উত্তর কোরিয়া থেকে পালানো নারীরা যেভাবে প্রতারিত ও নির্যাতিত হচ্ছেন

উত্তর কোরীয় তরুণী লি ইয়ুমি (ছদ্মনাম) তুলনামূলক সচ্ছল পরিবারের সদস্য ছিলেন। তার বাবা-মা ওয়ার্কার্স পার্টির তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী ছিলেন। দরিদ্র পরিবারদের মতো তাদের খাবারের অভাব ছিল না। কিন্তু তার বাবা ছিলেন খুবই কঠোর। তাকে অনেক সিদ্ধান্তই জোর করে চাপিয়ে দিতেন। লিয়ের ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হওয়ার। কিন্তু বাবা রাজি ছিলেন না। একদিন বাবা-মায়ের সাথে ঝগড়া হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিলেন সীমানা পেড়িয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ চীনে চলে যাবেন।

চীনে যাওয়ার জন্য দালালদের খোঁজা শুরু করলেন যাদের মাধ্যমে সীমানা অতিক্রম করতে পারবেন। এক দালালকে পেয়েও গেলেন। ওই লোক তাকে প্রতিশ্রুতি দিলো তিনি চীনে গিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে কাজ করতে পারবেন। কিন্তু সেটা ছিল আসলে একটা ফাঁদ। লিয়ের মতো নারীদের সাধারণত ৫০০-১,০০০ মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয় দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য।

কিন্তু সীমানা পেড়িয়ে দেখেন দালালরা তাকে নারী পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। তারপর পাচারকারীরা তাকে অনলাইনে সাইবার সেক্সের কার্যক্রম করতে বাধ্য করে। এক দক্ষিণ কোরীয় ওয়েবসাইটে খদ্দেরদের অনলাইনে খুশি করতে তাদের কথা মতো কাজ করতে হতো। লি সেখানে পাঁচ বছরের জন্য আটকা পড়েন। তাকে সাইবার সেক্স থেকে পাওয়া অর্থের লাভের ৪০ শতাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এক পয়সাও পাননি তিনি। তার মতো আরো অসংখ্য উত্তর কোরীয় নারী চীনে এভাবে আটকা পড়ে আছেন।

উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা নারীদের চীনে সাইবার সেক্সে বাধ্য করা হয়; Image Source: CHUN KIWON

প্রশ্ন আসতে পারে তারা এভাবে পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে বৈধভাবে চলে গেলেই তো হয়! কিন্তু দেশটি হচ্ছে উত্তর কোরিয়া। বহির্বিশ্বের কাছ থেকে নিজেদের সব সময় বিচ্ছিন্ন রাখে দেশটি। রাষ্ট্রের অনুমতি ও উপযুক্ত কারণ ছাড়া উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের দেশ ত্যাগ করা নিষিদ্ধ। কেউ ধরা পড়লে তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।

চীনও উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা নাগরিকদের শরণার্থীর স্বীকৃতি দেয় না। তারা উত্তর কোরীয়দের অবৈধ অভিভাসী হিসাবে দেখে। চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে অবৈধ উত্তর কোরীয় নাগরিক ধরা পড়লে তাদেরকে উত্তর কোরিয়ায় ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারপর দেশে তাদেরকে বিশ্বাসঘাতকতা ও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে মাত্রা ভেদে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়।

তাহলে সেখানকার নাগরিকরা এভাবে দেশ ছেড়ে পালায় কেন? কারণ আড়াই কোটি জনসংখ্যার দেশটি খুবই দরিদ্র। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্ন শ্রেণির পরিবারগুলো অনেক সময় তিন বেলা খেতেই পারে না। নব্বইয়ের দশকে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আর ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সেসময় লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়। অনেক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। তাই নব্বই দশকে যারা জন্মেছে, তারা খুব প্রতিকূল পরিবেশে ‘কষ্টকর যাত্রা’ (Arduous March)-র সময়টায় বড় হয়েছে।  

তাছাড়া বর্তমানে চীন থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে চীনা, দক্ষিণ কোরীয় ও হলিউডের চলচ্চিত্র ও নাটক দেখার সুযোগ পাচ্ছে তারা। বিদেশি ছবি দেখা অবৈধ হলেও প্রায় সব পরিবারই লুকিয়ে সেগুলো দেখে থাকে। ফলে সেই প্রজন্মের কাছে বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। চীনে কাজ করে অনেকে দেশে পরিবারের কাছে অর্থও পাঠিয়ে থাকেন। এসব কারণে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় গত দুই দশকে অনেক নাগরিকই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

তারা যদি দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছাতে পারেন, তাহলে সরাসরি দেশটির নাগরিকত্ব পেয়ে যান। ১৯৯৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৩,০০০ উত্তর কোরিয়ার নাগরিক দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকত্ব পেয়েছেন। কিন্তু দুই কোরিয়া সীমান্তের দুই দিকেই এত সৈন্য ও মাইন পুতে রাখা যে, দক্ষিণ কোরিয়ায় সরাসরি পালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য অসম্ভব ব্যাপার। তাই তাদের দেশ ছাড়ার একমাত্র উপায় চীন সীমান্ত। তারা সাধারণত তুমেন নদী দিয়ে চীনে পাড়ি দেন।    

পালিয়ে যাওয়া নাগরিকদের সিংহভাগই থাকেন নারী। কারণ তাদের পক্ষে পালানোটা তুলনামূলক সহজ। নারীরা যেহেতু কল-কারখানা বা খনিতে খুব একটা কাজ করেন না, তাদের অনুপস্থিতি তাই দৃষ্টিগোচর হয় না। তাছাড়া চীনে প্রবেশ করেও তারা চীনা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পুরুষদের তুলনায় নিজেদের আড়ালে রাখতে পারেন বেশি। দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়াদের মাঝেও ৭২ শতাংশই নারী।

উত্তর কোরীয় মানবাধিকার কর্মী ইওনমি পার্ক চীনে পাচারকারীদের শিকার হয়েছিলেন; Image Source: Beowulf Sheehan

কিন্তু যে সুখের উদ্দেশ্যে তারা ঘর ছাড়েন, সেটা তারা পান কি? চীনে উত্তর কোরীয় নারীদের যৌন কর্মীতে পরিণত করতে বাধ্য করা খুবই সাধারণ ঘটনা। উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা আরেক তরুণী ও মানবাধিকার কর্মী ইওনমি পার্কের আত্মজীবনী ‘ইন অর্ডার টু লিভ’ বইয়েও এমন ঘটনার কথা জানা যায়। তিনি ও তার মা পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েছিলেন। তার ইউটিউব চ্যানেলে নিজের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়মিতভাবেই প্রকাশ করে আসছেন।     

তুমেন নদী পার হয়ে উত্তর কোরীয় নারীরা যখন চীনের মাটিতে পা রাখেন, তাদের নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে বিক্রি করে দেওয়া হয় নারী পাচারকারীদের কাছে। পরবর্তীতে তাদের আরো কয়েক স্তরে বিক্রি করা হয়। উত্তর-পূর্ব চীনের বিভিন্ন জেলায় প্রচুর অভিভাসী শ্রমিক থাকায় সেখানকার পতিতালয়গুলোতে তাদের যৌনকর্মী হিসাবে বিক্রি করা হয়। তাদের উত্তর কোরিয়ায় ফেরত পাঠানোর ভয় দেখিয়েও এসব কার্যক্রমে বাধ্য করা হয়। তারা ধর্ষণেরও শিকার হন।  

অপরাধী সংগঠনগুলোর এভাবে নারী পাচার করে আয় হয় বছরে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাদের সাধারণত ৬,০০০ থেকে ৩০,০০০ চীনা ইউয়ান মুদ্রায় বিক্রি করা হয় (৮৯০ থেকে ৪,৫০০ মার্কিন ডলার)। তাদের মূল্য নির্ভর করে বয়স, উচ্চতা আর সৌন্দর্যের উপর। সাধারণত তাদের বয়স হয়ে থাকে ১২ থেকে ২৯ বছর। তবে ৯ বছরের বাচ্চাদেরও বিক্রি করা হয় এভাবে।  

এসব নারীদের একটা বড় অংশকে বিক্রি করা হয় ইয়ানবিয়ান প্রদেশের ইয়ানজি শহরে। শহরটিতে কোরীয় বংশদ্ভূত চীনাদের বসবাস। এ শহরে বিভিন্ন কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধরে আনা হয় নারীদের।

ইয়ানজি শহরে কোরীয় বংশদ্ভূতদের বসবাস; Image Source: Julie Zaugg

এছাড়া তাদেরকে চীনা নাগরিকদের কাছে ‘স্ত্রী’ হিসাবেও বিক্রি করা হয়। বর্তমানে চীনে তিন সন্তান নীতি থাকলেও গত কয়েক দশক সেখানে ছিল ‘এক সন্তান নীতি’। এক সন্তান নীতির কারণে চীনের গ্রামাঞ্চলে কৃষিকাজের জন্য পুরুষ সদস্য প্রয়োজন থাকায় তারা নারী শিশুর ক্ষেত্রে ভ্রুণ হত্যা করে ফেলত। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে পুরুষদের বিয়ে করার জন্য নারী পাওয়া যায় না।

তাদের চাহিদা পূরণ করা হয় পাচার করা নারীদের দিয়ে। চীনের দক্ষিণাঞ্চলে সাধারণত ভিয়েতনাম, লাওস, মিয়ানমার থেকে পাচার করে আনা নারী সরবরাহ করা হয়। আর উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ করা হয় উত্তর কোরিয়ার নারীদের। উত্তর কোরীয়দের সাধারণত ১,০০০-৫০,০০০ ইউয়ান দিয়ে স্ত্রী হিসেবে কিনে নেয় চীনের পুরুষরা। সেই স্বামীদের কাছেও বিক্রি হওয়া নারীরা ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হন।

এছাড়া লিয়ের মতো সাইবার সেক্সেও বাধ্য করা হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ হওয়ায় তাদের কাছে এ সাইবার সেক্স জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাধারণত ৬-৮ জন নারীকে একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্টে বন্দি করে রাখা হয়। তাদের আসবাব বলতে থাকে শুধু একটা বিছানা আর টেবিল-চেয়ার, যেখানে কম্পিউটার স্ক্রিনে তারা খদ্দেরদের সাথে কথা বলেন। তাদের প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের আয়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়, যা পূরণ করতে না পারলে শারীরিক নির্যাতন করে শাস্তি দেওয়া হয়।

দেশ ছেড়ে পালিয়েও ভালো নেই উত্তর কোরীয় নারীরা; Image Soruce: Reuters

তারা চার ঘণ্টার বেশি ঘুমানোরও সুযোগ পান না। বাকি সময়টা খদ্দেরদের সময় দিয়েই কাটাতে হয়। রুম তালা দেওয়া থাকায় বাইরেও বের হতে পারেন না। তাদের ‘মালিক’রা নির্দিষ্ট সময় পর পর খাবার দিয়ে যান। ছয় মাসে এক বার তারা বাইরে বের হওয়ার সুযোগ পান। আয়ের পরিমাণ বেশি হলে প্রতি মাসেও একবার সুযোগ মেলে। যদিও তাদেরকে বাইরে কারো সাথে কথা বলতে দেওয়া হয় না। তাদের পারিশ্রমিক চাইতে গেলেও হুমকি কিংবা নির্যাতনের শিকার হন।

এসব কারণে উত্তর কোরিয়ার নারীরা দেশ ত্যাগ করেও শান্তিতে নেই। তাদেরকে তাই দুবার পালাতে হয়। চীনা কর্তৃপক্ষ আর পাচারকারীদের নজর এড়িয়ে খুব অল্প সংখ্যক নাগরিকই দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন। তাদের সাধারণত বিভিন্ন এনজিও ও খ্রিস্টান মিশনারির পাদ্রীরা সাহায্য করে থাকেন চীন থেকে পালাতে। আগে গোবি মরুভূমি হয়ে মঙ্গোলিয়া দিয়ে কোরিয়ায় আসলেও বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার সাথে মঙ্গোলিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন হওয়ায় সে পথ দিয়ে পালানোর পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে ভিয়েতনাম, মিয়ানমার এসব দেশ হয়েই দক্ষিণ কোরিয়ায় যেতে হয়।

তাছাড়া কিম জং উন ক্ষমতায় আসার পর থেকে গত এক দশকে উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের দেশ থেকে পালানোর প্রবণতা অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। তিনি সীমান্তবর্তী অঞ্চলে কড়াকড়ি বাড়িয়ে দেওয়ায় দালালরাও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। গত বছর তো করোনার কারণে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় সে সংখ্যা আরো নিচে নেমে এসেছে। সব মিলিয়ে দেশে কিংবা দেশের বাইরে কোথাও ভালো নেই উত্তর কোরিয়ার নাগরিকরা।

This is a Bengali article written about North Korean defectors slavery in China. All the references are hyperlinked in the article. 

Featured Image: REUTERS/BBC

 

Related Articles

Exit mobile version