গত বছর ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করার পরে রাজ্যের সন্ন্যাসী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে অনেকে পরবর্তী বিজেপি প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও ভাবতে শুরু করেছিলেন।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে বিরাট জয় পাওয়ার পরে ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপি এখানে বাজিমাত করাতে দলীয় নেতৃত্ব, কর্মী এবং সমর্থকদের আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠার কারণ বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। কিন্তু আদিত্যনাথ লখনউয়ের তখতে বসার এক বছরের মধ্যে তার এবং তার অন্যতম উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্যের ছেড়ে আসা লোকসভা আসনের উপনির্বাচনে বিজেপির হারের পরে আচমকা হাওয়া উল্টোদিকে বইতে শুরু করেছে। বলা হচ্ছে, এই তবে বিজেপির শেষের শুরু।
বিজেপি জেতার পরে বা তাদের হারের পরে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া নতুন কিছু নয়। সমসাময়িক ভারতীয় রাজনীতিতে মোদী এবং তার সেনাপতি অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন বিজেপির জয়রথ যেভাবে দৌড়াচ্ছে, তাতে ক্রমাগত জয় বা এক-আধটা হারের পরে চরম প্রতিক্রিয়া আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুধুমাত্র আবেগ দিয়ে রাজনীতির রুক্ষ বাস্তবে আঁচড় কাটা যায় না, আর সেটা বিজেপির সমর্থক এবং সমালোচক- দুই পক্ষই যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, ততই মঙ্গল।
উপনির্বাচনের ফল জাতীয় নির্বাচনের এজেন্ডা ঠিক করে না
গোরক্ষপুর এবং ফুলপুর- উত্তরপ্রদেশের দুটি হাই-প্রোফাইল লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি হার মানার পর অনেক সংবাদমাধ্যমে এবং সামাজিক মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে ২০১৯ এর আগে এ হচ্ছে গেরুয়াবাহিনীর জন্য এক অশনি সংকেত। ব্যাপারটি কিন্তু অত সহজ-সরল নয়। এক বছরের মধ্যেই আদিত্যনাথ সরকারের বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া উঠেছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। সমাজবাদী পার্টি বা সপা নেতৃত্ব গত বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে শিক্ষা নিয়ে বেশ কয়েকটি নতুন কৌশল নেন, আর তাতেই বিজেপির পরাজয় ঘটে।
এই উপনির্বাচনে অখিলেশ যাদবের মাস্টারস্ট্রোক বিজেপিকে কাত করেছে
প্রথমত, উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব রাজ্যসভা নির্বাচনে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি বা বসপার প্রার্থীকে সমর্থন জানানোর পরিবর্তে এই উপনির্বাচনগুলিতে বসপার সমর্থন পান। আর উত্তরপ্রদেশের এই দুই প্রধান আঞ্চলিক দলদুটি হাত মেলাতেই কেল্লাফতে হয়। গোরক্ষপুরে সপা-র প্রার্থী প্রবীণ কুমার নিষাদ প্রায় ২২,০০০ ভোটে জেতেন আর ফুলপুর, যা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর একসময়ের কেন্দ্র ছিল, সেখানে নগেন্দ্র প্রতাপ সিং প্যাটেল জেতেন প্রায় ৬০,০০০ ভোটে। মায়াবতী এই রাজ্যে গত দুটি নির্বাচনে বিশেষ সুবিধা না করতে পারলেও প্রাক্তন এই মুখ্যমন্ত্রীর প্রভাব যে রাজ্য রাজনীতিতে কমেনি বিশেষ, তা প্রমাণিত হলো এই উপনির্বাচনে।
দ্বিতীয়ত, অখিলেশ যাদব শুধুমাত্র মায়াবতী নয়, কাছে টেনেছিলেন বামসহ বেশ কিছু ছোটখাটো দলকেও, যাদের তৃণমূল স্তরে যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। গোরক্ষপুরে যেমন অখিলেশ স্থানীয় নিষাদ পার্টির প্রধান সঞ্জয় নিষাদের ছেলে প্রবীনকে প্রার্থী করেন। ফুলপুরে একইভাবে তিনি নগেন্দ্র প্যাটেলকে প্রার্থী করেন স্থানীয় প্যাটেল সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করতে। এভাবে অখিলেশ বিভিন্ন দলের সান্নিধ্যে অসাধ্য সাধন করে দেখান এই দুটি কেন্দ্রে।
আর তৃতীয় যে বড় কারণে সপা এবারে বাজিমাত করে তা হলো, কংগ্রেসের সঙ্গে সমদূরত্ব রাখা। গত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে অখিলেশ যাদবের দল মুখ থুবড়ে পড়েছিল। আর তাই এবারে শুরু থেকেই রাহুল গান্ধীর দলের ছায়াও মাড়াননি সপা নেতৃত্ব। গতবার এই জোট নিয়ে সপার নিম্নস্তরের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল যথেষ্ঠ। এমনকি দলের প্রাক্তন নেতা এবং রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিংহ যাদবও এই জোটের যথেষ্ঠ বিরোধিতা করেন। অথচ এই মুলায়মই এবারে তার একসময়কার ঘোর শত্রু মায়াবতীর সঙ্গে পুত্রের সমঝোতা নিয়ে কোনো আপত্তিই তোলেননি।
এই মাস্টারস্ট্রোকগুলোর পাশাপাশি বিজেপির অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসও ছিল তাদের হারের অন্যতম বড় কারণ, যা স্বয়ং আদিত্যনাথও স্বীকার করে নিয়েছেন। সপা-বসপা-র সমঝোতা বুঝতেও তার দল ব্যর্থ হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বিরোধীরা উজ্জীবিত হবে; কিন্তু ওই পর্যন্তই
এই জয়ের ফলে ভারতের মোদী-বিরোধী শিবির যে উজ্জীবিত হবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একের পর এক নির্বাচনী বিপর্যয়ের পরে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে ফের আরেকবার হারের ধাক্কার আশঙ্কায় ত্রস্ত বিরোধীরা উত্তরপ্রদেশের পাশাপাশি প্রতিবেশী রাজ্য বিহারে অনুষ্ঠিত হওয়া তিনটি উপনির্বাচনের মধ্যে দুটিতে বিজেপির হারেও কিছুটা হলেও আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। কিন্তু এই উপনির্বাচনের ফল কি সত্যি বিজেপিকে বিব্রত করার মতো যথেষ্ঠ?
উপনির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের অনেক তফাৎ। জাতীয় নির্বাচনের এজেন্ডা, কৌশল, দলগত সমীকরণ, নেতৃত্ব ইত্যাদি সবই আলাদা। জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি লড়বে মোদীকে সামনে রেখে। ক্ষমতায় চার বছর প্রায় কাটিয়ে দেওয়ার পরেও যে মোদীর কোনো বিকল্প ভারতীয় রাজনীতি খুঁজে পায়নি।
২০১২ সালের উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টি একক গরিষ্ঠতা পেলেও দু’বছরের মধ্যে তারা লোকসভা নির্বাচনে এই একই রাজ্যে ধুয়ে-মুছে যায়। অমিত শাহের তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বুদ্ধির সামনে দাঁড়াতে পারেনি সপা-কংগ্রেস-বসপা কেউই। সেই একই চিত্র দেখা যায় ২০১৭ সালেও। এই বৃহৎ পতনের পরে দুটি উপনির্বাচন জেতার ব্যাপারটি বিরোধীদের কাছে বিশাল হতে পারে, বিশেষ করে কেন্দ্রগুলির একটি যেখানে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের। কিন্তু সার্বিকভাবে দেখলে এই জয়ের ফলে ২০১৯-এ বিজেপি বিপাকে পড়বে, তা বলা চলে না কখনই। আদিত্যনাথ এবং বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে এ এক নৈতিক পরাজয় বড়জোর।
আঞ্চলিক নেতাদের পক্ষে জাতীয় আবেদন গড়ে তোলা সহজ নয়
এই উপনির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কংগ্রেসের ব্যর্থতা এবং তাদের প্রার্থীদের জামানত জব্দ হওয়া। বিজেপিকে জাতীয় স্তরে ঠেকাতে যে সর্বভারতীয় দলীয় আবেদন এবং নেতৃত্ব প্রয়োজন, তা একমাত্র কংগ্রেসই দিতে পারত। কিন্তু তাদের এমন শনির দশা চলছে এখন যে, সেই ভূমিকা পালন করা রাহুল গান্ধীর দলের পক্ষে কার্যত অসম্ভব; এমনকি তাদের প্রাক্তন দলনেত্রী সোনিয়া গান্ধীর বিরোধী দলগুলোকে কাছে টানতে অপরাহ্নভোজনের আয়োজন করার পরেও। সেক্ষেত্রে বাকি রইল আঞ্চলিক দলগুলো, কিন্তু এদের সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতা কোথায়?
অখিলেশ, মায়াবতী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- এরা কেউই নিজেদের রাজ্যের গণ্ডির বাইরে প্রভাবশালী নন। নীতীশকুমার তো ইতিমধ্যে ফিরে গেছেন বিজেপির কাছে আর লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল বিহারে নির্বাচন জিতলেও দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তার গুরুত্ব নেই বিশেষ। জয়ললিতা আর নেই, বামপন্থীদেরও আজকাল অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হয়। দুই দক্ষিণী মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও এবং চন্দ্রবাবু নাইডু তৃতীয় ফ্রন্টের উপর আলোকপাত করলেও তাদের ভৌগোলিক আবেদনও সীমিত। আর ওডিশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক নিজের রাজ্যের বাইরের বিষয় নিয়ে খুব একটা ভাবিত নন।
এই প্রেক্ষাপটে উত্তর প্রদেশ এবং বিহার বা তারও আগে রাজস্থানের উপনির্বাচনে বিজেপির বিরুদ্ধে জয়ের হাওয়াকে কাজে লাগানোর মতো শক্তি কোথায়? এই জয়গুলো বড়জোর বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলিকে এক মঞ্চে নিয়ে আসতে পারে, কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদীকে সংখ্যায় সরাসরি হারিয়ে দেওয়ার মতো রসদ এদের থাকবে, এমন দাবি বিজেপির অতি বড় সমালোচকও বোধহয় করার সাহস পাবেন না।
ফিচার ইমেজ: DNA India