স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলের দেশ এস্তোনিয়া বিশ্বের মানুষের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিভিন্ন কারণে যে দেশগুলোর নাম নিয়মিত শোনা যায়, সে তালিকাতেও দেশটি খুঁজে পাবেন না আপনি। এমনকি এটাও হতে পারে, আজই প্রথমবারের মতো আপনি জানতে পারলেন পৃথিবীতে ‘এস্তোনিয়া’ নামের একটি দেশ রয়েছে! সে যা-ই হোক, এস্তোনিয়াকে আপনার না চেনা থাকলেও বিশেষ কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে এই ছোট দেশের নাম শোনা যাবে বেশ জোরেশোরেই। খুব বেশি দিন বাকি নেই যখন এস্তোনিয়া হয়ে উঠবে পৃথিবীর অনেক দেশের রোল মডেল। যে দেশটি একেবারে খালি হাতে শুরু করে প্রযুক্তিগত দিক থেকে আজকের পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক দেশগুলোর একটি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে, তাদের সাফল্যগাঁথা নিয়ে সামনের দিনগুলোতে অনেক বেশি আলোচনা হবে। একটি ছোট্ট দেশ, যার মোট আয়তনের অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চল দুর্গম জঙ্গলে পরিপূর্ণ, সে দেশের নাগরিকেরা স্টার্ট-আপের নিত্যনতুন ধারণা নিয়ে প্রযুক্তিবিশ্ব কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
গত শতকের বেশিরভাগ সময় এস্তোনিয়া দেশটি শাসিত হয়েছে বাইরের শাসকদের মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে হিটলারের নাৎসি বাহিনী এস্তোনিয়া দখল করে, কিন্তু যুদ্ধে হিটলার ও তার সামরিক বাহিনী মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হয়। যুদ্ধ শেষ হলে পুঁজিবাদী আমেরিকা ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ। অন্যান্য পূর্ব-ইউরোপীয় দেশের মতো এস্তোনিয়াও সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে চলে যায়। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা হয়। সোভিয়েত আমলে এস্তোনিয়ায় উন্নয়ন হয়েছিল খুব ধীর গতিতে। আসলে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রতিটি দেশেই খুব ধীরগতির উন্নয়ন সাধিত হয়, যেহেতু সেখানে ব্যক্তিপর্যায়ে অর্থনৈতিক উদ্যোগ নেয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। প্রায় পঞ্চাশ বছরের সোভিয়েত শাসনের পর যখন এস্তোনিয়া স্বাধীনতা লাভ করে, তখন দেখা যায়, ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় তারা সবদিক থেকেই অনেক পিছিয়ে আছে।
একটি দেশের উন্নয়নের জন্য রাজনীতি ও অর্থনীতি– দুটো ক্ষেত্রেই সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া খুব জরুরি। সোভিয়েত আমলের সমাজতন্ত্র এস্তোনিয়াকে উন্নয়নের পথে খুব বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারেনি। তাই স্বাধীনতা লাভের পর সোভিয়েত আমলের সমস্ত নীতি ও বিধিনিষেধ পরিবর্তন করা হয়। রাজনীতি ও অর্থনীতির জন্য পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রকে বেছে নেয়া হয়। স্বাধীনতার ঠিক পরের সময় এস্তোনিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সোভিয়েত আমলের সমস্ত কিছু উপড়ে ফেলে একটি নতুন ব্যবস্থাকে দাঁড় করানো মোটেই সহজ কাজ ছিল না। তবে সবচেয়ে বড় বিষয়, সেসময়ের এস্তোনিয়ান রাজনীতিবিদরা জনগণের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লাভ করেছিলেন। রক্ষণশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দেশের দ্রুতগতির উন্নয়ন সম্ভব নয়, তাই মুক্ত অর্থনীতির দেশ হিসেবে এস্তোনিয়াকে গড়ে তোলার জন্য রাজনীতিবিদরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বাইরের দেশ থেকে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ লাভের জন্য সোভিয়েত আমলের কড়া আইনগুলো সংশোধন করে বাণিজ্যবান্ধব আইন প্রণয়ন করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে দেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করেছিল, তাদের জাতীয় উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা ছিল দুর্নীতি। এস্তোনিয়ার রাজনীতিবিদরা বুঝতে পেরেছিলেন সরকারি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে যদি প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকে কাজে না লাগানো হয়, তবে গতানুগতিক ব্যবস্থায় উন্নয়ন গতি থমকে যাবে। এজন্য খুব দ্রুত ই-গভর্নমেন্ট নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। ২০০০ সালে এস্তোনিয়া সরকার ‘ইন্টারনেট সেবা’কে নাগরিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করে। ২০১২ সালে এস্তোনিয়ার সরকারি কার্যক্রমের প্রায় ৯০ শতাংশ অনলাইনের মাধ্যমে সম্পাদিত হতে শুরু করে। এতে করে একদিকে সরকারি অফিসগুলোতে কাজের দীর্ঘসূত্রিতা কমে যায়, অপরদিকে নাগরিক জীবন নতুন গতি লাভ করে। বর্তমানে এস্তোনিয়ায় যাদের বয়স পনের বছরের অধিক, তাদের সবার কাছে একটি ইলেক্ট্রনিক আইডি কার্ড রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা ব্যাংকে অর্থ লেনদেন থেকে শুরু করে কর প্রদান– সবধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন।
আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে প্রতিটি সরকার। ২০০০ সালের দিকে এস্তোনিয়ার প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার স্থাপন করার প্রকল্প হাতে নেয় সেদেশের সরকার এবং ২০০২ সালের মধ্যে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। এস্তোনিয়ার শিক্ষার্থীরা যেন সঠিক প্রযুক্তিজ্ঞান লাভ করতে পারেন, সেজন্য শুরু থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে সবধরনের সহায়তা করা হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এস্তোনিয়ান শিক্ষার্থীরা ছোট থেকেই প্রোগ্রামিং শেখা শুরু করেন। দেশটিতে ছোট-বড় অসংখ্য স্টার্টআপ কোম্পানি থাকায় কর্মক্ষেত্র নিয়ে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয় না তাদের। বর্তমানে করোনা মহামারীর জন্য পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ যেখানে ‘অনলাইন এডুকেশন সিস্টেম’-এর শরণাপন্ন হয়েছে, সেখানে অনেক আগে থেকেই এস্তোনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি অনলাইন-নির্ভর। মোটকথা, এস্তোনিয়ার চাকরির বাজারে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এমনসব কর্মী চায় যারা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ এবং এস্তোনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা একজন শিক্ষার্থীকে ছোট থেকে সেভাবেই গড়ে তোলে।
এস্তোনিয়ার একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হলো ই-রেসিডেন্সি। ২০১৪ সালে এস্তোনিয়ার সরকার এই প্রকল্প শুরু করে। এর মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণের মাধ্যমে আপনি এস্তোনিয়ার সরকারের কাছ থেকে ডিজিটাল নাগরিকত্ব লাভ করতে পারেন। এর মাধ্যমে আপনি নিজ দেশে বসেই এস্তোনিয়ার নাগরিক হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশাল বাজারের সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন, এস্তোনিয়ায় যেকোনো অনলাইন স্টার্টআপের ধারণা কাজে লাগিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে ফেলতে পারবেন কিংবা এস্তোনিয়ার ব্যাংকে আর্থিক লেনদেনও সেরে ফেলতে পারবেন। ইতোমধ্যে পুরো বিশ্বের ১৩৬টি দেশ থেকে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ ই-রেসিডেন্সির জন্য আবেদন করেছেন এবং ই-রেসিডেন্টদের হাত ধরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৬,০০০ কোম্পানি। বিশ্বায়নকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলা এস্তোনিয়া সরকারের এই প্রকল্প পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা উদ্যোক্তাদের আকর্ষণ করছে।
২০১৮ সালে এস্তোনিয়ার প্রেসিডেন্ট কের্স্তি কালজুলাইদ একটি টুইট করেন, “এস্তোনিয়ায় বাস করে তের লক্ষ মানুষ এবং আমাদের চারটি ইউনিকর্ন রয়েছে।” ইউনিকর্ন বলতে পৌরাণিক মিথের যে রহস্যময় ঘোড়ার কথা জানি আমরা, সেটার কথা আসলে বলা হয়নি এখানে। ২০১৩ সালে মার্কিন বিনিয়োগকারী আইলিন লি যেসব স্টার্টআপের বাজারমূল্য এক বিলিয়ন ডলার বা এর চেয়ে বেশি, সেগুলোকে ‘ইউনিকর্ন ‘ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মাত্র তের লক্ষ মানুষের দেশ এস্তোনিয়ায় চার চারটি স্টার্টআপ রয়েছে যাদের বাজারমূল্য এক বিলিয়ন ডলার বা এর বেশি– বিষয়টি রীতিমতো বিস্ময়কর এবং একইসাথে দেশটির প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় বহন করে। বর্তমানে ইউরোপের সবচেয়ে মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করতে ‘ডিজিটাল নোম্যাড ভিসা’ প্রোগ্রাম চালু করেছে এস্তোনিয়ান সরকার, যার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন পাওয়া যাবে।
আগামীর বিশ্বে পৃথিবী হয়ে উঠবে আরও বেশি প্রযুক্তিনির্ভর এবং প্রযুক্তিখাতে এগিয়ে থাকা দেশগুলো হয়ে উঠবে আরও শক্তিশালী। এস্তোনিয়া ভবিষ্যতে পৃথিবীর ‘প্রযুক্তির রাজধানী’ হয়ে উঠলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও অর্থনৈতিক দূরদর্শিতা যে একটি দেশকে শেকড় থেকে শিখরে নিয়ে যেতে পারে, তার সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ বোধহয় এস্তোনিয়া। দুই যুগ আগেও যে দেশে প্রযুক্তির ছোঁয়া ছিল না, উন্নয়নের গতি ছিল বেশ ধীর, সেই দেশই এখন হয়ে উঠেছে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর তীর্থস্থান, এস্তোনিয়ার নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে গিয়েছে অনেক গুণ। এস্তোনিয়ার প্রযুক্তিবিদ ও উদ্যোক্তারা যেভাবে উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাতে দেশটি নিয়মিত নতুন নতুন সব প্রকল্প হাজির করছে বিশ্ববাসীর সামনে। মাত্র দুই যুগের ব্যবধানে একটি দেশের এমন অভাবনীয়, টেকসই পরিবর্তনের গল্প জানলে দেশটি সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।