১৫ বছর বয়সী আর দশজন কিশোরীর মতোই ছিল তার জীবন। বয়ঃসন্ধিকালীন নানা দুশ্চিন্তা, মিথ্যা মোহ, খামখেয়ালি- কোথাও কোনো ছন্দপতন ছিল না। বড় বোন সাহিমার মতে একেবারে সাধারণ একটি মেয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় তাকে। সমবয়সী অন্যান্য ব্রিটিশ মেয়েদের দেখাদেখি সারাক্ষণ অনুসরণ করে বেড়াত কার্দাশিয়ান বোনদের। কিন্তু হলিউডের ঘোর লাগা দৃষ্টি ছাড়াও দুনিয়াকে একেবারে নতুন করে আবিষ্কার করার এক দুর্বার আকর্ষণ ছিল শামীমার কিশোরী মনের।
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আর মাত্র ৪ মাস বাকি। ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশি বাবা-মা’র কন্যা শামীমাকে এককথায় সবাই মেধাবী, প্রগতিশীল আর বুদ্ধিমতী বলেই জানত। কাজেই তাকে নিয়ে সবার প্রত্যাশার পারদও ছিল গগনচুম্বী। ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পায়নি বেথনাল গ্রীন অ্যাকাডেমির এই শিক্ষার্থী তখন চুপিসারে পরিকল্পনা করছে ঘর থেকে পালিয়ে লন্ডনের পূর্ব প্রান্তে এক পরিচিত ব্যক্তির বাসায় ওঠার, যেখান থেকে সে নির্বিবাদে সিরিয়ায় পালিয়ে গিয়ে হতে পারবে জিহাদি বধূ! ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ত বা আইএসআইএল-এ (বর্তমান আইএস) যোগ দেয়াই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য।
স্কুলে শামীমার দুই বান্ধবী, খাদিজা সুলতানা (১৬) এবং আমীরা আবাসি (১৫), তার এই পরিকল্পনার অংশ ছিল। এই দুই বান্ধবীর সাথে পরিচয় ছিল শারমীনা বেগমের, মাস দুয়েক আগে সে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে। পাঁচ সদস্যের এই পরিকল্পনাকারী দলের মধ্যে শারমীনা যে ফ্লাইটে পালিয়েছে সেই ফ্লাইট থেকেই একজনকে আটক করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। কিন্তু তাদের নাকের নীচ দিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয় প্রথমে শারমীনা, আর তারপরে পালা আসে বাকি তিনজন। ইনস্টিটিউট ফর স্ট্রাটেজিক ডায়ালগের তথ্যানুযায়ী, শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই আনুমানিক ৫৫০ জন নারী ও কিশোরী পশ্চিমা দেশসমূহ থেকে আইএস বা ইসলামিক স্টেটে যোগদানের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছে। শামীমারাও ছিল সেই দলেরই সদস্য, যারা আইএসের মূলমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে।
২০১৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারির সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, শামীমা, খাদিজা ও আমীরা শীতের পোশাক হুডি পরে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা লাগিয়ে হাসিমুখে গ্যাটউইক বিমানবন্দরে পায়চারি করছে। তাদের দেখে এতটাই শান্ত আর নিশ্চিন্ত লাগছিল যে, মনে হচ্ছিল, তারা যেন স্কুল থেকে কোথাও শিক্ষাসফরে যাচ্ছে। তুর্কি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে সেখান থেকে ইস্তাম্বুল পৌঁছায় তারা। সুনিপুণভাবে ফন্দি এঁটেছিল মেয়েরা। বাড়ি থেকে সোনার গহনা চুরি করে বিক্রি করে ফ্লাইটের টিকেট কিনেছে, আরও কিছু নগদ অর্থ যেন হাতে থাকে তা-ও নিশ্চিত করেছে। সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকার যেখানে আইএস খেলাফতি করছে, সীমানা পেরিয়ে তাদের সেই অবধি পৌঁছে দেয়ার চুক্তিতে এক লোককে ঐ টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শামীমারা।
শারমীনা সিরিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পর স্কুলে যতজন মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তাদের মধ্যে এই তিনজনও ছিল। কিন্তু সাফল্যের সাথে পুলিশকে ধোঁকা দিতে সমর্থ হয় তারা। এসব ৪ বছর আগের কথা। রাশিয়ান এক বিমান হামলায় নিহত হয়েছে খাদিজা। ১৯ বছর বয়সী শামীমা উত্তর সিরিয়ার এক শরণার্থী শিবিরে তৃতীয় সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। প্রথম দুটি সন্তান অপুষ্টিজনিত কারণে মারা গেছে। আমীরা আর শারমীনাকে শেষবার জীবিত দেখা গেছে গত বছরের জুন মাসে আইএস অধ্যুষিত এক এলাকায়।
দুটি সন্তান হারিয়েছে শামীমা, তার যোদ্ধা স্বামী শত্রুশিবিরে বন্দী। সিরিয়ায় আসা নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই তার। কিন্তু অনাগত সন্তানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করায় আইএসকে পরিত্যাগ করেছে শামীমা। গত চার বছরের প্রতিটি দিন ভাগ্যের জোরে যুদ্ধ-বিগ্রহের সাথে লড়াই করে টিকে থাকা জিহাদি বধূ শামীমা এবার ঘরে ফিরতে চায়। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে ক্লান্ত মেয়েটি আবারও ব্রিটেনের পানে ফিরে যেতে চায়।
শামীমারা যখন সিরিয়ায় পৌঁছায়, আইএসের ডাবল এজেন্ট মোহাম্মদ রশিদ তাদের বোন বলে ডেকে সিরিয়ান পাসপোর্ট হাতে ধরিয়ে দেয়। আবু জেল্লার এক অবৈধ সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে সিরিয়ায় ঢোকে তারা। আইএসের এক সেফ হাউজে রাখা হয় তাদের, যাবতীয় কাগজপত্র, পরিচয়পত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় রাক্কা এলাকায়। প্রথমদিন তাদের ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় উম লাইথ নামক এক নারীর জিম্মায়। মেয়েদের মন থেকে পশ্চিমা অপসংস্কৃতি ঝেড়ে-মুছে শরিয়াহ মোতাবেক সঠিক জীবনবিধানের শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল উমের উপর।
প্রথম সপ্তাহে আইএসের কেউ তাদের উপর আস্থা পোষণ করেনি। আইএসের কোনো সদস্যের সাহচর্য ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি ছিল না তাদের। শরণার্থী শিবিরে বসে দ্য টাইমসকে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় সে দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে শামীমা। তারা বারংবার উমকে জিজ্ঞেস করত কেন অন্য নারীদের কাছে তাদের পাঠানো হচ্ছে না। তখন কোনো উত্তর না আসলেও পরবর্তীতে বুঝতে পারে তারা গুপ্তচর কি না তা নিশ্চিত না হয়ে তাদেরকে কোথাও পাঠানো হবে না। খুব শীঘ্রই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় শামীমাদের তিনজনের। খাদিজার বিয়ে হয় সোমালিয়ান এক জিহাদির সাথে। আমীরার বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান জিহাদি আবদুল্লাহ আলমীরের সাথে। বিয়ের কিছুদিন পরে বিমান হামলায় মারা যায় আবদুল্লাহ।
আর শামীমার বিয়ে হয় ধর্মান্তরিত ডাচ মুসলিমের সাথে। শামীমার ভাষ্যমতে তার জীবন ছিল একেবারে ‘স্বাভাবিক’। চারদিকে বোমা আর মৃত্যুর ঝুঁকি ছাড়া আর সবকিছুই তার খুব সহজ-স্বাভাবিক লাগছিল। চোখের সামনে কোনো হত্যাকাণ্ড না দেখলেও ময়লার স্তূপে কাটা মুণ্ডু দেখার অভিজ্ঞতা ছিল তার। আবেগহীন আর ধীরস্থির মস্তিষ্কের এক নারী যেন আটকা পড়েছে ১৯ বছর বয়সী শামীমার শরীরে। দুটি সন্তান হারানোর কষ্টও খুব বেশি দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে। তবে তৃতীয় সন্তানের বেলায় যেন একটু বেশি সচেতন সে। এ কারণেই ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে গেলে অন্তত বাচ্চাটা অপুষ্টিতে মারা যাবে না এটুকু সে নিশ্চিত।
খাদিজার কথা প্রায়ই মনে পড়ে তার। বিশ্বাসঘাতক এক গুপ্তচরের পাল্লায় পড়ে অকালে প্রাণ হারাতে হয় মেয়েটাকে। খাদিজার বড় বোন ফাহমিদা খানম খুব দৃঢ় বিশ্বাসী যে তার বোন এখনো বেঁচে আছে। আমীরার বাবা আবাসি হোসেনের ধারণা তার মেয়ে ভালো আছে। সবাইকে খুব হাসাতো মেয়েটা, বাচ্চার সেই ছবিগুলোই বুকে ধারণ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান তিনি। এখনো মানতে পারছেন না তার মেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এমন কোনো কাজে জড়িয়ে পড়তে পারে। যেখানে থাকুক ভালো থাকুক আমীরা, আর কিছুই চান না তিনি।
শামীমার বোন রেনু ২০১৫ সালে খুব করে বলেছিল তার বোন আইএসের সাথে জড়িত নয়, শারমীনাকে উদ্ধার করতে সিরিয়া গিয়েছে মেয়েগুলো। এখন বোনের অবস্থা দেখে নিজেকে আর কোনোভাবেই ধরে রাখতে পারছে না রেনু। গণমাধ্যম আর সরকারের কাছে হাতজোড় করে মিনতি করছে যে কোনোভাবে তার বোনকে যেন দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। বোনকে খুঁজে পেয়ে এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে তার গোটা পরিবার। শারমীনা চলে যাওয়ার পরে তার পরিবার বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তেমনটা ঘটেনি শামীমার বেলায়, তার পরিবারের অটুট মনোবল ছিল একদিন না একদিন শামীমা ফিরে আসবেই।
শারমীনার বাবা মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিন টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ব্রিটিশ সরকারের উচিত মেয়েদেরকে দেশে ফেরত আনা। তারা যেমন কষ্ট পাচ্ছে, তেমনি প্রতিটি মেয়ের পরিবারই তো কষ্ট পাচ্ছে। মেয়েরা ভুল করেছে এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে আরেকটা সুযোগ তারা পাবে না, এটা তো হতে পারে না। দেশ থেকে পালানোর সময় মেয়েগুলো ছোট ছিল, তাদের মগজ ধোলাই করে এই কাজ করানো হয়েছে। এবার পূর্ণবয়সে ঐ ভুলের পথে তারা আর পা বাড়াবে না এমনটাই মনে করেন নাজিমউদ্দিন।
সিরিয়ায় একসাথে গেলেও আইএস তাদেরকে এক জায়গায় থাকতে দেয়নি, একেকজনকে রাখা হয়েছে একেক এলাকায়। শরণার্থী শিবিরে এসে বেথনাল গ্রীন অ্যাকাডেমির এক মেয়ের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছে শামীমার। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কাকে বলে বুঝতে পেরেছে দুজনই। বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠা মেয়েদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। শামীমা জানায় মেয়েরা সবাই যে চলে আসতে চাচ্ছে, এমনটাও নয়। যাদের স্বামী মারা গেছে, স্বাধীন নারী হিসেবে ভবিষ্যৎ কর্তব্য ঠিক করা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব। নিজেকে সে এখন একজন মানুষ নয়, একজন মা হিসেবে দেখছে। সুস্থ একটি সন্তানের মা হয়ে বাকি জীবন কাটানো তার প্রধান লক্ষ্য।
ব্রিটিশ সরকার বলছে যেহেতু তারা আইএসে যোগ দেয়ার জন্য অনুতপ্ত নয়, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার তাই সন্দিহান। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের ফেরত আনতে চাচ্ছে না সরকার। এদের মধ্যে কয়েকজনের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়া হয়েছে ইতোমধ্যে। শামীমার ব্যাপারেও একই রকম সিদ্ধান্ত নেয়ার চিন্তা করছে যুক্তরাজ্য। তারা চাচ্ছে শামীমাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে।