকার ব্যবস্থা এই একটি মানি লন্ডারিং স্ক্যাম অপারেশনের কারণে ভেঙ্গে পড়ে। এছাড়াও এই তদন্ত থেকে উন্মোচিত হওয়া অন্যান্য অপরাধের তদন্ত করতে গিয়ে পেরুর প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে, ইকুয়েডরের ভাইস-প্রেসিডেন্টকে জেলে পাঠানো হয়েছে।
কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতার এখানে শেষ নয়। যার কারণে এই অপারেশন শুরু হয়েছিল, তিনি হলেন ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, ট্রেভর জাভাস্কি। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি না থাকলে কোন অপারেশন কার ওয়াশই হতনা এবং তার কারণেরই পুরো ব্যাপারটি এতদূর পর্যন্ত এসেছিল। বলাই বাহুল্য, তিনি ব্রাজিলের রাজনৈতিক দলগুলোর চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। শেষ পর্যন্ত, ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি, রিও ডি জেনিরো থেকে ১৫০ মাইল দূরে সমুদ্রে ভূপাতিত হয়ে একটি বিমান দুর্ঘটনায় জাভাস্কির মৃত্যু হয়।
শুরুতে এটাকে স্বাভাবিক বিমান দুর্ঘটনা মনে হলেও, সন্দেহের দানা বাঁধতে থাকে যখন বিমান যাত্রীর তালিকায় জাভাস্কির নাম উঠে আসে। এখন পর্যন্ত তার মৃত্যুর রহস্যের সমাধান করা যায়নি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জাভাস্কির মৃত্যুর পরও লেবার পার্টির সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট, মিশেল টেমার তার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি।
বরং, এরপর ব্রাজিলের আরেকজন ফেডারেল বিচারক, সার্জিও মোরো, এই বিচারকাজ এগিয়ে নিয়ে যান। এতে তিনি ব্রাজিলের সাধারণ মানুষের চোখে রীতিমত বীরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে অবমাননা, মৃত্যুর হুমকি – এতকিছুর পরও মোরো সমসময় মিডিয়া এবং সাধারণ জনগণের কাছ থেকে বিপুল সমর্থন পেয়েছেন।
শুধু রাজনৈতিক নয়, গত কয়েক বছর ধরে ব্রাজিল বিরাট অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিরাট কম্পারিশ প্রজেক্টে যে ১০,০০০ লোকের কাজ করার কথা ছিল, তারা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গেছে। পেট্রোব্রাস এবং এই স্ক্যান্ডালের সাথে জড়িত যত ছোট-বড় কোম্পানি ছিল তাদের আরো অনেক প্রজেক্ট ব্রাজিল সহ পুরো লাতিন আমেরিকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল। যার অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে গেছে অথবা বন্ধ হওয়ার পথে।
এই ভয়াবহ স্ক্যান্ডাল উন্মোচনের ৪ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কম্পারিশ পেট্রোলিয়াম প্ল্যান্ট শুরু হয়নি, ক্ষতিগ্রস্তরা কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি, ব্রাজিলের রাজনীতি পুরোটাই দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। কবে, কিভাবে ব্রাজিলের মানুষের দুর্দশার আকাশে সূর্য উঠবে তা হয়তো একমাত্র সময়ই বলে দেবে।