ব্যর্থতাই ছিলো যাদের সফলতার বাহন

কে জানতো সেই স্কুল থেকে বের করে দেয়া ১৬ বছরের দুরুন্তমনা আর চরম মাত্রায় দুঃসাহসী ছেলেটি এক সময় বিশ্ব কাঁপাবে। যদিও স্কুল থেকে বের হবার সময় প্রধান শিক্ষক তার সম্পর্কে একটা কঠিন ভবিষদ্বাণী করেন, এই দস্যি ছেলে হয় জেলে যাবে, নয়তো কোটিপতি হবে। কিন্তু সেই ভবিষদ্বাণী যে দুটোই ফলে যাবে কিশোর রিচার্ড ব্র্যানসনের ভাগ্যে, এই ব্যাপারটা হয়ত অজানাই ছিলো সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের।

হ্যাঁ, রিচার্ড ব্র্যানসন, দুনিয়াজুড়ে তার পরিচিতি হলো দ্য রেবেল বিলিওনিয়ার নামে। এমন বিদ্রোহী টাইপ নামের পিছনে রয়েছে তার খ্যাপাটে স্বভাব, সাহসী ব্যবসায়ীক সিদ্ধান্ত এবং ঝুঁকি গ্রহণের অস্বাভাবিক মানসিকতা। ভয়ংকর সব অ্যাডভেঞ্চারাস শখের ব্যপারেও তিনি বিন্দুমাত্র পিছপা হন না। আর তার সাহসী ব্যবসায়ীক সিদ্ধান্তগুলো ছাপিয়ে গেছে সকল প্রকার ব্যবসায় অধ্যয়নের ইতিহাসকে। শত শত বন্ধুর পথ তার এগিয়ে চলাকে বিন্দুমাত্র থামাতে পারেনি। তবে তার ব্যর্থতার লিস্টটাও কিন্ত কম বড় নয়।

রিচার্ড ব্র্যানসনের ব্যর্থতার শুরুটা হয় প্রথম ব্যবসায় উদ্যোগ ভার্জিন মেইল অর্ডারকে ঘিরে।  মূলত গানের রেকর্ড বিক্রির এই কোম্পানির কাজ ছিল কমদামে গানের রেকর্ড বিদেশে পাঠানো। কোম্পানিটি শুধু ব্যর্থই হয়নি, এর জন্য জেলের ঘানিও টানতে হয় রিচার্ড ব্র্যানসনকে।

এই জেলে যাওয়াই তার শাপে বর হলো। বুঝলেন, শর্টকাট পথে ব্যবসা করে খুব বেশি টাকা কামানোর উপায় নেই। জেল থেকে বেরিয়েই নেমে গেলেন পুরোনো ব্যবসাকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর কাজে। যদিও সেই সময়টায় গান রেকর্ড করা একটা বিরক্তিকর ও দুঃসাধ্য কাজ ছিলো। কঠিন বিষয়গুলো মাথায় রেখে বড়সড় একটা পরিবর্তন নিয়ে আসলেন। তিনি বুঝলেন স্থায়ীভাবে কোনো ব্যবসা দাঁড় করাতে হলে অবশ্যই সে অনুযায়ী আইন মেনেই নিজের উদ্ধাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে।

তারপরের কাহিনীগুলো সব ইতিহাস, একে একে গড়ে তিনি তোলেন আপন সাম্রাজ্য। তার প্রতিষ্ঠিত রেকর্ড স্টোরগুলো এতই বিশাল ছিল যে, লোকে রেকর্ড কিনতে এসে খেই হারিয়ে ফেলত। ফলাফল এই ব্যবসাতেও বিপুল সাফল্য। একে একে অনেক ব্যবসায়ই হাত দেন তিনি। বিমান ভ্রমণেও তিনি আনেন বিপুল বৈচিত্র ও আনন্দের ছোঁয়া। ফলাফল এখানেও ব্যবসাসফল এবং দ্রুত ফুলে ফেঁপে ওঠে তার এয়ারলাইন্স কোম্পানি।

আর এভাবেই তিনি দাঁড় করান অনেকগুলো সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তবে নিজের প্রথম ব্যর্থ উদ্যোগ ভার্জিন মেইলের ভার্জিন নামটি তিনি জুড়ে দেন তার বাকী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে। আর এভাবেই দাঁড়িয়ে যায় তার বিশাল ব্যবসায়ীক সাম্রাজ্য। যার মধ্যে Virgin Megastores, Virgin Records, Virgin Airlines, Virgin Holidays, Fuel, Money, Digital, Cosmetics, Trains, Healthcare, Virgin Galactic দুনিয়াজুড়েই পরিচিত।

তবে এরপরও ব্যর্থতা তার পিছু ছাড়েনি, তার ব্যর্থ উদ্যোগুগলো সংখ্যাও নেহায়েৎ কম নয়। যেমন- Virgin Cola, Virgin brides, Virgin Clothes, Virgin Vodka ইত্যাদি। তবে এসব ব্যর্থতাকে কখনোই তিনি প্রশ্রয় দেননি। বিপুল কর্মোদ্যম দিয়েই জয় করেছেন ব্যর্থতাকে। আর তাই ব্যবসার দুনিয়ায় সফল বলে আজ তার খ্যাতি বিশ্বজোড়া।

স্টিভেন স্পিলবার্গ

এই একবিংশ শতাব্দীতে খুব কম মুভি দেখা কোনো মানুষকেও যদি কোনো চলচ্চিত্র পরিচালকের নাম বলতে বলা হলে, নির্দ্বিধায় চলে আসবে স্টিভেন স্পিলবার্গের নাম। মূলত চলচ্চিত্র নির্মানে তার অভিনবত্বের মাত্রা এতটাই ছাড়িয়ে গেছে যে, ইতিহাসের পাতাও তার নাম টুকে রাখতে ভুল করেনি।

কথাটা কিছুটা একরোখা হলেও, বলতে হয় সিনেমার জগতে স্পিলবার্গের আগমন যেন ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ টাইপের। শুরুটা হয় একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানানোর মধ্য দিয়ে। মাত্র ৫০০ ডলার বাজেটে বানিয়ে ফেলেন একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, তাও আবার ১৬ বছর বয়সে! এর মাঝেই তিনি ঠাওর করতে পারেন চলচ্চিত্র বানানোয় তার সহজাত প্রতিভা সম্পর্কে।

খ্যাপাটে ও প্রতিভাবান বলে খ্যাত এই পরিচালকের প্রথম বড়সড় আকারে চলচ্চিত্রের নাম ছিল “Jaws”, যাকে ইতিহাসের অন্যতম হিট ছবির একটি বলা চলে।

Jaws ছবিটির পোস্টার

বলা বাহুল্য, যে পরিচালক ৫০০ ডলারে একটি পুরোদস্তুর মুভি বানিয়ে ফেলতে পারেন, তার কাছে তো বাজেট নিয়ে কোনো সমস্যাই থাকার কথা না। তবে অবাক করার বিষয় হলো, এইবারের মুভিতে স্পিলবার্গ বাজেট এবং সাথে শিডিউলের ঝামেলায় পড়লেন। যেখানে ছবি শেষ হবার কথা ৫৫ দিনে, সেখানে ছবি শেষ হয়েছে ১৫৯ দিনে। আর সাড়ে চার মিলিয়ন ডলারের বাজেট গিয়ে ঠেকলো ১০ মিলিয়ন ডলারে।

এদিকে স্পিলবার্গের নিজের মনমত শট না হওয়া পর্যন্ত কাজ চূড়ান্ত করা ছিলো একেবারেই স্বভাব বিরুদ্ধ, তার এই এহেন আচরণে ক্ষুব্ধ ছিলো প্রযোজক থেকে শুরু করে প্রোডাকশন টিম, স্টুডিও সবাই। যখন ছবিটি সেরা ছবির তালিকায় স্থান করে নেয়, তখন কষ্ট কিছুটা লাঘব হলেও থেকে যায় মুভির বাজেট নিয়ন্ত্রণ এবং শিডিউল নিয়ে স্পিলবার্গের ব্যর্থতার গ্লানি।

এরপরের মুভিটিতেও স্পিলবার্গ  আগের মতোই বাজেট এবং শিডিউলজনিত ঝামেলার মধ্য দিয়ে শেষ করেন “Close encounters of the Third Kind” শিরোনামের ছবিটি। এবারের ছবিটিও ব্যবসাসফল হলো।

Close encounters of the Third Kind ছবিটির পোস্টার

স্পিলবার্গ তখনো টগবগে তরুণ। সাফল্যের হাওয়ায় আকাশে উড়ছেন। মাথায় আসলো এক উচ্চাভিলাষী ছবির পরিকল্পনা। এই ছবিটিই যে তার পতনের কারণ হবে তা হয়ত তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। যেই কথা সেই কাজ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ছবি বানাবেন, নাম দিলেন ১৯৪১। মূলত ছবিটির বিষয় ছিলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিদের পার্ল হারবার আক্রমণের প্রেক্ষাপটে আমেরিকানদের ভীতি নিয়ে একটি প্রহসনমূলক সিনেমা। কিন্তু বিধিবাম, ১২ মিলিয়ন ডলারের বাজেট গিয়ে ঠেকলো ৩১ মিলিয়ন ডলারে আর শিডিউল অনুযায়ী এবারও কাজ করা হলো না। অন্যদিকে আমেরিকানদেরও নিজেদের নিয়ে প্রহসনমূলক সিনেমা দেখতে আগ্রহেরও বেশ কমতি ছিলো। গায়ে লাগলো আমেরিকার অন্যতম সুপারফ্লপ ছবির তকমা।

“1941” ছবির পোস্টার

স্পিলবার্গ এবার ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিলেন, শরণাপন্ন হলেন কিংবদন্তী পরিচালক জর্জ লুকাসের, জর্জ লুকাস বিখ্যাত ছিলেন তার বাজেট এবং শিডিউলের মধ্যে দারুণ দারুণ সিনেমা তৈরিতে। নিছক পরামর্শ নিলেই হয়তবা কাজ হয়ে যেত সেসময়ের নামী দামী পরিচালক স্পিলবার্গের। কিন্তু তিনি হয়ে গেলেন জর্জ লুকাসের সহকারী পরিচালক। আর এতে জর্জ লুকাসেরও আপত্তি ছিলো না।

Indiana Jones and the Raiders of the Lost Ark

এরপর “Indiana Jones and the Raiders of the Lost Ark” নামের ছবিটি তৈরিতে স্পিলবার্গ শিখলেন একেবারে হাতে কলমে। মাত্র ৭৩ দিনেই শেষ হয়ে যায় ৮৫ দিনের শিডিউল করা ছবিটি। আর সাফল্য? ১৯৮১ সালের সেরা ব্যবসাসফল ছবির একটি হয় এই ছবিটি। আর স্পিলবার্গের শিখার খাতায় যোগ হলো নতুন আরেকটি পালক। শিখলেন কিভাবে পরিমিত শৃঙ্খলা বজায় রেখে নিজের উচ্চাভিলাসী প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যায়।

এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি, তাবৎ দুনিয়ার সিনেমাপ্রেমীদের উপহার দিয়েছেন দারুণ দারুণ সব চলচ্চিত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- Jurassic Park, Lincoln, Munich, Saving Private Ryan, Schindler’s list, Bridge of Spies এর মতো চোখ ধাঁধানো চলচ্চিত্র।

সবগুলো ছবিই ছিল ব্যবসাসফল এবং অস্কারসহ অনেক পুরস্কার জিতে নেয় ছবিগুলো। আর এসব ছবি বানাতে গিয়ে সব সময় স্পিলবার্গ মনে রেখেছেন তার প্রথম দুটি ছবির ব্যর্থতা থেকে নেওয়া শিক্ষাগুলো।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন-বক্তৃতায় স্টিভেন স্পিলবার্গ বলেছেনঃ

আমার কাজ হলো দুই ঘণ্টার একটা পৃথিবী সাজানো। আর তোমরা সাজাবে এমন এক পৃথিবী, যা অনন্তকাল টিকে থাকবে। তোমরাই ভবিষ্যতের আবিষ্কারক। তোমরাই নেতৃত্ব দেবে, প্রেরণা দেবে, দেখভাল করবে। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, চোখে চোখ রাখা ভুলে যেয়ো না।

তথ্যসূত্র

১) en.wikipedia.org/wiki/Richard_Branson

২) biography.com/people/richard-branson-9224520

৩) en.wikipedia.org/wiki/Steven_Spielberg

৪) en.wikipedia.org/wiki/Raiders_of_the_Lost_Ark

Related Articles

Exit mobile version