গুগলে যদি সার্চ দিয়ে দেখেন দক্ষিণ কোরিয়ার পরবর্তী সুনেউং (Suneung) পরীক্ষা কবে, তাহলে নভেম্বর মাসের কোনো একটা তারিখ দেখাবে। এখন থেকে (ফেব্রুয়ারি) পরবর্তী পরীক্ষার জন্য আরো প্রায় ৯ মাস সময় বাকি থাকলেও দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষার্থীরা হয়তো এর জন্য আরো বছরখানেক কিংবা তার আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিয়েছে!
পরীক্ষাটা যখন সুনেউং, তখন সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা এমন এক পরীক্ষা যার জন্য পুরো দেশটাই স্থবির হয়ে যায় সেই সময়টায়। রাজধানী সিউলে যেন পিনপতন নীরবতা নেমে আসে পরীক্ষার সময়টায়। দোকানপাট, ব্যাংকের কার্যক্রম পরীক্ষার দিন বন্ধ থাকে। রাস্তায় যানজট না হওয়ার জন্য যানবাহনের চাপ কম রাখা হয়। পরীক্ষার হলে যেন শব্দ না যায়, সে কারণে বিমান অবতরণের সূচিও সমন্বয় করা হয়। সামরিক প্রশিক্ষণ স্থগিত রাখা হয়। এমনকি শেয়ার বাজারের কার্যক্রমও ঘণ্টাখানেক দেরিতে শুরু হয়। কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষার হলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেলে পুলিশ তাদের দ্রুত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেয়।
অভিভাবকরা স্থানীয় বৌদ্ধ মন্দির কিংবা চার্চে প্রার্থনা করতে যান সন্তানদের সাফল্য দেখার জন্য। মধ্য সিউলের জংনো এলাকার জগ্যিসা মন্দিরে ১০০ দিনের বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থাও হয় শুধুমাত্র এই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে। এই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানা, চাকরি জীবন, তাদের আয়, জীবনযাত্রা, এমনকি জীবনসঙ্গীও। অর্থাৎ, একটা প্রজন্মের পুরো ভবিষ্যতই ঠিক করে দেয় এই একটা পরীক্ষা।
বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত এই সুনেউং পরীক্ষার কেতাবি নাম কলেজ স্কলাস্টিক অ্যাবিলিটি টেস্ট বা সিএসএটি (CSAT)। পর পর আট ঘণ্টার এই ম্যারাথন পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত নাম্বার বা গ্রেড পেতে পারলেই কেবল স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া যায়। পরীক্ষায় প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত গ্রেড দেওয়া হয়। এর মাঝে সর্বোচ্চ গ্রেড হচ্ছে ১। পরীক্ষা নেওয়া হয় কোরিয়ান, গণিত, ইংরেজি, কোরিয়ার ইতিহাস, সামাজিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, কারিগরি শিক্ষা, এবং দ্বিতীয় কোনো বিদেশি ভাষা কিংবা চীনা ভাষার ওপর। প্রতিটিতেই আলাদা আলাদা গ্রেডিং থাকে। ১২ বছর পড়াশোনা করার পর শিক্ষার্থীরা এতে ভালো করার জন্য মুখিয়ে থাকেন। কেউ কেউ পাঁচ বার পর্যন্তও পরীক্ষা দিয়ে থাকেন।
পরীক্ষার হলে প্রবেশের সময় মেটাল ডিটেক্টরে পর্যবেক্ষণ করা হয়। ডিজিটাল ঘড়ি, ফোন, ব্যাগ, বই এসব কিছুই নেওয়া যায় না। পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে শিক্ষার্থীরা একে অন্যকে শুভ কামনা জানালেও ভেতরে ঢোকার পর পুরো হলেই নীরবতা বিরাজ করে। এমনকি শিক্ষকদেরও নির্দেশ দেওয়া হয়, শব্দ না হয় এমন জুতা পরে পরীক্ষার হলে আসতে।
পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কীভাবে করা হয়, সেটা আরেক রহস্য। প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে সমগ্র দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৫০০ জন শিক্ষককে নির্বাচন করা হয় প্রশ্ন করার জন্য। তারপর তাদেরকে পর্বতময় গ্যাংওন প্রদেশের একটা গোপন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এক মাসের জন্য তাদের ফোন জব্দ করা হয়। এ সময় তারা বহির্বিশ্বের সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারেন না। শিক্ষকদের সহকর্মীরাও তাদের ব্যাপারে জানতে পারেন না। এমনকি পরিবারের সাথেও তারা যোগাযোগ করতে পারেন না।
আনুষ্ঠানিকভাবে পরীক্ষার ফলাফল জাতীয় ওয়েবসাইটে এক মাস পর প্রকাশ করা হয়। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে পরীক্ষার পর পরই জেনে নেওয়া যায় প্রাপ্ত স্কোরের সাথে শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হবে কিনা। অনেকের প্রথম পছন্দ বা স্বপ্ন থাকে দেশটির স্বনামধন্য তিন বিশ্ববিদ্যালয়, সিউল, কোরিয়া ও ইয়োনসেইয়ে পড়ার। এগুলোর ইংরেজি অদ্যাক্ষরের প্রথম তিনটিকে একত্রে ‘স্কাই’ (SKY) বলে সম্বোধন করা হয়। এগুলোকে দক্ষিণ কোরিয়ার হার্ভার্ড, ইয়েল, এবং অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজের মতো বিবেচনা করা হয়। স্কুলজীবন পার করে আসা প্রায় ৭০ ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাবেন, কিন্তু স্কাইয়ে শতকরা ২ ভাগও সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম। উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা শিক্ষার্থীরা আশা করেন স্কাইয়ে পড়ার। কারণ প্রত্যেকে সেখানে বিচার করে ডিগ্রি আর ডিগ্রির প্রতিষ্ঠান দেখে।
স্কাইয়ে পড়তে চাওয়ার আরেকটি কারণ চাকরির বাজারে অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া। দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি সচল থাকে অল্প কয়েকটি প্রভাবশালী কংলোমারেট কোম্পানির দ্বারা, যাদের ‘চেইবল’ বা অভিজাত বংশ বলা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে এলজি, হুন্দাই, এসকে, লোটে, এবং এদের মাঝে সবচেয়ে বড় স্যামসাং। স্কাইয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেলে এসব কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার একটা ভালো সম্ভাবনা থাকে। এতে সমাজে নিজের মর্যাদা বাড়ানো যায়। দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চশিক্ষিত দেশগুলোর একটি। কিন্তু এখানে এক-তৃতীয়াংশ স্নাতকই বেকার। কর্মসংস্থানে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু সুযোগ পেলেই হয় না, প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ পেতে হয়। শুধু স্কাই থেকে স্নাতক সম্পন্ন করলেই চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তবে তারা নিচের সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে থাকে।
সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার তরুণদের জন্য এই পরীক্ষার গুরুত্ব কতটা। ১৯৯৪ সালে এই পরীক্ষা পদ্ধতির সূচনা হয়। কিন্তু একে নিয়ে উন্মাদনার পাশাপাশি আছে চরম বিতর্ক। এই পরীক্ষা পদ্ধতির সূচনা হয়েছিল সমাজে গতিশীলতা নিয়ে আসার জন্য। গরিব শিক্ষার্থীরাও যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায়, সে কারণেই এর প্রবর্তন হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্দেশ্য কতটা পূরণ করতে পারছে, সেটা নিয়ে আছে প্রশ্ন। কারণ সুনেউংয়ে সাফল্য যেন হয়ে উঠেছে অভিভাবকদের আর্থিক সামর্থ্যের সমানুপাতিক। পরীক্ষা পদ্ধতিও কতটা গ্রহণযোগ্য, সেটা নিয়েও আছে বিতর্ক।
এই পরীক্ষায় ন্যায্যভাবে সবাইকে বিচার করা সম্ভব নয়। কারণ চার বছর বয়স থেকেই অনেককে গড়ে তোলা হয় সুনেউংয়ের জন্য। এর জন্য শিক্ষার্থীদের শুধু স্কুলের পড়াশোনা কার্যকর নয়। তাদেরকে ‘হ্যাগাওন’ বা ‘ক্র্যাম স্কুল’ বা কোচিং সেন্টারে পড়তে হয়। এগুলোতে এখন অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থাও আছে। দক্ষিণ কোরিয়াতে এক লাখেরও বেশি ক্র্যাম স্কুল আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি শিক্ষার্থী ক্র্যাম স্কুলে পড়াশোনা করছে। ২০১৮ সালে ক্র্যাম স্কুল ছিল ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি। এসব স্কুলে ক্লাস নিয়ে অনেক শিক্ষকই তারকা খ্যাতি পেয়েছেন। তারা বছরে কয়েক মিলিয়ন ডলার আয় করে থাকেন।
ক্র্যাম স্কুলে শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে ছয় দিনই ক্লাস করতে হয়। অনেক জায়গায় আবার ছুটির দিনও ‘রিভিশন’ ক্লাসের ব্যবস্থা থাকে। ব্যয়বহুল ক্র্যাম স্কুল অভিভাবকদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার দম্পতিরা তাই বাচ্চা নেওয়ার প্রতিই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। দেশটির প্রজনন হার বিশ্বের সর্বনিম্ন হারের তালিকার মধ্যে আছে।
সরকার জন্মহার বৃদ্ধির জন্য আর শিশুদের বিকাশের জন্য এই ক্র্যাম স্কুলগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। আইন অনুযায়ী রাত ১০টার আগে এই স্কুলগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করতে হয়। মূল স্কুলগুলোর পড়ানোর চেয়ে ক্র্যাম স্কুলের পড়া এগিয়ে রাখা যায় না। স্কুলগুলোর ফিও কমানো হয়েছে। কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়। অভিজাত শ্রেণির অভিভাবকরা ঠিকই সন্তানদের স্কাই প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর জন্য ব্যয়বহুল ক্র্যাম স্কুলে দিচ্ছেন। ফলে অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
তাছাড়া ক্র্যাম স্কুল ছাড়া সুনেউংয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা সম্ভবও নয়। মূলধারার স্কুলের পাঠ্যক্রম সরকারের ঠিক করে দেওয়া থাকে। কিন্তু সুনেউংয়ের সিলেবাস থাকে আলাদা। অনেক সময় পাঠ্যক্রম বিবেচনায় নেওয়া হয় না।
শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবোর্ডের বইয়ের চেয়ে সুনেউংয়ের জন্য বিশেষায়িত বইগুলোর প্রতিই মনোযোগ বেশি দিয়ে থাকেন। দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অজুহাতে মূলধারার স্কুলে অনুপস্থিত থাকেন, আর ক্র্যাম স্কুলে সময় বেশি দেন। কিছু শিক্ষার্থী স্কুল একেবারে ছেড়েই দেন পুরোদমে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। ২০২১ সালে ৫,০৯,৮২১ জন শিক্ষার্থী সুনেউংয়ের জন্য নিবন্ধন করেন। এর মাঝে ১৪,২৭৭ জন ড্রপ আউট হওয়া কিংবা স্কুলে নিয়মিত ছিলেন না। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ঘুমিয়ে পড়া খুবই নিয়মিত দৃশ্য। কারণ তারা রাত জেগে ক্র্যামের ক্লাসগুলো করেন। অনেকে স্কুলের শিক্ষকদের পড়ানো মনোযোগ না দিয়ে সুনেউংয়ের পরীক্ষার পড়াশোনা করেন। সুনেউং এদিক দিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার স্কুলের পড়াশোনা ধ্বংস করে দিচ্ছে।
সুনেউং তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৩০ থেকে ৮০ বছর বয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কমলেও ৯ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে সেটা কেবলই উর্ধ্বমুখী হচ্ছে। ২০১৯ সালে এই বয়সীদের ৮৭৬ জন আত্মহত্যা করে, যা ছিল প্রতি এক লাখে ৯.৯ জন। এর কতগুলোর জন্য সরাসরি কারণ ছিল সুনেউং এর পরীক্ষা। পরীক্ষার ফলাফলের ওপর বিজয়ী আর বিজিত নির্ধারিত হওয়ায় অনেকেই পরাজয় মেনে নিতে পারেন না। তারাই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
এসব সমস্যার সমাধানের জন্য দেশটির সচেতন নাগরিক আর বুদ্ধিজীবী সমাজ সুনেউং পরীক্ষা ব্যবস্থা বাতিল বা সংস্কারের পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়াতে পরিবর্তন আনাও জরুরি মনে করেন। কারণ শেষ পর্যন্ত সবাই আকর্ষণীয় চাকরি আর সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্যই এত কিছু করে।