ফ্রান্সে গত ১৭ নভেম্বর এক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। গত একমাসের সহিংসতায় যেখানে মারা গিয়েছে ৮ জন, আহত হয়েছে ১,৬০০ জনেরও বেশি এবং প্রায় ২,৩০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এত বিশালাকারের আন্দোলনের চিত্র গত কয়েক দশকে ফ্রান্সে দেখা যায়নি। আন্দোলনটির নাম দেয়া হয়েছে ‘হলুদ জ্যাকেট আন্দোলন’ (Yellow Vest Movement)। ফরাসি ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে Gilets jaunes।
আন্দোলনরত হাজার হাজার মানুষ হলুদ রঙের উজ্জ্বল একটি সড়ক নিরাপত্তার জ্যাকেট পরে রাস্তায় নামে। ফ্রান্স সরকারের নতুন আইন অনুসারে মোটর চালক বা গাড়ি চালকদেরকে এই হলুদ রঙের উজ্জ্বল জ্যাকেট পরতে হবে। হলুদ জ্যাকেটটি খুব সহজলভ্য হওয়ায় আন্দোলনের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ফরাসি জনগণ এটি বেছে নেয়। ইতিহাসজুড়ে এরকম অনেক আন্দোলনেই আমরা দেখতে পাই আন্দোলনকারীরা একই রকম মুখোশ, প্রতীকী এক টুকরো কাপড় কিংবা একটি নির্দিষ্ট প্রতীকের পতাকা বা ব্যানার ব্যবহার করে। সেরকম একটি চিত্রই ফ্রান্সের এই আন্দোলনে দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু কারা করছে এই আন্দোলন এবং কেন?
এই আন্দোলনটি প্রথমদিকে শুরু হয় জ্বালানী তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ হিসেবে। ফ্রান্সের গ্রামীণ এলাকার মানুষদের ব্যবসার জন্য মালামাল গাড়িতে নিয়েদূরদূরান্তে যেতে হয়। তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে, যা তাদের জীবনযাত্রায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। মূলত তারাই এই আন্দোলনটির সূত্রপাত ঘটায়। এর পাশাপাশি যোগ দেয় কর্মজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। দিন দিন তাদের জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন সরকারী সুযোগ সুবিধা ভোগ করার যে আয়সীমা, সেটি তাদের জন্য একটি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। কারণ একদিকে তাদের আয় সরকারী আয়সীমা অতিক্রম করে যাওয়ায় তারা সুযোগসুবিধা ভোগ করতে পারছে না, যেখানে তাদের চেয়ে কম উপার্জন করা অনেকেই সেসব সুযোগসুবিধা ভোগ করছে। অন্যদিকে দৈনন্দিন ব্যয় অনুসারে তাদের আয় কম। এরকম একটি অসমতা সৃষ্টি হওয়াতে এই শ্রেণীর মানুষেরা তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলনের পথে নেমেছে। প্রায় ২ লক্ষ ৮০ হাজার ফরাসি সারা দেশজুড়ে এই বিশাল আন্দোলনে সামিল হয়েছে।
ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রন ক্ষমতায় আসেন ২০১৭ সালে। শুরু থেকেই তিনি পরিবেশবান্ধব কর্মসূচীর দিকে বেশি নজর দিয়ে আসছেন। তিনি নানা ধরনের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কথা বলে আসছেন। এরই মধ্যে বেশ কিছু নতুন কর্মসূচী হাতে নিয়েছেন। তার সরকার পরিবেশবান্ধব কর্মকান্ডের অংশ হিসেবে জ্বালানী তেলের ব্যবহার কমানোর জন্য এবং পরিবেশবান্ধব যানবাহন ব্যবহার উৎসাহিত করার জন্য তেলের কর বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন নিয়মানুসারে কর বাড়িয়ে দেওয়াতে তেলের দাম প্রতি গ্যালনে ৩০% করে বাড়বে এবং পরবর্তী বছরগুলোতে তা আরো বাড়তে থাকবে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে ডিজেলের উপর। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্সের জ্বালানী তেল ক্রয়ের খরচ অনেক বেশি। অথচ ফরাসিদের একটি বিশাল অংশ ডিজেল নির্ভর যানবাহন ব্যবহার করে এবং এই অতিরিক্ত কর তাদের জন্য অনেক বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব কিছুর পাশাপাশি সাধারণ কর্মজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর ব্যাপার ফ্রান্স সরকার সচেষ্ট হচ্ছে না। সেজন্যও ফরাসিরা তাদের সরকার ও প্রেসিডেন্টকে দায়ী করছে। ফরাসিদের মতামত ম্যাক্রন ধনীদের রাষ্ট্রপতি, সাধারণ শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। ম্যাক্রন বিভিন্ন কোম্পানী ও ইন্ডাস্ট্রিকে যেকোনো সময় বিনা নোটিশে কোনো কর্মী নিয়োগ বা চাকরিচ্যুত করে দেয়ার সুবিধা প্রদান করেছেন। ফলে শ্রমিকরা তীব্র অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বিভিন্ন ইউনিয়নকে কিছু কিছু সেক্টরে ভর্তুকি দেয়া বন্ধ করার জন্য বাধ্য করেছে। এর ফলে সাধারণদের জন্য নানারকম অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
এছাড়াও আন্দোলনে সামিল হয়েছে শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষাব্যবস্থার নানা সমস্যা নিয়ে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান নকশা অব্যাহত থাকলে অনেক গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাজীবন শেষ না করেই ছিটকে পড়তে পারে। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে একপর্যায়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের মাথার পেছনে হাত দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করে, যেটির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং শিক্ষার্থীদের উপর এহেন আচরণের জন্য সমালোচনার ঝড় ওঠে।
এই আন্দোলনের মূল দাবীগুলো হচ্ছে তেলের দাম কমানো, অর্থের সঠিক বিতরণ, বেতন, ভাতা, পেনশন ও গড় আয় বাড়ানো। তাছাড়াও ম্যাক্রনের পদত্যাগের দাবীও অনেকে করছে। ইমানুয়েল ম্যাক্রনকে ফ্রান্সের বেশিরভাগ জনগণ নির্বাচনের সময় যেরকম ভেবেছিল, ক্ষমতায় আসার পর বুঝতে পারলো যে, তিনি ধনীদের সুবিধার্থে যা করা দরকার তা নিয়ে ব্যস্ত। সাধারণ জনগণদের জীবনযাত্রা সহজ করার ক্ষেত্রে তার চেষ্টা কম। তিনি রাজনীতিতে আসার আগে একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে কাজ করতেন। ক্ষমতায় আসার পর তিনি বিভিন্ন স্থাপনা বেসরকারি মালিকানায় প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ধনীদের কর কমিয়েছেন। ফ্রান্সের মধ্যবিত্ত জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থা বছরের পর বছর ধরে খারাপের দিকে যাচ্ছে। বেকারত্ব, অভাব ও ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হওয়াতে ফরাসিদের মনে এত ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
এই বছরের মাঝামাঝি থেকে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহায়তায় সবাই একত্রিত হওয়া শুরু করে। ১৭ নভেম্বর আন্দোলন শুরু হয়। এভাবে বিগত একমাস প্রত্যেক শনিবার ফরাসিরা আন্দোলনে নেমেছে এবং বিভিন্ন জায়গায় অবরোধের সৃষ্টি করেছে। কিছু কিছু জায়গায় আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করেছে, যার ফলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি সাধন হয়েছে। অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর, লুটপাত ও প্রচুর দাঙ্গা হয়েছে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর টিয়ার শেল ও জলকামান নিক্ষেপ করে। ১ ডিসেম্বর ভয়ানক সহিংসতা হয় কেবল প্যারিসেই। শতাধিক গাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়, জাতীয় ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়, যার মধ্যে আছে বিখ্যাত আর্ক ডি ট্রিয়ম্ফ। সেদিনের সহিংসতার প্যারিসের ক্ষতি হয় প্রায় ৩-৪ মিলিয়ন ইউরো।
একপর্যায়ে ফ্রান্স সরকার দেশে জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন শপিং মল, দোকানপাট বন্ধ রাখা হয় আন্দোলনের সময়। বিখ্যাত স্থাপনা লুভর জাদুঘর, আইফেল টাওয়ার ও প্যারিস অপেরার মতো স্থান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। স্থবির হয়ে পড়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, দৈনন্দিন ব্যবসাবাণিজ্য। পুলিশ সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সবরকম চেষ্টা করে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাজার হাজার সদস্যকে বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন করা হয়।
আন্দোলন চলাকালীন সময় ম্যাক্রন তেলের কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষণা করেন। কিন্তু এটি ছাড়াও ফরাসিদের অন্যান্য দাবী-দাওয়া ছিল। ১০ ডিসেম্বর ম্যাক্রন জাতির উদ্দেশ্যে টেলিভিশনে একটি ভাষণ দেন, যেখানে তিনি আন্দোলনকারীদের দাবী অনুসারে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ২০১৯ সাল থেকে গড় আয় ১০০ ইউরো করে বাড়ানো হবে, অতিরিক্ত ঘণ্টা কাজ করার জন্য যে আয় হবে এবং বছর শেষে যে বোনাস দেয়া হবে সেজন্য কোনো আলাদা কর দিতে হবে না ও যারা কম পরিমাণে পেনশন পায় তারা বেশি কর দেয়ার নতুন নিয়মের আওতার বাইরে থাকবে। কিন্তু ম্যাক্রন ধনীদের জন্য কোনো পরিবর্তনের আশ্বাস দেননি। এই প্রতিশ্রুতিতে অনেক আন্দোলনকারীই খুশি হননি, যেজন্য ১৫ ডিসেম্বর আবারো ফরাসিরা রাস্তা অবরোধ করার চেষ্টা করে এবং এর ফলে অনেককে গ্রেফতার করা হয়।
তারা একটি সুষ্ঠু সরকারব্যবস্থা চায়, যেখান থেকে সাধারণ জনগণদের সমস্যার সঠিক সমাধান আসবে এবং ধনীদের অধীনে থেকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হবে না। ম্যাক্রনের উপর থেকে অনেকেরই আস্থা সরে এসেছে। অন্যদিকে ম্যাক্রন জ্বালানী তেলের দাম বাড়িয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির পেছনে কাজ করার কথা চিন্তা করছেন, যাতে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানো যায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের অভিমত হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যাটি তৈরি করেছে বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানি ও ধনীদের এক বিশাল অংশ। সমস্যার সমাধান হিসেবে সাধারণ মধ্যবিত্ত জনগণের উপর চাপ প্রয়োগ না করে সেসব কোম্পানির উপর চাপ প্রয়োগ করা উচিত, যাদের কারণে আজ জলবায়ুর এই দশা।
একটি দেশের জনগণ যদি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে অসচ্ছলতা ও অসমতার শিকার হয় তাহলে সেটি ক্ষোভে পরিণত হয়। সেই ক্ষোভ থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তারই উদাহরণ আমরা দেখতে পারছি ফ্রান্সে। অথচ ফ্রান্স পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী, ক্ষমতাধর, আধুনিক ও উন্নত দেশ। সেখানে এত বিশালাকারের প্রতিবাদ হওয়ার সম্ভাবনা কল্পনা করাও কঠিন।
বেশ কিছু দাবী নিয়ে ফরাসিরা রাস্তায় নেমেছে এবং অনেক সহিংসতা ও আন্দোলনের পর তারা কিছু অর্জনও করতে পেরেছে। কিন্তু এক বছর আগে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির উপর যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে সেই চিন্তা থেকে তারা অদূর ভবিষ্যত জীবনযাত্রা নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করছে। এই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর অনেকেই ধারণা করছিল, এ থেকে একটি গৃহযুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি গত একমাসের সহিংসতায় সাধন হয়েছে তা কাটিয়ে উঠে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথ সহজ হবে না।
ফ্রান্সের জনগণ আদৌ তাদের সমস্যার সমাধান আদায় করতে পারবে কি না সেটি এখন শুধুমাত্র সময়ই বলে দিতে পারে।