১৬৪৮ সালের ২৪ অক্টোবর জার্মানির ওয়েস্টফেলিয়াতে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার নাম ট্রিটি অব ওয়েস্টফেলিয়া বা পিস অব ওয়েস্টফেলিয়া। এই শান্তিচুক্তির মাধ্যমে ইউরোপে ৩০ বছর ধরে চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটে। এ যুদ্ধে ইউরোপের প্রায় অধিকাংশ দেশই অংশগ্রহণ করেছিলো। অস্টিয়ান হাবসবুর্গ যখন বোহেমিয়ার প্রোটেস্ট্যান্টদের উপর ক্যাথলিক মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তখনই এই যুদ্ধের সূচনা হয়। পরবর্তীকালে জার্মান, রোমান, ফরাসি, সুইডিশ, পোলিশ, সুইস, ডেনিশ এবং রাশিয়ানরাও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য ১৯৪৪ সালে শান্তি আলোচনার ডাক দেওয়া হয়। এই শান্তি আলোচনায় ইউরোপের ছোট বড় মোট ১৯৪টি রাজ্যের ১৭৯ জন পূর্ণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং কয়েক হাজার কূটনৈতিক অংশগ্রহণ করেন। চার বছরের দীর্ঘ আলোচনার পর ইউরোপের দেশগুলো মতৈক্যে আসে এবং ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তি সম্পন্ন হয়। এই চুক্তির মূল বিষয় ছিল প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব। প্রতিটি দেশ নিজ নিজ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। অন্য কোনো দেশ তাদের সেই সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করতে পারবে না। পরবর্তীকালে বিষয়টি বিশ্বের অন্যান্য দেশও মেনে নেয় এবং তখন থেকেই দেশে দেশে কার্যকরীভাবে সীমানা নির্ধারণ করা হয়।
১৬৪৮ সালে বিশ্বের প্রতিটি দেশে সীমানা ও সার্বভৌমত্ব স্থাপিত হলেও গত শতকের শেষ দিক থেকে সেই সীমানাকে ভেদ করেছে ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের বদৌলতে বিশ্বজুড়ে সীমানা এখন শুধুমাত্র সামরিক বিষয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোতে এখন আর কোনো সীমানা নেই। চাইলে খুব সহজেই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষজন পাশ্চাত্যের জীবনযাপন সম্পর্কে জানতে পারছে। বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, সেই বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে জানা যাচ্ছে।
ইন্টারনেট পুরো বিশ্বকে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ এ রূপান্তরিত করেছে। কিন্তু এই ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ এর স্থায়িত্ব আর কত বছর? কেননা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ ইন্টারনেট ব্যবস্থায় সীমানা তৈরির কথা ভাবছে। বিশেষ করে রাশিয়া ও চীন। ২০১০ সালে এক অধিবেশনে রাশিয়া ও সিরিয়া জাতিসংঘের কাছে একটি অদ্ভুত অনুরোধ করে বসে। তারা ইন্টারনেটের উপর সার্বভৌমত্ব স্থাপনের দাবি জানায়। এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থায় প্রতিটি দেশের আলাদা আলাদা পরিচয় নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা বলে। যেমন- প্রতিটি দেশের ফোন নম্বরে আলাদাভাবে দেশভিত্তিক কোড দেওয়া হয়েছে।
পরবর্তীতে এই বিষয়ে এক বছর ধরে রাশিয়ার সাথে জাতিসংঘের আলোচনা চলে। কিন্তু এতে কোনো ফলাফলই আসেনি। কারণ জাতিসংঘের মতে এ ধরনের আইন তৈরি করলে অনেক দেশের সরকার জনগণকে আরো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। পাশাপাশি ইন্টারনেটকে ভিত্তি করে যে সীমানাবিহীন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন মানুষ দেখছে, সেটিও ব্যাহত হবে। ফলে জাতিসংঘের কাছে থেকে রাশিয়াকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়।
তবে হাল ছাড়েনি রাশিয়া। তারা তাদের পরিকল্পনাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। চলতি বছরের এপ্রিলে রাশিয়ায় ইন্টারনেটকে ‘আইসোলেটেড’ করবার জন্য দুটি আইন পাস করেছে পুতিন সরকার। এই আইনের মাধ্যমে কোন কোন দেশ রাশিয়ার কোন কোন তথ্যে প্রবেশাধিকার পাবে তার একটি কাঠামো তৈরির চেষ্টা করছে। রাশিয়ার এই প্রচেষ্টার ফলে মুক্ত ইন্টারনেটের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে। বরং রাশিয়ার বেশ কয়েকটি মিত্র দেশ ‘ডিজিটাল ওয়েস্টফেলিয়ানিজম’ বাস্তবায়ন করার সংকল্প নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
মুক্ত ইন্টারনেটে সমস্যা কোথায়?
মুক্ত ইন্টারনেটের মূলত দুই ধরনের সমস্যা রয়েছে। একটি রাজনৈতিক, অপরটি সামরিক। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আবার ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক এই দুভাগে বিভক্ত। বিশ্বের অনেক দেশই পশ্চিমা জোটকে বিশ্বাস করে না এবং তাদের সাথে প্রকাশ্য ও গোপনে ব্যাপক বৈরিতা রয়েছে। বিশেষ করে চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক খুবই খারাপ। কিন্তু পশ্চিমারা ইন্টারনেট সৃষ্টির শুরু থেকেই নিজেদের প্রভাব ধরে রেখেছে। পশ্চিমারা রাশিয়া ও তাদের মিত্রদের বেশ ভুগিয়েছে। বর্তমান সময়ে সামরিক যুদ্ধের চেয়ে সাইবার যুদ্ধ অধিক ভয়ঙ্কর। আর এক্ষেত্রে তথ্যের নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই কারণে রাশিয়া ও চীন তথ্যের অবাধ প্রবাহ বন্ধ করতে চাচ্ছে।
এদিকে ঘরোয়া রাজনীতির ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ায় কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। সেখানে প্রকৃত অর্থে কোনো গণতন্ত্র নেই। বিভিন্ন সময় চীন ও রাশিয়ায় সরকার বিরোধী আন্দোলনের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো আন্দোলন আলোর মুখ দেখেনি। তবে বর্তমান সময়ে তথ্যের অবাধ প্রবাহ থাকায় জনগণকে বোকা বানিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা বেশ কষ্টসাধ্য। আর এজন্য এই তথ্যের আদান-প্রদানের টুঁটি চেপে ধরতে চায় স্বৈরাচারী সরকাররা। তবে সামরিক ক্ষেত্রে মুক্ত ইন্টারনেটের অবসান বেশ যৌক্তিক। কেননা অনেক সময় সাইবার আক্রমণের কারণে সামরিক ব্যবস্থা অচল হয়ে দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে যায়। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র লোপাটের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করা হয়।
ইন্টারনেটে সীমানা তৈরি কি আসলেই সম্ভব?
২০১১ অথবা ২০১২ সালের দিক থেকে চীন ও রাশিয়া প্রকাশ্যে ‘সার্বভৌম ইন্টারনেট’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা শুরু করে। এর আগে দুই বছর রাশিয়াতে ইন্টারনেট ভিত্তিক ‘উইন্টার অব প্রোটেস্ট’ আন্দোলন চলমান ছিল। এ ধরনের আন্দোলন আরো বেশ কিছু স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে নাড়া দিয়েছিল। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের আরব বসন্ত। রাশিয়াতে কোনো আন্দোলন হলেই তার পেছনে পশ্চিমা বিশ্বের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এ কারণে রুশ সরকার ডিজিটাল সীমানা তৈরি করতে চায়। যাতে করে পশ্চিমারা রাশিয়ানদের কাছে ঘেঁষতে না পারে। একই ধরনের চিন্তাভাবনা চীনের।
কিন্তু সার্বভৌম ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তোলা একেবারে সহজ নয়। কারণ যারা এই সীমানা তৈরি করবে তারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার কথাই ধরা যাক। দেশটির জনসাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বঞ্চিত। কিন্তু এরপরও দেশটির সাথে একটি মাত্র ইন্টারনেট ক্যাবল দিয়ে হলেও বাকি বিশ্বের যোগাযোগ রয়েছে। সেটা রয়েছে বলেই কিম-জং-উন কী করছেন সেটা জানা যাচ্ছে। বেশ কিছু দেশ উত্তর কোরিয়ার মতো ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। যেখানে তথ্যের পরিমাণ থাকবে খু্বই সীমিত। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে সেটা একেবারেই অসম্ভব।
রাশিয়া যদি কোনোভাবে তাদের ইন্টারনেটে সীমানা তৈরি করতে সক্ষমও হয়, তবু সেটা তাদের স্বস্তি দিবে না। কারণ এর ফলে তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্তমানে বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট একটি অপরিহার্য বিষয়। তাই চাইলেও রাশিয়াকে সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া সম্ভব নয়। তবে চীন এক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে গেছে। তারা অনেক আগে থেকেই নির্দিষ্ট কিছু সাইট, নির্দিষ্ট কিছু শব্দ, নির্দিষ্ট কিছু আইপিসহ আরো অনেক কিছু ব্লক করে রেখেছে। কিন্তু এটা পুরোপুরি কার্যকরী নয়।
ভিপিএন ব্যবহার করে ব্লক করা সাইটগুলোতে প্রবেশ করা যায়। কিন্তু রাশিয়ার জন্য এই পদ্ধতি উপযোগী নয়। এছাড়া ইন্টারনেট ব্যবস্থা তৈরির ক্ষেত্রে রাশিয়ার চেয়ে চীন ভিন্ন পন্থা গ্রহণ করেছে। চীনে পশ্চিমা বিশ্বের অল্প কিছু কোম্পানির আইটি সেবা গ্রহণ করা হয়। আর সেটাও খুবই পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে। কারণ চীন পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারের মতো সেখানকার কোম্পানিগুলোকেও বিশ্বাস করে না। কিন্তু রাশিয়া ইন্টারনেট চালু হওয়ার প্রথম থেকেই পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর পণ্য ব্যবহার করে আসছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
রাশিয়া এখন চাইলে কর্পোরেট ইন্টারনেট তৈরি করতে পারবে না, আবার চীনের মতো কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারবে না। এ কারণে তারা ভিন্ন রাস্তায় হাঁটছে। রাশিয়ার সরকার এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে যাতে করে তাদের দেশের সাইটগুলোতে আসা ট্রাফিকের ধরন বুঝে তথ্য সরবরাহ করবে। অর্থাৎ সব ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রাশিয়ার সকল তথ্য পাবে না। একই সাথে রাশিয়ার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা তাদের নিজ দেশের বাইরের সাইটগুলোতে ভ্রমণ করতে পারবে না। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সার্চ ইঞ্জিনে। এর জন্য তারা বিশ্বের বিভিন্ন জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতোই নতুন সাইট করছে। যখন রাশিয়ান কোনো ভিজিটর বাইরের কোনো সাইটে যেতে চাইবে, তখন তাকে সেই সাইটের আদলে তৈরি করা দেশীয় সাইটে ফেরত পাঠানো হবে। অর্থাৎ, কেউ গুগল সার্চ করলে তাকে ইয়ানডেক্সে পাঠানো হবে। আবার কেউ ফেসবুকে যেতে চাইলে তাকে ভিকেতে পাঠানো হবে। রাশিয়ার মতো এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছোট ছোট রাষ্ট্রের জন্য ব্যয়বহুল হবে। তবে যেসব দেশের সরকার নিজেদের স্থায়িত্বের জন্য মুক্ত ইন্টারনেটকে হুমকি মনে করে, তারা রাশিয়ান ইন্টারনেটকে গ্রহণ করবে।
পশ্চিমা দেশগুলো কী ভাবছে?
রাশিয়া ও চীনের সার্বভৌম ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠার কাজে বড় সহায়ক হতে পারে স্বয়ং পশ্চিমা বিশ্ব। বরং এমনও হতে পারে যে, তাদের কোনো কাজই করতে হবে না। কারণ ফেসবুকের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বিগত নির্বাচনে রাশিয়া প্রভাব বিস্তার করার পর থেকে পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা মুক্ত ইন্টারনেটকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করছেন। এই কারণে তাদের অনেকেই রাশিয়া ও চীনের মতো ইন্টারনেটে সীমানা তুলতে চান।
এছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে ফেসবুককে ভুয়া খবরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। পাশাপাশি ঘৃণা ছড়ানো এবং সন্ত্রাসবাদী প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্যও ফেসবুকের সমালোচনা করা হচ্ছে। তবে তথ্যের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডার হচ্ছে গুগল। তারা একইসাথে পূর্ব ও পশ্চিমে তধ্য সরবরাহ করে আসছে। ফলে তাদেরও ফেসবুকের মতো ভুয়া খবরের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে।
আর এসব বিষয়কে মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তথ্যের সরবরাহ কমে যাচ্ছে। ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধ চাপছে। তবে সার্বভৌম ইন্টারনেট আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে কি না সে বিষয়ে এখনো কোনো নিশ্চয়তা মেলেনি। তবে কোনো দেশ, জোট কিংবা ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে ইন্টারনেট বিভক্ত হোক বা না হোক। একটা বিষয় নিশ্চিত যে, মুক্ত ইন্টারনেট ও গ্লোবাল ভিলেজের দিন খুব দ্রুতই শেষ হতে চলেছে।