ভ্রমণপ্রিয় শৌখিন যে মানুষেরা অবকাশ যাপনের জন্য একা, বন্ধুদের সাথে বা পরিবার নিয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য উন্নতমানের, আরামদায়ক, আকর্ষণীয় হোটেলের আবেদনই আলাদা। এই মানুষদের প্রয়োজনের তাগিদেই বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে বিলাসবহুল হোটেল ব্যবসা। এই ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের আনন্দ দিতে শুধু বিলাসবহুলই নয়, বিশ্বজুড়ে নানা জায়গায় গড়ে উঠেছে অদ্ভূতদর্শন আর আজব নির্মাণশৈলির কিছু কিম্ভূতকিমাকার হোটেল। চলুন জেনে আসি আজব সব হোটেলের কথা, যেগুলোর জুড়ি মেলা ভার।
১. আইসহোটেল, জাকাসজার্ভি, সুইডেন
আইসহোটেল, মানে বরফের হোটেল। শুধু নামই আইস হোটেল নয়, আক্ষরিক অর্থেই সুইডেনের জাকাসজার্ভি এলাকায় রয়েছে এক বরফের হোটেল। হোটেলের দেয়াল তো বটেই, সেই হোটেলের খাট থেকে শুরু করে বেশিরভাগ আসবাবপত্রই তৈরি বরফ দিয়ে। সেখানকার গড় তাপমাত্রা কত জানেন? মাইনাস ফাইভ ডিগ্রি সেলসিয়াস!
সুইডেনের এই আইসহোটেলটি যে কেবল বরফ দিয়ে তৈরি বলেই বিখ্যাত তা কিন্তু নয়। এর জনপ্রিয়তার মূল কারণ, এই বরফের হোটেলটি বছরের নির্দিষ্ট সময়ে, যখন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, সম্পূর্ণভাবে গলে হয়ে যায়। এবং প্রতি বছরের নভেম্বরে, যখন তাপমাত্রা কমতে থাকে, তখন এটি আবারও নতুন করে নির্মাণ করা হয়। প্রতি বছর বহু স্থপতির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শত শত টন বরফ দিয়ে নির্মিত হয় হোটেলের ঘরগুলো, প্রার্থনালয়, ভোজনালয় এবং পানশালা। অনন্যসাধারণ এই হোটেলটি তাই সুইডেনে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।
২. প্যালাসিও ডেল স্যাল, বলিভিয়া
প্রথমে তো বললাম বরফের হোটেলের কথা, এবার বলা যাক লবণের হোটেলের কথা। বলিভিয়ার প্যালাসিও ডেল স্যাল হোটেলটি বিশ্বের একমাত্র হোটেল, যেটি লবণ দিয়ে তৈরি। হোটেলের দেয়াল, ছাদ, মেঝে, এমনকি কিছু কিছু আসবাবও লবণ দিয়ে তৈরি। প্রচুর লবণের ব্লক একের পর এক যুক্ত করে নির্মাণ করা হয়েছে এ হোটেল।
বলিভিয়ার বিখ্যাত ‘সালার ডি ইউনি’র’ কথা কি শুনেছেন আগে? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লবনের সমভূমি। শুনে থাকলে এতক্ষণে বুঝে ফেলার কথা, সালার ডি ইউনিতেই রয়েছে প্যালাসিও ডেল স্যাল নামক এই লবননির্মিত হোটেলটি। যদি কখনো এখানে যাবার সুযোগ হয়, তবে সাবধান! দেয়ালে ফুটো করার চেষ্টা করবেন না ভুলেও। ছোট্ট একটি ফুটোর কারণেই ক্রমান্বয়ে ধ্বসে পড়তে পারে পুরো হোটেলের দেয়াল।
৩. আটার ইন, সুইডেন
সুইডেনের তৃতীয় বৃহত্তম স্বাদু পানির লেক, লেক ম্যাল্যারেনের উপর অবস্থিত এই হোটেলটিও অদ্বিতীয়। এখানে কেবলমাত্র একটি রুম আছে। লেকের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত আটার ইন হোটেলে রয়েছে পানির উপর ভাসমান একটি কেবিন ও একটি ডেক। সেগুলোর পাশে থাকা একটি সরু, খাড়া সিঁড়ি ধরে পানির নিচে গেলে রয়েছে সেই একমাত্র শোবার ঘর, যা আসলে একটি অ্যাকুরিয়াম। চারিদিকে পানি আর জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ, মাঝখানে ঘরের মধ্যে হোটেলের বাসিন্দা। চমৎকার এই হোটেলে পৌঁছতে হয় একটি ডিঙি নৌকায় করে, যেটি হোটেল কর্তৃপক্ষই সরবরাহ করে থাকে।
৪. দ্য মিরর কিউব, সুইডেন
সুইডেনের হারদাস নামক জায়গায় একটি হোটেল রয়েছে গাছের উপর, ট্রি হোটেল। গাছের উপর হোটেল এটাই তো মজার ব্যাপার, তার উপর আবার হোটেলটি যদি হয় কাচের তৈরি কিউব, তবে তো ব্যাপারটা একেবারে জমে ক্ষীর! এ কারণেই এই হোটেলকেও দুনিয়ার সবচেয়ে আজব হোটেলের তালিকায় রাখা যায়।
গাছের গুড়ির উপরে ৬৪ ঘন মিটারের অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স চারপাশে আয়না দিয়ে ঘেরা, যে আয়নায় রুমের বাসিন্দারা ভেতর থেকে দেখতে পাবে চারপাশের পুরো পরিবেশ- বিস্ময়াভিভূত হওয়ার জন্য আরও কোনো তথ্যের দরকার কী আছে! এই হোটেলে একই আকারের বেশ কয়েকটি ঘর আছে গাছে গাছে, যেগুলোতে রয়েছে একটি করে ডাবল বেড রুম, রিডিং রুম এবং বাথরুম। গাছের উপর হোটেলের রুমগুলোতে যেতে ব্যবহৃত হয় একটি দড়ির ব্রিজ।
৫. মারমারা আন্টালিয়া, তুরস্ক
নিচের ছবিতে যে বৃত্তাকৃতির হোটেল দেখছেন, সেটির নাম মারমারা আন্টালিয়া। তুরস্কের এই হোটেলে রয়েছে ২১৪টি ঘর, যেগুলোর প্রতিটির ব্যালকনি থেকে আপনি দেখতে পাবেন আন্টালিয়া শহর, তাওরুস পর্বতমালা এবং ভূমধ্যসাগর। ভাবছেন, কী করে? এটিই এই হোটেলের বিশেষত্ব, যা একে করেছে অনন্য।
হোটেলটি আসলে ঘূর্ণায়মান। হোটেলটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে এটি ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুরতে থাকে, যার ফলে চারপাশের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যপট সুন্দরভাবে অবলোকন করা যায় প্রতিটি রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই।
৬. প্লেন হোটেল, কোস্টারিকা
কোস্টারিকার এই হোটেলটি দূর থেকে দেখলে হঠাৎ ভুল করে মনে হবে, একটি বোয়িং ৭২৭ প্লেন বুঝি ক্রাশ করে পড়ে আছে গাছের উপরে। কিন্তু সত্যি হলো- সেই দেশের সান জোসে এয়ারপোর্ট থেকে বাতিল এই প্লেনটি একটি জঙ্গলে এনে গাছের উপর হোটেল নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে।
প্লেনের ভেতরে সেগুন কাঠের আসবাব দিয়ে নতুন করে সাজানো হয়েছে হোটেল রুম হিসেবে। প্লেনের ডানদিকের পাখায় কাঠের একটি পাটাতন এমন করে তৈরি করা হয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে হোটেলের কাস্টমাররা চারদিকের সুন্দর দৃশ্য অবলোকন করতে পারে। মাটি থেকে ৪৫ ফুট উঁচুতে গাছের উপর এই প্লেন হোটেল স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে আরাম-আয়েশের সাথে নির্জনতায় হারিয়ে যাওয়া যাবে কিছু সময়ের জন্য।
৭. কোকোপেল্লি’স কেভ ব্রেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট, ফ্রেমিংটন, নিউ মেক্সিকো
পর্বতের গায়ে গুহার ভেতরে এক রুমের এই হোটেলটি নির্মিত হয়েছে ১৯৮০ সালে। পর্বতচূড়া থেকে একশো ফুট নিচে গড়ে তোলা হয়েছে এটি। নানাবিধ জিনিসপত্র, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং আলো-বাতাস যাতায়াতের সুবিধার্থে তিনটি বড় বড় ফুটো তৈরি করা হয়েছে পর্বতচূড়া থেকে। আরাম-আয়েশ আর রোমাঞ্চের যথেষ্ঠ ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। তবু এ হোটেলে থাকতে গেলে কেবল অর্থ থাকাই যথেষ্ট নয়, দরকার পর্যাপ্ত দক্ষতা ও সাহসিকতারও। কেননা, খাড়া পর্বতগাত্রে মই বেয়ে এ হোটেলে পৌঁছতে গেলে জীবননাশেরও সম্ভাবনা আছে।
৮. সোভোটেল, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া
বুটিক হোটেল! সে আবার কী? একটি হোটেল আর একটি শপিংমল কি একই বিল্ডিংয়ে! হতেই তো পারে, এ আবার নতুন কি! হোটেলের ছবি দেখে সেটিই ভাবছেন তো? যা ভাবছেন তা নয়। সোভোটেল নামের এই হোটেলটি মোটেও সাধারণ নয়। এটি শপিংমলের পাশে কোনো হোটেল নয়, বরং পুরো শপিংমলই একটি হোটেল।
এই হোটেলে আপনাকে ঘুমানোর জন্য আরামদায়ক ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। দেওয়া হবে স্লিপ মাস্ক, বালিশ এবং ঠান্ডা ধাঁচের গান শোনার ব্যবস্থা। চাইলে ঘুমানোর জন্য বিছানাও পাওয়া যাবে এখানে। আপনি এখানে মন ভরে কেনাকাটা করবেন। যখন কেনাকাটা করতে করতে ক্লান্ত হবেন, তখন আরামে ঘুম দেবেন। ঘুম থেকে উঠে আবারও পূর্ণোদ্দমে শপিং করতে শুরু করবেন।
৯. প্রপেলার আইল্যান্ড সিটি নজ, বার্লিন, জার্মানি
জার্মানির বার্লিনে অবস্থিত এই হোটেলকে শুধু আজবই নয়, পাগলাটেও বলা চলে। এ হোটেলের আছে ২৭টি ঘর, প্রত্যেকটিরই রয়েছে অদ্ভুতুড়ে বৈশিষ্ট্য। যেমন- একটি যদি হয় কারাগারের সেলের মতো, তবে অন্যটি কাচ দিয়ে তৈরি। কী, যথেষ্ট পাগলাটে মনে হচ্ছে না? তবে শুনুন এ হোটেলের রুমের বর্ণনা। টু লায়ন রুম (দুটি সিংহের খাঁচা রয়েছে এ রুমে, যার মধ্যে ঘুমানো যাবে), কফিন রুম (কফিনের মধ্যে শোবার ব্যবস্থা), ব্লু রুম (পুরো রুমের সবকিছুই নীল), আপসাইড ডাউন রুম (উপরের দিকে শোবার ব্যবস্থা, নিচের দিকে ছাদ) সহ আরও কত কী!
১০. ডগ বার্ক পার্ক ইন, কটনউড, আইডাহো, যুক্তরাষ্ট্র
দৈত্যাকৃতির একটি শিকারী কুকুরের আদলে বানানো হয়েছে একটি হোটেল। ১৫ ফুট চওড়া এবং ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট কুকুরটির আবার একটি গালভরা নামও আছে- সুইট উইলি। এই কুকুরের পেটেই রয়েছে একটি ডাবল বেডের কামরা, থুতনির দিকে রয়েছে একটি চিলেকোঠা। শুধু যে হোটেলের আকৃতিই কুকুরের মতো তা-ই নয়, হোটেলের রুমের ভেতরের সাজসজ্জা, কম্বলসহ সবকিছুতেই আছে কুকুরের ছাপ। অন্যদের কাছে হোটেলটি আজব মনে হলেও কুকুরপ্রেমীদের জন্য এটি হতে পারে একটি অসাধারণ হোটেল।