সমালোচনা ও অভিযোগ যেন পিছু ছাড়ছে না মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের। কয়েক মাস আগেও মহাক্ষমতাধর এক ব্যক্তি ছিলেন তিনি, কয়েকশ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। তবে গত ৯ মে নির্বাচনের ফলাফলে যখন তার দল একটার পর একটা আসন হারাচ্ছিল তখন তিনি বুঝতে পারেন দেশটির স্বাধীনতার পর ছয় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা দল বারিসান ন্যাসিনাল এবার ক্ষমতাচ্যুত হতে যাচ্ছে এবং সেই সাথে তিনিও।
অবশেষে অবিশ্বাস্যভাবে তাকে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন তারই দলের একসময়ের নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদ। অনেক বছর পরে আবারও সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে ফিরে এসে বিরোধীদলে যোগদান করেন তিনি। নাজিব রাজ্জাককে চ্যালেঞ্জ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পেছনে মাহাথিরের প্রধান কারণ ছিলো নাজিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ব্যাপক অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ। তাই ক্ষমতায় আসার পরেই সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আসা অভিযোগগুলো অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছেন তিনি।
তবে আসলেই কি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি? চলুন জেনে নেওয়া যাক নাজিব রাজ্জাক ও তার বিরুদ্ধে আসা দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে।
ক্ষমতার অপব্যবহার
রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট প্রভাবশালী পরিবারে জন্ম নাজিব রাজ্জাকের। তার বাবা আবদুল রাজ্জাক ছিলেন মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। মালয়েশিয়ার তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হুসেন অনও তার আত্মীয়।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব নটিংহাম থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ১৯৭৪ সালে দেশে ফেরেন এবং রাষ্ট্রীয় তিলফার্ম পেট্রোনাসে যোগদান করেন। শক্তি, টেলি যোগাযোগ, শিক্ষা, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে বেশ কয়েকবার মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করেন নাজিব।
২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হলে অপেক্ষাকৃত উদারনৈতিক রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিলেও তা অনুসরণ করেননি। জনসমাবেশের কড়া আইন সংস্কার ও বিতর্কিত ইন্টার্নাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১১ রদ করলেও তিনি বিনা বিচারে আটকের ব্যাপারটি পুনরায় প্রচলন করেন। পরের বছর দেশদ্রোহী আইন রদ করার কথা থাকলেও সেটি আরও জোরালো করেন তিনি। সমালোচকদের মতে, আইনগুলো তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নিশ্চুপ করে দেওয়ার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
২০১৫ সালে বিরোধীদলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহীমকে সমকামিতার দায়ে দ্বিতীয়বারের মতো দোষী সাব্যস্ত করে কারাগারে পাঠানো হয়। সমালোকদের মতে, এটি রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।
২০১৬ সালে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তৈরি আইন নির্বাচনী সংস্কারপন্থীদের আটক করার কাজে ব্যবহার করা হয়। এই বছর এপ্রিলে তার সরকার ভুয়া সংবাদ ছড়ানোর বিরুদ্ধে একটি আইন তৈরি করে।
বিতর্কিত বিষয় ও চ্যালেঞ্জসমূহ
কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে নাজিব রাজ্জাক বেশ সমালোচিত হন। কর্মজীবনে তিনি যেসব চ্যালেঞ্জ ও বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছেন তার মধ্যে ২০০২ সালে দুটি ফ্রেঞ্চ সাবমেরিন ক্রয়ের পেছনে দুর্নীতির অভিযোগ, ২০০৬ সালে একজন মঙ্গোলীয় হত্যা, ২০১৪ সালের মার্চে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এমএইচ৩৭০ হারিয়ে যাওয়া ও একই বছর জুলাইয়ে ইউক্রেনে এমএইচ১৭ গুলি করে বিধ্বস্ত হওয়া অন্যতম।
এছাড়াও ২০১৫ সালে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার উপর ৬% করারোপ করার নীতিও দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।
তবে সবচেয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত বিষয়টি হচ্ছে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় ফান্ড ১ মালয়েশিয়ান ডেভেলপমেন্ট বারহ্যাড নিয়ে। এর কারণে কুয়ালালামপুরে গণবিক্ষোভে তাকে পদত্যাগের দাবি জানানো হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদও তা সমর্থন করেন। কিন্তু নাজিব ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানান।
এ ঘটনা পরিচালনার ব্যাপারে তার সমালোচনা করায় ২০১৫ সালে তার ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী বদল করেন এবং এই মামলার অনুসন্ধানকারী অ্যাটর্নি জেনারেলকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা দেখিয়ে অপসারণ করেন।
২০১৬ সালে নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল তাকে নির্দোষ সাব্যস্ত করেন। তিনি জানান, সৌদি রাজ পরিবার থেকে ব্যক্তিগত অনুদান হিসেবে অর্থগুলো এসেছে এবং নাজিব রাজ্জাক সেই অর্থের ৬২ কোটি মার্কিন ডলার ফেরত দিয়েছেন।
২০১৭ সালের মার্চ মাসে পার্লামেন্টকে দেওয়া এক চিঠিতে তিনি জানান, ১এমডিবি ফান্ড ঋণমুক্ত। তবে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশ এখনও এই ফান্ডের অর্থ লেনদেনের ব্যাপারটি অনুসন্ধান করে দেখছে।
১এমডিবি কী?
১এমডিবি মালয়েশিয়ার একটি রাষ্ট্রীয় ফান্ড। নাজিব রাজ্জাক ২০০৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। কথা ছিলো এটি কুয়ালালামপুরকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করবে এবং কৌশলগত বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলবে।
তবে ২০১৫ সালে কিছু ব্যাংক ও বন্ডধারকদের তাদের পাওনা ব্যাপক পরিমাণে অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় এটি আলোচনায় আসে। এরপর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে নাজিব রাজ্জাকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ফান্ডটি থেকে প্রায় ৭০ কোটি মার্কিন ডলার স্থানান্তরের খবর প্রকাশিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের পক্ষ থেকে এই ফান্ডের প্রায় ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়। তবে ফান্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা কখনোই সেখান থেকে কোনো অর্থ দেশটির প্রধানমন্ত্রীকে দেননি এবং এই অভিযোগ প্রমাণিত নয়। নাজিব রাজ্জাকও বারবার এই ফান্ড থেকে অর্থ গ্রহণের ব্যাপারটি অস্বীকার করেছেন।
নাজিবের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান
মালয়েশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ নাজিব রাজ্জাকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনার অনুসন্ধান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় এসে তিনি সেই কাজ জোরালোভাবেই শুরু করেছেন।
গত ১৬ মে রাতে নাজিব রাজ্জাকের কুলারামপুরের দুটি পারিবারিক ভবনসহ তার সাথে সম্পর্কিত ছয়টি স্থানে তল্লাশী চালানো হয়। সেখান থেকে ৭২টি ব্যাগ ভর্তি গহনা, কয়েকটি দেশের মুদ্রা, ৩০০টি বাক্সভর্তি ডিজাইনার হ্যান্ডব্যাগ ও বেশ কিছু বিলাসবহুল সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ।
বর্তমানে নাজিব রাজ্জাক ও তার স্ত্রী রোজমাহ মনসুরের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাকে এ ফান্ড থেকে তার অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তরের ব্যাপারে তলব করা হলে ২২ মে, মঙ্গলবার তিনি কারণ দর্শাতে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজির হন।
আসলেই কি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন তিনি?
অর্থ আত্মসাতের ব্যাপক অভিযোগ একেবারে হেলা করার মতো নয়, বিশেষত তার বাসা থেকে ব্যাপক পরিমাণে বিলাসবহুল সামগ্রী উদ্ধার হবার পরে সন্দেহ আরও জোরদার হয়েছে।
১৫ মে রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, নাজিবের বিরুদ্ধে ১এমডিবি ফান্ডের অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে সেই ২০১৫ সালেই। মালয়েশিয়ান অ্যান্টি-করাপশন কমিশন ২০১৫ সালের শেষের দিকে ১এমডিবি ফান্ড থেকে নাজিব রাজ্জাকের একটি অ্যাকাউন্টে ৪২ কোটি (১০ কোটি ৬০ লক্ষ মার্কিন ডলার) রিঙ্গিত স্থানান্তরের প্রমাণ পেয়েছে।
এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধানের সুপারিশ করলে তা নাকচ করে দেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল আপান্দি আলি। রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্যানেল সদস্য লিম চি উই জানান অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অ্যাটর্নি জেনারেল আপান্দি আলি অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে রাজি হননি। লিম চি উই ১এমডিবি সংক্রান্ত অনুসন্ধানের ৮ সদস্যের প্যানেলের একজন সদস্য।
এ ব্যাপারে রয়টার্সের পক্ষ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল আপান্দি আলির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে নাজিব রাজ্জাক বা তার মুখপাত্রের সাথেও যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয় রয়টার্স।
নাজিব রাজ্জাকের বাসা থেকে এতসব বিলাসবহুল সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করা, তার ও তার স্ত্রীর বিলাসবহুল জীবনযাপন, প্যানেল সদস্যের বক্তব্যের জের ধরে বলা যায়, নাজিব রাজ্জাক দোষী সব্যস্ত হয়ে বিচারের মুখোমুখী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
Featured Image Source: Mohd Rasfan / AFP