মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বরাবরই অশান্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরব বসন্ত এবং মোহাম্মদ বিন সালমানের উত্থানের ফলে এ পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। তবে আগামী ১২ থেকে ১৪ মের মধ্যে পরপর ইরান, ইরাক ও ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে এমন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের আগামী দিনগুলোর ভবিষ্যত। এ ঘটনাগুলো কি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য শান্তি বয়ে আনবে, নাকি এ অঞ্চলের পরিস্থিতিকে আরো উত্তাল করে তুলবে, তা নিয়েই আমাদের আজকের বিশ্লেষণ।
১২ মে: ইরান পারমাণবিক চুক্তি
আগামী ১২ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত ইরান পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করতে যাচ্ছেন এবং এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য সংকটকে নতুন করে উস্কে দিতে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য এখনও পরিস্কারভাবে জানাননি তিনি চুক্তিটি আসলেই বাতিল করবেন কিনা। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্লেষকের ধারণা, ট্রাম্প চুক্তিটি আসলেই বাতিল করবেন। গত মাসে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাঁক্রো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এই চুক্তি বাতিলের পরিকল্পনা থেকে ফিরিয়ে এনে তার পরিবর্তে চুক্তিটি সংশোধন করার ব্যপারে রাজি করাতে। কিন্তু ফ্রান্সে ফেরত যাওয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের সামনে মন্তব্য করেছিলেন, তার ধারণা ট্রাম্প চুক্তিটি বাতিলই করতে যাচ্ছেন।
ইরান পারমাণবিক চুক্তি, যার প্রকৃত নাম সম্মিলিত সর্বাঙ্গীন কর্ম পরিকল্পনা (Joint Comprehensive Plan of Action, JCPOA), তা স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৫ সালের ১৪ই জুলাই, মোট ৭টি দেশের মধ্যে। এই চুক্তির অধীনে ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি ব্যাপকভাবে হ্রাস করে, বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ ইরানের উপর থেকে বিভিন্ন অবরোধ তুলে নেয়। যদিও আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) বারবার সত্যায়িত করেছে যে, ইরান চুক্তির সবগুলো শর্ত মেনে চলছে, তারপরও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চুক্তিটি বাতিল করবেন বলে হুমকি দিয়ে আসছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনানুযায়ী, অবরোধ প্রত্যাহারের নির্দেশ প্রেসিডেন্টকে প্রতি চার মাস পরপর নিশ্চিত করতে হয়। সে হিসেবে আগামী ১২ই মে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সামনে এই নির্দেশ পুনরায় উপস্থাপন করার কথা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবার ট্রাম্প সত্যি সত্যিই ইরানের উপর অবরোধ পুনর্বহাল করবেন, যার ফলে ইরান পারমাণবিক চুক্তিটি মোটামুটি অকার্যকর হয়ে পড়বে।
ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের ফলাফল মধ্যপ্রাচ্যকে দীর্ঘমেয়াদে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। চুক্তি বাতিল করা হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার হুমকি দিয়েছে ইরান। এছাড়াও নতুন করে সৃষ্ট এ উত্তেজনা ইতোমধ্যেই সিরিয়াতে শুরু হওয়া ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বকেও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে।
সিরিয়াতে ইরানের শক্তিশালী হয়ে ওঠাকে ইসরায়েল তো বটেই, সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রও নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। ইসরায়েল ইতোমধ্যেই সিরিয়াতে অবস্থিত ইরানী সামরিক ঘাঁটিগুলোর উপর বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে উত্তর কোরিয়ার সাথে শান্তি স্থাপন করছে এবং সৌদি আরবকে কাতারের সাথে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার ব্যাপারে চাপ দিচ্ছে, এ থেকেও ধারণা করা যেতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র অন্য সবার সাথে শত্রুতা মিটিয়ে শুধুমাত্র ইরানের উপর আক্রমণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। আগামী ১২ তারিখে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত থেকে তাই অনেকটাই পরিষ্কার হবে, ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাচ্ছে।
১২ মে: ইরাকের সংসদীয় নির্বাচন
আগামী ১২ মে সংগঠিত হতে যাচ্ছে ইরাকের সংসদীয় নির্বাচন। জঙ্গি সংগঠন আইএসের (ইসলামিক স্টেট, আইসিস, আইসিল, দায়েশ নামেও পরিচিত) দখল থেকে ইরাককে মুক্ত করার পর এটিই হতে যাচ্ছে প্রথম জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন। সঙ্গত কারণেই নির্বাচনটি ইরাক এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দিনগুলোতে ইরাক আইএসের দখলে থাকা অবশিষ্ট এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের নিরসন ঘটিয়ে একটি কার্যকর ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা, তা অনেকটাই নির্ভর করবে এই নির্বাচনে যে দল জয়লাভ করবে, তাদের নীতিমালা এবং গৃহীত পদক্ষেপগুলোর উপর।
ইরাকের সংসদীয় নির্বাচনের পরপরই সাংসদদের ভোটে নির্বাচিত হবেন প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি। মোট পাঁচটি জোটের প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য লড়াই করছেন। সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুযায়ী এদের মধ্যে ১৫% ভোটে অন্যদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে আছেন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল-আবাদি, যিনি ‘নাস্র আল-ইরাক’ তথা ‘ভিক্টরি অফ ইরাক’ জোটের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এই নামটি বাছাই করা হয়েছে আইএসের বিরুদ্ধে তাদের জয়লাভের স্মরণে। অন্যদিকে ৫% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকি। তবে জরিপ অনুযায়ী, দেশটির ৬০ শতাংশ ভোটারই এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, তারা কাকে ভোট দিবেন।
ইরাকের রাজনীতির অন্যতম প্রধান সংকট শিয়া-সুন্নী সাম্প্রদায়িক বিভাজন। সাদ্দাম হোসেনের সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও শিয়ারা ছিল উপেক্ষিত। অন্যদিকে সাদ্দামের পতনের পর সুন্নীরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়। সাদ্দামের বাথ পার্টির সদস্যদের উপর গৃহীত প্রতিশোধের ফলে তাদের অনেকে পরবর্তীতে চরমপন্থী ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সাথে যোগ দেয় এবং আল-কায়েদাকে শক্তিশালী করে তোলে, যা থেকে পরবর্তীতে একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে আইএস হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকির সময় ইরাকের সুন্নীরা ছিল চরমভাবে উপেক্ষিত এবং নিগৃহীত। মালিকি প্রশাসনের চরম সাম্প্রদায়িক ভূমিকায় সুন্নী সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার জনগণ এতই বিক্ষুদ্ধ ছিল যে, আল-কায়েদাসহ চরমপন্থী সংগঠনগুলো যখন একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছিল, তখন অনেকেই তাদেরকে বাধা দেয়নি। আইএসের উত্থানের পেছনের অনেকগুলো কারণের একটি হিসেবে অনেকে তাই মালিকি প্রশাসনের সাম্প্রদায়িকতা এবং অযোগ্যতাকে দায়ী করে থাকে।
জরিপে প্রাথমিকভাবে হায়দার আল-আবাদি এগিয়ে থাকলেও শেষপর্যন্ত হয়তো বৃহত্তর জোটের সমর্থন পেয়ে নুরি আল-মালিকি অথবা তৃতীয় স্থানে থাকা হাদি আল-আমেরি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতে পারেন। হাদি আল-আমেরি হচ্ছেন পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটস (পিএমইউ) জোটের প্রতিনিধি, যা মূলত শিয়া মিলিশিয়াগুলোর একটি জোট। আইএস বিরোধী যুদ্ধের সময়ই এরা বেশি পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু মালিকির মতোই এদেরকেও সাম্প্রদায়িক চরিত্রের হিসেবে দেখা হয় এবং মালিকির মতোই এরাও ইরান সমর্থিত। এদের অনেকগুলো মিলিশিয়া সরাসরি ইরানের সাহায্যপ্রাপ্ত।
অন্যদিকে হায়দার আল-আবাদি শিয়া হলেও তাকে তুলনামূলকভাবে মধ্যপন্থী হিসেবে দেখা হয়। ইরানের বেশ কয়েকটি সুন্নী সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার নেতারা আবাদির প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে। মালিকি এককভাবে ইরানের প্রতি অনুগত হলেও আবাদি একইসাথে ইরান, সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। ১২ মের নির্বাচনে যদি আবাদি বিজয়ী হন, তাহলে হয়তো ইরাকের শিয়া-সুন্নী সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব হ্রাস পেতে পারে, যদিও কুর্দি সমস্যাটা রয়েই যাবে। কিন্তু যদি মালিকি অথবা আমেরি নির্বাচিত হন এবং পূর্বের মালিকির সরকারের মতো সাম্প্রদায়িক নীতিতে অটল থাকেন, তাহলে ইরাক হয়তো আবারও নতুন করে অশান্ত হয়ে উঠতে পারে।
১৪ মে: ট্রাম্পের জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর
আগামী ১৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলে তাদের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করবে। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেরুজালেমের উপর ইসরায়েলের কোনো একক অধিকার না থাকা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে অবৈধভাবে দখলকৃত জেরুজালেমকেই ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের দূতাবাস সেখানে স্থানান্তর করতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন কিনা, তা এখনও জানা না গেলেও ট্রাম্পের কন্যা ইভাঙ্কা ট্রাম্প এবং জামাতা জ্যারেড কুশনার সেখানে উপস্থিত থাকবেন।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল পরিস্থিতি সব সময়ই সংকটময় থাকে, কিন্তু গত ৩০ মার্চ থেকে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নিরাপত্তা বেষ্টনির কাছাকাছি হাজার হাজার ফিলিস্তিনি তাদের দখলকৃত বসতভিটায় ফিরে যাওয়ার দাবিতে আন্দোলন এবং অবস্থান কর্মসূচী পালন করে আসছে। ‘গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন‘ নামের শান্তিপূর্ণ ঐ কর্মসূচীতে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে এখন পর্যন্ত ৪৩ জন নিহত এবং অন্তত ৭,০০০ জন আহত হয়েছে।
গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন আন্দোলন শেষ হওয়ার কথা আছে আগামী ১৫ মে, যে দিনটি ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ তথা বিপর্যয় দিবস হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৮ সালের এই দিনে, ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পরপরই ৭৫,০০০ হাজার ফিলিস্তিনিকে তাদের বসতভিটা থেকে অবৈধভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এ বছর দিবসটির ৭০তম বার্ষিকী পালিত হবে।
কিন্তু তার মাত্র একদিন আগেই ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্য জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের ঘটনা হয়তো ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভকে আরো উসকে দিতে পারে। গাজা সীমান্তে অবস্থান করা আন্দোলনকারীরা হয়তো বিক্ষোভে ফেটে পড়তে পারে, যার ফলে তাদের উপর ইসরায়েলি সেনাদের আক্রমণ বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে। আর এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের জন্য চাপা পড়ে যেতে পারে ফিলিস্তিন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রক্রিয়া।
Featured Image Source: Felipe Dana/ AP