বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোয় আসন্ন বর্ষাকাল, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা মোকাবেলায় সম্ভাব্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে প্রায় ৭ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য নিরাপদ আশ্রয় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের পরিপূর্ণ ব্যবস্থা করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য কাজ। খাড়া পাহাড়ী অঞ্চল এবং বন্যা প্রবণতাসম্পন্ন উপত্যকায় বসবাসরত এসব শরণার্থীগণ অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। যদি ভয়াবহ কোনো ঝড় বা জলচ্ছ্বাসে হয়, তাহলে কী হবে তাদের অবস্থা? আসলেই কি তারা এর মোকাবেলা করতে পারবে? বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোই বা কি ব্যবস্থা গ্রহণ করছে তাদের জন্য?
ঝড় নিয়ে দুশ্চিন্তা কেন?
বাংলাদেশে প্রচুর ঘুর্ণিঝড় সংঘঠিত হয়। সিডর, আইলা, মহাসেন ইত্যাদি খুব শক্তিশালী ঝড় ছাড়াও ছোট-বড় অনেক ঘুর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়েছে এই দেশ। ঝড়ের ফলে জলোচ্ছ্বাসের দেখা দেয় যা পরবর্তীতে জলাবদ্ধতা ও বন্যার সৃষ্টি করে।
এছাড়াও বর্ষাকালে এদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো কক্সবাজারে অবস্থিত। সারাদেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হওয়া অঞ্চলগুলোর একটি হচ্ছে এই কক্সবাজার। সাধারণত জুন-জুলাই মাস বর্ষাকাল হলেও মে মাসের শুরু থেকেই মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যায়। তাই এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে শরণার্থী শিবিরগুলোতে আরও ভোগান্তি ও রোগ-শোকের আশঙ্কা রয়েছে।
আসন্ন বর্ষাকাল ও সম্ভাব্য ঝড়ে রোহিঙ্গারা কীরকম অরক্ষিত?
মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের প্রস্থান আকস্মিক ছিল। তারা অথবা বাংলাদেশ সরকার কেউই এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাই শরণার্থীরা যেখানে যেভাবে পেরেছে সেখানেই তাদের আশ্রয় গেড়েছে। কর্দমাক্ত পাহাড় থেকে তারা গাছ নিধন করে বসতি স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের জন্য যে সকল নিচু পাহাড় বরাদ্দ দিয়েছে সেগুলোর ঢাল খনন করে দুর্বল স্থাপনা তৈরি করে বসবাস করছে তারা।
তাদের বেশিরভাগ ঘরবাড়িই তাঁবুর মতো, যা একটু জোরে বাতাস হলেই উড়ে যেতে পারে। সম্ভাব্য ঝড়ে সেগুলোর পক্ষে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। এছাড়া সে পাহাড়ি অঞ্চলটিতে ধস ও বন্যার আশঙ্কাও রয়েছে।
শরণার্থী শিবিরে জাতিসংঘের স্থাপনা মজবুতকরণ সংক্রান্ত একজন উপদেষ্টা এই অরক্ষিত অবস্থা ও ঝুঁকি সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত। তিনি বলেন, “কোনো বাঁশের তৈরি আশ্রয়স্থল ঘূর্ণিঝড়ে টিকে থাকবে এরকম সম্ভাবনা খুবই কম।” আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থাও সতর্ক করে দিয়ে জানিয়েছে যে এসময় রোগের ঝুঁকি ও প্রচুর প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
তাদের সাহায্যের জন্য কী কী করা হচ্ছে?
আসন্ন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে অনেক ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হচ্ছে। তাদের বাঁশের স্থাপনা কীভাবে শক্তিশালী করতে হবে সে বিষয়ে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। রাস্তাঘাট ও পাহাড়ের গা ঘেঁষে বালির বস্তা দেওয়া হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে নতুন রাস্তা ও সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে।
বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে নতুন সাঁকো ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। শরণার্থী শিবিরগুলো যদি বন্যা অথবা ঝড়ের কারণে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সেক্ষেত্রে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে খাবার ও জিনিসপত্র সংরক্ষণের জন্য জরুরি ডিপো স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়াও বর্ষাকালে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এরকম প্রায় ১৫ হাজার অরক্ষিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রায় ৫০ হেক্টর জমি পরিস্কার করে ও পাহাড় কেটে সমতল করা হচ্ছে।
ঘুর্ণিঝড় আঘাত আনলে শরণার্থী শিবিরগুলো কি খালি করা সম্ভব?
যদিও এসব দুর্যোগের পূর্বাভাসের জন্য বাংলাদেশের উন্নত সতর্কীকরণ ব্যবস্থা রয়েছে, তারপরও এরকম পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের শিবিরগুলো থেকে তাদেরকে সরিয়ে ফেলার কোনো পরিকল্পনা নেই। কেননা তারা সংখ্যায় অনেক বেশি এবং তাদের স্থানান্তর করার মতো কোনো নিরাপদ জায়গাও এই মুহূর্তে নেই।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কি ভাসান চরে স্থানান্তর করা হবে?
ভাসান চর প্রায় দুই দশক আগে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা একটি ছোট দ্বীপ। বাংলাদেশ সরকার সেখানে রাস্তাঘাট, সামুদ্রিক প্রতিরক্ষা ও আশ্রয়স্থল নির্মাণ করছে। এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চিত করেন প্রায় ১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে এই দ্বীপে স্থানান্তর করার পরিকল্পনার কথা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, “শরণার্থী শিবিরগুলো অস্বাস্থ্যকর।“ তিনি আরও বলেন, “আমরা তাদের থাকার জন্য বাড়ি ও আশ্রয়সহ আরও ভালো জায়গা প্রস্তুত করেছি যেখানে তারা রোজগার করতে পারবে।”
তবে এ পরিকল্পনার ব্যাপারে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থাগুলো বেশ উদ্বিগ্ন। তাদের আশঙ্কা, ভাসান চরে শরণার্থীদের রাখলে তারা আলাদা হয়ে পড়বে এবং দুর্যোগ ও মানবপাচারকারীদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
রোহিঙ্গারা কখন নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করবে?
গত বছর নভেম্বরে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মাঝে প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ছয় মাস হয়ে গেলেও এখনও কোনো রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরে যায়নি। যদিও মিয়ানমার ৫ সদস্যের এক রোহিঙ্গা পরিবারকে প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার তা নাকচ করে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “মিয়ানমার বলেছে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত কিন্তু তারা কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।” অপরদিকে মিয়ানমার জানিয়েছে, তারা প্রত্যাবাসনের জন্য শরণার্থীদের যাচাই করছে কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের কাছে সকল প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া হয়নি। দেশটি জানিয়েছে, তারা জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কাজে সহায়তা করতে দেবে যেন তারা নির্ভয়ে দেশে ফিরতে পারে।
কী কী পদক্ষেপ সম্পন্ন হয়েছে?
রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প এলাকায় সড়ক, সেতু ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করার কাজ চলছে। এর মাঝে তাদের জন্য যে কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে সেগুলো হচ্ছে–
- ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের মতে, এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৭০ শতাংশ রোহিঙ্গা সাহায্য হিসেবে খাদ্য পাচ্ছে।
- প্রায় ১ লক্ষ রোহিঙ্গাকে পুষ্টিহীনতার জন্য চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
- মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত ১৫ বছরের নিচে প্রায় ৩ লক্ষ ১৫ হাজার শিশুকে ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি ও টিটেনাসসহ ৫টি প্রয়োজনীয় টিকার মাঝে একটি টিকা দেওয়া হয়েছে।
- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রায় ৪৭ হাজারেরও বেশি জরুরি অস্থায়ী ল্যাট্রিন তৈরি করেছে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োজন। কেননা প্রত্যাবাসনের চুক্তি হওয়ার পরে তা ৬ মাসেও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এত বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর সকল চাহিদা মেটানো বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যাবহুল উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই দুষ্কর। এছাড়া অরক্ষিত অবস্থায় থাকা এই বিশাল জনগোষ্ঠী আসন্ন দুর্যোগের সময় আরও অসহায় হয়ে পড়বে। অনেক প্রাণহানি ও রোগ-শোক এড়াতে এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
Featured Image Source: Fred Dufor/AFP