একটা সময় পর্যন্ত জাপানিদের সুখ্যাতি ছিল পরস্পর মিলেমিশে বসবাসের জন্য। কাজকর্ম, আড্ডা, মদের আসর সবকিছুতেই তাদের সহজতা প্রবণতা ছিল দল হিসেবে থাকার। একটা সময়ে কোনো জাপানি নাগরিকের একাকী মধ্যাহ্নভোজ সারার দৃশ্য রীতিমতো বিরল ছিল। কেউ একাকী দুপুরের খাবার সেরে নিচ্ছেন নিজের মতো করে, নিভৃতে- এ এক অকল্পনীয় দৃশ্য। সবার কাছে ব্যপারটা এতটাই অস্বাভাবিক এবং উদ্ভট লাগত যে কারও যদি একাকী খেতেই ইচ্ছে হতো তাহলে তিনি বাথরুমে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে খেয়ে নিতেন। ভাবা যায় বলুন তো- সঙ্গীহীন থাকাটা এতটাই নীচু চোখে দেখা হয় যে শেষমেশ শৌচাগারে গিয়ে খাবার দাবারের পাট চুকাতে হতো!
কিন্তু ধীরে ধীরে এই প্রবণতা বদলে যাচ্ছে। জাপানীদের মাঝে ‘একলা চলো রে’ মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। একসময় যে জাতির কাছে একাকীত্ব এতটা নেতিবাচক হিসেবে আবির্ভূত হতো তারাই কিনা এখন ‘গো সোলো’ স্লোগানে বিশ্বাসী! একাকীত্বের কালিমা মোচনে কাউকে আর শৌচাগার পর্যন্ত তো যেতে হয়ই না বরং জীবনের সর্বক্ষেত্রে সকলে যাতে একাকীত্বের অভিজ্ঞতা নিতে পারেন সেই যজ্ঞই চলছে। রেস্তোরাঁর নকশা বদলে যাচ্ছে, বারে মদ পানে আসর বসানোর বদলে একাকী শুরা পানকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে, কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে এবং আরও কত কী। জাপানীদের সামগ্রিক জীবনযাত্রায় একলা থাকি, একলা চলি, একলা বাঁচি দৃষ্টিভঙ্গির এই জাগরণকে অভিহিত করা হয়েছে ‘ওহিতোরিসামা’ নামে।
ওহিতোরিসামার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইংরেজি অনুবাদ হতে পারে ‘পার্টি অভ ওয়ান’। অর্থাৎ প্রত্যেকে উপভোগ করছে তবে সম্মিলিতভাবে না, যে যে যার যার নিজের মতো করে। অত্যন্ত জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইন্টাগ্রামে বেশ কিছুদিন ধরেই হ্যাশট্যাগ ওহিতোরিসামার তুমুল জোয়ার। গত প্রায় দেড় বছর যাবৎ জাপানিদের মাঝে ওহিতোরিসামার প্রতি সমর্থনের আকাশচুম্বী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর পাশাপাশি পত্র পত্রিকাতেও উল্লেখযোগ্য হারে দেখা যাচ্ছে যে রেস্তোরাঁয় একজনের জন্যই আহারাদির ব্যবস্থা করা, রোমাঞ্জকর অভিযানে বেরিয়ে পড়ছে মানুষ নিজে নিজেই, সিনেমা হলগুলোতে প্রায় সকলেই আসছেন সঙ্গীহীন অবস্থায়।
রেস্তোরাঁগুলোতে এককালে অত্যন্ত স্বাভাবিক দৃশ্য ছিল ‘হিতোরি ইয়াকিনিকু’ যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ঝলসানো মাংস। অর্থাৎ তুলনামূলক স্বল্প দৈর্ঘ্যের একটি টেবিলের চারপাশে সকলে বসে একসাথে মজা আর গল্প করে এবং সকলে মিলে মাংস ঝলসিয়ে খাবে। অথচ এই দৃশ্য এখন ওহিতোরিসামার কারণে হারানোর পথে। ওহিতোরিসামার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণের ফলে জাপানিরা এখন দলবদ্ধভাবে এই আয়োজনটিকে উপভোগ করার বদলে একাই যাচ্ছেন রেস্তোরাঁয়, নিজেই মাংস ঝলসিয়ে খাচ্ছেন; প্রত্যেকে পৃথক পৃথকভাবে। শুধু যে খাবারের ক্ষেত্রেই এই রূপবদল তা কিন্তু না। কারাওকে সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সিঙ্গেল কারাওকের ব্যবস্থা করছেন প্রচুর পরিমাণে। মোট কারাওকে খদ্দেরদের মাঝে এখন প্রায় ৪০% সুরের সাথে গলা সাধতে ভালোবাসেন সম্পূর্ণ একাকী।
দলবদ্ধতা বা পারস্পরিক বন্ধনের সংস্কৃতি থেকে জাপানিদের বেরিয়ে আসার এই চর্চা শুধু খাওয়া আর আড্ডার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। একাকী চলার যে চিন্তাধারা সেটিকে তারা অনেকটা নিজেদের মননে ধারণ করেছেন। অর্থাৎ জীবনযাত্রার সামগ্রিক ধারায় তারা আসলে একাকীই চলতে ইচ্ছুক। বিয়ের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ছে। আগের তুলনায় মানুষ বর্তমানে অবিবাহিত থাকাতেই আরামদায়ক বোধ করছেন। ২০১৫ সালে ২০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মাঝে মাত্র ৫৪% জাপানি বিবাহিত অবস্থায় ছিলেন। বিবাহিতদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যাও। চলমান পরিস্থিতিতে প্রতি তিনটি বিবাহিত দম্পতির দাম্পত্য জীবন শেষ অবধি বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়।
১৯২০ সালে করা জাপানের প্রথম আদমশুমারির পরবর্তী ৭ দশকে কখনোই অবিবাহিত (পুরুষ এবং নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই) নাগরিকের সংখ্যা ৫% এর বেশি হয়নি। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জাপানের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বিয়ে ছিল একটি সর্বজনীন ঘটনা। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হলে মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে এটিই ছিল চল বা অন্যভাবে বললে অবিবাহিত থাকার ঘটনা ছিল একেবারেই বিরল। ১৯৯০ এর পর থেকে এই চিত্রটি বদলে যেতে শুরু করে। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত আদমশুমারিতে দেখা গেলো যে ২৩.৪% পুরুষ এবং ১৪.১% নারী অবিবাহিত।
ধারণা করা যাচ্ছে যে ২০৪০ সাল নাগাদ প্রতি তিনজন পুরুষের মাঝে একজন এবং প্রতি পাঁচজন নারীতে একজন তাদের জীবনের পুরোটা জুড়ে অবিবাহিত অবস্থায় রয়ে যাবেন। এই অবস্থার দিকে জাপান যে সত্যিই এগোচ্ছে তার একটা প্রমাণ হতে পারে প্রতি বছরে বিবাহের সংখ্যা। ১৯৭৩ সালে মোট বিবাহের সংখ্যা ছিল ১.১ মিলিয়ন (১১ লক্ষ) যেটি ২০১৮ সালে কমে হয়েছে ৫ লক্ষ ৯০ হাজার।
অবিবাহিত থাকার পেছনে নিজের চাহিদার সুযোগ্য সঙ্গী না পাওয়াও একটি কারণ। জাপানের মোট জনসংখ্যার মাঝে পুরুষের উপস্থিতি নারীদের চেয়ে অনেক বেশি। পুরুষরা অনেক ক্ষেত্রেই বিয়ে করতে ইচ্ছুক থাকলেও নারীদের সংখ্যা কম থাকায় নিজের মনমতো জীবনসঙ্গিনী খুঁজে পান না। এসব পুরুষদের ক্ষেত্রে একাকী জীবন কাটানোটা মূলত বাধ্য হয়ে করা। জাপানে অবিবাহিত পুরুষের সংখ্যা অবিবাহিত নারীর চেয়ে প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন বেশি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে এই সমস্যাটি শুধু জাপানের একার না বরং পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশই একই সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ চীনের কথা প্রণিধানযোগ্য। চীনে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা ৩০ মিলিয়ন বেশি এবং সেখানেও অবিবাহিত থাকার চিত্রটা মোটামুটিভাবে জাপানের মতোই।
সামাজিক পরিবর্তনের এই ধারাটি জাপানের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই। জন্মহার কমে যাওয়া, বিয়ের বয়স ক্রমেই বেড়ে যাওয়া এবং একটি উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো দেশে দেশে নাগরিকদের একাকী জীবনযাপনের জন্য দায়ী। লন্ডনভিত্তিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনালের পূর্বাভাসানুযায়ী ২০০০ থেকে ২০৩০ সালের মাঝে একা বাসা ভাড়া করে থাকার প্রবণতায় রেকর্ড পরিমাণ ১২৮% বৃদ্ধি হবে। গেল বছরে জাপানে জন্মেছিল মাত্র ৮৬৪,০০০ টি শিশু যা ১৮৯৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সর্বনিম্ন।
কিছু দেশে একলা চলাচলের ব্যপারটা বেশ স্বাভাবিক, যার কারণে যে কেউ যেকোনো বয়সেই একাকী থাকলেও লোকে অবাক হয় না কিংবা বাঁকা চোখে দেখে না। যুক্তরাষ্ট্রের অভিনেত্রী ক্রিস্টিনা হেন্ড্রিক্স হ্যাশট্যাগ সোলোডেট (#solodate) দিয়ে নিজের ছবি পোস্ট করছেন ইন্সটাগ্রামে। সৌন্দর্যের আরেক নাম এমা ওয়াটসন নিজের একা থাকাকে বেশ গর্ব ও আত্মবিশ্বাসের সাথেই স্বীকার করে থাকেন। নিজেকে তিনি গণমাধ্যমের সামনে পরিচয় দেন সেলফ পার্টনার্ড বলে এবং তিনি বেশ দৃঢ়তার সাথে নিজের সুখী থাকার কথা ব্যক্ত করেন। এমনকি পশ্চিমের কিছু কিছু দেশে একা থাকাটাকে এত বেশি স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয় যে সেখানে একাকী বারে গিয়ে মদ্যপান আর বই পড়ার ওপর নির্দেশিকাও লেখা হয়ে থাকে।
নারীরা একাকী ভ্রমণে অভ্যস্ত হওয়ার মাধ্যমে এটাকেই তাদের পেশা হিসেবে নিচ্ছেন এবং এর বদৌলতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। কিন্তু জাপানের বিষয়টা সেসব দেশের মতো এতটাও স্বাভাবিক না কিংবা বলা ভালো প্রথাগত না। সুতরাং আসছে বছরগুলোতে জাপান তার নাগরিকদের এই নব্য একলা চলার নীতিকে কীভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার করবে সেটিই দেখার বিষয়।