বৈচিত্র্যময়তার দিক থেকে সমস্ত পৃথিবীতে ভারতবর্ষের জনবসতির জুড়ি মেলা ভার। এখানে যে কত ধর্ম আর বর্ণের মানুষ আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আছে অগণিত আদিবাসীও। আর্য, অনার্য, দ্রাবিড়, শক, হুন, পাঠান, মোগল, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- সব মিলে হরিহর আত্মা। বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসী আর নৃগোষ্ঠীর সাথে আমরা সকলেই কম-বেশি পরিচিত। ঠিক তেমনটি আমাদের পাশের দেশ ভারতেও রয়েছে।
‘শবর’ নামটি খুব বেশি মানুষের কাছে পরিচিত নয়। শবর কোনো একজনের নাম নয়, এটি একটি জনগোষ্ঠীর নাম। বর্তমানে ভারতে এই শবর জনগোষ্ঠী একটি অন্যতম সমস্যা হিসেবে প্রভূত হয়েছে, অবশ্য তাতে শবরদের হাত নেই। জগতের নিয়ম সম্ভবত এমন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা দিনে দিনে আরও বড় হয়, আর সংখ্যালঘুরা দিনকে দিন পড়ে পড়ে মার খায়। শবররা আর দশটা অধিবাসীর মতোই ভারতের অধিবাসী। কিন্তু তাদের ঘিরে রয়েছে অগণিত বিতর্ক। কিন্তু কেন? এই শবররা আসলে কারা?
শবর জাতির ইতিহাস
শবর কথাটির উৎপত্তি হয়েছে ‘সগর’ থেকে। স্কাইথিয়ান ভাষায় ‘সগর’ শব্দের অর্থ হলো কুঠার। বোঝাই যাচ্ছে, শবররা কুঠার হাতে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। সেখান থেকেই শবর নামটির প্রচলন হয়। শবররা বাস করেন পশ্চিম বাংলা, চেন্নাই, মধ্যপ্রদেশ, ছোটনাগপুর আর উড়িষ্যায়। ইদানীং ত্রিপুরা জেলাতেও কয়েক ঘর শবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ শাসনের মাঝামাঝি শবররা বাংলাদেশের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমদিকে যাযাবর থাকলেও পরবর্তীতে চা শ্রমিক হিসেবে কাজ নেন তারা। মৌলভীবাজার জেলার হরিণছড়া, রাজঘাট ও নন্দরাণী এলাকায় শবরদের দেখা মেলে। আমাদের দেশে বর্তমানে শবরদের সংখ্যা ২,০০০ এর কিছু বেশি।
আজকের দিনে শবরদের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, শবরদের অতীত অনেক গৌরবের। প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারত, রামায়ণ, হর্ষচরিত, চর্যাপদ আর পুরাণে শবরদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাহিত্য কিংবা লোকগাঁথা ছাড়াও ধর্মচর্চায়ও শবররা মর্যাদার দাবিদার। বলা হয়ে থাকে, পুরীর জগন্নাথ নাকি এই শবরদেরই দেবতা। জগন্নাথের এই লীলাভূমি সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীর পবিত্র স্থান। চর্যাপদে শবরদের সম্পর্কে লেখা আছে, “উঁচা উঁচা পাবত তোঁহি বসতি শবরী বালি”।
শবরদের বর্তমান
এককালে মাথা উঁচিয়ে বেঁচে থাকা শবরদের বর্তমান অবস্থা কেমন? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে হলে আপনাকে চলে যেতে হবে ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শাসনামলে। কেননা তখনই প্রথম শবরদের জাতিগত অস্তিত্বে আঘাত আসে। বন থেকে বিভিন্ন আদিবাসী ও নৃ-গোষ্ঠীদের উচ্ছেদ করতে থাকে ইংরেজরা। অরণ্যের গভীরে বাস করা শবররা তখন দিশেহারা হয়ে পড়ে। কেউ বেছে নেয় যাযাবর জীবন। কেউ বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং চা বাগানে কাজ নেয়। তবে অভাব-অনটন আর কাজের অভাবে অনেকেই বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। ক্রুদ্ধ ইংরেজরা ১৯১৬ সালে শবরসহ বেশ কিছু জাতিকে ‘অপরাধপ্রবণ আদিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। সেই চিহ্ন তারা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে কোনো কারণ ছাড়াই।
শবররা যে শুধু ইংরেজদের অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছে তা নয়। তারা নিপীড়িত হয়েছে নিজেদের মানুষদের দ্বারাই। বর্ণবাদী হিন্দু, সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদী শক্তির সাথে শবরদের লড়তে হচ্ছে নিত্যদিন। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারত সরকার তাদের ‘ডিনোটিফাইড ট্রাইব’ বা বিমুক্ত জাতি হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয় না।
অস্পৃশ্য হিসেবে আখ্যায়িত করে শবরদের সমস্ত সামাজিক কার্যক্রম থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। তাই মূল সমাজ থেকে তারা এখন অনেক দূরে। জঙ্গলনির্ভর শবররা এখন বেশিরভাগই কর্মহীন, কেননা গাছ কাটা বেআইনী। তারা বেশিরভাগই কৃষিকাজ বা পশুপালনের কাজ পারেন না। ফলে অধিকাংশই অনাহারে জর্জরিত জীবনযাপন করে। কাগজে-কলমে ভূমিহীন না হলেও বাস্তবে শবরদের নিজেদের কোনো জমি নেই।
পশ্চিমবঙ্গের আমলাশোল এলাকায় প্রসিদ্ধ কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী মহাশ্বেতা দেবী শবরদের গ্রাম দেখতে যান এবং সেখানে বেশ কিছু কাজ করেন। সেই সঙ্গে যান ডক্টর দীপক কুমার। ডক্টর দীপক সেখান থেকে ফিরে এসে তার ‘আমলাশোলের দিনলিপি’ বইটি লিখেন, যেখানে বর্ণিত হয় শবরদের দুঃসহ জীবন। শবরদের গ্রামগুলোতে মানুষের জন্মহারের তুলনায় মৃত্যুহার অনেক বেশি। শিশু মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৫০ জনেরও বেশি। প্রতি ১,০০০ পুরুষ পিছু নারীর সংখ্যা অনেক বেশি, এমনকি শিশুদের মাঝেও মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের চাইতে অনেক কম। এর কারণ জৈবিকভাবে কোনো এক বিচিত্র কারণে শবর ছেলেশিশুরা মেয়েদের চেয়ে দুর্বল হয়ে জন্ম নেয়।
যেসব শিশুরা বেঁচে থাকে, তারা প্রকারান্তরে আরও অভাগা। দুদিন পর একদিন ভরপেট খেতে পায় তারা, সারা বছর অপুষ্টি আর অনাহারে ভুগতে থাকে। বাড়ির বড়রা মদের নেশায় পেটের জ্বালা ভুলে থাকতে চায়, কিন্তু শিশুদের সেই সুযোগটা নেই। সামাজিক অক্ষমতা আর অমর্যাদার জন্য শবররা অন্যান্য গোষ্ঠীর চোখেও নিচু। মুন্ডারা শবরদের প্রতিবেশী গোষ্ঠী, কিন্তু তাদের কাছেই হেয় হতে হয় নিত্যদিন। মুন্ডারা বলে, শবরদের যেহেতু জমি নেই, তাই তাদের কোনো সম্মানও নেই।
তবে এসবের চাইতেও ভিন্ন রকমের সমস্যায় শবরদের প্রতিনিয়ত লড়তে হয়। কিছুদিন পর পরই বর্ডার গার্ড আর পুলিশ হানা দেয় শবরদের গ্রামে। প্রায় নির্বিচারে বাসিন্দাদের মাওবাদী সন্দেহে তুলে নিয়ে যায় অথবা মাওবাদীদের আশ্রয়দাতা সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ধরে নিয়ে যায়। আর জিজ্ঞাসাবাদকালে চলে কারেন্টের শক, মারধোর আর কানের ভেতর পেট্রোল ঢেলে দেওয়ার মতো অবর্ণনীয় সব অত্যাচার। শুধু তা-ই নয়, আশেপাশে কোথাও কোনো চুরি-ডাকাতি, খুন বা ছোটখাট ঝামেলা হলেও সবার আগে শবরদের দিকে আঙ্গুল তোলে প্রশাসন।
শবরদের সামাজিক অবস্থান
আগেই বলা হয়েছে, শবররা প্রতিনিয়ত অস্পৃশ্যতার অত্যাচারে জর্জরিত হতে থাকে, যে কারণে গোটা সমাজ থেকে শবররা আলাদা। ডঃ দীপক কুমার আমলাশোলে গিয়ে আবিষ্কার করেন, সেখানে সুবিধাবঞ্চিত ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর জন্য ভিন্নধর্মী স্কুল ‘বেড়াভেঙ্গে বিদ্যালয়’ নির্মিত হয়েছে। স্থানীয় মুন্ডা আর অন্যান্য আদিবাসী বাচ্চারা সেখানে পড়াশোনা করলেও শবর ছেলেমেয়েদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। কারণ শবররা অস্পৃশ্য আর নিচু জাত। তাই তাদের পড়তে নেওয়া হয় না। শবরদের কোনো ধরনের কাজেও নেওয়া হয় না।
শবররা অস্পৃশ্য বলে তারা কর্মহীন, কর্মহীন বলে ভূমিহীন, আর ভূমিহীন বলে তারা সামাজিক মর্যাদাহীন। তারা বাজারের দিকে যেতে চায় না, হাসপাতালের পথ মাড়ায় না। স্কুলে পড়া তাদের জন্য বিলাসিতা। শবরদের জন্য দেওয়া সরকারি ত্রাণ খরচ না হয়েই ফেরত চলে যায়। শবর-শবরীদের আর্ত চিৎকার শোনার মতো আসলে কেউই নেই। তাদের কথা অনুযায়ী, সরকার টাকা দিয়ে পুলিশ রেখে মারধোর করাতে পারলেও, তাদের উন্নয়নের জন্য কিছুই করা হচ্ছে না।
শবরদের নিয়ে গবেষণা করার পর বেরিয়ে আসে অনেকগুলো ভয়াবহ তথ্য। ২০১৬ সালে ‘ওয়ার্ল্ড জার্নাল অব ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাসিটিউকাল সায়েন্সেস’ জার্নালে শবর ও সাঁওতালদের পুষ্টি বিষয়ক একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। ৪টি গ্রামের ওপর করা এই সমীক্ষায় জানা যায়, লোধা শবর রমণীদের ৩৩.৩ শতাংশই অপুষ্টিতে ভোগেন। এখানকার মানুষজনের মধ্যে যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, রক্তস্বল্পতা, কলেরা, চর্মরোগ ইত্যাদি লেগেই থাকে। আধুনিক চিকিৎসার চাইতেও ওঝাদের ঝাড়-ফুঁক আর শেকড় বাকড়ের ওপর ভক্তি বেশি তাদের। কারণ গ্রাম থেকে হাসপাতালের দূরত্ব এতই বেশি যে সেখানে নিতে নিতেই রোগী ইহকাল ত্যাগ করেন। আর যাতায়াতের ভাড়া দেবার সামর্থ্য তো নেই-ই।
শবরদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থা
এবার জেনে নেওয়া যাক শবরদের কিছু রীতিনীতি, যা সময়ের সাথে মোটামুটিভাবে অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। শবররা বেশিরভাগই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। লক্ষ্মীদেবী ও মঙ্গলচণ্ডী তাদের পারিবারিক দেবী, যাদের জন্য মন্দিরে বেদী নির্দিষ্ট করা থাকে। দুর্গোৎসব, দোলযাত্রা, ফাগুয়া ইত্যাদি তাদের প্রধান উৎসব। পূজা-পাঠ, বিবাহ এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে হিন্দু ব্রাহ্মণরাই পুরোহিতের কাজ করেন।
বর্ণ বিভেদ তাদের মাঝে কঠিনভাবে বিদ্যমান। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য প্রমুখ জাতির কাছ থেকে তারা খাদ্য গ্রহণ করেন, আবার নিজেদের চেয়ে নিচু জাতির কাছ থেকে তারা আবার ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলেন। সমস্ত শবর সমাজ আবার ছোট ছোট কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত। যেমন- বড়ভুক্ত, ছোটভুক্ত, নায়েক, কোটাল, আখারি ইত্যাদি।
শবর জনগোষ্ঠী হিন্দু ধর্ম আর আদি ধর্মের মতোই মৃতদেহ দাহ করে। নিজেদের মধ্যে নাপিত, ধোপা প্রভৃতি বিভাজন নেই। তাই অশৌচ পালনের সময় নিজেরাই নিজেদের মাথার চুল মুড়িয়ে নেয়। বিশেষ করে নাপিত জাতটি তাদের মাঝে আলাদা করে নেই বলেই তাদের উঁচু জাতের লোকজন অনেক বেশি হেয় করে।
উন্নয়নের রথের চাকার তলায় দিনকে দিন পিষ্ট হচ্ছে উঁচু উঁচু পাহাড় পর্বত। সবুজ গাছগাছালি দলিত-মথিত হয়ে পড়ছে। আকাশচুম্বী দালান তৈরি তো হচ্ছে, কিন্তু তাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কোনো লাভ হচ্ছে না; সেটা ভারত হোক বা বাংলাদেশ। আদিবাসীরা তো এই পরিবেশে বাঁচে না, তাদের উন্নয়ন করতে হলে তাদের অস্তিত্বকে বুঝতে পারা চাই। শবররা তাই প্রতিদিন মরতে মরতে বাঁচছে। এত কিছুর পরও তারাও স্বপ্ন দেখে, একদিন নিশ্চয়ই তারা তাদের মর্যাদা পাবে। জঙ্গলে বাস করার গৌরব নিয়ে আবারও তারা তাদের আগের ঐতিহ্য ফিরে পাবে।