পলান সরকার, এক অশীতিপর বৃদ্ধ; কাঁধে একটি ঝোলা আর ঝোলাভর্তি বই, চোখে মোটা কাঁচের ঘোলাটে চশমা, গায়ে সাদামাটা পাঞ্জাবী। হাঁটছেন গাঁয়ের কোনো মেঠো রাস্তা ধরে। পাশের ধানক্ষেত থেকে কেউ বলে উঠলো “ বইওয়ালা দুলাভাই, কই যান?”। মিষ্টি হেসে জবাব দিলেন দুলাভাই। গ্রামের সকলের কাছে তিনি বইওয়ালা দুলাভাই নামে পরিচিত।
বাউসা গ্রামের খুব ভোরে যারা মাঠে যেত, তারা সবার আগে পলান সরকারকেই দেখতে পেত। গ্রামের লোকজন খুব ভোরেই তার কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পায়। আর দরজা খুললেই দেখা যেত হাসি মুখে পলান সরকার দাঁড়িয়ে। প্রতিদিন খুব ভোরে উঠেই বইয়ের ঝোলা কাঁধে পলান বেরিয়ে যেতেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে দূর দুরান্তের গ্রামে যেতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নেড়ে বই দিতেন এবং তা আবার সপ্তাহখানেক বাদে ফেরত নিতেন। এভাবে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রামে হাজারো মানুষকে তিনি যে আলোয় আলোকিত করেছেন তার নজির এ দেশে খুব কম। বই দেয়া এবং নেয়ার মাধ্যমে তিনি যে শিক্ষা আন্দোলন গড়ে তুলেছেন তা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে দেশবাসীর নজরে আসে।
এবার আসা যাক পলান সরকারের এমন উদ্যোগের নেপথ্যের কাহিনীতে।
১৯২১ সালে নাটোর জেলার বাগাতি পাড়া গ্রামে পলান সরকারের জন্ম। হায়াত উল্লাহ সরকার এবং মইফুন্নেসার ৩ পুত্র এবং ২ কন্যার মৃত্যুর পর তার জন্ম হয় বলে মা তাকে পলান বলে ডাকতেন। প্রকৃত নাম হারেজ উদ্দিন সরকার। মাত্র ৫ মাস বয়সে পিতার মৃত্যু হলে নানা ময়েন উদ্দিন নিজ কন্যা ও নাতিকে নিজ গ্রাম বাউসাতে নিয়ে আসেন। নানা ময়েন উদ্দিনের কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় পলান বেশ আদরেই বেড়ে উঠছিলেন নানার সংসারে। সেখানে তিনি একটি স্কুলে ভর্তি হন যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণীর পর লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। এইটুকু বয়সেই তার বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠে। সেই অভ্যাসের বশেই তিনি যেখানে যে বই পেতেন, সংগ্রহ করতেন, নিজে পড়তেন এবং অন্যকেও বই পড়তে উৎসাহিত করেন।
নানা ময়েন উদ্দিন ছিলেন স্থানীয় ছোটখাট জমিদার। যৌবনে নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন এবং পরবর্তীতে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারীর চাকুরি পান। বেতনের টাকা দিয়ে নিজে বই কিনতেন এবং মানুষকেও ধার দিতেন। নানার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি ৪০ বিঘা সম্পত্তির মালিক হন। সে সম্পত্তিও তিনি মানবকল্যাণে উৎসর্গ করেন।
যৌবনে তিনি যাত্রাদলে ভাঁড়ের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। মানুষকে হাসি আনন্দ আর বিনোদন দিতে পছন্দ করতেন বলেই ভাঁড়ের ভুমিকায় অভিনয় করতেন। সেকালে যাত্রাপালার দলে লেখাপড়া জানা মানুষের বেশ অভাব ছিল। যাত্রাদলে একমাত্র লেখাপড়া জানা মানুষ ছিলেন পলান সরকার। সেই সময় যাত্রার স্ক্রিপ্ট কপি করার মতো ফটোকপি মেশিন ছিল না। ফলে পলানকেই যাত্রার স্ক্রিপ্ট লিখে লিখে কপি করতে হত। মাঝে মাঝে তিনি প্রম্পটের কাজও করতেন। প্রম্পট হলো যিনি মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দেন। এভাবে লেখাপড়ার সাথে তার সম্পৃক্ততা থেকেই যায়, যা পলানকে বই পাঠের অভ্যাস বজায় রাখতে সাহায্য করে।
অত্যন্ত প্রচারবিমুখ একজন মানুষ পলান সরকার । ১৯৬৫ সালে স্থানীয় বাউসা হারুন অর রশীদ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের জন্য ৫২ শতাংশ জমি দান করেন তিনি। জমি দান করলেও প্রচারবিমুখ এই মানুষটি নিজের নাম প্রকাশ করতে চান নি, চান নি স্কুলের বড় কোনো পদ। কিন্তু স্থানীয় শিক্ষক, স্কুল পরিচালনা পর্ষদের অনুরোধে তিনি পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বইপাগল এই মানুষটি স্কুলের সেরা ১০ মেধাবী ছাত্রদের টাকা বা বৃত্তি না দিয়ে বই উপহার দিতেন। কিন্তু বাকি ছাত্র ছাত্রীদেরও বই পড়ার উৎসাহ দেখে তিনি সবাইকে বই দিবেন এবং তা সময়মত ফেরত নিবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। শুধু তাই নয়, বাউশা গ্রামে তার একটি চাল কল ছিল, সেখানে যারা প্রতিনিয়ত দেনা পরিশোধ করতো তাদের তিনি বই উপহার দিতেন। এছাড়া আত্মীয় স্বজনদের বা পাড়া প্রতিবেশীর বিয়েতে নানান জিনিসের পাশাপাশি বইও উপহার দিতেন। এভাবেই শুরু হয় তার বই পড়ার আন্দোলনের ভিত।
১৯৯২ সালে তার ডায়াবেটিকস ধরা পড়লে ডাক্তার তাকে নিয়মিত ৩-৪ কিলোমিটার হাঁটার পরামর্শ দিলেন। এই হাঁটাকে তিনি ভিন্নভাবে কাজে লাগালেন। শুধু স্কুল ভিত্তিক বই বিতরণ না করে বাড়ি বাড়ি বই বিতরণের কথা ভাবলেন। যেই ভাবা সেই কাজ। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, “আমি ভেবে দেখলাম, যারা আমার বাড়ি থেকে বই নিয়ে যায়, আমি নিজেই তো হেঁটে হেঁটে তাদের বাড়িতে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি। সেই থেকে শুরু। এক বাড়িতে বই দিতে গেলে তার দেখাদেখি আরেক বাড়ির লোকেরাও বই চায়। বই নিয়ে হাঁটা আস্তে আস্তে আমার নেশায় পরিণত হলো।”
পলান সরকার হাঁটতে শুরু করলেন গ্রামে গ্রামে, বই পৌছে দিতে থাকলেন মানুষের ঘরে ঘরে। গ্রামের সাধারণ গৃহিণী থেকে শুরু করে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের নিকট হয়ে উঠলেন বইওয়ালা দুলাভাই। কোনো বাড়িতে গেলে তাকে খুব আপনজনের মত সমাদর করা হত। গ্রামের পথে ঘুরতে ঘুরতে নিজেই হয়ে উঠলেন এক ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। তার এই বই পড়ার আন্দোলন উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সেই সুবিধাবঞ্চিত গ্রামগুলোতে এক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ফেলে। আবদুর রহিম নামক এক মুদি দোকানদার তার নিয়মিত পাঠক। ৫৫ বছর বয়সী এই মুদি দোকানদার প্রচুর বই পড়তেন, আবার প্রতিদিন বিকেলে পাঠক সমাবেশ করতেন। পলান সরকারের এই উদ্যোগ এক মাদকাসক্তকেও দিয়েছিল নতুন জীবন।
প্রচারবিমুখ এই ‘সাদা মনের মানুষ’ সম্পর্কে জানতো শুধু সেই বাঘা উপজেলার ২০টি গ্রামের মানুষ। ঐ নিভৃত পল্লী অঞ্চলের এমন মহৎ উদ্যোগ অনেকদিন অজানা থেকে যায়। তারপর ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে সারা বিশ্ব পলান সরকারের এই উদ্যোগ সম্পর্কে অবহিত হয়। ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো তাঁকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। চারদিকে তাঁর প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে স্থানীয় জেলা পরিষদ তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। ২০১১ সালে রাষ্ট্রের বিশেষ সম্মাননা একুশে পদকে তাঁকে ভূষিত করা হয়। শুধু তাই নয়, তার জীবনী অবলম্বনে গোলাম সারোয়ার দোদুল বিটিভিতে ‘অবদান’ নামক একটি নাটকও তৈরি করেছেন।
৯৪ বছর বয়সী পলান সরকার একজন প্রচন্ড জীবনবাদী এবং সুরসিক মানুষ। আর দশটা মানুষের মত তিনিও বিয়ে করেছেন এবং ৯ সন্তান সন্ততিকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলেছেন। নিজে পড়াশুনার সুযোগ পান নি বলে ছেলে মেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। বড় ছেলে মোজাফফর হোসেন বাউসা কলেজের প্রভাষক। ছোট ছেলেদের মধ্যে একজন একই কলেজের MLSS, আরেকজন বাউসা উচ্চ বিধ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, আরেকজন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, একজন মোবাইল ফোন কোম্পানির প্রকৌশলী এবং অপরজন ধানকলের ব্যবসায়ী। ৩ মেয়ের মধ্যে ছোটজন এম.এ পাস করেছেন বাকি দুইজন স্কুলের শিক্ষিকা।
সকাল বিকাল ২ বার হাঁটতে বের হন পলান সরকার। এই ৯৪ বছর বয়সেও তিনি ২-৩ গ্রাম যান প্রতিদিন। এভাবে বই বিতরণ করে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে চলছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। বয়স পারে নি তাকে থামাতে।