একটি লাশের সন্ধান
২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল। ভোর ৬টা ৩৫ মিনিট। সিডনি শহরের পূর্ব দিগন্তে সূর্য তখন কেবল উঁকি দিচ্ছে। ঠিক ঐ সময়ই ক্যাম্পসি এলাকার বিমিশ স্ট্রিট ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক ভদ্রলোক। বিমিশ আর ফ্লেচার স্ট্রিট যেখানে একসাথে মিলেছে, তার কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। তার সামনে পড়ে আছে একটি মৃতদেহ!
যে মানুষটির মৃতদেহ পড়ে আছে, তার বয়স আনুমানিক ৫০ বছর। দেখে মনে হয় এশিয়ার কোনো দেশে তার জন্ম। মাঝারি গড়ন, উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের একটু উপরে। পরনে ফুলহাতা নীল রঙের চেক শার্ট, সাথে ক্রিম কার্গো প্যান্ট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বেশ অনেকক্ষণ আগেই ইহলীলা সাঙ্গ হয়েছে তার।
পুলিশকে খবর দেয়া হলো। পুলিশ এসে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত ঘোষণা করলো মানুষটিকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, আত্মহত্যা করেছে মানুষটি। শার্ট ও প্যান্টের প্রতিটি পকেট হাতড়ে দেখা হলো। একটি ওপাল ট্রান্সপোর্ট কার্ড ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। মানিব্যাগ বা খুচরো পয়সা তো নয়ই, এমনকি কোনো কাগজপত্র বা আইডি কার্ডও না, যা থেকে মানুষটির নাম-পরিচয় জানা যায়।
সিডনি শহরে কারও নাম-পরিচয় বের করতে ওপাল কার্ড খুবই কাজে দেয়। কারণ ওপাল কার্ড সাধারণত কোনো একটি বাড়ি বা ইমেল ঠিকানায় নিবন্ধন করা থাকে, সেই সাথে সংযুক্ত থাকে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। তাই পুলিশের পক্ষে ঐ কার্ডের মালিককে খুঁজে বের করা কোনো ব্যাপারই না।
জমে উঠলো রহস্য
কিন্তু এই বিশেষ ক্ষেত্রে সেই সহজ কাজটি কেবল কঠিনই নয়, পুরোপুরি অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। একে তো কার্ডটি অনিবন্ধিত, তার উপর আবার নগদ টাকার বিনিময়ে সেটি তোলা হয়েছে এমন একটি জায়গা থেকে, যেখানে কোনো সিকিউরিটি ক্যামেরাই ছিল না!
ওপাল কার্ডটি তাই বিশেষ কোনো কাজে এলো না। কেবল এটুকুই জানা গেল যে, মৃত মানুষটির যাত্রা সবসময় শুরু বা শেষ হতো ‘ড্যান’স কর্নার’ নামক একটি বাস স্টপে। এবং তার লাশও উদ্ধার করা হয়েছে ঐ বাস স্টপের খুব কাছ থেকেই।
এছাড়াও ওপাল কার্ডের হিস্টোরি বলছে, মানুষটি সর্বশেষ ১০ এপ্রিল বিকাল ৪.৪২-এ বাস থেকে নেমেছিল। মাত্র ২৫০ মিটার (৮০০ ফুট) আগে বাসে উঠে, একটি এশিয়ান গ্রোসারি শপের সামনে নেমে গিয়েছিল সে।
রহস্য আরও ঘনীভূত হলো। কে এই মানুষটি? কী তার পরিচয়? কীভাবেই বা মৃত্যু হলো তার? এসব প্রশ্নের সদুত্তর পেতে পুলিশ চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখল না।
চলতে থাকল তদন্ত
লাশটি যেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, তার আশেপাশের অঞ্চলের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, কেউ মানুষটিকে চেনে কি না। যে বাস স্টপ থেকে সে নিয়মিত বাসে উঠত, সেই একই বাস স্টপে যাতায়াতকারী অন্য কেউও তাকে চিনতে পারল না।
পুলিশের তরফ থেকে সিডনির স্থানীয় চীনা ভাষার টিভি চ্যানেলগুলোতে মানুষটির ছবি বারবার দেখানো হলো, এই আশায় যে কেউ যদি তাকে চিনতে পেরে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু না, কেউই এগিয়ে এলো না।
ইতিমধ্যেই পোস্ট-মর্টেম হয়ে গেছে মানুষটির। পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলো আরও চমকপ্রদ একটি তথ্য: মানুষটি মরণব্যাধী মাল্টিপল মাইলোমায় ভুগছিল। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছিল তার পায়ের হাড়ের ক্ষতচিহ্ন থেকে। এছাড়াও নিয়মিত নন-টক্সিক লেভেলের প্যারাসিটামল সেবন করে আসছিল সে।
নাম-পরিচয়হীন মানুষটি হয়ে গেল ‘অজ্ঞাতনামা’
শেষ পর্যন্ত সিডনির তৎকালীন স্টেট করোনার লেস ম্যাবাট (ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেছেন তিনি) তার প্রতিবেদনে মানুষটিকে ‘অজ্ঞাতনামা’ হিসেবে চিহ্নিত করেন, এবং সন্দেহ প্রকাশ করেন সে হয়তো একজন ‘বেআইনি অনাগরিক’ ছিল। যেসব অভিবাসী অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বাস করে, তাদেরকে এ নামে অভিহিত করা হয়।
প্রতিবেদনে ম্যাবাট লেখেন, “সে হয়তো কারও পুত্র, কারও ভাই, এবং সম্ভবত কারও বাবাও। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অস্ট্রেলিয়া কিংবা বাইরেও এমন কেউ নেই যে জানে সে কে ছিল, তার সাথে আসলে কী ঘটেছিল।”
কিন্তু এই আধুনিক সময়েও কি এমনটা সম্ভব যে একটা মানুষ তার অস্তিত্ব পুরোপুরি আড়াল করে এতদিন বেঁচে ছিল, এবং কেউ তার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে পুলিশের কাছে কোনোদিন রিপোর্টও করেনি?
বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তাই পুলিশ ঐ রাস্তার প্রতিটি বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নেড়েছে, জনে জনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু কোনো সাফল্য পাওয়া যায়নি। সাম্প্রতিক অতীতে ‘হারিয়ে যাওয়া’ মানুষদের ভেতরেও কারও শারীরিক বিবরণের সাথে এই মানুষটির সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মানুষটির লাশ যে রাস্তা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, তার আশেপাশের অন্যান্য রাস্তার সিসিটিভি ফুটেজও খতিয়ে দেখা হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি তাতেও। মানুষটি বুঝি অন্য কোনো রাস্তা পাড়ি না দিয়ে সরাসরি ঐ রাস্তায় এসে হাজির হয়েছিল, আর ওখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিল!
হাল ছেড়ে দিল পুলিশ
শেষমেষ তদন্তকারী পুলিশের কাছেও মানুষটির ‘বেআইনি অনাগরিক’ হওয়ার সম্ভাবনাকেই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। এবং এমন মনে হওয়ার পেছনে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যাও আছে তাদের কাছে, “ঐ এলাকায় এমন অনেক শেয়ার হাউজ ও বোর্ডিং হাউজ রয়েছে যেখানে ‘বেআইনি অনাগরিক’রা থাকতে পারে।”
অজ্ঞাতনামা মানুষটিকে সম্ভাব্য ‘বেআইনি অনাগরিক’ হিসেবে ধরে নিলে আরও কিছু ব্যাপারে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতেও পুলিশের পক্ষে সুবিধা হয়। যেমন মানুষটি অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বাস করছিল বলেই তার কোনো আইডি কার্ড ছিল না, ওপাল কার্ডটিরও নিবন্ধন করা ছিল না, এবং তার মৃত্যুর পরও কেউ তার লাশ গ্রহণ করতে আসার সাহস পায়নি।
আরও কিছু ক্ষীণ সম্ভাবনা রয়েছে, যেমন মানুষটি হয়তো মানসিকভাবে সুস্থ ছিল না (যদিও তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি), কিংবা সে হয়তো তার পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল, যারা অস্ট্রেলিয়ারই অন্য কোনো এলাকায় বাস করে।
করোনার ম্যাবাট নিজেও কোনো তত্ত্বেই পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারেননি বলে তার প্রতিবেদন শেষ করেছেন এভাবে, “আমরা কেবল এটুকুই আশা করতে পারি যে ভবিষ্যতে হয়তো এমন কোনো তথ্য সামনে আসবে, যার সাহায্যে আমরা লাশটির প্রকৃত পরিচয় জানতে পারব, এবং যারা তাকে জানতো, তাদের কাছে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারব।”
ক্যাম্পসি: সিডনির অজ্ঞাতনামাদের দুনিয়া
ক্যাম্পসি এলাকাটির অবস্থান সিডনির ধনাঢ্য বন্ডি বীচের চেয়ে মাত্র ২০ কিলোমিটার (১২ মাইল) দূরে। কিন্তু এই এলাকাটি যেন বন্ডি বীচের থেকে একদমই আলাদা কোনো জগতের অংশ।
সিডনির অপেক্ষাকৃত সচ্ছল এলাকাগুলো থেকে এই এলাকার মানুষের গড় সাপ্তাহিক আয় দুই-তৃতীয়াংশ কম। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ক্যাম্পসিতে বর্তমানে বসবাসকারীদের মধ্যে মাত্র এক-তৃতীয়াংশের জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়, এবং এই এলাকায় প্রতি তিনজনে একজন ব্যক্তি বাড়িতে চীনা ভাষায় কথা বলে।
এই এলাকায় অসংখ্য বোর্ডিং হাউজ রয়েছে, যেখানে নিজেদের নাম-পরিচয় লুকিয়ে বা পরিবর্তন করে ‘বেআইনি অনাগরিক’ ব্যক্তিরা অনায়াসে দিনের পর দিন থাকতে পারে।
সাধারণত যা হয়, একজন ব্যক্তি হয়তো সংক্ষিপ্ত মেয়াদের ভিসায় অস্ট্রেলিয়ায় আসে, এবং নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও তারা এ দেশে থেকে যায়। তারা এখানেই কাজ করতে থাকে, এবং গোপনে নিজের দেশে টাকা পাঠাতে থাকে। এমনও দেখা গেছে যে, প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ার আগে কেউ কেউ এক দশকেরও বেশি সময় অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় বাস করে ফেলেছে।
দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে অজ্ঞাতনামারা
মনাশ ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক মেরি সেগ্র্যাভের মতে, এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়ায় ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ অভিবাসী অবৈধভাবে বাস করছে। তাদের এক-তৃতীয়াংশই অবৈধভাবে কাজও করছে। কিন্তু এমন অনেকেই আছে যারা খুবই দুঃসময় পার করছে। ধরা পড়ার ভয়ে অনেকে কোনো বেতন ছাড়াই শুধু ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থায় বেঁচে আছে।
নাগরিকত্ব ও আত্মপরিচয় না থাকায় এই ‘বেআইনি অনাগরিক’রা কোনো নাগরিক সুবিধাই পাচ্ছে না। এমনকি তারা মারা গেলে কেউ মৃতদেহটা পর্যন্ত দাবি করছে না। ‘অজ্ঞাতনামা’ হিসেবেই তাদের লাশ রয়ে যাচ্ছে মর্গে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/