টিকটকের যাত্রা শুরু ২০১৬ সালে। বর্তমানে এটা তুমুল জনপ্রিয়তা পেলেও শুরুতে এটা তেমন জনপ্রিয় ছিল না। তবে এর ব্যবহারকারী বৃদ্ধির হার ছিল খুব দ্রুত। যাত্রা শুরুর পাঁচ বছরের মাথায় ২০২১ সালেই এর গায়ে ‘সবচেয়ে বেশিবার ডাউনলোড করা অ্যাপ’-এর তকমা এঁটে যায়। ২০২০ সালে করোনার সময় যখন মানুষ লকডাউনের কবলে পড়ে ঘরবন্দী হয়ে পড়ে, তখন একঘেয়ে জীবনে সবচেয়ে বড় বিনোদনের উৎসগুলোর একটি হয়ে দাঁড়ায় টিকটক। পরিসংখ্যান বলছে, এখন পর্যন্ত এই ছোট পরিসরের ভিডিও-শেয়ারিং অ্যাপ্লিকেশনটি সাড়ে তিন বিলিয়নেরও বেশি ডাউনলোড করা হয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এর পরিচালনা পরিষদ ‘এক বিলিয়ন সক্রিয় ব্যবহারকারী’র রেকর্ড গড়ার ঘোষণা দেয়। ২০২০ সালে এর বাজারমূল্য ধরা হয়েছিল ৫০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ২০২২ সালে সেটি উন্নীত হয়েছে ৭৫ বিলিয়ন ডলারে।
টিকটকের ব্যবসায়িক সাফল্য, সব বয়সী মানুষের মাঝে এর জনপ্রিয়তা কিংবা এর অবিশ্বাস্য উত্থান নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক। কিন্তু কেউই বোধহয় ভাবতে পারেননি এই অ্যাপ একসময় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দুটো রাষ্ট্রের বিবাদের বিষয়বস্তুতে পরিণত হবে। বর্তমানে মার্কিন রাজনীতিতে ‘হট টপিক’ হচ্ছে টিকটক। মার্কিন রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তারা বেশ আগে থেকেই বলে আসছিলেন এই অ্যাপ্লিকেশন মার্কিন নাগরিকদের জন্য নিরাপদ নয়। তাদের আশঙ্কা ছিল হয়তো এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মার্কিন নাগরিকের তথ্য চীনা সরকারের হাতে চলে যেতে পারে। চীনের একটি আইন আছে, যেখানে বলা হয়েছে ‘জাতীয় স্বার্থে’ চীনা সরকার যদি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কাছে তাদের সংগৃহীত তথ্য চায়, তাহলে সেই চীনা কোম্পানিগুলো তথ্য সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে। আমেরিকার মূল মাথাব্যথার কারণ এই আইন। তাদের ধারণা- হয়তো এই আইন ব্যবহার করেই চীনা সরকার কোটি কোটি মার্কিন নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে।
আমেরিকার ভোগপণ্যের পণ্যের বাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। আমেরিকায় শ্রমের দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় স্থানীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলেও পণ্যের দাম কমিয়ে বাজারে বাড়তি সুবিধা আদায় করতে পারে না। অপরদিকে যদি বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান দেশটির ভোগ্যপণ্য ক্রেতাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে তাদের চাহিদানুযায়ী সঠিক পণ্য সঠিক দামে সরবরাহ করে, তাহলে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও বেশি বেকায়দায় পড়ার সম্ভাবনা আছে। অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি দেখিয়েছে- টিকটক অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশনগুলোর তুলনায় অনেক বেশি তথ্য সংগ্রহ করে। আমেরিকার আশঙ্কা- টিকটকের সংগ্রহ করা অর্থগুলো যদি সরকারের মাধ্যমে চীনা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে পৌঁছায়, তাহলে সেগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় বাড়তি সুবিধা লাভ করবে। এজন্য টিকটকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ কিংবা এর ব্যাপ্তিকে সংকুচিত করে কড়া নজরদারিতে আনার জন্য বার বার দেশটির রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তারা দাবি জানিয়ে আসছেন।
মার্কিন নীতিনির্ধারকদের শঙ্কার কারণ আছে আরও। টিকটক ইতোমধ্যেই মার্কিন সমাজে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে সমর্থ হয়েছে। মার্কিনীদের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে অ্যাপ্লিকেশনটি। মার্কিন ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ সংবাদের উৎস হিসেবে প্রায় পুরোপুরি টিকটকের উপর নির্ভরশীল। তাদেরকে এই অ্যাপে যেসব সংবাদ দেখানো হয়, তারা সেগুলোই দেখেন, বিশ্বাস করেন। মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, এর মাধ্যমে সহজেই মার্কিনিদের মস্তিষ্ক ধোলাই করা সম্ভব। চীনা প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর আরেকটি বড় মাধ্যম হতে পারে এটি– এমনটাই মনে করেন অনেকে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের অনেকেই সোচ্চার হয়েছেন। তারা বলছেন, ক্রমবর্ধমান চীন-বিদ্বেষের অংশ হিসেবেই আমেরিকা টিকটক বন্ধের সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছে। এ ধরনের পদক্ষেপ হবে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের উপর আঘাত।
গত মাসে হোয়াইট হাউজ বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে ত্রিশ দিন সময় দিয়েছে, যাতে এই সময়ের মধ্যে সংস্থায় চাকরিরত কারও মোবাইলে টিকটক না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে। প্রায় ত্রিশটি মার্কিন অঙ্গরাজ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের টিকটক ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। প্রায় একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে। কিছুদিন আগে হোয়াইট হাউজ কংগ্রেসের একটি বিলে সমর্থন জানিয়েছে। এই বিল আইনে পরিণত হলে কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেই চীন, ইরান, ভেনেজুয়েলা, কিউবা, উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ায় উৎপাদন করা প্রযুক্তিপণ্যগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা বা আমেরিকার বাজারে সেগুলো প্রবেশ করার সীমিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন করতে পারবে। এই বিলে টিকটক বা বিশেষ কোনো অ্যাপ্লিকেশন বা পণ্যেট নাম ব্যবহার না করা হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন- মূলত টিকটককে আটকাতেই এই বিল পাশ করানোর জন্য তোড়জোড় চলছে। সংক্ষেপে এই বিলকে বলা হচ্ছে ‘রেসট্রিক্ট অ্যাক্ট’।
টিকটকের পক্ষ থেকে চীনা সরকারের কাছে তথ্য সরবরাহের সবধরনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক সাক্ষাৎকারে টিকটকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শৌউ জি চিউ জানিয়েছেন, টিকটক নিষিদ্ধ করলেই আমেরিকা তথ্য চুরির হাত থেকে বেঁচে যাবে– এটা ভাবলে ভুল হবে। টিকটকের দ্বারা মার্কিনিদের তথ্য পাচারের কোনো প্রমাণ নেই। এই ধরনের পদক্ষেপ দেশটিকে বাড়তি কোনো নিরাপত্তা এনে দেবে না। টিকটকের বর্তমান পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, টিকটকের সমস্ত তথ্যের জগতে মাত্র দুটো কর্তৃপক্ষের প্রবেশাধিকার আছে। একটি হচ্ছে ওরাকল ক্লাউড, আরেকটি টিকটকের মার্কিন ডেটা সিকিউরিটি টিম। গত ২৩ মার্চ তিনি কংগ্রেসের ‘এনার্জি এন্ড কমার্স কমিটি’র সামনে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি তাকে টিকটকের বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। আমেরিকার প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলেরই রাজনীতিবিদরা এই অ্যাপ্লিকেশনটি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিশ্বজুড়ে টিকটকের এক বিলিয়নেরও বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী রয়েছেন। শুধু আমেরিকাতেই রয়েছে প্রায় দশ কোটি ব্যবহারকারী। ২০২১ সালে টিকটক কন্টেন্ট ডেভেলপারদের অর্থ প্রদানের ঘোষণা দেয়। যেসব ব্যবহারকারীর দশ হাজার ফলোয়ার এবং তৈরিকৃত কন্টেন্টে এক লাখ ভিউ রয়েছে, তাদের কন্টেন্টের জনপ্রিয়তার উপর ভিত্তি করে মাসিক ভিত্তিতে অর্থ প্রদান করা হবে। এই সিদ্ধান্তে মার্কিন টিকটক কন্টেন্ট ডেভেলপাররা বেশ খুশি হয়েছিলেন। আমেরিকার তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ক্যারিয়ার হিসেবে টিকটকের কন্টেন্ট তৈরিকে বেছে নিচ্ছে। এরকম একটা সময়ে টিকটকের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হলে তাদের সমস্ত প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা জলে যাবে। অনেকের ধারণা টিকটকের সাথে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্ন হওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ গুজব। তারা মনে করছেন মার্কিন প্রতিষ্ঠান মেটা টিকটকের সাথে না পেরে ওঠায় তাদের ষড়যন্ত্রেই টিকটকের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হচ্ছে।
টিকটকের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটি একেবারে নতুন নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার বিভিন্ন দেশে টিকটক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছিল। ২০২০ সালে সীমান্তে সংঘাতের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারত চীনের বেশ কিছু পণ্যের পাশাপাশি টিকটকের উপরও নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। আফগানিস্তানের টিকটক শুরু থেকে নিষিদ্ধ। ‘অনুপযুক্ত কনটেন্ট’ সরবরাহের জন্য ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানেও টিকটকের উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। ইউরোপের অনেক দেশের মতো তাইওয়ানও গত বছর সকল সরকারি ডিভাইস থেকে টিকটক নিষিদ্ধ করেছে। একটু পরিষ্কার করে দেখলেই বোঝা যায়, পশ্চিমা বিশ্ব থেকেই নিষেধাজ্ঞাগুলো আসছে। আমেরিকায় টিকটকের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে।