মানবসমাজের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে একজন মানুষকে নানান রুপ রুপ ধারণ করতে হয়। তার অন্যতম একটি রুপ হচ্ছে নেতৃত্ব দান। আবার নেতৃত্ব বলতে যে কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই বোঝায় তা-ও কিন্তু নয়। যদিও সময়ের কালক্ষেপণে নেতৃত্ব নামক বিষয়টি অনেকটা মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করার বস্তু হয়ে গিয়েছে। মূলত ব্যক্তিচিত্তে নেতৃত্বের ফুল তখনই ফোটে, যখন একজন ব্যক্তি তার মেধা মনন ও চিন্তাধারা এবং সর্বোপরি নিজের আত্মবিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেয় সবার মাঝে।
বস্তুত লিডারশীপ বা নেতৃত্ব বলতে বোঝায় একজন মানুষের এক ধরনের সক্ষমতা যা একটি নির্দিষ্ট সমাজের মানুষকে বা কোনো দলকে অনুপ্রেরণা ও দিক নির্দেশনা দিয়ে পরিচালিত করতে পারে। একজন সফল নেতা যেমন সমাজ জীবনের প্রতিটি স্তরে সুচিন্তা ও সুপরিকল্পনার বিকাশ ঘটান, তেমনি তাকে পারিবারিক জীবনেও সফলভাবে পরিবার পরিচালনার ক্ষমতা জোগায়।
গঠনগত দিক থেকে নেতৃত্ব একটি টপ-ডাউন পিরামিড স্টাইল প্রক্রিয়া। যদিও শীর্ষের লক্ষ্য আমাদের শুরুতেই নির্ধারণ করে নিতে হয়। কিন্তু আমাদের কাজ শুরু করতে হয় একেবারে ভূমি থেকে। কারণ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিচের ভীত যত মজবুত হবে, উপরের স্থাপত্য ততো টেকসই হবে।
ধরা যাক একজন গ্র্যাজুয়েট যদি চিঠি বাছাই বা কফি বিক্রি দিয়ে কাজ শুরু করে, তবে সে ১৫ বছর পর নিশ্চিত কফি অর্ডার করারই যোগ্যতা অর্জন করবে। এটা নিতান্তই বাস্তব।
বলা বাহুল্য, আজকাল নেতৃত্ব ব্যাপারটা বলতে বিড়াল পোষ মানানোর মতো কাজকে বোঝায়। কিন্তু চরম সত্য হলো একদল মানুষ আছে যারা আজকাল তার বর্তমান বেতন আর অবস্থান নিয়ে খুশি থাকতে পারে না। উপরন্তু আরেকটি দল আছে তারা ১৫ বছর অপেক্ষাও করতে রাজি নয়। বরং তারা তৎক্ষণাৎ পরিবর্তন চায়। তারা প্রত্যেকেই কিন্তু তাঁদের জীবনটাকে নিজেদের কাছে লটারির টিকেটের মতো উপস্থাপন করছে, কিন্তু তাতে তারা কেউই হারতে রাজি নয়। তাহলে আমরা কী করতে পারি? কিভাবে আমরা ওইসব মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারি যারা তা মেনে নিতে চায় না?
এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই আমাদের স্বচ্ছতা, সহনশীলতা আর পারস্পরিক সৌহার্দমূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আর তার সাথে নিচের ৭টি নিয়ম মেনে চললে তবেই অবাধ্যকে বাধ্য করে নেতৃত্বের গুন অর্জন করা সম্ভব হবে।
বিশেষ কিছুতে গুরুত্ব প্রদান
সাধারণত অনেক বড় বড় কোম্পানী কিংবা অর্গানাইজেশন, যাদের নিজস্ব একটি লক্ষ্য পূরণের বাস্তবসম্মত বিবৃতি থাকে, সেখানে তাদের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপগুলো সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করা থাকে। এটি কর্মীদের মধ্যে একটি তাৎক্ষণিক অনুপ্রেরণার জন্ম দেয়। সত্যিকার অর্থে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক পরিকল্পনায় কাজ করার যে প্রয়াস তা এককভাবে পরিচালনা প্রায় অসম্ভব। আপনার অফিসের প্রত্যেকেই আপনার কোম্পানীর মিশন কিংবা ভিশন সম্পর্কে অবগত এবং তাঁদের জানার জায়গাটুকুর মানদণ্ডে আপনাকেই এগিয়ে আসতে হবে কর্মীদের সাথে একই কাতারে।
সত্যি বলতে যদি কোনো কিছু আঁকড়ে না ধরা যায়, তবে কোনোদিনই ভালো কিছু ধরা দেয় না। কোনো কিছু আঁকড়ে ধরা বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া। যদি অল্প পরিসরে লক্ষ্যটা সম্পূর্ণরুপে দৃশ্যমান হয় কিংবা বোঝা যায়, তবে তা অর্জনও অনেকটা সহজতর হয়। আর অন্যকে তা সম্পর্কে আকৃষ্ট করতেও সুবিধা হবে।
স্বপ্রণোদিত করার অভ্যাস
উদ্যোক্তা যদি কর্মচারীদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়, তবে তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে কাজ করা শুরু করবে যা ব্যবসায়ে অভূতপূর্ব সাফল্য আনতে সক্ষম। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০% কোম্পানিতে দেখা যায় কর্মচারীরা তাদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগে কাজ ছেড়ে দেয়। তাই যদি তাদের মূল্যায়নের মাধ্যমে অনুপ্রানিত করা যায়, তাহলে তারা নিজ থেকেই কাজে আগ্রহী হবে এবং তার মেধার সর্বোচ্চ প্রদানের জন্যে তৈরি থাকবে।
বিপক্ষে অবস্থান
টাইটেলটা শুনতে বেমানান হলেও ব্যাপারটার গভীরে গেলে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। এখানে কোম্পানীর স্বার্থে যেমন পক্ষে অবস্থান নেওয়া জরুরি, তেমনি বিশেষ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষে অবস্থান নেওয়াটাও দরকার। সাধারণত সংকটকালীন মুহূর্তে কর্মীরা যখন অসহায় বোধ করে, তখন নেতাকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হয়, যা কর্মীদের মাঝে তার জন্যে ভরসার জায়গা তৈরি করে দেয়।
আনন্দে রাখা
কেউ হতাশা বা দুঃখকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায় না। মানুষের যাবতীয় কাজকর্মের উদ্দেশ্য সুখে থাকা। কোনো কারণে হতাশাগ্রস্থ থাকা কর্মীদের অনেক সময় মনে আলাদা বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যা কোম্পানীর কাজের ক্ষেত্রে মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে তখন আপনাকে হতে হবে তাঁদের প্রিয়জনের চেয়েও সহানুভূতিশীল। তাই নেতাকে অবশ্যই কর্মীর মানসিক প্রশান্তির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। আর কেউ যখন মানসিকভাবে প্রশান্ত থাকে, তখন তার কর্ম পরিধিও বৃদ্ধি পায়।
স্বেচ্ছাসেবী খোঁজ করা
কিছু সেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে অভিজ্ঞতা নেওয়া যেতে পারে কিংবা এমন কাউকে তাঁদের সামনে উপস্থাপন করা যেতে পারে যাতে তারা সামনে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত হবে। কিভাবে কর্মীরা সেখানে স্বেচ্ছায় কাজ করে? এবং এতে তারা গর্বও বোধ করে। তাই এক্ষেত্রে নিজের কর্মীদেরও কাজের ভেতরে ও বাইরে সন্তুষ্ট রাখতে হবে, যাতে সঠিক তথ্য তাদের থেকে পাওয়া যায়। ধরা যাক কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা তার কর্মীদের ছুটির দিনে কোম্পানির উৎপাদিত পোশাক ব্যবহারের প্রস্তাব দিল। উত্তর যদি ‘না’ আসে, তাহলে বুঝতে হবে এই পণ্য বাজারেও চলার সম্ভাবনা কম। তাই তাদের স্বেচ্ছায় কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
পদ্ধতি অপেক্ষা পরিমাণে গুরুত্বদান
কর্মীদের কাজের ব্যাপারে স্বাধীনতা দেওয়া জরুরি। কারণ এতে তার অতিরিক্ত চাপ যেমন মাথায় থাকবে না, তেমনি সে নিজ উদ্যোগেই অধিক উদ্যমে কাজ করতে পারবে। তাছাড়া বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারানোর সম্ভাবনাই বেশি। তাই কর্মীকে তার মতো করে কাজ করেতে দেওয়াই ভাল। আর নেতা হিসেবে শুধু পরিমাণের হিসাব রাখাই যথেষ্ট।
প্রশংসা করার অভ্যাস করতে হবে
একটু প্রশংসাই পারে একটা পরিবেশকে আরও বন্ধুভাবাপন্ন এবং কর্ম তৎপর করতে। কর্মীর যেকোনো ভালো কাজের প্রশংসা করা অতীব জরুরী। এতে তার উৎসাহ বহুগুণ বেড়ে যায় এবং তার প্রোডাক্টিভিটিও বেড়ে যায় শতগুণ। যদি তার কাজের জন্যে সে শুধু ধন্যবাদ পায়, তাতেই তার বেতনের সমান উপযোগ সে পেয়ে যায়। তাই যেকোনো নেতৃত্বের পূর্বশর্তই হলো কর্মীর কাজের প্রশংসা।
যদিও নেতৃত্ব একটি বিশাল ব্যাপার, কিন্তু মানুষের সামান্য কিছু আচরণের দিকে দৃষ্টি দিয়েই সে তার এই গুণকে অনেকখানি বাড়িয়ে তুলতে পারে। উপরের সাতটি ধাপ সেক্ষেত্রে অনেক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাই নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে কাউকে নিজের নেতৃত্বের আওতায় আনতে, উপরের সাতটি ধাপ অবশ্য পালনীয়।
মোটকথা নেতৃত্বের সাফল্য বহুলাংশেই নেতার ব্যবস্থাপনা-দক্ষতার উপর নির্ভর করে। একটি দক্ষ ব্যবস্থাপনাই প্রকৃতভাবে সকল সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে ধরা দেয়। এমনিভাবে সমাজে বা রাষ্ট্রে বিদ্যমান বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষদেরকে পরিচালনার ক্ষেত্রে যত দক্ষ, দূরদর্শী, প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যাবে ততই মঙ্গল।