প্রখ্যাত ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন,
“স্বাধীনতা হলো মানুষ যা শুনতে চায় না তা বলার অধিকার।”
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই আলাদা মস্তিষ্কের অধিকারী। প্রত্যেক মানুষের আলাদা চিন্তাভাবনা রয়েছে, তাদের প্রভাবিত হওয়ার ধরনও আলাদা। ফলে, পৃথিবীর সবার মতামত ও চিন্তাভাবনা এক না হওয়াই স্বাভাবিক। মানব ইতিহাসে অনেক আগে থেকেই মানুষ একে অপরের চিন্তাভাবনার বিরোধিতা করে এসেছে। নিজের মতামত প্রকাশ করা কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হলো নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া, বা অন্যকে তার চিন্তাভাবনা প্রকাশে বাধা দেওয়া, কিংবা নিজের পছন্দ নয় এমন মতামত প্রকাশ না করতে অন্যকে বাধ্য করা।
সবাই নিজের বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। কিন্তু কেউ কি আর নিজের মতের বিরোধী কোনো কথা শুনতে চায়? এটা প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য সব জায়গায় একইরকম। তবে পার্থক্য রয়েছে প্রতিক্রিয়ায়। একেক অঞ্চলে একেকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। পশ্চিমা বিশ্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতার জন্য বেশ বিখ্যাত। আমরা, তথা প্রাচ্যের অধিকাংশ মানুষ ভাবি, সেখানে যে কেউ ইচ্ছেমতো যা খুশি বলতে পারে। সেখানে মানুষ সবকিছুর সমালোচনা করতে পারে, কেউ কোনো বাধা দেবে না, বরং আপনাকে সুযোগ করে দেবে আপনার মত প্রকাশের। বিষয়টা এমন যে- সেখানকার সবাই ভলতেয়ারপন্থী। ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তিটি হয়তো শুনেছেন। তিনি বলেছিলেন,
“আমি তোমার কথার সাথে বিন্দুমাত্র একমত না হতে পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি জীবন দেবো।”
ভলতেয়ারের উক্তিটি শুনতে বেশ ভালো লাগে। নিজের মত প্রকাশের বেলায় সবাই ভলতেয়ারপন্থী, কিন্তু অন্যের মত প্রকাশের বেলায় তা মনে থাকে না। মানুষ ততক্ষণ পর্যন্তই অন্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই মত নিজের চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে যায়। যখনই অন্যের মত নিজের মতের বিরুদ্ধে যায়, তখনই সে প্রতিক্রিয়া দেখায়। পশ্চিমা বিশ্ব অবশ্যই মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বের অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলের তুলনায় বেশ উদার। কিন্তু তারাও নিরঙ্কুশ ও শর্তহীন উদার নয়। পশ্চিমা বিশ্বও ভিন্নমত দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তারা দমিয়ে রাখে বয়কট ও বাতিলের মাধ্যমে। বাকস্বাধীনতাকে দমিয়ে রাখার সেই পশ্চিমা নীতির নাম ‘ক্যানসেল কালচার’।
ক্যানসেল কালচার বলতে বোঝায়, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় এমন কোনো কার্যক্রম বা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে প্রকাশ্যে বয়কট, প্রত্যাখ্যান বা অসহযোগিতার ঘটনা ও প্রথা। পশ্চিমারা তাদের সংস্কৃতি, চিন্তাভাবনা ও দর্শনের বিরোধীদের সাধারণত এভাবে বাগে আনে। সাধারণত একজন সেলিব্রিটি বা অন্য সুপরিচিত ব্যক্তিকে ক্যানসেল করা মানে সেই ব্যক্তিকে সমর্থন করা বন্ধ করা। সেটা হতে পারে একজন অভিনেতার চলচ্চিত্র বয়কট করা, বা তার সেই চলচ্চিত্র না দেখতে অন্যকে উৎসাহিত করা, অথবা একজন লেখকের বই আর না পড়া বা প্রচার না করা। আবার এমনও হতে পারে- কোনো ব্যক্তিকে তার চাকরি থেকে বহিষ্কার করা। এই কালচার অনেক মানুষের ক্যারিয়ার প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে চলেছে। ক্যানসেল কালচারের চর্চা এখন মূলধারার গণমাধ্যম ছাড়িয়ে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপকভাবে করা হয়।
চলমান ইউক্রেন সংকট নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ‘রাশিয়াও জে. কে. রোলিংয়ের মতো পশ্চিমা ক্যানসেল কালচারের ভুক্তভোগী।’ জে. কে. রোলিংও পশ্চিমা ক্যানসেল কালচারের শিকার হয়েছিলেন। হ্যারি পটারের স্রষ্টা জে. কে. রোলিং তার সমকামীদের বিষয়ে মতামতের জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। তিনি ট্রান্সজেন্ডারদের একটি আন্দোলনের সমালোচনা করায়, তাকে ট্রান্সফোবিক ও সমকামী-বিদ্বেষী আখ্যা দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, তাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে বয়কট করা হয়, এবং তার কাজের প্রচার ও পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় তার বই বর্জনের ডাক দেওয়া হয়। জে. কে. রোলিংয়ের মতো প্রভাবশালী লেখিকাও পশ্চিমা ক্যানসেল কালচারের ভুক্তভোগী।
পশ্চিমা ক্যানসেল কালচারের আরেক বড় ভুক্তভোগী হলো ফিলিস্তিনপন্থীরা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বললে ক্যারিয়ার ধ্বংসের সম্ভাবনা তৈরি হয়। পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের উপর অত্যাচার-নিপীড়নের খবর প্রকাশিত হয় না বললেই চলে। উপরন্তু, ফিলিস্তিনপন্থীদের তথাকথিত ‘অ্যান্টি-সেমিটিক’ আখ্যা দিয়ে বিভিন্নভাবে বয়কট ও হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। হাম্মাম ফারাহ নামক পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসরত এক ফিলিস্তিনি বলেন,
“ক্যানসেল হওয়া লোকদের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্যতম ঘটনার শিকার হলো ফিলিস্তিনিরা, এবং যারা আমাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। যখন ফিলিস্তিনিদের নিজেদের অধিকারের জন্য দাঁড়ানোর কথা আসে, তখন এটা খুবই কঠিন কাজ। আমাদের বাকস্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বার বার আক্রমণ করা হয়েছে।” (সূত্র: দ্য ইনটারসেপ্ট)
পশ্চিমা বিশ্বে ফিলিস্তিনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করাও যেন অপরাধ! ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বললে চাকরি হারানো থেকে শুরু করে সামাজিকভাবে বয়কট হওয়াসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
তবে এই ক্যানসেল কালচার নিয়ে মার্কিন জনগণ দ্বিধাবিভক্ত। অনেকেই একে জবাবদিহিতার অংশ বলে মনে করেন, আবার অনেকে একে অন্যায় শাস্তি ও নিষেধাজ্ঞা বলে বিবেচনা করেন। ক্যানসেল কালচারের পক্ষে থাকা লোকজন মনে করেন- একজন যা ইচ্ছা তা-ই বলতে পারেন না, সেখানে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে। আবার অনেকেই এর বিরুদ্ধে যুক্তি দেন। তারা মনে করেন- এর ফলে সেসব মানুষকে অন্যায় শাস্তি দেওয়া হয়, যাদের এই শাস্তি পাওয়া আদৌ উচিত নয়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের একটি জরিপে একজন অংশগ্রহণকারী বলেন,
অন্যরা কী আপত্তিকর বলে মনে করে তা আমরা জানব কীভাবে? সমস্যা বোঝার চেষ্টা না করে বিক্ষুব্ধ হওয়া খুবই সহজ। আলোচনা বা বিতর্ক বলে একটা বিষয় আছে। প্রত্যেকেরই তাদের মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতা থাকা উচিত, এবং তারপরে বিক্ষুব্ধ হওয়ার পরিবর্তে একমত কিংবা ভিন্নমত পোষণ করার অধিকার থাকা উচিত। প্রায়শই লোকেরা বলে ‘বৈচিত্র্য স্বীকার করুন’, কিন্তু তারা নিজেরাই অন্যদের মতামত শুনতে অনিচ্ছুক।
ক্যানসেল কালচারকে অনেকেই মব জাস্টিস বলে মনে করেন। এর ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবিচারের শিকার হতে হয়। কয়েক বছর আগে বিখ্যাত হলিউড অভিনেতা জনি ডেপের উপর তার স্ত্রী অ্যাম্বার হার্ডকে শারীরিক ও মানসিকভাবে অত্যাচারের অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে (তখনও অপরাধ প্রমাণিত হয়নি) জনি ডেপকে বয়কটের ডাক আসে। বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন তাকে ক্যানসেলের আহ্বান জানায়। ফলে তাকে অনেকগুলো চলচ্চিত্রের কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়, এবং তার ক্যারিয়ার হুমকিতে পড়ে।
যে অভিযোগ আদালতে বিচারাধীন, সেই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই পাবলিকের চাপে তাকে কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়। অন্যদিকে জনি ডেপ অ্যাম্বার হার্ডের বিরুদ্ধেও মামলা করেন। ফলে জনি ডেপের ভক্ত ও অনুসারীরা অ্যাম্বার হার্ডকে বিভিন্ন চলচ্চিত্রের কাজ থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানায়। এ উদ্দেশ্যে তারা গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করতে শুরু করে। তাদের ব্যক্তিগত সমস্যার বিচার পাবলিকের হাতে চলে যায়। এসব মব জাস্টিসের ফলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ব্যাপকভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই পাবলিক ট্রায়াল সুবিচারের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় অন্তরায়।
ক্যানসেল কালচারের ফলে অধিকাংশ সময়ই লঘু পাপে গুরু দন্ড পেতে হয়। ফলশ্রুতিতে অনেকেই স্বাধীনভাবে নিজের মতামত দিতেও ভয় পায়। বিভিন্ন ট্যাগ পেয়ে ক্যারিয়ার ধ্বংসের ভয়ে অনেকেই নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে পারে না। এই তথাকথিত ‘ক্যানসেল কালচার’ বাকস্বাধীনতার জন্য এক বিরাট অন্তরায়। এই মুহূর্তে নম চমস্কির সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে যায়। যেখানে তিনি বলেছিলেন,
“আমরা যদি আমাদের অপছন্দের মানুষদের বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস না করি, তবে ধরে নিতে হবে প্রকৃতপক্ষে আমাদের বাকস্বাধীনতার উপর বিশ্বাসই নেই।”
ক্যানসেল কালচারের ফলে বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে পশ্চিমা অবস্থানের উপর প্রশ্ন ওঠে। কেউ যদি অপরাধমূলক কোনো কর্মকাণ্ড করে, তবে সেক্ষেত্রে অবশ্যই আদালতে তার বিচার করা উচিত, এবং প্রয়োজনে তাকে বয়কট করা যেতে পারে। কিন্তু কাউকে শুধুমাত্র তার মত প্রকাশের জন্য বা কোনো বিষয়ের সমালোচনা করার জন্য বয়কট করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তথাকথিত ‘সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য’ কোনো কথার কারণে একজনকে হয়রানি করা, বয়কট করা, চাকরিচ্যুত করা অবশ্যই বাকস্বাধীনতার লঙ্ঘন।
ক্যানসেল কালচারের এমন বেপরোয়া প্রয়োগের ফলে অনেক সেলিব্রিটি এর বিরোধিতা করেছেন। কিছুদিন আগে এলন মাস্ক এক টুইটে বলেন, ‘cancel cancel Culture’ অর্থাৎ ক্যানসেল কালচারকেই ক্যানসেল করে দিন। কিছুদিন আগে নম চমস্কি, জে. কে. রোলিং সহ প্রায় দেড় শতাধিক লেখক, বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তি ক্যানসেল কালচারের বিরোধিতা করে একটি পাবলিক লেটারে স্বাক্ষর করেন। তারা ক্যানসেল কালচারকে বিরোধী মতামতের প্রতি অসহিষ্ণুতা বলে মনে করেন। তাদের মতে, তথ্য এবং চিন্তাভাবনার অবাধ আদান-প্রদান হলো একটি উদার সমাজের প্রাণ, কিন্তু এটি প্রতিদিন আরও সংকুচিত হয়ে উঠছে।
কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা বিশ্বাসকে অপমান কিংবা ছোট করার ফলে যদি কাউকে বয়কটের ডাক দেওয়া হয়, তবে সেটা শর্তসাপেক্ষে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু শুধুমাত্র তথাকথিত ‘সমাজে অগ্রহণযোগ্য’ মতামত প্রকাশের ফলে যদি এমন হয়, তবে তা অবশ্যই বাকস্বাধীনতাকে অস্বীকার করার নামান্তর। ক্যানসেল কালচারের মাধ্যমে অনেক সময় পশ্চিমাদের দ্বিচারিতাও প্রকাশ পেয়ে যায়। ফ্রান্সসহ পশ্চিমা বিশ্বে যারা হলোকাস্ট অস্বীকার করে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়। সেখানে জায়োনিজমের বিরোধিতা করাকে এবং ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের উপর অত্যাচারের সমালোচনা করাকে ‘এন্টি-সেমিটিক’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
একইভাবে অন্যায় কোনো ধর্মের প্রবর্তককে অপমান করা। ফরাসি ম্যাগাজিন শার্লি হেবদো অনেকবার হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে অপমানজনক কার্টুন আঁকলেও তাদের কোনো শাস্তি হয়নি। ফ্রান্সে ইহুদি-বিদ্বেষের ফলে যেমন শাস্তি হয়, ইসলাম-বিদ্বেষের ফলে তেমন শাস্তি হয় না। সেখানে ইহুদি-বিদ্বেষের বেলায় ক্যানসেল কালচার কাজ করলেও ইসলাম বিদ্বেষের বেলায় কাজ করে না। অন্যান্য পশ্চিমা দেশেও একইরকম। ফলে জবাবদিহিতা বলে যে ক্যানসেল কালচারকে সমর্থন করা হয়, সেটা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।
কোনো ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও ব্যক্তিকে অপমান ও তার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা অবশ্যই অন্যায়, এবং এরকম করলে শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু শুধুমাত্র সমালোচনা করার ফলে কোনো মানুষকে ক্যানসেল করে দেওয়া কখনোই উচিত নয়, এটা স্পষ্টতই বাকস্বাধীনতার লঙ্ঘন। পাশ্চাত্য সমাজে এভাবেই ভিন্নমত দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়।