আমাদের এই ঘটনাবহুল জীবনের মধ্যে একটা সুপরিচিত দার্শনিক মতবাদ প্রচলিত আছে যে, আপনি অনেক সময় চাইলেই সব কিছু গ্রহণ করতে পারবেন না কিংবা চাইলেই কিছু ছেড়ে দিতে পারবেন না। দিনকে দিন আপনি বড় হচ্ছেন, বড় হবার সাথে সাথে আপনার চারপাশের অবস্থা বদলে যাচ্ছে, আপনার চাহিদা বদলে যাচ্ছে, আপনার চাওয়া পাওয়ায় আসছে আমূল পরিবর্তন। কিন্তু আপনি সব কিছুই দু’হাতে আগলে নেবার চেষ্টা করছেন। না আপনি নিজেকে সামাল দিচ্ছেন, না আপনি আপনার মানসিকতাকে ধরে রাখতে পারছেন। তবে এটাও সত্য যে, কাঙ্খিত স্বপ্ন পূরণ করতে হলে অনেক সময়ই আমাদের সামনে আসা কিছু সুযোগ ছেড়ে দিতে হয়।
অনেক সময় আক্ষরিক অর্থেই আমাদের বাস্তবিক জীবনকে আরেকটু মধুর করতে অনেক চাকরি, পদোন্নতি বা নতুন ব্যবসার সুযোগ চোখের সামনে ছোটাছুটি করতে থাকে। বলাবাহুল্য যেসব সফল ব্যক্তিত্ব কিংবা প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ এই সুযোগ প্রদানের প্রস্তাব করেন, তারা এর নানামুখী সুবিধার কথাও তুলে ধরেন। যেমন- আপনি এই চাকরি করলে আপনার পদোন্নতি বা ব্যবসায় উদ্যোগ জীবনের জন্য বিশাল সাফল্যের দুয়ার খুলে যাবে আরও কত কি। আপনার জন্য এই সুযোগটি হবে অনেক আকষর্ণীয়, বয়ে আনবে অঢেল টাকার স্রোত এবং যশের ঢেউ।
কিন্তু এই ধরনের সুযোগ পাওয়ার পরও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একটু ভাবুন। মানব জীবনের এই স্বল্প সময়ে আমাদের মুখোমুখি হতে হয় নানাবিধ জিনিসপত্র কিংবা ব্যবস্থাপত্রের মধ্য দিয়ে, কিছু আমাদের খুব কাজে লাগে, আবার কিছু জিনিস কিংবা সুযোগ না চাইতেও ফেলে দিতে হয় কিংবা ছেড়ে দিতে হয়। তবে সেটা নির্ধারণ করবে ওই বিষয়টি নিয়ে নিজের মধ্যে কতটুকু আস্থা আছে।
একটু চিন্তা করুন। বিবেচনা করে দেখুন যে, এই নতুন সুযোগটি আপনার জীবনের মূল লক্ষ্যের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। যারা আপনাকে এই সুযোগের প্রস্তাবটি দিচ্ছেন, তারা হয়তো ভাবছেন আপনার লক্ষ্য অর্জনে এই সুযোগটি সহায়ক হবে। তবে মনে রাখবেন, এখানে কিন্তু তাদের প্রয়োজনের বিষয়টিই তাদের কাছে প্রাধান্য পাবে। আর তাই অনেক সময় নতুন সুযোগ আসার পর ভেবে দেখতে হয়, সুযোগটি নেবেন, কি নেবেন না। আপনার এই সু-সিদ্ধান্তকে আরেকটু তাৎপর্যপূর্ণ, সঠিক ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে আমাদের এ আয়োজন এবং এই পরার্মশগুলো আপনাকে সহায়তা করবে সামনে এগিয়ে চলার পথেও।
সুযোগটি কি আমার জন্য সঠিক?
ধরুন আপনি কোনো কিছুতে সুযোগ পেয়েই গেছেন, এখন কী করবেন? হ্যাঁ, এখন একটু ভেবেচিন্তে দেখুন এই নতুন সুযোগটি আপনার জন্য কতটুকু সঠিক। অথবা আপনি জীবনে যা অর্জন করতে চাচ্ছেন বা আপনার জীবনের মূল লক্ষ্যের দিকে এই নতুন কাজটি পরিচালিত করবে কি না? মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়, কারণ মানুষের বিবেচনা শক্তি অসাধারণ। নিজের ওপর ভরসা রেখে একবার গভীরভাবে ভাবুন সুযোগটি নিয়ে। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন, এই সুযোগটি কি আসলেই আপনার সামর্থ্যের মধ্যে পড়ে কি না।
আপনি কি আসলেই কাজটি বা সুযোগটি চাচ্ছেন? নাকি প্রস্তাবকারীর মনভোলানো চটকদার যুক্তিতে রাজি হয়ে যাচ্ছেন? আরও ভালোভাবে লক্ষ্য করুন কারা এই কাজটি করছে। তাদের জীবনযাত্রা দেখুন এবং সিদ্ধান্ত নিন। হ্যাঁ, এবার আপনার পালা, চিন্তা করে দেখুন আপনিও কি তাদের মতো একজন হতে চাচ্ছেন কিনা। যদি উত্তর হ্যাঁ-বোধক হয়, তাহলে সুযোগটি আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আর যদি না হয়, তবে শুধু প্রস্তাবকর্তার যুক্তিতে বা অনুরোধে ঢেঁকি না গেলাই আপনার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হবে।
এ প্রসঙ্গে জেফ ফক্সওয়ার্থি বলেন,
“এমন কাজ খুঁজে বের করুন যা আপনি করতে ভালোবাসেন। যদি অনেক টাকা আসে, সেটি বোনাস। কিন্তু যদি না-ও আসে, তবুও আপনি কাজে যেতে পছন্দ করবেন।”
অজানা ভয়ের উদয় হচ্ছে?
হ্যাঁ, এরকমটা সবার মধ্যেই হয়, আমার মধ্যেও হয়েছে অনেকবার। সত্যি বলতে কি, আমাদের নিজেদের মনের মধ্যে অজান্তেই একটা বাঘ লুকিয়ে রাখি, যা আমাদের সব সময় দৌড়ের উপর রাখে। সোজা বাংলায় বললে হবে, সব সময় নিজেকে একটা অজানা ভয়ের মধ্যে রাখা, এইটা করলে না জানি ওইটা হবে, সেটা হবে, আরও কত কি। এবং ব্যাপারগুলো নতুন একটা সুযোগ সামনে আসলে ঠিক সেই ভাবেই ধরা দেয়, একটা খাপ ছাড়া ভয়।
তবে এবারও স্রেফ নিজের কাছেই আসতে হবে; হ্যাঁ নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনার ভীতি এবং উদ্বেগ আপনার সিদ্ধান্তকে কতটুকু প্রভাবিত করছে কিংবা এই সুযোগটি ছেড়ে দিলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে সে ব্যাপারে আপনি চিন্তিত?
অজানা ভবিষ্যত নিয়ে এই উদ্বেগ আসাটা খুবই স্বাভাবিক। আমরা আসলে কেউই জানি না সামনে কি ঘটবে। আমাদের কাছে সব সময়ই জানা এবং চেনা পথটিই সহজ এবং নিরাপদ মনে হয়। অন্যদিকে অজানা পথ নিয়ে মনের মধ্যে জন্ম নেয় নানা ধরনের শঙ্কা। হতে পারে সেটি আরো সহজতর, আরো আকর্ষণীয় অথবা কঠিন থেকে কঠিনতর কিছু। কিন্ত কে জানে এই কঠিন যাত্রা বা এই কঠিন অজানা পথ হয়তো আপনার জন্য কেমন সারপ্রাইজ নিয়ে অপেক্ষা করছে। সেক্ষেত্রে অজানা পথকে না বলাই উত্তম। শুধুমাত্র অজানা উদ্বেগের ভয়ে হাতের কাছে প্রাপ্ত যেকোনো সুযোগে হ্যাঁ বলে দেবেন না।
সুযোগটি কি সহজ বলেই লুফে নিচ্ছেন?
আপনার ধারণা ভুল নয়, আমরা অনেকেই এ কাজটি করে থাকি। কিছু কিছু সুযোগকে শুধু এই কারণেই ভালো মনে হয় যে সেগুলো খুব সহজ। ধরুন আপনি আপনার নিজস্ব ব্যবসা নিয়ে খুব বাজে অবস্থায় আছেন। এমন সময় কেউ একজন আপনাকে খুব সহজ একটা কাজের প্রস্তাব আপনাকে দিল, যেখানে খুব সহজ কাজে এবং তুলনামূলক অল্প পরিশ্রমে অনেক টাকা আয় করতে পারবেন। তবে এই ধরনের সুযোগ শুধু সহজ বলেই লুফে নেয়া ঠিক হবে না।
নিজের ব্যবসার শুরুর দিকে অনেক কঠিন কাজ নিজেকে একাই সামাল দিতে হয়। উৎপাদন থেকে শুরু করে বিপনন, প্রচার এমনকি হিসেবপত্র রাখাসহ আরও অনেক দুরুহ কাজ। আপনি হয়ত ভাববেন এর বদলে হয়তো অন্যের হয়ে সহজ একটা কাজে এর চেয়ে আরও বেশি টাকা থাকবে। কিন্তু একটিবার ভেবে দেখুন তো, সেই সহজ সুযোগটি কি আপনাকে আপনার আপন লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে দেবে কি না? আপনার পেশাগত ক্ষেত্রটাকে শুধুমাত্র একটা গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে উন্নতির পথ রুদ্ধ করে দেবে কি না? তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, সহজে বেশি টাকা আয়ের চটকদার সুযোগগুলো অনেক সময়ই অন্যায় উপার্জনের পথ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সুযোগ লুফে নেয়ার আগে অন্তত দশবার ভাবুন।
ফ্যান্টাসির জগতে বন্দী হয়ে আছেন?
সবার শুরুতেই আপনি আপনার স্বপ্ন এবং আপন লক্ষ্যের দিকে নজর দিন। একবার ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করে দেখুন তো সেগুলো কি আসলেই ফ্যান্টাসি নির্ভর কিনা? তবে আমি বলবো, যদি আপনার স্বপ্ন হয় বিখ্যাত হওয়া, তাহলে লক্ষ্যটি আপাতত একটি কল্পনার জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখুন। তবে আপনি যদি আলালের ঘরের দুলাল হয়ে থাকেন, তাহলে অন্য কথা। বিখ্যাত হবার চিন্তাভাবনা করা বা স্বপ্ন দেখা এমন একটি বিষয় যার মাধ্যমে আপনি অনেক আনন্দ পেতে পারেন, কিন্তু আপনার কাজের মাধ্যমে কবে অর্জন করতে পারবেন এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
শুধু ফ্যান্টাসির জগতে সীমাবদ্ধ না থেকে আপনার দরকার নতুন কিছু শেখা বা ব্যবসা আরম্ভ করা। তবে আমি এটাও বলছি না যে, আপনি ফ্যান্টাসির মধ্যে থাকতে পারবেন না। এ দুটোকেই আপনি আপনার কাজের দ্বারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, এ ধরনের লক্ষ্য বেছে নেওয়ার অন্যতম একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে আপনি এর দ্বারা বিখ্যাত হতে পারেন বা অনেক বড় ধনী হয়ে যেতে পারেন অথবা কিছু নাও হতে পারেন। যদি আপনার সামনে এমন সুযোগ আসে যেটি আপনার ফ্যান্টাসির বা কল্পনায় আঁকা ছকের সঙ্গে একেবারেই মানানসই এবং আপনি আসলেই সেই কাজটি করতে জানেন ও ভালোবাসেন, তাহলে আপনার ওই সুযোগটিই লুফে নেওয়াটা ঠিক হবে।
শুধু শুধু বসে দিবাস্বপ্ন দেখার চেয়ে নিজের নাগালের ফ্যন্টাসিগুলো পূরণের জন্য কাজে লেগে যাওয়াই তো ভালো। তাই নয় কি?