Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুদানে ওয়াগনার গ্রুপ: রুশ মার্সেনারিরা যেভাবে সুদানে আধিপত্য বিস্তার করছে

২০২০ সালের এপ্রিলে সুদান নিউজ এজেন্সির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ‘মেরোয়ে গ্রুপ’ নামক একটি রুশ খনিজ বিষয়ক কোম্পানি কোভিড–১৯ মহামারী মোকাবেলা করার জন্য উত্তর–পূর্ব আফ্রিকার রাষ্ট্র সুদানকে বিভিন্ন চিকিৎসা ও অন্যান্য সামগ্রী সহায়তা হিসেবে প্রদান করেছে। ২০২০ সালের মার্চ থেকে সুদানে কোভিড–১৯ মহামারী বিস্তার লাভ করেছে এবং সুদানি সরকারের হিসেব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রায় ১২,০০০ সুদানি নাগরিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে ৮০০ জনের বেশি মৃত্যুবরণ করেছে। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে একটি রুশ কোম্পানি কর্তৃক সুদানকে চিকিৎসা বিষয়ক সহায়তা প্রদান করা আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু ‘মেরোয়ে গ্রুপ’ কোম্পানিটি সাধারণ কোনো বাণিজ্যিক কোম্পানি নয়। এই কোম্পানিটি রুশ মার্সেনারি সংগঠন ‘ওয়াগনার গ্রুপে’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং ধারণা করা হয়, ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ই এই কোম্পানিটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, একটি রুশ মার্সেনারি সংগঠন কেন সুদানকে ‘মানবিক সহায়তা’ প্রদান করছে?

‘ওয়াগনার গ্রুপ’ (রুশ: Группа Вагнера, ‘গ্রুপ্পা ভাগনেরা’) একটি রুশ মার্সেনারি সংগঠন। ‘মার্সেনারি’ বলতে সাধারণত সেসব যোদ্ধাকে বোঝায় যারা অর্থের বিনিময়ে কোনো রাষ্ট্র, সংগঠন বা অন্য কারো পক্ষে যুদ্ধ করে। ‘প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানি ওয়াগনার’ (পিএমসি ওয়াগনার) বা ‘চাস্তনায়া ভোয়েন্নায়া কোম্পানিয়া ভাগনেরা’ (সিএইচভিকে ওয়াগনার) নামে পরিচিত ওয়াগনার গ্রুপও এরকমই একটি মার্সেনারি সংগঠন। রুশ আইন অনুযায়ী রাশিয়ার অভ্যন্তরে কোনো ধরনের মার্সেনারি সংগঠন পরিচালনা করা নিষিদ্ধ, এজন্য ওয়াগনার গ্রুপ রাশিয়ায় একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত। আর্জেন্টিনা এবং চীনের হংকং–এ কোম্পানিটির শাখা রয়েছে। ২০১৪ সালে রুশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং রুশ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘গ্রু’র স্পেশাল ফোর্সের প্রাক্তন সদস্য দিমিত্রি উৎকিন এই মার্সেনারি সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে ওয়াগনার গ্রুপ ইউক্রেন থেকে মোজাম্বিক এবং সিরিয়া থেকে ভেনেজুয়েলা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন সামরিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত। অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ওয়াগনার গ্রুপকে মার্কিন মার্সেনারি গ্রুপ ‘অ্যাকাডেমি’র (প্রাক্তন ‘ব্ল্যাকওয়াটার’) সঙ্গে তুলনা করেছেন, যে গ্রুপটি ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

ওয়াগনার গ্রুপের নামকরণ করা হয়েছে গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা লেফটেন্যান্ট কর্নেল উৎকিনের সাঙ্কেতিক নাম ‘ওয়াগনার’ অনুসারে। ওয়াগনার গ্রুপ আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বেসরকারি আধা–সামরিক সংগঠন। রুশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা ও সদস্যরা, বিশেষত যাদের আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান ও উত্তর ককেশাসে যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তারা এই গ্রুপের সদস্য। এর পাশাপাশি উগ্র জাতীয়তাবাদী রুশ তরুণরা, রুশ অপরাধ জগতের সদস্যরা এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকরাও এই গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু মার্কিন ও ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ এবং অন্যান্য সূত্রের তথ্যমতে, ওয়াগনার গ্রুপ প্রকৃতপক্ষে কোনো বেসরকারি সংগঠন নয়, বরং এটি রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাদের মতে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ স্বার্থ জড়িত রয়েছে, সেসব স্থানে ব্যবহারের জন্য ক্রেমলিন এই সংগঠনটির সৃষ্টি করেছে। ওয়াগনার গ্রুপকে ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন এসব যুদ্ধক্ষেত্রে ‘আনুষ্ঠানিক’ রুশ সৈন্যদের মৃত্যুর হারকে কম হিসেবে রুশ জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করা যায়, তেমনিভাবে এসব যুদ্ধক্ষেত্রে মস্কোর জড়িত থাকাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে অস্বীকার করাও সহজ হয়ে ওঠে।

সিরীয় গৃহযুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা রুশ, সিরীয় ও ইরানি সৈন্য এবং হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের পাশাপাশি লড়াই করেছে; Source: Syrian Observatory for Human Rights

রুশ সরকার ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে তাদের কোনো রকম সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছে, কিন্তু গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা উৎকিনকে ক্রেমলিনে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে এবং বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী ওয়াগনার ‘মার্সেনারি’দের রুশ রাষ্ট্রীয় পদকও প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং পুরোপুরি বেসরকারি হোক, রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন হোক, কিংবা ক্রেমলিন–নিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসিত সংগঠন হোক, ওয়াগনার গ্রুপ যে রুশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বস্তুত অনেকের ধারণা, ‘পুতিনের বাবুর্চি’ নামে পরিচিতি অর্জনকারী রুশ ব্যবসায়ী ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন, যার ওপর মার্কিন সরকার ২০১৬ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তিনিই ওয়াগনার গ্রুপের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণকারী। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যদের বিভিন্ন রাষ্ট্রে সক্রিয় দেখা গেছে, যেগুলো মধ্যে রয়েছে ইউক্রেন, সিরিয়া, লিবিয়া, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, মোজাম্বিক, ভেনেজুয়েলা এবং সুদান।

মধ্যপ্রাচ্যের প্রান্তিক অঞ্চলে উত্তর–পূর্ব আফ্রিকায় অবস্থিত আরব রাষ্ট্র ‘সুদান প্রজাতন্ত্র’। উত্তরে মিসর, উত্তর–পশ্চিমে লিবিয়া, পশ্চিমে চাদ, দক্ষিণ–পশ্চিমে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণে দক্ষিণ সুদান, দক্ষিণ–পূর্বে ইথিওপিয়া এবং পূর্বে ইরিত্রিয়া দ্বারা বেষ্টিত এই রাষ্ট্রটির উত্তর–পূর্বে লোহিত সাগর অবস্থিত। ১৮,৮৬,০৬৮ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটি আরব বিশ্ব ও আফ্রিকার তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং বৃহৎ এই রাষ্ট্রটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ১৫ লক্ষ। ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই রাষ্ট্রটি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কটে বিপর্যস্ত এবং গৃহযুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, জাতিগত দাঙ্গা, সামরিক অভ্যুত্থান, আদর্শিক সংঘাত প্রভৃতি রাষ্ট্রটিতে ‘স্বাভাবিক ঘটনা’য় পরিণত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে সুদানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ওমর হাসান আহমেদ আল–বশির একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রটির শাসনক্ষমতা দখল করেন এবং ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তিনি সুদানের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।

ওমর আল–বশিরের ক্ষমতা লাভের আগে থেকেই সুদানের আরব ও মুসলিম–অধ্যুষিত উত্তরাঞ্চল (যেখানে সুদানের শাসনক্ষমতা কেন্দ্রীভূত) এবং অনারব খ্রিস্টান ও বিভিন্ন স্থানীয় ধর্মের অনুসারী দ্বারা অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছিল। বশির সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে এই গৃহযুদ্ধের সমাধান করতে ব্যর্থ হন এবং ১৯৮৩ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত চলমান এই যুদ্ধে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। অবশেষে ২০১১ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে সুদানের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো ‘দক্ষিণ সুদান’ নামে স্বাধীনতা অর্জন করে। বশিরের শাসনামলে ২০০৩ সাল থেকে পশ্চিম সুদানের দারফুর অঞ্চলে এবং ২০১১ সাল থেকে সুদানের দক্ষিণাঞ্চলের দক্ষিণ করদোফান ও ব্লু নাইল প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলমান। দারফুরে গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় মদদদাতা’র তালিকায় যে ৪টি রাষ্ট্রের নাম রয়েছে, তার মধ্যে সুদান একটি।

রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ‘পুতিনের বাবুর্চি’ খ্যাত রুশ ব্যবসায়ী ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন; Source: South China Morning Post

স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে ১৯৬০–এর দশকের শেষদিকে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন সুদানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল এবং ১৯৬৯ সালে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের পর এই সম্পর্ক আরো জোরালো হয়। এসময় সুদান সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করে এবং সোভিয়েত যুদ্ধজাহাজগুলো লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত ‘পোর্ট সুদান’ বন্দর ব্যবহারের অধিকার লাভ করে। কিন্তু ১৯৭১ সালে সুদানি কমিউনিস্টরা একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ব্যর্থ চেষ্টা করার পর থেকে সুদানি রাষ্ট্রপতি জাফর নিমেইরি পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং স্নায়ুযুদ্ধের বাকি সময় সুদান পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ ছিল। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের শেষ পর্যায় থেকেই ইরানের সঙ্গে সুদানের সুসম্পর্ক ও বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপের প্রতি সুদানি সমর্থনের কারণে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সুদানের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। অবশ্য সুদানের অর্থনৈতিক দুরবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে সুদানি রাষ্ট্রপতি বশির সৌদি–ইরানি দ্বন্দ্বে সৌদি আরবের পক্ষ অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেন এবং ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি–নেতৃত্বাধীন জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ইয়েমেনে সৈন্য প্রেরণ করেন। এই প্রেক্ষাপটে ২০১৬ সালের প্রারম্ভে ইরানের সঙ্গে সুদানের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয় এবং ২০১৯ সালে বশিরের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুদানের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়, কিন্তু এখনো রাষ্ট্রটির ওপর মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বিদ্যমান।

১৯৯০–এর দশকে সুদানের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্কের অবনতির সুযোগে রাশিয়া সুদানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ অর্জন করে। বিশেষত ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সুদানের সঙ্গে রাশিয়া ঘনিষ্ঠ সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। ২০০৫ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দারফুরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের প্রস্তাব করলে রাশিয়া এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে এবং সুদানের ‘ভৌগোলিক অখণ্ডতা’র প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ওমর আল–বশিরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে রাশিয়া (এবং আরব লীগ, আফ্রিকান ইউনিয়ন ও জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন) এর বিরোধিতা করে। এসময় রাশিয়া সুদানের বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারীতে পরিণত হয় এবং স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতে, ২০০৯ সালে সুদানের আমদানিকৃত অস্ত্রশস্ত্রের প্রায় ৯০% এসেছিল রাশিয়া থেকে। রুশ মার্সেনারিরা এসময় সুদানি সরকারি বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ্ব অংশ নিয়েছিল এবং ২০০৮ সালে সুদানি বিদ্রোহীরা একটি রুশ মার্সেনারি বৈমানিক দ্বারা চালিত যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল বলে জানা যায়।

২০১৫ সালে রাশিয়া গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করে এবং সিরীয় রাষ্ট্রপতি বাশার আল–আসাদের সরকারকে সম্ভাব্য পতনের হাত থেকে রক্ষা করে। স্বভাবতই এটি সুদানি সরকারের দৃষ্টি এড়ায় নি, কারণ সুদানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছিল না এবং সৌদি জোটে যোগদানের পরও সুদানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হয় নি। এই পরিস্থিতিতে ওমর আল–বশির তাঁর শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য রুশ সহায়তা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ২০১৭ সালের নভেম্বরে রাশিয়া সফর করে রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর সোচিতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে বশির পুতিনকে জানান যে, সুদানি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুদানকে ৫টি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রে বিভক্ত করার ‘চক্রান্ত’ করছে এবং মার্কিন ‘আগ্রাসন’ থেকে সুদানকে রক্ষা করার জন্য তিনি রাশিয়ার সহায়তা প্রার্থনা করেন। বিনিময়ে তিনি সুদানে রুশ নৌঘাঁটি স্থাপনের প্রস্তাব করেন, যে সম্ভাবনাটি তিনি এর আগে নাকচ করে দিয়েছিলেন।

সিরিয়ায় একটি যৌথ টহল শেষে রুশ ও তুর্কি সৈন্যরা। সিরিয়ায় রুশ সাফল্যের কারণে সুদানি রাষ্ট্রপতি ওমর আল–বশির সুদানে রুশ হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছিলেন; Source: Hurriyet Daily News

সুদানে নৌঘাঁটি স্থাপনের প্রস্তাব রুশ রণকৌশলবিদদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়, কারণ সুদান লোহিত সাগরের তীরে এবং ভূরাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাব এল–মান্দেব প্রণালীর সন্নিকটে অবস্থিত। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে রপ্তানিকৃত জ্বালানি তেলবাহী ট্যাঙ্কারগুলোর মধ্যে যেগুলো সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে, তাদের সিংহভাগকেই বাব এল–মান্দেব প্রণালী অতিক্রম করতে হয় এবং এজন্য বৈশ্বিক জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রণালীটির ভূকৌশলগত তাৎপর্য অপরিসীম। এজন্য সুদানে রুশ নৌঘাঁটি থাকলে রুশ নৌবাহিনীর কৌশলগত সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, এবং এর পাশাপাশি ‘আফ্রিকার শৃঙ্গ’ ও ‘সাব–সাহারান আফ্রিকা’ অঞ্চলে রুশ প্রভাব বৃদ্ধি পাবে, সামগ্রিকভাবে আফ্রিকা মহাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে রুশ সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং এতদঞ্চলে বিদ্যমান মার্কিন ও চীনা প্রভাবের মোকাবেলা করা যাবে।

কিন্তু রুশ ভূখণ্ড থেকে এত দূরে একটি অস্থিতিশীল অঞ্চলে একজন স্বৈরশাসককে সহায়তা করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করা মস্কোর জন্য যেমন আকর্ষণীয় নয়, তেমনিভাবে রুশ জনসাধারণও বিশ্বের দূর–দূরান্তে রুশ সামরিক হস্তক্ষেপকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে না। কিন্তু রুশ–মার্কিন ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে সুদান মস্কোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ক্রেমলিন সুদানের মরুভূমিতে রুশ ‘বুশফায়ার ব্রিগেড’গুলোকে প্রেরণ করতে আগ্রহী না হলেও তাদের জন্য একটি বিকল্প রয়েছে – ওয়াগনার গ্রুপ। ইতোমধ্যে ওয়াগনার গ্রুপ ইউক্রেন ও সিরিয়ার রণক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছিল এবং এজন্য মস্কো সুদানেও এই ‘মার্সেনারি’দের ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়।

২০১৭ সালের নভেম্বরে সোচিতে পুতিন–বশির বৈঠকের অন্তরালে আরো একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে অংশ নেন সুদানি খনিজ বিষয়ক মন্ত্রী হাশিম আলী সলিম এবং ‘এম ইনভেস্ত’ নামক একটি রুশ ‘লিমিটেড লায়্যাবিলিটি কোম্পানি’র আঞ্চলিক পরিচালক মিখাইল পোতিওপকিন। এর মধ্য দিয়ে রুশ কোম্পানিটি সুদানের স্বর্ণখনি থেকে স্বর্ণ উত্তোলনের সুযোগ অর্জন করে। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে একটি স্বাভাবিক বাণিজ্যিক চুক্তি হিসেবে মনে হলেও এটি আসলে তা নয়, কারণ ‘এম ইনভেস্ত’ ওয়াগনার গ্রুপেরই একটি ফ্রন্ট কোম্পানি। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ওয়াগনার গ্রুপ সুদানি সরকারি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান ও সুদানের স্বর্ণ, ইউরেনিয়াম ও হীরকের খনিগুলো পাহারা দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে, আর বিনিময়ে লাভ করে সুদানের স্বর্ণখনিগুলোর ওপর প্রায় একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। এই চুক্তির পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরেই প্রায় ৩০০ ওয়াগনার গ্রুপ সদস্য সুদানে পৌঁছে, এবং ২০১৮ সালের মধ্যে এদের সংখ্যা ১,০০০–এ উন্নীত হয়।

সুদানি সৈন্যদের ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা মরুভূমির মাঝে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, এরকম একটি ভিডিও একজন রুশ সাংবাদিক টুইটারে আপলোড করেছিলেন; Source: Popular Front

২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে রুশ পত্রিকা ‘কমসোমলস্কায়া প্রাভদা’র সামরিক বিষয়ক সাংবাদিক আলেক্সান্দর কোৎস তার টুইটার অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও আপলোড করেন, যেটিতে দেখা যায় যে, ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা মরুভূমির মধ্যে সুদানি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বস্তুত, কেবল সুদানি সৈন্যদের নয়, ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা সুদানি গোয়েন্দা সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিস’ (এনআইএসএস) এবং এনআইএসএস–এর অধীনস্থ ‘র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস’ (আরএসএফ) আধা–সামরিক বাহিনীর সদস্যদেরও প্রশিক্ষণ প্রদান করে। আরএসএফ গঠিত হয়েছে মূলত ‘জানজাবিদ’ মিলিশিয়াদের সমন্বয়ে, যারা দারফুরে গণহত্যা ও নারী নির্যাতন চালিয়ে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সুদানি বিদ্রোহী দল এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র দক্ষিণ সুদানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সুদানি সৈন্যদের সঙ্গে ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরাও অংশ নিয়েছে বলে জানা যায়।

এভাবে ওয়াগনার গ্রুপের মাধ্যমে সুদানের ওপর রুশ প্রভাব আরো বৃদ্ধি পায় এবং এই পরিস্থিতিতে মস্কো সুদানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক আরো জোরদার করার প্রক্রিয়া আরম্ভ করে। দক্ষিণ সুদান আন্তর্জাতিক বাজারে যে অপরিশোধিত তেল বিক্রি করে, সেই তেল পরিশোধনের জন্য রাশিয়া সুদানে একটি তেল শোধনাগার স্থাপনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। রাশিয়া সুদানি সশস্ত্রবাহিনীকে অত্যাধুনিক ‘সুখোই এসইউ–৩৫’ যুদ্ধবিমানসহ নানাবিধ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করার প্রক্রিয়াও শুরু করে। ২০১৮ সালের মে মাসে রুশ নৌবাহিনীর উপপ্রধান সুদান সফর করেন এবং সুদানের লোহিত সাগর উপকূলে একটি নৌঘাঁটি নির্মাণের বিষয়ে সুদানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সুদানে চলমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং সুদানি সরকার কর্তৃক গৃহীত ব্যয় সঙ্কোচন নীতির প্রতিবাদে সুদানি জনসাধারণ সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। ক্রমে এই বিক্ষোভ তীব্র রূপ ধারণ করে এবং কিছু রাজনৈতিক ছাড় দিয়েও ওমর আল–বশির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্র বিক্ষোভকারীদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে, কিন্তু তাদের সক্রিয় কোনো সহায়তা প্রদান থেকে বিরত থাকে। অন্যদিকে, ওয়াগনার গ্রুপ বিক্ষোভ দমনের জন্য সুদানি সরকারকে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ প্রদান করে। তারা বিক্ষোভকারীদেরকে ‘ইসরায়েলপন্থী’, ‘মার্কিনপন্থী’ এবং ‘সমকামিতার সমর্থক’ হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য বশিরকে পরামর্শ দেয়, কিন্তু বশির তাদের পরামর্শ পুরোপুরি কার্যকর করেন নি। রুশ রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম সুদানি বিক্ষোভকারীদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে এবং যেহেতু রুশ রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম ‘আরটি’র আরবি সংস্করণ ‘আরটি অ্যারাবিক’ সুদানিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়, সেহেতু তাদের এই প্রচারণা সুদানি জনমতের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে।

সুদানের রাজধানী খার্তুমে ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যদের বহনকারী একটি গাড়ি; Source: Popular Front

এসময় সুদানের সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমনে সুদানি নিরাপত্তারক্ষীদের পাশাপাশি ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরাও অংশ নিচ্ছে বলে কিছু প্রচারমাধ্যমে অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগ এতটাই মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে, রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রদান করে এই অভিযোগকে অস্বীকার করে। তারা জানায় যে, সুদানে কিছুসংখ্যক ‘রুশ নাগরিক’ সুদানি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, কিন্তু তারা সুদানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জড়িত নয় এবং রুশ সরকারের সঙ্গেও তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

আন্দোলন চলাকালেই ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সুদানি আইনসভা রুশ যুদ্ধজাহাজগুলোকে সুদানি সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করে। সম্ভবত এটি ছিল মস্কোর সমর্থন লাভের জন্য বশিরের একটি প্রচেষ্টা, কিন্তু তাঁর এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ মস্কোর দৃষ্টিতে ব্যক্তি বশির ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রিকভাবে সুদানের শাসকশ্রেণি। এজন্য মস্কো ব্যক্তিগতভাবে বশিরকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার পরিবর্তে সুদানের বর্তমান শাসকশ্রেণিকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখার ওপর জোর প্রদান করে। এমতাবস্থায় মস্কো বশিরকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরাসরি হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে এবং ২০১৯ সালের এপ্রিলে সুদানি সেনাবাহিনী একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সুদানের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য অভ্যুত্থানকারীরা ‘ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিল’ (টিএমসি) নামক একটি পরিষদ গঠন করে।

রাশিয়া টিএমসির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে এবং ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা টিএমসিকে আগের মতোই সহায়তা করতে থাকে। ২০১৯ সালের মে মাসে রাশিয়া ও সুদানের মধ্যে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার মধ্য দিয়ে রুশ নৌবাহিনীর সুদানি সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত হয় এবং উভয় দেশের সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, সুদান আফ্রিকা মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রুশ অস্ত্র আমদানিকারক রাষ্ট্র এবং এখনো সুদানের আমদানিকৃত অস্ত্রশস্ত্রের সিংহভাগ আসে রাশিয়া থেকে।

‘খার্তুম গণহত্যা’র প্রাক্কালে সুদানি বিক্ষোভকারীরা জ্বলন্ত টায়ার দিয়ে সুদানি সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের প্রবেশপথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল; Source: Anadolu Agency/Middle East Monitor

এদিকে বশিরের ক্ষমতাচ্যুতির পরও সুদানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল এবং বিক্ষোভকারীরা সুদানে বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের দাবি জানায়। টিএমসি বল প্রয়োগের মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের দমন করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ২০১৯ সালের জুনে সুদানের রাজধানী খার্তুমে ওয়াগনার গ্রুপের দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আরএসএফ সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ওপর আক্রমণ চালায়। ‘খার্তুম গণহত্যা’ নামে পরিচিত এই ঘটনায় ১২৮ জনের বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হয়, কয়েক শত বিক্ষোভকারী গুরুতরভাবে আহত হয় এবং ৭০ জন বিক্ষোভকারী নারীকে ধর্ষণ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে টিএমসি বিক্ষোভকারীদের কাছে এটা স্পষ্ট করে দেয় যে, তারা পুরোপুরিভাবে ক্ষমতা ছাড়তে রাজি নয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই গণহত্যার জন্য টিএমসির প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, কিন্তু রাশিয়া এই প্রস্তাবে ভেটো প্রদান করে।

পরবর্তীতে টিএমসি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছায় এবং ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ‘সোভারিনটি কাউন্সিল অফ সুদান’–এর (এসসিএস) নেতৃত্বে একটি সামরিক–বেসামরিক মিশ্র সরকার সুদানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। রাশিয়া এই সমঝোতাকে সমর্থন জানায় এবং সুদানকে অর্থনৈতিক ও খাদ্য সহায়তা প্রদান করতে সম্মত হয়। অক্টোবরে সুদানি রাষ্ট্রপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল–বুরহান রাশিয়া সফর করেন এবং সোচিতে রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অবশ্য সুদানের সামরিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি বেসামরিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও মস্কো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত, কারণ মস্কো কোনো একটি নির্দিষ্ট পক্ষের ওপর সমস্ত রাজনৈতিক পুঁজি বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত নয়।

রুশ সুদান বিশেষজ্ঞদের মতে, সুদানের পরিস্থিতি পূর্ণ গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত নয় এবং সামরিক শাসন থেকে আকস্মিকভাবে বেসামরিক শাসনে রূপান্তর ঘটানো হলে ‘বিভিন্ন গোত্র ও সুফি ব্রাদারহুডগুলোর একটি অস্থিতিশীল জোট’ সুদানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে। এজন্য তাঁদের মতে, সামরিক বাহিনীর অধীনে ধাপে ধাপে বেসামরিক শাসনের প্রবর্তনই সুদানের স্থিতিশীলতার জন্য উপযোগী।

বিগত বছরগুলোতে সুদানে মস্কোর কার্যকলাপ রাষ্ট্রটিতে রুশ প্রভাব বৃদ্ধি করেছে। সুদানি সামরিক বাহিনীকে সমর্থন প্রদানের মাধ্যমে মস্কো ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রটিতে একটি দীর্ঘমেয়াদী অবস্থানের নিশ্চয়তা অর্জন করেছে এবং এর পাশাপাশি পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও মস্কো এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত শুরু থেকেই সুদানের সরকারবিরোধী বিক্ষোভের বিরুদ্ধে ছিল এবং এই ব্যাপারে তারা মস্কোর সঙ্গে একমত, অন্যদিকে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছে। স্বভাবতই সুদান সঙ্কট মস্কোকে রিয়াদ ও আবুধাবির নিকটবর্তী করেছে।

লোহিত সাগরে রুশ বাল্টিক নৌবহরের একটি যুদ্ধজাহাজ। রাশিয়া লোহিত সাগরের তীরে নৌঘাঁটি স্থাপন করতে আগ্রহী; Source: Vitaly Nevar/TASS

বস্তুত সুদানে রুশ প্রভাব বিস্তার রোধের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেমন কোনো চেষ্টাই করে নি। ২০২০ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্র সুদানে ওয়াগনার গ্রুপের ‘ঔপনিবেশিক’ ও ‘শোষণকারী’ কার্যকলাপের জন্য রুশ ব্যবসায়ী প্রিগোঝিনের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বর্ধিত করেছে, কিন্তু এর বাইরে আর তেমন কিছুই করে নি। অন্যদিকে, মস্কো সুদানে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। রুশ নিরাপত্তা বিশ্লেষক কিরিল সেমিয়োনোভের মতে, সুদানে রাশিয়ার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং চীন! ভবিষ্যতে সুদানে প্রভাব বিস্তারের জন্য চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জনের জন্য রুশ সশস্ত্রবাহিনী সুদানি সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে

সামগ্রিকভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব বসন্তের সময় তার দীর্ঘদিনের মিত্র মিসরের শাসকশ্রেণিকে রক্ষা করে নি, কিন্তু রাশিয়া সিরিয়ার শাসকশ্রেণিকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছে এবং সুদানের শাসকশ্রেণিকেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। আরব বিশ্ব ও আফ্রিকার কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর কাছে এর ফলে ওয়াশিংটনের ভাবমূর্তি আংশিকভাবে হলেও ক্ষুণ্ণ হয়েছে, অন্যদিকে মস্কোর ভাবমূর্তি তাদের কাছে উজ্জ্বল হয়েছে। ভবিষ্যতে মস্কো ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতি তাদের বিবেচনায় থাকবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

সর্বোপরি, সিরিয়া ও সুদানে রুশ হস্তক্ষেপের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। সিরিয়ার উচ্চ তীব্রতার সংঘাতে দামেস্ককে রক্ষা করার জন্য ক্রেমলিনকে রুশ সৈন্য মোতায়েন করতে হয়েছিল, কিন্তু সুদানের নিম্ন তীব্রতার সংঘাতে ক্রেমলিন অল্প সংখ্যক ‘মার্সেনারি’ মোতায়েন করেই খার্তুমকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। অল্প কিছু রুশ ‘মার্সেনারি’ আফ্রিকা ও আরব বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্রে মস্কোর পছন্দনীয় একটি সরকারকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহায়তা করেছে এবং বিনিময়ে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রটিতে লাভজনক বাণিজ্যিক চুক্তি হস্তগত করেছে। ‘ওয়াগনার গ্রুপে’র এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ভবিষ্যতে এই ধরনের নিম্ন তীব্রতার সংঘাতে মস্কো আবার ওয়াগনার গ্রুপকে ব্যবহার করবে, এমন সম্ভাবনা প্রবল।

This is a Bengali article about the activities of the Wagner Group, a Russian private military company, in Sudan. Necessary sources are hyperlinked within the article.

Source of the featured image: Khartoum Star

Related Articles