সঠিক পথের দিশাহীনতা, সময়োপযোগী পরিকল্পনার অভাব, নিজের উদ্যোগকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে না পারা, বিনিয়োগকারীদের নেটওয়ার্কের সাথে পরিচিতি না থাকা সহ নানাবিধ সমস্যায় ভুগে থাকেন অধিকাংশ তরুণ উদ্যোক্তাই। এ ব্যর্থতাগুলোই একটু একটু করে জমে তিলকে পরিণত করে তালে, গলা টিপে মেরে ফেলে একজন উদ্যোক্তার লালিত স্বপ্নকে, বিফল করে দেয় তার শত-সহস্র ঘণ্টার পরিশ্রমকে।
প্রায় সাড়ে ষোল কোটি মানুষের মাতৃভূমি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আয়তনের তুলনায় অতিরিক্ত এ জনসংখ্যাকে একদিকে যেমন তার সমস্যা বলা যায়, তেমনই তেত্রিশ কোটি হাতকে বলা যায় তার অপার সম্ভাবনার চালিকাশক্তি। এই বিপুল জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি হলো তরুণ। একটি দেশকে উন্নতির দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিতে, বিশ্বের বুকে একটি জাতির মাথা তুলে দাঁড়াতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা যে পালন করে তরুণরাই, সে কথা কারোরই অজানা নয়। আর বর্তমানে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠীর অনেকেই প্রথাগত চাকরির ধ্যানধারণা ছেড়ে নিজেরাই শুরু করতে চাইছে নতুন কিছু, হয়ে উঠতে চাইছে একেকজন সফল তরুণ উদ্যোক্তা। পুরাতনকে পেছনে ফেলে নতুনের এ জয়গান যে অতুলনীয় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা সমস্যাগুলোর মতো নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে অনেকের সেই স্বপ্নই পরিণত হয় দুঃস্বপ্নের অধ্যায়ে।
এই বিশাল তরুণ জনতাকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়ে তাদের উদ্যোগগুলোকে টেকসই, বাস্তবসম্মত ও গ্রাহকদের পছন্দসই করে গড়ে তুলতে ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে ইয়াং সাস্টেইনেবল ইমপ্যাক্ট (ওয়াইএসআই) বাংলাদেশ। ওয়াইএসআই প্রকৃতপক্ষে একটি আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংগঠন, যার সদরদপ্তর নরওয়ের রাজধানী অসলোতে অবস্থিত। বাংলাদেশ ছাড়া চীন এবং সিঙ্গাপুরেও শুরু হয়েছে সংগঠনটির একই কার্যক্রম।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাড়া হয় ওয়াইএসআই বাংলাদেশের প্রথম ইনকিউবেশন প্রোগ্রাম ‘মেগাপ্রেনার্স ২০১৮’ এর আবেদনপত্র। পাঁচ শতাধিক আবেদনপত্র থেকে বিভিন্ন ধাপে যাচাইবাছাইয়ের মাধ্যমে সারা দেশ থেকে বেছে নেয়া হয় যোগ্যতম ২১ জনকে, যাদের সবারই ছিল উদ্ভাবনী নানা ব্যবসায়িক আইডিয়া। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী এই ২১ জন থেকে পরবর্তীতে গঠন করা হয় ৫টি দল। উল্লেখ্য, ঢাকার মতো একটি মেগা সিটির নানাবিধ সমস্যা সমাধানে যে এন্ট্রাপ্রেনার তথা উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছে, তাদেরকেই বলা হচ্ছে ‘মেগাপ্রেনার’।
এই ২১ জন উদ্যোক্তাকে নিয়ে এরপর শুরু হয় তিন মাসব্যাপী অনলাইন ইনোভেশন প্রোগ্রাম। এ সময় উদ্যোক্তাদের গড়ে তুলতে নরওয়ে, বাংলাদেশ, চীন ও সিঙ্গাপুরে অনুসরণন করা হয় একই গাইডলাইন। এর মধ্য দিয়ে সঠিক দল গঠন, উদ্যোগটিকে ঠিকমতো এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় গবেষণা, মার্কেট অ্যানালাইসিস, জনমত যাচাই, প্রোটোটাইপ তৈরির মতো নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাদের, যা তাদের উদ্যোগগুলোকে টেকসই করে গড়ে তুলতে সামনের দিনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। অনলাইন ইনোভেশন প্রোগ্রামের পরপরই শুরু হয় ৫ দিনব্যাপী ক্যাম্পেইন। এ সময় প্রতিযোগীরা দিনভর তাদের পণ্যের নানা বিষয়ের সর্বশেষ দিকগুলো নিয়ে কাজ করছিলো। তাদের কাগজগুলো যেন আরো নিখুঁত ও সুন্দর করে এগিয়ে নেয়া যায়, সেজন্য নরওয়ে থেকে ছুটে আসেন ওয়াইএসআই এর সিইও মার্কাস ব্রুন্স, এক্সটার্নাল রিলেশন্স অফিসার ডানাট টেকি এবং চিফ অপারেটিং অফিসার দিদ্রিক আলেকজান্ডার।
ওয়াইএসআই বাংলাদেশ এবং ওয়াইএসআই গ্লোবালের নিবিড় তত্ত্বাবধানে কাটে তাদের এই দিনগুলো। এ সময় একদিকে যেমন তারা সবকিছুতে শেষ মুহূর্তের তুলির আচড় লাগাচ্ছিলো, তেমনই বিভিন্ন সফল উদ্যোক্তার জীবনের নানা কঠিন মুহূর্তের কাহিনী শুনে বুঝে নিচ্ছিলো তাদের সামনের দিনগুলোর বাধাবিঘ্ন ও সাফল্যের হাতছানি সম্পর্কে।
অবশেষে গত ১২ জুলাই, বৃহস্পতিবার রাজধানীর বসুন্ধরায় অবস্থিত জিপি হাউজে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ‘মেগাপ্রেনার্স ২০১৮’ এর ডেমো ডে। ৫টি দল সেখানে তাদের উদ্যোগগুলো দেশের বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে থেকে আগত বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরে। হোয়াইট বোর্ডে আয়োজিত সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নরওয়ের রাষ্ট্রদূত সিডসেল ব্লেকেন, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ওয়াইএসআই এর সিইও মার্কাস ব্রুন্স এবং গ্রামীণফোনের চিফ অফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার জনাব মাহমুদ হোসেন।
সম্মানীত বিচারক মণ্ডলীর রায়ের নির্বাচিত হয় চূড়ান্ত ৩ বিজয়ী দল, যাদের জন্য পুরষ্কার হিসেবে থাকছে সর্বমোট ১,০০০ মার্কিন ডলার। ১ম স্থান অধিকার করেছে ‘ক্রুড প্লাস’। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরি নিয়ে কাজ করেছে তারা। দলের সদস্যরা হলেন মাজেদুর রহমান মাসুম, মাহবুবা জান্নাত, শারমিন আক্তার, মো. সাজ্জাদ আজিম, মো. রশিদুন নেওয়াজ এবং তিলোত্তমা সাহা। ২য় স্থান অর্জনকারী দলটির নাম ‘বিম’। তারা কাজ করেছে এমন একটি স্মার্টওয়াচ নিয়ে, যা রাস্তাঘাটে নারীদেরকে উত্যক্তকারীদের হাত থেকে সুরক্ষা দেবে, যা আজকের সমাজের নারীদের জন্য বেশ দরকারী। এ দলের সদস্যদের মাঝে আছেন মো. রোহান কামাল, রাসিব আফ্রিদি এবং সৌরভ চৌধুরী। ৩য় স্থান অধিকার করেছে ‘অ্যাকোয়ালাইন’। মাছের ফেলে দেয়া বর্জ্যকে পুনরায় ব্যবহার করে আরো নানা কাজে লাগানোর মতো চমৎকার একটি বিষয় নিয়ে কাজ করেছে তারা। দলটির সদস্যরা হলেন তন্ময় কুমার ঘোষ, এস. এম. ইমতিয়াজ ভূঁইয়া এবং মো. মুজাহিদুল ইসলাম।
‘মেগাপ্রেনার্স ২০১৮’ এর স্পন্সর হিসেবে ছিলো লিডসাস লিমিটেড, ইএমকে সেন্টার এবং ওয়াইএসআই বাংলা লিমিটেড। ইনোভেশন এনাব্লার হিসেবে ছিলো হোয়াইট বোর্ড। সহযোগীতায় ছিলো নরওয়েজীয় দূতাবাস, ইয়াং সাস্টেইনেবল ইম্প্যাক্ট, বাংলাদেশ সায়েন্স সোসাইটি এবং ওয়ার্ক ফর অ্যা বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট। চমৎকার এই আয়োজনটির গর্বিত মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিলো রোর বাংলা।
সামনের দিনগুলোতে এ দলগুলোকে নিয়মিত তত্ত্বাবধানে রাখবে ওয়াইএসআই বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। তাদের কাজগুলোকে সামনের দিকে ঠিকমতো এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় সাহায্য এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের বিনিয়োগকারীদের সাথে বসার ব্যবস্থাও করবে তারা। এককথায়, এই তরুণ উদ্যোক্তাদের সামনের দিনের চলার পথগুলো সহজ করে তুলতেই কাজ করবে ওয়াইএসআই বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের তরুণদের এমন প্রতিভা দেখে মুগ্ধ ওয়াইএসআই এর সিইও মার্কাস ব্রুন্স। তাদের কাজ, কর্মনিষ্ঠা এবং পণ্যগুলো ছাড়িয়ে গেছে তার প্রত্যাশাকেও। হোয়াইট বোর্ডকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পাশাপাশি তিনি আশা প্রকাশ করেছেন সামনের দিনগুলোতেও ওয়াইএসআই বাংলাদেশের এমন অসাধারণ কাজ চালিয়ে নেয়ার।
ওয়াইএসআই বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সুমন সাহা এ সম্পর্কে বলেছেন,
“ওয়াইএসআই বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে এক বছরও হয়নি। এরই মাঝে দেশের সেরা মেধাবী তরুণদের নিয়ে এত চমৎকার একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব হবে সেটা প্রায় অবিশ্বাস্য ছিল সকলের জন্য। কিন্তু আমরা সেটা করে দেখিয়েছি, আমাদের উদ্যামী তরুণেরা করে দেখিয়েছে। বেরিয়ে এসেছে আমাদের মেগা সিটির মারাত্নক ৫টি সমস্যার সমধান, তৈরি হয়েছে বিজনেস মডেল ও এমভিপি। আশা করি খুব দ্রুতই তারা তাদের সেবা নিয়ে ঢাকাকে আরো বাসোপযোগী শহরে রুপান্তরিত করতে সহায়তা করবে। আর আমরাও এমন দারুণ সফলতার পর আরো বেশি উদ্যামী হয়েছি আমাদের আগামী প্রোগ্রামগুলোর জন্য, আশা করি সবাই আমাদের পাশে থাকবেন।”