গত বছরের ডিসেম্বরে রুটির দাম তিনগুণ হওয়াকে কেন্দ্র করে রাস্তায় নামে আফ্রিকা মহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম দেশ সুদানের জনগণ। কিছুদিনের মধ্যেই তা প্রবল জনবিক্ষোভে রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। এই বিক্ষোভ থেকেই দাবি ওঠে ৩০ বছর ধরে সুদান শাসন করা স্বৈরশাসক ওমর আল বশিরের পদত্যাগের। কিন্তু অন্য সকল একনায়কের ন্যায় তিনিও আন্দোলন ঠেকাতে দমন-পীড়নকেই বেছে নেন। রক্তাক্ত হতে থাকে রাজধানী খার্তুমসহ অন্যান্য নগরী। আন্দোলন এতে আরও বেগবান হলে তা দমনে ব্যর্থ হয় বশিরের সরকারি বাহিনী। অবশেষে গত এপ্রিলে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বশিরের পতন ঘটে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়।
স্বৈরশাসক ওমর আল বশিরের পতনকে সুদানি জনগণের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে প্রথম বড় কোনো সাফল্য মানা হচ্ছে। লাখ লাখ সুদানি এই অর্জন উদযাপন করেছে রাস্তায় নেচে-গেয়ে। এ আনন্দ-উল্লাসে যেন তারা ৩০ বছরের নির্যাতন, নিপীড়ন থেকে মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করছিলেন। কিন্তু বশিরকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা সুদানি শোষিত জনসাধারণের রক্তে অর্জিত লাভের গুড়ে যে ভাগ বসাবে নতুন পিঁপড়া, তা হয়তো তারা ভাবতেও পারেননি! আন্দোলনকারীদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দিন দিন রূপ নিচ্ছে মরীচিকায়।
বশিরকে সিংহাসনচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করা সেনা শাসকরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার এবং অচিরেই জনগণের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বললেও বাস্তবে তার উল্টোটাই করছে। আন্দোলনকারী জোট এবং ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিলের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া ও এই সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে এক আলোচনা শুরু হলেও মে মাসের মাঝামাঝি তা ভেস্তে যায়। রাজধানীসহ সারাদেশে দিনে-দিনে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ আরও বৃদ্ধি পায়; ভারী অস্ত্র হাতে রাস্তায় রাস্তায় টহল বসিয়ে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে সেনারা।
এরই মধ্যে গত ৩ জুন খার্তুম, দারফুরসহ অন্যান্য শহরে আন্দোলনকারীদের উপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে ‘র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স’ বাহিনীর সদস্যরা, যারা নতুন সেনা শাসকদের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দেশটির বিভিন্ন শহর নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। সুদানের ডাক্তারদের কেন্দ্রীয় কমিটি জানায়, ঐ হামলায় শতাধিক লোককে হত্যার পাশাপাশি আরও অনেককে আহত এবং নারীদের ধর্ষণও করা হয়। এছাড়াও হতাহত অনেককেই নীলনদে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তারা।
কিন্তু কেন সেনারা হঠাৎ এত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অথবা কেন সহসা ক্ষমতা ছাড়তে চাইছে না – সে সম্পর্কে ইতোমধ্যেই নানা তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। জানা যাচ্ছে, বর্তমানে সুদানের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করা ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিলের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ্ বুরহান এবং তার ডেপুটি লে. জেনারেল হামদান দাগালোর (যিনি হিমাতি নামেই বেশি পরিচিত) ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশ সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরতের সাথে। এছাড়া জেনারেল বুরহান ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী দমনে গঠিত সৌদি জোটে সেনা পাঠিয়েও তাদের প্রিয়পাত্র হয়েছে।
এদিকে সৌদি, আরব আমিরাত ও মিশরের মতো রাজতান্ত্রিক অথবা স্বৈরাচারী দেশগুলো কখনোই চায় না তাদের নাকের ডগায় আন্দোলনের মাধ্যমে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক। আরব বসন্তের ফলাফলও সে কাজে তাদের প্রতিবেশি দেশ সম্পর্কে আরও সজাগ করেছে নিশ্চয়ই। আর এ কারণেই এসকল দেশগুলো নিপীড়িত সুদা্নিদের পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো নতুন নিপীড়ক তৈরিতে মনযোগী হয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক কোনো শক্তিকেও এখনো পর্যন্ত কিছু বিবৃতি দেওয়া ছাড়া সুদানি জনগণের পক্ষে বৃহৎ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
ইতোমধ্যে আন্দোলনকারীরা তাদের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। দেশটির প্রধান আন্দোলনকারী গ্রুপ সুদানিজ প্রফেশনালস্ অ্যাসোসিয়েশন (SPA) এক প্রচারণার মাধ্যমে সারাদেশে সামাজিক অবাধ্যতা বা ‘সোশাল ডিসঅবিডিয়েন্স’ পালনের ঘোষণা দিয়েছে এবং যতদিন পর্যন্ত কোনো বেসামরিক সরকার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে নিজেদের ক্ষমতা গ্রহণ করার ঘোষণা না দেয় ততদিন পর্যন্ত এ কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার হুমকিও দিয়েছে। তারা বলেছে, সামাজিক অবাধ্যতা হলো এমন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী যার মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রভাণ্ডারকেও এর কাছে আত্মসমর্পণ করানো যায়।
কিন্তু কীভাবে এ কর্মসূচী বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে রাজধানী খার্তুমে পালিত হবে তা এখনো পরিষ্কারভাবে জানাতে পারেনি তারা। কারণ রাজধানীসহ বড় বড় শহরের রাস্তা ও স্কয়ারে কড়াভাবে নজর রাখছে সেনারা এবং কোনো ধরনের সভা সমাবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
অবশ্য এরই মধ্যে আফ্রিকান ইউনিয়ন সম্প্রতি এক জরুরী সভায় সুদানকে এইউ থেকে বহিষ্কার করেছে। এছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানিয়েছে।
তাছাড়া ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ বিবাদমান দু’পক্ষের মধ্যে পুনরায় আলোচনা শুরুর লক্ষ্যে খার্তুম সফর করেছেন। তিনি গত ৭ জুন আলাদাভাবে দুই পক্ষের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তিনি সেনাবাহিনীকে দেশ ও দেশের জনগণের নিরাপত্তা আর রাজনীতিবিদের দেশের ভবিষ্যতের প্রতি মনোযোগী হতে আহবান জানান।
কিন্তু একদিন পরেই শুক্রবারের আলোচনায় অংশ নেয়া তিনজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানায় তাদের আন্দোনকারী সহযোগীরা, যা আবার নতুন করে উত্তেজনা বৃদ্ধির আশংকা তৈরি করেছে।
গত ৩০ বছর ধরে ওমর আল বশিরের স্বৈরচারী শাসনের যাতাকলে পিষ্ট হয়েছে সুদানবাসী। ১৯৮৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বশির দারিদ্র্য-পীড়িত এ দেশটির রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। কিন্তু ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি দেশটির মানুষের। দখল করা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিভিন্ন সময় নানা কৌশল ব্যবহার করে বশির। কয়েকবার লোক দেখানো নির্বাচন দিয়ে নিজের ঘাঁটিকে আরও শক্তিশালী করে এই একনায়ক।
এই বশিরেরই ছত্রছায়ায় ২০০৩ ও ২০০৪ সালে জানজাউইদ মিলিশিয়ারা দারফুরে ১৪,০০০ মানুষকে হত্যা করে। এছাড়াও সেই গণহত্যার সময় বাস্তুচ্যুত করা হয় ১০ লাখের বেশি দারফুরবাসীকে। শুধু তা-ই নয়, সে সময় বশিরের বাহিনী জনসাধারণের উপর রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করে! রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ আর লুটপাট করে দিনে দিনে দেশটিকে এবং দেশের মানুষকে দরিদ্র থেকে হতদরিদ্রে পরিণত করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কয়েকবার চেষ্টা করেও তার বিচার করতে সমর্থ হয়নি। ২০০৯ সালে আইসিসির তৎকালীন প্রধান প্রসিকিউটর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন। এরপরে ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে আরও একবার গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু তাতেও এই স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদের দেশগুলোর সাথে তার ঘনিষ্ঠতার কারণে!
উপরন্তু, ২০১৪ সালে নিরাপত্তা পরিষদের পর্যাপ্ত সমর্থনের অভাবে তার বিরুদ্ধে করা মামলাটি চালিয়ে নিতে অসমর্থ হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এসব কারণে দিনে দিনে আরও প্রতাপশালী হয়ে ওঠেন আল বশির। অবশেষে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে বশিরের তিন দশকের শাসনের।
কিন্তু তার পতন ঘটলেও এখনো পতন হয়নি সুদানী স্বৈরতন্ত্রের। মুক্তি মেলেনি সে দেশের সাধারণ মানুষের। মুক্তিকামী এসব আন্দোলনকারীর আরও কতটা পথ পাড়ি দিতে হবে, কবে সুদানের আকাশে উঠবে মুক্তির লাল সূর্য, সেটাই এখন দেখার।