২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন ভারতীয় সরকার দেশটির সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ এবং অনুচ্ছেদ ৩৫(ক) বাতিল ঘোষণা করে, যার মাধ্যমে ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের যে সীমিত স্বায়ত্তশাসন ছিল সেটি বিলুপ্ত হয়। পরবর্তী দিন, অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট ভারতীয় আইনসভায় ‘জম্মু ও কাশ্মির পুনর্গঠন আইন, ২০১৯’ প্রস্তাবিত হয়, যেটি ৯ আগস্ট অনুমোদন লাভ করে। এই আইনের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যকে দ্বিখণ্ডিত করা হয় এবং ‘জম্মু ও কাশ্মির’ ও ‘লাদাখ’ নামে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (Union Territory) সৃষ্টি করা হয়।
জম্মু ও কাশ্মিরের নিজস্ব আইনসভা থাকবে, কিন্তু লাদাখের নিজস্ব আইনসভা থাকবে না, এবং উভয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য একজন করে লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। এর ফলে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়, অন্যদিকে লাদাখ প্রাক্তন জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের একটি বিভাগ থেকে একটি স্বতন্ত্র কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে উন্নীত হয়। লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মির থেকে পৃথক করার কারণ হিসেবে ভারত সরকারের যুক্তি- লাদাখের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এটি প্রয়োজন ছিল।
বিজেপি সরকার কর্তৃক জম্মু ও কাশ্মিরের সীমিত স্বায়ত্তশাসন বাতিল করা নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে ও বাইরে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু যে কারণেই হোক, জম্মু ও কাশ্মির থেকে লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করা নিয়ে ততটা আলোচনা হয়নি। অথচ লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করার ফলে ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির ৫৮.৩৫% ভূমি হারিয়েছে। সত্যিই কি লাদাখকে কেবল অর্থনৈতিক প্রয়োজনে জম্মু ও কাশ্মির থেকে পৃথক করা হয়েছে? এ সম্পর্কে আলোচনার জন্য প্রথমে লাদাখের ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক এবং নৃতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা জরুরি।
লাদাখ, যেটি ভূগোলবিদ ও নৃতাত্ত্বিকদের কাছে ‘ক্ষুদ্র তিব্বত’ নামে পরিচিত, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল তিব্বতের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিভিন্ন ভারতীয় সাম্রাজ্য (যেমন: কুষাণ সাম্রাজ্য) এবং তিব্বতের অধীনে দীর্ঘদিন থাকার পর ৯ম শতাব্দীতে লাদাখ একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্য, মুসলিম-শাসিত কাশ্মির এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংঘাতের ফলে লাদাখের স্বাধীনতা দারুণভাবে হ্রাস পেলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্যন্ত লাদাখ একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে টিকে ছিল। ১৮৩৪ সালে শিখ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ সামন্ত রাজ্য জম্মুর রাজা গুলাব সিং লাদাখ দখল করে নেন। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে শিখদের পরাজয়ের পর শিখরা কাশ্মিরকে ব্রিটিশদের কাছে সমর্পণ করে এবং ব্রিটিশরা কাশ্মিরকে জম্মুর রাজার কাছে বিক্রি করে দেয়। এর ফলে সৃষ্টি হয় জম্মু ও কাশ্মির রাজ্য, যেটি ব্রিটিশ-ভারতের একটি স্বশাসিত আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়।
প্রশাসনিকভাবে লাদাখ ছিল এই জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের একটি ‘ওয়াজারাত’, যার শাসনকর্তাকে বলা হত ‘ওয়াজির-এ-ওয়াজারাত’। লাদাখ ওয়াজারাত ৩টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল- লেহ, কারগিল এবং স্কার্দু। ১৯৪৭-৪৯ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান স্কার্দু অঞ্চলটি দখল করে নেয়, যেটি বর্তমানে পাকিস্তানের গিলগিট-বালতিস্তান প্রশাসনিক অঞ্চলের অংশ। লাদাখের অবশিষ্ট অংশ ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের একটি বিভাগে (Division) পরিণত হয়।
এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে লাদাখ জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের অংশ হলেও অঞ্চলটি অর্থনৈতিকভাবে গিলগিট, বালতিস্তান এবং তিব্বতের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর গিলগিট ও বালতিস্তান পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ১৯৫০ সালে চীনের কমিউনিস্ট সরকার তিব্বত দখল করে নেয়। ফলে এই অঞ্চলগুলোর সঙ্গে লাদাখের অর্থনৈতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং লাদাখ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
লাদাখের ওপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ ছিল না। পাকিস্তান ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের সম্পূর্ণ অংশ (লাদাখ-সহ) নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে আনতে আগ্রহী। চীনও লাদাখকে তিব্বতের একটি অংশ হিসেবে দাবি করে। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময় লাদাখ একটি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং চীন লাদাখের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত জনবিরল ‘আকসাই চিন’ অঞ্চলটি দখল করে নেয় (৩৭,২৪৪ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট আকসাই চিন অঞ্চলটির অধিকাংশ বর্তমানে চীনের জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের খোটান প্রিফেকচারের (Prefecture) খোটান কাউন্টির অংশ; অবশিষ্ট অঞ্চল চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অন্তর্গত)। অর্থাৎ ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারত লাদাখের প্রায় ৩৮% ভূমি হারিয়েছে চীনের কাছে। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের সময় পশ্চিম লাদাখ আবারও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। এবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে, যদিও এই যুদ্ধে লাদাখের সীমান্তের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বর্তমানে লাদাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের উত্তরে চীনের জিনজিয়াং, পশ্চিমে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত গিলগিট-বালতিস্তান ও ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির, দক্ষিণে ভারতে হিমাচল প্রদেশ এবং পূর্বে চীনের তিব্বত অবস্থিত। লাদাখের বর্তমান আয়তন ৫৯,১৯৬ বর্গ কি.মি. এবং জনসংখ্যা ২,৭৪,২৮৯ জন (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। উল্লেখ্য, লাদাখের আয়তন প্রাক্তন ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের আয়তনের অর্ধেকের বেশি (৫৮.৩৫%) হলেও লাদাখের জনসংখ্যা ছিল জম্মু ও কাশ্মিরের জনসংখ্যার মাত্র ১.৯৭%। লেহ এবং কারগিল শহর দুটি লাদাখের রাজধানী (প্রথমে কেবল লেহ শহরকেই রাজধানী করা হয়েছিল, পরবর্তীতে কারগিলের অধিবাসীদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে কারগিল ও লেহকে যৌথভাবে লাদাখের রাজধানী করা হয়)।
বর্তমানে লাদাখ ২টি জেলায় বিভক্ত- লেহ এবং কারগিল। জনসংখ্যার দিক থেকে জেলা দুটি প্রায় সমান, কিন্তু আয়তনের দিক থেকে লেহ কারগিলের তিনগুণ।
লেহ জেলাটির আয়তন ৪৫,১১০ বর্গ কি.মি. এবং জনসংখ্যা ১,৩৩,৪৮৭ জন (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। লেহ জেলার জনসংখ্যার ৬৬.৪% বৌদ্ধ, ১৭.১৪% হিন্দু, ১৪.২৮% মুসলিম এবং বাকিরা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ, লেহ বৌদ্ধপ্রধান অঞ্চল।
অন্যদিকে, কারগিল জেলার আয়তন ১৪,০৮৬ বর্গ কি.মি. এবং জনসংখ্যা ১,৪০,৮০২ জন (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। কারগিল জেলার জনসংখ্যার ৭৬.৮৭% মুসলিম, ১৪.২৯% বৌদ্ধ, ৭.৩৪% হিন্দু এবং বাকিরা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ কারগিল মুসলিমপ্রধান অঞ্চল। কারগিলের মুসলিমদের মধ্যে ৬৩% শিয়া এবং ৩৭% সুন্নি ও ইসলামের অন্যান্য শাখার অনুসারী। সব মিলিয়ে কারগিল একটি শিয়া মুসলিমপ্রধান অঞ্চল।
সামগ্রিকভাবে, লাদাখের জনসংখ্যার ৪৫.৫৮% মুসলিম, ৪০.৩৫% বৌদ্ধ, ১২.২৪% হিন্দু এবং বাকিরা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ, মুসলিমরা এককভাবে লাদাখের বৃহত্তম সম্প্রদায়, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়।
লাদাখের মুসলিম ও বৌদ্ধদের মধ্যে সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ নয়। লাদাখের বৌদ্ধরা লাদাখি ভাষায় নিজেদেরকে বলে ‘নাং-পা’ (ভূমিপুত্র) এবং মুসলিমদেরকে বলে ‘ফি-পা’ (বহিরাগত)। সুন্নি মুসলিমদের বলা হয় ‘খা-চে’ (কাশ্মিরি) এবং শিয়া মুসলিমদের বলা হয় ‘স্বাল-তি’ (বালতিস্তানের অধিবাসী/বালতি)। এভাবে লাদাখের বৌদ্ধরা নিজেদেরকে প্রকৃত লাদাখি এবং মুসলিমদেরকে ‘কাশ্মিরি’ বা ‘বালতি’ হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু লাদাখের অধিকাংশ মুসলিমই জাতিগতভাবে কাশ্মিরি বা বালতি নয়, বরং লাদাখি, এবং লাদাখি বৌদ্ধদের সঙ্গে লাদাখি মুসলিমদের মূল পার্থক্য জাতিগত নয়, ধর্মগত।
লাদাখি বৌদ্ধদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, জম্মু ও কাশ্মিরের সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে লাদাখকে অবহেলা করে এসেছে এবং লাদাখের উন্নয়নের জন্য কোনোকিছুই করেনি। এই অভিযোগ অনেকাংশেই সত্য। জম্মু ও কাশ্মিরের সরকার লাদাখের উন্নয়নের জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি এবং লাদাখের প্রশাসনের উচ্চস্তরে লাদাখিদের পরিবর্তে কাশ্মিরিদের নিযুক্ত করত। এর ফলে ১৯৬০-এর দশক থেকেই লাদাখের বৌদ্ধরা লাদাখকে পৃথক একটি রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে শুরু করে। জম্মু ও কাশ্মিরের সরকার একে আমলে নেয়নি এবং ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদে বিপর্যস্ত জম্মু ও কাশ্মিরের সরকারের নাজুক পরিস্থিতিকে আরো দুর্বল করতে চায়নি।
১৯৭০-এর দশকে লাদাখি বৌদ্ধরা পৃথক রাজ্যের দাবি পরিহার করে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের অধীনেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানাতে থাকে। তদানীন্তন কাশ্মিরি নেতা শেখ আব্দুল্লাহ এই দাবির প্রতি কোনো গুরুত্ব দেননি, বরং তিনি জানিয়েছিলেন যে লাদাখ কাশ্মির থেকে পৃথক হয়ে গেলে তার কোনো আপত্তি নেই।
১৯৭৯ সালে জম্মু ও কাশ্মিরের সরকার লাদাখকে বৌদ্ধপ্রধান লেহ এবং মুসলিমপ্রধান কারগিল এই দুটি অংশে বিভক্ত করে। লাদাখি বৌদ্ধরা এতে আরো ক্ষিপ্ত হয় এবং স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন জোরদার করে। ১৯৮৯ সালে ‘লাদাখ বুদ্ধিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ (এলবিএ) লাদাখি বৌদ্ধদের আহ্বান জানায় মুসলিমদের বয়কট করার জন্য। অবশেষে ১৯৯৩ সালের ১০ অক্টোবর লাদাখের বৌদ্ধ ও মুসলিম নেতাদের মধ্যে একটি সমঝোতা হয় এবং ভারতীয় সরকার লাদাখের উন্নয়নের জন্য লেহ ও কারগিলের দুটি ‘স্বায়ত্তশাসিত পাহাড়ি উন্নয়ন পরিষদ’ গঠন করে।
কিন্তু তারপরও লাদাখি বৌদ্ধদের স্বায়ত্তশাসন ও পৃথক রাজ্যের দাবি অব্যাহত ছিল। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি এই দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এবং ভারতীয় লোকসভায় লাদাখের বর্তমান সদস্য জামিয়াং শেরিং নামগিয়াল বিজেপির একজন সদস্য। তিনি বারবার লোকসভায় লাদাখের উন্নয়নের ইস্যুটি তুলে ধরেছেন এবং লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মির থেকে পৃথক করার সিদ্ধান্তকে সোৎসাহে সমর্থন করেছেন। বলা বাহুল্য, লাদাখের বৌদ্ধরা লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মির থেকে পৃথক করায় যারপরনাই আনন্দিত (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ৫ আগস্ট ২০১৯)।
কিন্তু লাদাখের মুসলিমদের জন্য এই পরিস্থিতি সুখকর নয়। লাদাখের মুসলিমরা সাধারণভাবে ভারতের প্রতি অনুগত এবং কাশ্মির উপত্যকার মুসলিমদের মতো তারা কখনো বিচ্ছিন্নতার দাবি তোলেনি বা কাশ্মিরি মুসলিমদের বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনে অংশও নেয়নি। এমনকি কারগিল যুদ্ধের সময়ও কারগিলের মুসলিমরা পাকিস্তানের আক্রমণকে সমর্থন করেনি। কিন্তু লাদাখের মুসলিমরা জম্মু ও কাশ্মিরের অংশ হিসেবে থাকতে আগ্রহী, কারণ বৌদ্ধদের সঙ্গে তাদের বৈরিতার সম্পর্ক এবং লাদাখে বিজেপির রাজনৈতিক আধিপত্যের কারণে পৃথক লাদাখ অঞ্চলে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে (ডেকান হেরাল্ড, ৯ আগস্ট ২০১৯)। তাই লাদাখের মুসলিমরা জম্মু ও কাশ্মিরকে দ্বিখণ্ডিত করার বিরোধী।
কিন্তু লাদাখের বৌদ্ধ-মুসলিম সম্পর্ক বা লাদাখের বৌদ্ধদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মির থেকে পৃথক করার মূল কারণ নয়। এই সিদ্ধান্তের পেছনে ভারতীয় সরকারের নিজস্ব কিছু কারণ আছে।
প্রথমত, জম্মু ও কাশ্মির নিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে যে বিরোধ সেটির এখনো মীমাংসা হয়নি এবং নিকট ভবিষ্যতেও হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ভারত পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ জম্মু ও কাশ্মির আর গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চল দুটি এবং চীন-নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিন ও শাকসগাম উপত্যকা (যেটি ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান চীনের কাছে হস্তান্তর করেছিল) ভারতের অংশ হিসেবে দাবি করে। অনুরূপভাবে, পাকিস্তান ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির আর লাদাখকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দাবি করে, এবং চীন লাদাখকে তিব্বতের অংশ হিসেবে দাবি করে। ভারতীয় সরকার এটা ভালোভাবেই জানে যে, যুদ্ধ ছাড়া পাকিস্তান বা চীনের কাছ থেকে এসব অঞ্চল পুনর্দখল করা সম্ভব নয়। আর পারমাণবিক শক্তিধর দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের পরিণতি হতে পারে মারাত্মক। সুতরাং, ভারতীয় সরকার জম্মু ও কাশ্মিরের যেটুকু অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আছে সেই অংশকে ভারতীয় রাষ্ট্রে আত্তীকৃত করে ফেলতে ইচ্ছুক। জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্ত করা এবং লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মির থেকে বিচ্ছিন্ন করা এই লক্ষ্যের দিকে ভারতীয় সরকারের প্রথম ধাপ।
দ্বিতীয়ত, ১৯৯০-এর দশক থেকে ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ভারতীয় সরকারি বাহিনীর সশস্ত্র সংঘর্ষ চলে আসছে, যাতে এ পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে। উল্লেখ্য, জম্মু ও কাশ্মিরের জনসাধারণের যে অংশ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়, তারা জম্মু ও কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের। জম্মু ও কাশ্মিরের সংখ্যালঘু হিন্দু বা বৌদ্ধরা (এবং লাদাখের বৌদ্ধ ও মুসলিমরা) বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করে না। জম্মু ও কাশ্মিরের ৩টি প্রশাসনিক বিভাগের মধ্যে কাশ্মির উপত্যকা প্রায় সম্পূর্ণভাবে মুসলিম-অধ্যুষিত (কাশ্মির উপত্যকার ৯৭.১৬% শতাংশ অধিবাসীই মুসলিম)। তাই কাশ্মির উপত্যকাতেই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জম্মু ও কাশ্মির থেকে লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে ভারতীয় সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লাদাখ থেকে দূরে রাখতে এবং এই সংঘর্ষকে কাশ্মির উপত্যকার (ও আংশিকভাবে জম্মুর) মধ্যে সীমাবদ্ধ করতে ইচ্ছুক। এতে করে একদিকে যেমন এই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করা সহজ হবে ও ভারতীয় সৈন্যদের কর্মক্ষেত্র সঙ্কুচিত হবে, অন্যদিকে যদি কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদীরা জম্মু ও কাশ্মিরকে ভারত থেকে পৃথক করতে সক্ষম হয় (যেটির সম্ভাবনা কম), তাহলে ভারতের হারানো ভূমির পরিমাণ হবে অনেক কম (জম্মু ও কাশ্মিরের বর্তমান আয়তন ৪২,২৪১ বর্গ কি.মি., অর্থাৎ লাদাখের আয়তনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ)। আর যদি কখনো ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবনা ৪৭ অনুযায়ী ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে স্বাধীনতার ইস্যুতে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে বর্তমান জম্মু ও কাশ্মিরের হিন্দুপ্রধান জম্মুতে এবং লাদাখে সেই গণভোটের ফলাফল ভারতের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
তৃতীয়ত, লাদাখ সামরিক কৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লাদাখ নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীন ও পাকিস্তানের বিরোধ রয়েছে। উল্লেখ্য, চীন ও পাকিস্তান উভয়েই জম্মু ও কাশ্মির থেকে লাদাখকে পৃথক করার নিন্দা জানিয়েছে। লাদাখের ভৌগোলিক অবস্থান, বিশেষত চীনের জিনজিয়াং ও তিব্বত এবং পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের সঙ্গে লাদাখের সীমান্ত থাকায় এই অঞ্চলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বে এই উদ্দেশ্যে লাদাখে সৈন্য মোতায়েন করলেও লাদাখ যেহেতু জম্মু ও কাশ্মিরের অংশ, তাই সেটাকে কাশ্মিরে সৈন্য মোতায়েন হিসেবেই দেখা হত, যা ছিল ভারতীয় সরকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে সমস্যাসঙ্কুল। কিন্তু এখন লাদাখ জম্মু ও কাশ্মির থেকে পৃথক হওয়ায় ভারতীয় সরকার নির্বিঘ্নে লাদাখের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।
চতুর্থত, লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মির থেকে পৃথক করার পেছনে বিজেপি সরকারের দলীয় স্বার্থও রয়েছে। লাদাখের বৌদ্ধরা কয়েক দশক ধরে লাদাখকে স্বতন্ত্র একটি রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছিল। বিজেপি সরকার এই দাবি পূরণ করায় লাদাখে তাদের জনসমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৌদ্ধদের দাবি পূরণের মাধ্যমে বিজেপির ‘সর্বভারতীয়’ ভাবমূর্তি জোরদার হয়েছে।
পঞ্চমত, লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মির থেকে পৃথক করার সিদ্ধান্তটি কেবল লাদাখের বৌদ্ধদের মধ্যেই নয়, জম্মুর হিন্দুদের মধ্যেও জনপ্রিয়। ২০১৪ সালে জম্মু ও কাশ্মিরের আইনসভা নির্বাচনে ৮৭টি আসনের মধ্যে বিজেপি ২৫টি আসন লাভ করেছিল। লাদাখকে পৃথক করায় এখন জম্মু ও কাশ্মির আইনসভার আসনসংখ্যা ৮৩টি। পরবর্তী নির্বাচনে বিজেপি তাদের এই সিদ্ধান্তের ফলে জম্মু ও কাশ্মিরের হিন্দুদের মধ্যে সৃষ্ট জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে আইনসভায় তাদের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারবে এবং অন্য কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে জম্মু ও কাশ্মিরে সরকারও গঠন করতে পারবে (হিন্দুস্তান টাইমস, ৬ আগস্ট ২০১৯)।
সর্বোপরি, রুদ্ধশ্বাস প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি লাদাখ সংঘাতপূর্ণ জম্মু ও কাশ্মির থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সেখানে এখন পর্যটন শিল্পের প্রসারের বিশেষ সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে লাদাখের এবং বৃহত্তর অর্থে ভারতীয় সরকারের আর্থিক লাভ হওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
একটি সংঘাতপূর্ণ রাজ্যের প্রান্তিক একটি বিভাগ থেকে লাদাখ একটি স্বতন্ত্র অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এর ফলে লাদাখের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটা সত্য। কিন্তু লাদাখের এই প্রশাসনিক বিবর্তনের মূল কারণ অর্থনৈতিক নয়- বরং ভারতীয় সরকারের রাজনৈতিক, সামরিক ও রণকৌশলগত বিচার-বিবেচনা থেকেই এর উৎপত্তি।