Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কোটা সংস্কার নাকি বাতিল?

সম্প্রতি দেশের সবচেয়ে আলোচিত শব্দগুচ্ছ হচ্ছে ‘কোটা ব্যবস্থা’। বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে গত বেশ কিছুদিন ধরেই আন্দোলন করছে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে বিভিন্ন মহল সরব হলেও, এবারের আন্দোলনের মাত্রা বিগত সময়েরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই আন্দোলনে খুব দ্রুতই সংহতি জানিয়ে যুক্ত হয়ে পড়ে সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। কোটা সংস্কারের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু দাবি তুলে ধরা হয় তাদের পক্ষ থেকে।

আন্দোলন চলাকালীন পুলিশ এবং ছাত্রসংগঠনগুলোর ভূমিকা নিয়ে তুমুল বিতর্ক চললেও এতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের হার কমেনি একটুও। এরই জের ধরে আজ বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বক্তব্য প্রদানের সময় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করার ঘোষণা দেন। একই সাথে প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও উল্লেখ করেন।

সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; Source: Prothom Alo/Focus Bangla

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, কোনটি সঠিক সিদ্ধান্ত হবে? কোটা সংস্কার, নাকি বাতিল? যেহেতু কোটা বাতিল নয়, বরং সংস্কারের সুনির্দিষ্ট দাবি নিয়ে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে; সেহেতু আন্দোলনকারীদের প্রধান আলোচনা ঘনীভূত হয়েছে এখন এই একটি প্রশ্নতে। সেদিকটি আলোচনা করতে হলে আমাদের জানতে হবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের দাবিগুলো কী ছিল এবং কোটা ব্যবস্থা আসলে কী তা নিয়ে।

কোটা সংস্কারের দাবিগুলো কী?

প্রথমেই জানা যাক আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো কী কী। যে পাঁচটি দাবিকে সামনে রেখে কোটা সংস্কারের আন্দোলন চলছে সেগুলো হলো

  • কোটা-ব্যবস্থা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা।
  • কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়া।
  • সরকারি চাকরিতে সবার জন্য অভিন্ন বয়স-সীমা।
  • কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা না নেওয়া।
  • চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ব্যবহার না করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের অবস্থান; Source: The Daily Star

কোটা আসলে কী?

দেশের অনগ্রসর মানুষদের শিক্ষা, ব্যবসা, চাকরি বা নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য কোটা একটি বিশেষ পদ্ধতি বা ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার পেছনে প্রধান যুক্তি হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা। এর লক্ষ্য হলো, দেশের সকল পর্যায়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে অনগ্রসর বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কিছু সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। জাতির পিছিয়ে পড়া অংশকে মূলস্রোতে নিয়ে আসাটাই হলো কোটা ব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য। শিক্ষা বা চাকরির ক্ষেত্রে অনগ্রসর ব্যক্তিরা যখন তাদের সীমাবদ্ধতার কারণে পিছিয়ে পড়েন, তখন তাদেরকে কোটা সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে সামনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে রাষ্ট্র।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একই ধরনের কোটা ব্যবস্থা কি সারাজীবন ধরে চলতে থাকবে? নাকি সময়ের সাথে সাথে বিদ্যমান অবস্থার প্রেক্ষিতে কোটা ব্যবস্থারও পরিবর্তন প্রয়োজন?

কোটার প্রয়োজনীয়তা বোঝা যাবে এই ছবিটি থেকে; Source: Interaction Institute for Social Change

একটি চলমান ব্যবস্থার বিলুপ্তি তখনই করা হয় যখন এর আর প্রয়োজনীয়তা থাকে না। সাধারণভাবেই বলা যায়, কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজের অনগ্রসর অংশকে ধীরে ধীরে যদি মূলস্রোতে নিয়ে আসা যায়, তাহলে সংরক্ষিত কোটার সুযোগও ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা উচিত। কোটা প্রদানের উদ্দেশ্য যখন সম্পূর্ণভাবে পূরণ করা যাবে, অর্থাৎ, যখন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কোনো একটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী অন্যদের মতোই সমান মাত্রায় প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবে; তখনই কোটা ব্যবস্থা বিলুপ্তির প্রয়োজন দেখা দেবে।

এই অঞ্চলে কোটা ব্যবস্থার ইতিহাস

প্রতিনিধিত্বে সমতা বজায় রাখার জন্য সরকারি চাকরিতে (সেন্ট্রাল সার্ভিস অব পাকিস্তান বা সিএসপি) কোটা ব্যবস্থার প্রচলন ছিল পাকিস্তান আমলেও। এছাড়াও অন্যান্য কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪০%, পাঞ্জাব ও ভাওয়ালপুর ২৩%, সিন্ধু, খায়েরপুর ও উত্তর-পশ্চিমের প্রদেশগুলোর জন্য ২% এবং সীমান্ত অঞ্চল, আদিবাসী, বেলুচিস্তান, আজাদ কাশ্মীর ও কাশ্মীরের অভিবাসীদের জন্য ১৫% কোটা সংরক্ষিত ছিল। বাকি ২০% মেধার ভিত্তিতে সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল। আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক দিক থেকে সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এটিই ছিল কোটার বিধান। জনসংখ্যার ভিত্তিতে সবচেয়ে বড় প্রদেশ হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে কোটা সবচেয়ে বেশি ছিল।

স্বাধীনতার পরে কোটা সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা

স্বাধীনতার পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সর্বক্ষেত্রে সৎ ও সাহসী মানুষের যেমন প্রয়োজন ছিল, তেমনি যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত, অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতে যুক্ত করারও দরকার ছিল। ১৯৭২ সালের ৫ জুন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মেধার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০% কোটা। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০%, যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের জন্য ১০% এবং বাকি ২০% ছিল জেলা কোটা। যদিও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী কোটার আওতায় কোনো নারী এতে অংশগ্রহণ করতে আসেননি। পরবর্তীতে ১৯৭৬ ও ১৯৮৫ সালে কোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা হয়।

১৯৭৬ সালে জেলা কোটার আওতায় ২০% রেখে মেধার জন্য ৪০% বরাদ্দ করা হয়। এরপর ১৯৮৫ সালে মেধার জন্য বরাদ্দ ৪৫% করা হয়। একই সাথে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারী কোটা বাতিল করা হয়, ১৯৮৫ সালে মাত্র একজন নারী এর আওতায় আসেন কিন্ত তিনি নিজেকে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীর চেয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পরিচয় দেওয়াতেই আগ্রহী ছিলেন। তাই এর পরিবর্তে যুক্ত হয় ১০% নারী কোটা এবং ৫% ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা। ১৯৯৭ ও ২০১১ সালে কোটা ব্যবস্থাকে আরও সম্প্রসারিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও তাঁদের নাতি-নাতনিদেরকেও এর আওতাভুক্ত করা হয় এবং ১% প্রতিবন্ধী কোটা যুক্ত করা হয়। ফলে শুধুমাত্র মেধার জন্য অবশিষ্ট থাকে ৪৪%।

বর্তমানে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি কেন?

আগেই বলা হয়েছে, কোটা ব্যবস্থা এমন একটি পদ্ধতি যেখানে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। এই উপলব্ধি থেকেই মূলত কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রদান এবং তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনই মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রবর্তনের মূল আকাঙ্ক্ষা। সেই বিষয়টি বিবেচনা করেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা এই গোটা ব্যবস্থার সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৭ বছর পর বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সবচেয়ে সম্মানিত, মর্যাদাপূর্ণ ও প্রতিষ্ঠিত জায়গায় থাকবেন, এটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে কি সেটা বিদ্যমান রয়েছে? এই প্রশ্নের জবাব দিতে গেলেই বোঝা যাবে কতটুকু সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটার। সেই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় প্রজন্মকে কোটার অন্তর্ভুক্ত করা কতটুকু যুক্তিসম্মত, সেটিও ভেবে দেখার বিষয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন; Source: channelionline.com

একই সাথে আরেকটি জরুরি তথ্য উঠে আসছে সামনে। সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ২৪ জানাচ্ছে,

“জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গত ১৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে জানান, সরকারি চাকরিতে তিন লাখ ৫৯ হাজার ২৬১টি পদ ফাঁকা রয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ হাজার ২৪৬টি প্রথম শ্রেণির, ৫৪ হাজার ২৯৪টি দ্বিতীয় শ্রেণির, এক লাখ ৮২ হাজার ৭৩৭টি তৃতীয় শ্রেণির এবং ৭৩ হাজার ৯৮৪টি চতুর্থ শ্রেণির পদ শূন্য আছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ৯ম থেকে ১২তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) কর্মকর্তা সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) নিয়োগ দেয়। আর ১৩তম থেকে ২০তম গ্রেডের (তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) পদে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থা নিজস্ব নিয়োগবিধি অনুযায়ী নিয়োগ দেয়।”

আবার সেখানে এও উল্লেখ করা হয়েছে,

“জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি চাকরিতে শূন্য থাকার পদগুলোর বেশিরভাগই কোটা পূরণ না হওয়া পদ।”

এই দুই তথ্যের সমন্বয় করলে বোঝা যায়, বেকারত্ব পরিস্থিতি ও বিদ্যমান সংকট বিবেচনা করে হলেও কোটা সংস্কার নিয়ে ভাবার অবকাশ আছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলী খানের বক্তব্যটি। দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত মতামতে তিনি উল্লেখ করেন,

“বর্তমানে ২৫৮ ধরনের কোটা আছে। চাকরিতে এই কোটা ব্যবস্থা অবশ্যই সংস্কার করা উচিত। “

যেসব কোটা বর্তমানে সরকারি চাকরির জন্য বহাল রয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিই নতুনভাবে পর্যালোচনা করে বৃদ্ধি কিংবা হ্রাস করার প্রয়োজনীয়তাটি সময়ের দাবি হিসাবেই উচ্চারিত হচ্ছে। প্রসঙ্গত, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,

“প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।”

এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিকতা বোঝা যাবে ২৮(৪) অনুচ্ছেদ থেকে। সেখানে বলা হয়েছে, “নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।”

স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, দেশের অনগ্রসর গোষ্ঠীকে সকলের সাথে সমান অধিকার পাবার যোগ্য করে তুলতেই কোটার প্রণয়ন। আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, নারী এই তিনটি জনগোষ্ঠীর অবস্থাই মোটাদাগে এখনও এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছায়নি, যা থেকে বলা সম্ভব যে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত কোটা বিলুপ্ত করতে হবে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের জমায়েত; Source: Collected from Facebook

এই মুহূর্তে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝে আলোচনা চলছে কোটা সংস্কার কিংবা বাতিল এই দুইয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে স্পষ্টভাবে সরকারের অবস্থান বোঝা না যাওয়ার কারণেই আন্দোলনকারীরা এখনও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানায়নি। তবে কোটা পদ্ধতির প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য বিবেচনা করে এর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার দিকটিই বারবার উঠে আসছে সচেতন মহলের আলোচনায়।

Featured Image Source: Twitter

Related Articles