সিঙ্গাপুরের জাতিগত দিক থেকে নির্দিষ্ট কয়েকটি শিক্ষা, বিশ্বাস ও আদর্শ রয়েছে। সিঙ্গাপুরের নাগরিকরা এসব বিশ্বাস সম্পর্কে পরিবার থেকেই জানতে পারে। তবে পূর্বে দেশটিতে এই বৈশিষ্ট্যগুলো একত্রে কোথাও লিপিবদ্ধ করা ছিল না। ১৯৯১ সালের ১৫ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরের সরকার নিজেদের জাতীয় পরিচয়কে যথাযথ বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলি দিয়ে প্রকাশ করার প্রয়াস চালায়। মূলত পাঁচটি বিশ্বাস বা বৈশিষ্ট্যকে ‘দ্য শেয়ারড ভ্যালুস’ বা ‘ন্যাশনাল ভ্যালুস অব সিঙ্গাপুর’ বলে। এগুলো দেশটির বহুসংস্কৃতি ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, পূর্বপুরুষদের বিশ্বাস, মনোভাব, আচার-আচরণের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। আর এসব বিশ্বাস বা আদর্শ স্কুলে শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের আদর্শগুলোকে একসাথে নিয়ে সরকারিভাবে একটি সেট বা লিপি প্রকাশের জন্য সর্বপ্রথম গোহ চোক টং উপদেশ দেন। ১৯৮৮ সালের ২৮ অক্টোবর পিপলস অ্যাকশন পার্টির ইউথ উইংয়ে ভাষণ দিতে গেলে তিনি এসব আদর্শ লিপিবদ্ধ করার গুরুত্ব সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন।
সেই সময়ে তিনি দেশটির সহকারী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি এই বক্তৃতায় নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার ভাষ্যমতে, সিঙ্গাপুরের অধিবাসীরা ধীরে ধীরে দেশের প্রতি নিজেদের দায়িত্ব হারিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। আর এর পেছনে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব দায়ী বলে তিনি মনে করেন। গোহ চোক টং ধারণা করছিলেন, এই ধরনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ একসময় সিঙ্গাপুরের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোকে গ্রাস করে ফেলবে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ এবং জাতীয় প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে করে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জাতীয় জীবনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এসব নেতিবাচক ফলাফল প্রতিরোধ করতে চাইলে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো ধরে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। সিঙ্গাপুরের সমাজব্যবস্থা উন্নত করার তাগিদে গোহ নিজ দেশের ভাবাদর্শকে একত্রে প্রকাশ করার প্রস্তাব দেন। তবে সেই সময়ে তার পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন করা হয়ে ওঠেনি।
১৯৮৯ সালের ৯ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি উই কিম উই আবারও নিজেদের আদর্শগুলোকে লিপিবদ্ধ করে সরকারিভাবে প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জানান। আর সেই সময়ে পরিস্থিতি আরো প্রতিকূলে ছিল।
সিঙ্গাপুরের অনেকেই পশ্চিমা দেশগুলোর বৈশিষ্ট্য বা আদর্শ অনুসরণ করা শুরু করেছিল। ফলশ্রুতিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এবং আত্মকেন্দ্রিক হতে শুরু করে। সেগুলো ছিল সিঙ্গাপুরের তথা এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী সমাজব্যবস্থা, নৈতিকতা এবং দায়িত্ববোধের বিরুদ্ধে। উই পাঁচটি ‘শেয়ারড ভ্যালুস’- এর কথা বলেন:
১) সমাজের স্বার্থকে নিজের স্বার্থের চেয়েও বেশি মর্যাদা দেওয়া,
২) পরিবারকে সমাজ গঠনের মৌলিক উপাদান হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া,
৩) সামাজিক সহায়তা ও ব্যক্তিবিশেষের প্রতি শ্রদ্ধা,
৪) কোনো সমস্যার সমাধান তর্ক না করে সর্বসম্মতি অনুসারে করা এবং
৫) জাতিগত ও ধর্মীয় ঐক্য এবং সঙ্গতি রক্ষা করা।
এসব আদর্শ বা শিক্ষা সিঙ্গাপুরের পরিচিতিকে পরিশুদ্ধ রাখতে সহায়তা করে। সিঙ্গাপুরে জাতিগত বৈচিত্র্যের কোনো অভাব নেই। তারা সকলের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসকে সমান গুরুত্ব দিতে সর্বাধিক চেষ্টা করে; সেটা জতিগত হোক কিংবা ধর্মীয়।
দ্য শেয়ারড ভ্যালুস
১) সম্প্রদায়ের আগে দেশ এবং নিজের আগে সমাজ
এই ভ্যালুর দুটি অংশ আছে। সিঙ্গাপুরের আদর্শ বলে নিজের সম্প্রদায় বা বর্ণের স্বার্থের পূর্বে নিজের দেশের স্বার্থ পূরণ করতে হবে। সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের মানুষের বসবাস রয়েছে। স্বভাবতই সবাই নিজ নিজ বর্ণের স্বার্থ পূরণে সচেষ্ট হতে চায়। তবে দেশের সকলে এরকম চিন্তা করলে যে সামগ্রিকভাবে দেশের স্বার্থটি পূরণ হবে না তা সত্য। শান্তি রক্ষার্থেই এই আদর্শ।
দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে নিজ সম্পর্কে ভাবার আগে সমাজ সম্পর্কে ভাবা। যে কাজে সমাজের মঙ্গল সাধিত হবে সেই কাজ আগে করতে হবে। এতে করে ব্যক্তিস্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে তা মেনে নিতে হবে। কারণ সর্বাঙ্গে সমাজের উন্নতি সাধন মানেই ব্যক্তিগহ উন্নতি। তবে এজন্য ছোটখাট ব্যক্তিগত উন্নতির সাথে আপস করে নিতেই হবে। সিঙ্গাপুরে এই আদর্শকে বাধ্যতামূলকই ধরা হয়।
২) পরিবারকে সমাজ গঠনের মৌলিক উপাদান হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া
এই ধরনের শিক্ষা পরিবারের পবিত্রতা রক্ষা করে, যা একটি সুষ্ঠু ও সুপ্রতিষ্ঠিত সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত। পরিবার শুধুমাত্র একটি শিশুর জন্য বড় হয়ে ওঠার মতো নিরাপদ পরিবেশই নয়, বরং জীবনের প্রয়োজনীয় সকল শিক্ষা-দীক্ষা পাওয়ার উপযুক্ত স্থান। এসব শিক্ষা অনুযায়ী দেশের প্রতি প্রত্যেকের যা যা দায়িত্ব রয়েছে তা কখনও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তাদের মতো যৌথ পরিবারে থাকলে মানুষ দায়িত্ববোধ ও সহনশীলতার মতো গুণ আরো সহজে অর্জন করতে পারে। তাই সিঙ্গাপুরে একক পরিবার বা একক অবিভাবকত্বের মতো বিষয়গুলোকে নিরুৎসাহিত করা হয়।
৩) সামাজিক সহায়তা ও ব্যক্তিবিশেষের প্রতি শ্রদ্ধা
এই শিক্ষাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই যথাযথ সম্মান পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং কাউকেই হেয় করা চলবে না। এই শিক্ষা শুধুমাত্র পরস্পরকে সম্মান করতে শেখায় না, বরং একজন মানুষ যেরকম তাকে সেভাবেই মেনে নেওয়ার মতো মূল্যবোধ বা ভদ্রতাও শেখায়। বহুজাতিভিত্তিক একটি রাষ্ট্রে দেশপ্রেমে সকলে উদ্বুদ্ধ হলেও প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজের সম্প্রদায় বা জাতির প্রতি আলাদা টান থাকবেই।
এটাই স্বাভাবিক। সেজন্য ‘দ্য শেয়ারড ভ্যালু’র প্রথমে নিজ সম্প্রদায়ের আগে দেশকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বললেও এরপরে নিজ জাতির স্বার্থ রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। কারণ ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর এই নাগরিকদেরকে নিয়েই দেশটি গঠিত। এজন্য মূল স্তরের কল্যাণমূলক ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো সক্রিয়ভাবে কাজ করে থাকে। এই সংস্থাগুলো নিজ নিজ সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধনে সহায়তা করে থাকে। এতে করে সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে পরাধীনতার কোনো বিষয় থাকে না।
৪) কোনো সমস্যার সমাধান তর্ক না করে সর্বসম্মতি অনুসারে করা
এই শিক্ষার লক্ষ্য হলো কোনো বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাধ্যমে কোনো বিতর্ক বা মনোমালিন্যের অবসান ঘটানো। মুখোমুখি আলোচনার চেয়ে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমত্য প্রকাশ করাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। এই ভ্যালু বলে সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের উচিত অকপটতার সাথে গঠনমূলক আলোচনা করা এবং জাতীয় স্বার্থ পূরণে যথাযথ দায়িত্ব পালন করা। রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ছাড়াও এই আদর্শের ইতিবাচক প্রভাব ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনেও দেখা যায়। যেমন- কর্মচারী ও মালিকদের নিজস্ব ক্লেশ দূর হয়, সমাজের বিভিন্ন মানুষজন কিংবা বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের নিজস্ব মনোমালিন্য দূর করা।
৫) জাতিগত ও ধর্মীয় ঐক্য এবং সঙ্গতি রক্ষা করা
এই শিক্ষা বা ভ্যালু সিঙ্গাপুরে জাতিগত ও ধর্মীয় সঙ্গতি বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করে। ‘দ্য শেয়ারড ভ্যালুস’-এ লিখিত আছে যে, একটি দেশের শান্তি বজায় রাখার জন্য অভ্যন্তরীণ জাতিগুলোর মধ্যেও শান্তি রক্ষা করা দরকারি। একজন ব্যক্তি গরিষ্ঠ কোনো সম্প্রদায়ের হতে পারে, আবার লঘিষ্ঠ কোনো সম্প্রদায়েরও হতে পারে। সকলেরই উচিত একে অপরের ধর্ম বা বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা। তাহলেই একটি শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব।
সিঙ্গাপুর এসব অনন্য আদর্শ ও সংস্কৃতির জন্যই বিশ্বের নিকট সমাদৃত। বহুজাতিক রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও সিঙ্গাপুর যেভাবে নিজেদের মধ্যে ঐক্য এবং শান্তি বজায় রাখছে তা আসলেও প্রশংসনীয়।