গণতন্ত্র আমাদের সবারই প্রিয়। আজ পর্যন্ত মানব ইতিহাসে যে ক’টি রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্মেষ ঘটেছে, তার মধ্যে গণতন্ত্রই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কারণ, গণতন্ত্র মানুষের স্বাধীনতাকে সম্মান দেয়; নিজের মতো করে তাকে বাঁচার সুযোগ করে দেয়; মানবাধিকারকে কদর করে।
গণতন্ত্রের শরীর ভালো নেই, বলছে সমীক্ষা
কিন্তু সাম্প্রতিককালে, এই গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছে অনেক গবেষণাই। ২০১৭ এবং ২০১৮ সালের গোড়াতে প্রকাশিত দুটি রিপোর্টে বলা হয়েছে দুনিয়াজুড়ে গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণের কথা। গত বছর দ্য ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স এর ‘অ্যানুয়াল ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্স’-এ বলা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে গণতন্ত্রের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো নয়। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নম্বর ৮.০৫ থেকে ৭.৯৮ এ নেমে গিয়েছে। যদিও সেটি বিরাট পতন নয়, কিন্তু যেহেতু দেশটির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাকে বলা হয় গণতন্ত্রের অন্যতম পীঠস্থান, সেখানে এহেন অবনতিকে বেশ উদ্বেগের চোখেই দেখছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
এরকমই এই বছর জানুয়ারিতে প্রকাশিত হওয়া ফ্রিডম হাউস-এর একটি সমীক্ষা বলছে, সারা পৃথিবীতে মাত্র ৮৮টি দেশে প্রকৃত অর্থে উদার পরিবেশ রয়েছে। ৫৮টি দেশ ‘আংশিকভাবে উদার’ এবং ৪৯টি ‘অনুদার’। এই সমীক্ষা দেখার পর নড়েচড়ে বসেছে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম এবং সামাজিক স্বাধীনতার উপরে নজরদারি রাখা সংস্থাগুলো। গণতন্ত্রের কি তাহলে সময় ফুরোলো?
এই প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেওয়া অসম্ভব। কারণ, এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কিন্তু একথা অস্বীকার করার বিশেষ উপায় নেই যে, নানাবিধ কারণেই আজ গণতন্ত্র তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে এবং এই সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে অগণতান্ত্রিক শক্তিরা। বিশ্ব রাজনীতিতে আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে যত গুটিয়ে নিচ্ছে, তত রাশিয়া এবং চীনের মতো অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো সেই জায়গাটি হাতিয়ে নেওয়ার মতলব করছে। ভয়ের কথা হচ্ছে, গণতন্ত্র ভুল পথে চলতে শুরু করলে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসার উপায় রয়েছে, কিন্তু অগণতান্ত্রিক শক্তিদের সংস্কার করার পথ বিশেষ নেই। আর তাই গণতন্ত্রের এই অবক্ষয় আশঙ্কিত হওয়ার মতোই ঘটনা।
জনপ্রতিনিধিদের উপর থেকে ভরসা কমছে
কিন্তু কেন গণতন্ত্রের এমনতর অবক্ষয় ঘটছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অনেকেই যেমন বলে থাকেন যে, বর্তমান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প আসার পরেই সেখানকার গণতন্ত্রের রাস্তা বন্ধুর হয়েছে। কথাটি ঠিক নয়। ট্রাম্প সমস্যার কারণ নন; বরং তিনি সমস্যার পরিণতি। আর সেটা ইকোনমিস্ট এর ইনডেক্স রিপোর্টটিও বলেছে। সেটির মতে, গণতন্ত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষয় হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে সরকার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর থেকে বিশ্বাস ক্রমেই দুর্বল হওয়া।
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র ভালো, মনে করছেন এক বৃহৎ শতাংশ মানুষ
মার্কিন মুলুকের এক শ্রেণীর ভোটারদের ওবামা প্রশাসনের উপর অসন্তুষ্টির ফলাফলেই ট্রাম্পের উদয় ঘটে এবং তার ক্ষমতায় আসার পরেও যে এই রোগের নিরাময় ঘটেছে তা কিন্তু নয়। অর্থাৎ, পরোক্ষ গণতন্ত্রের উপর থেকে ক্রমশই মানুষের ভরসা উঠে যাচ্ছে এবং তারা অনেক ক্ষেত্রেই চাইছে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র। ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এর ইনডেক্স যেমন বলেছে যে, গণতন্ত্র হিসাবে গ্রেট ব্রিটেনের নম্বর বেড়েছে, যার কারণ হলো ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট, যাতে বাহাত্তর শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। গত বছর অক্টোবরে পিউ রিসার্চ সেন্টার এর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৩৮টি দেশের অন্তত ৬৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন, প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র, যেখানে প্রতিনিধিদের বদলে সাধারণ নাগরিকরাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরাসরি সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটিই ভালো।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে সাধারণ নাগরিক কতটা তৈরি? দু’বছর আগে ব্রেক্সিট গণভোটের পরেও দেখা গেছে ব্রিটেনের অনেক সাধারণ মানুষকেই ‘হায় হায়’ করতে। কারণ, তাদের অনেকেই নাকি বোঝেননি ব্রেক্সিটের মতো এক অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রভাব তাদের দেশ এবং জীবনের উপর কীভাবে নেমে আসতে পারে। শুধুমাত্র অরাজনৈতিক আবেগ দিয়ে কি কঠিন রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব?
ব্রেক্সিটের ক্ষেত্রে দেখা গেছে গণভোটের পর সেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ভারতেও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে অরাজনৈতিকের রাজনৈতিক অভিযান এবং সাধারণ মানুষই নিজের ভালোটা বুঝে নেবেন বলে ক্রমাগত দাবি করতে থাকার ঘটনাটি। আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল এর এই সাধারণ মানুষমুখী রাজনীতিতে ভোটাররা সাময়িকভাবে গলে গেলেও তা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কখনোই হয়নি। যে মুহূর্তে মানুষের ভ্রম ভেঙেছে, তারা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। আবেগমথিত প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র তাহলে সমস্যার সমাধানে কতটা ফলপ্রসূ?
সমস্যা হচ্ছে, আজ পরোক্ষ গণতন্ত্র আদতে হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোটে জেতার লড়াই। অর্ধেকের বেশি আসন পেলেই গণতন্ত্র চরিতার্থ হয়ে গেল বলে ধরে নেওয়া হয়, আর এই ভুল চিন্তা থেকেই তৈরি হয় এক ভয়ঙ্কর সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের মনন, যা শেষাবধি গিলে খায় গণতন্ত্রকেই। আজ ভারতসহ বিশ্বের নানা বড় গণতান্ত্রিক দেশেই এই প্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর এতে শেষপর্যন্ত ক্ষতি হচ্ছে গণতন্ত্রের মতো জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাটিরই।
গণতন্ত্রের এই পদস্খলনের পিছনে রয়েছে আরও একটি বড় কারণ। সেটি হলো গণমাধ্যমের ভূমিকা। আজকের দিনে একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে গণমাধ্যমের ভূমিকা যে অপরিহার্য, তা অস্বীকার করা যায় না। আর এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি পালন করতে গিয়েও যদি গণমাধ্যমের কাজের ধরন বাজার অর্থনীতির দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয় তা হলে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের দিকটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় (মিডিয়া মালাইজ তত্ত্ব অনুযায়ী)।
এর বিপক্ষের তাত্ত্বিকরা যদিও মনে করেন এটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়, কিন্তু আজকের দিনে গণমাধ্যম যে ব্যবসায়িক দিকটিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে তা উপেক্ষা করা চলে না। আর সেটি করতে গিয়ে তারা একধরনের চাটুকারিতার আশ্রয়ও নিয়ে ফেলছে। কারণ, ব্যবসায়িক মুনাফা যতটা আসে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে থাকলে, ততটা আসে না তার বিরুদ্ধাচরণ করলে। অতএব, গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরীই যদি তার দায়িত্বের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলে তাহলে গণতন্ত্রের খুঁটি মজবুত থাকবে কীভাবে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, একদিকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র চালানোর মতো যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রয়োজন, সাধারণ মানুষের মধ্যে তার অভাব; অন্যদিকে, যে গণমাধ্যমের উচিত গণতন্ত্রের নাগরিককে সত্য পথের সন্ধান দেওয়া, তারাও সেটি ঠিকঠাক করে উঠতে পারছে না। এর সম্মিলিত পরিণাম হচ্ছে গণতন্ত্রের অবক্ষয় এবং তার ক্ষয়িষ্ণু প্রাচীরে গজিয়ে ওঠা পপুলিজম (জনপ্রিয়তাবাদ) বা একধরনের হিতৈষী একনায়কতন্ত্রের আগাছা। আর এই প্রবণতাগুলোই দীর্ঘ সময়ের পর গণতন্ত্রের ভিতটাকেই নড়বড়ে করে দিতে শুরু করে।
গণতন্ত্রের রীতিনীতি বোঝার মতো কি যথেষ্ঠ তৈরি আমরা?
বিপদ হচ্ছে, গণতন্ত্রের নাগরিকরা এই অশনি সংকেত আগে থেকে ধরতে পারেন না। যেহেতু আমরা সবাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা মেটাতে ব্যস্ত, আমাদের কাছে গণতন্ত্রের রীতিরক্ষার থেকে সেই সমস্ত সমস্যার আশু সমাধানটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটা খুব ভালোরকম বোঝে আমাদেরই আঙুলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। তারা জানে যে সত্যিকারের জটিল সমস্যা মেটানো সহজ নয়, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো সিদ্ধান্ত সর্বগ্রহণযোগ্য হয় না। তাই ভোট হারানোর ভয়ে তারা শুরু করে তোষণের রাজনীতি, যাতে অল্পবিস্তর সবাইকেই খুশি রেখে পরের নির্বাচনী বৈতরণী পেরিয়ে যাওয়া যায়। এই নির্বাচনসর্বস্বতা ক্রমেই দুর্বল করে গণতন্ত্রের কণ্ঠকে। কিন্তু হাতের কাছে ‘কল্পতরু’ পেয়ে মধ্যমেধার জনগণ ভাবে, ‘এই বেশ ভালো আছি’। কিন্তু একটা সময়ের পরে এই ধূর্ততা প্রকট হয়েই পড়ে প্রকাশ্যে।
সারা দুনিয়া জুড়ে এই সস্তা জনপ্রিয়তাবাদ গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত যেমন করছে একদিকে, অন্যদিকে অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও উজ্জীবিত করছে। চীনের শি জিনপিং বা রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন সমসাময়িক বিশ্বে এমন দুই নেতা, যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী না হয়েও যথেষ্ঠ কদরপ্রাপ্ত। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তায়িপ এর্দোয়ানও সেরকম আরেকজন রাষ্ট্রনেতা।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যত নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে, তত জিনপিং ও পুতিনরা নিজেদের আরও মেলে ধরছেন এবং বিশ্বের দরবারে নিজেদের আরও বড় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছেন। এবং শুধু করছেনই নয়, তাদের নিজ নিজ দেশের মানুষের সমর্থনও তাদের পিছনে রয়েছে। কারণ, পৃথিবীর অনেক মানুষই মনে করেন, গণতন্ত্রের ভুলভুলাইয়া আদতে মানুষকে ধোঁকা দেয়, হতাশ করে। তার চেয়ে একনায়কতন্ত্র হলেও দৃঢ় নেতৃত্বই ভালো।
গণতন্ত্রের উদার দিকটিই আজ তার সবচেয়ে বড় শত্রু। কারণ, এই উদারবাদের জন্যেই গণতন্ত্র আজ ডামাডোলের শিকার এবং নির্বাচিত নেতাদের অপদার্থতায় সাধারণ মানুষ চূড়ান্ত বিরক্ত। সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, প্রতি পদক্ষেপে প্রতিক্রিয়া, অর্থহীন এবং অন্তহীন বিতর্ক ইত্যাদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আজ এক মধ্যমেধার ব্যবস্থায় পরিণত করেছে। বিশ্বের দরবারে নিজের হারানো সম্মান ফিরে পেতে গণতন্ত্রের আজ প্রয়োজন এক শক্তিশালী, সৎ এবং উৎকৃষ্ট নেতৃত্ব। যতক্ষণ না সেটা হচ্ছে, গণতন্ত্রের পদস্খলন চলতেই থাকবে আর গণতন্ত্র গিলে খাবে নিজের অস্তিত্বকেই।
ফিচার ইমেজ: LYNE LUCIEN/THE DAILY BEAST