মালয়েশিয়ার সাধারণ নির্বাচনে অসাধারণ জয়ের মাধ্যমে ৯২ বছর বয়সে আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেছেন মাহাথির মোহাম্মদ। যদিও অধিকাংশই ধরে নিয়েছিলেন সদ্য ক্ষমতা হারানো নাজিব রাজ্জাকই পুনরায় প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক অবিশ্বাস্য এক ফলাফল নিয়ে ১৫ বছর পরে আবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসলেন মাহাথির। মালয়েশিয়ার ইতিহাসের গত ৬০ বছরের মাঝে এই প্রথম কোনো বিরোধীদল নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভের পরে এই প্রথম দেশটিতে সরকারি দল ব্যতীত কোনো বিরোধী দল নির্বাচনে জয় লাভ করেছে। তবে এর পেছনের কৃতিত্ব অনেকটাই বিরোধী দলীয় নেতা মাহাথির মোহাম্মদের। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত বছর পরে তার আবারও ক্ষমতায় আসার কারণ কী? কেনই বা মালয়েশিয়ার জনগণ তাকে আবার ৯২ বছর বয়সে নির্বাচিত করল?
People cluster round to watch Mahathir Mohamad sworn in as Malaysia’s 7th PM (he was its 4th too). Cheers when he’s finished – they really are delighted to have him back. But what does his disparate coalition government do next? Is he the man the cleanse the Augean stables? pic.twitter.com/8vRhujep8J
— Jonathan Head (@pakhead) May 10, 2018
মাহাথির মোহাম্মদ: আধুনিক মালয়েশিয়ার রুপকার
মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার সবচেয়ে শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিবিদদের একজন। এর আগে ক্ষমতায় থাকাকালীন তার নেওয়া বিভিন্ন নীতির ফলে দেশটির বাণিজ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেওয়া কঠোর সিদ্ধান্তের কারণে তার বেশ কিছু সমালোচনা হলেও তিনি তার সিদ্ধান্তে সবসময় অটল ছিলেন।
তিনি ছিলেন মালয়েশিয়ার ইউনাইটেড মালয়ে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের প্রথম সদস্যদের একজন। সংস্থাটি ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের আশায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সংগঠনে যোগদানের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর।
মাহাথির পেশায় ছিলেন একজন ডাক্তার, ১৯৬৪ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নিজ প্রদেশে ৭ বছর চিকিৎসক হিসেবে অনুশীলন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আক্রমণাত্মক এক খোলা চিঠি লেখার কারণে তার আসন হারান এবং দল থেকে বহিষ্কৃত হন।
পরবর্তীতে তিনি দ্য মালয়ে ডিলেমা নামে একটি বই লিখেন। বইটিতে তিনি যুক্তি দেখান মালয়েশিয়ার মালয়ে জনগণকে অবমূল্যায়ন করা হয়। তবে নিজেদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানব হিসেবে মেনে নেওয়ার কারণে তাদের সমালোচনাও করেন তিনি। এটি তরুণ ইউএমইও নেতাদের মাঝে উপলব্ধির সৃষ্টি করে এবং তাকে আবারও দলে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়।
তিনি ১৯৭৪ সালে আবারও সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। ৪ বছরের মাঝে তিনি ইউএমইও এর জ্যেষ্ঠ নেতা হিসেবে পরিণত হন এবং ১৯৮১ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি ২২ বছর ধরে ক্ষমতায় আসীন থাকেন। এছাড়াও তিনি মালয়েশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘসময় পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী।
মালয়েশিয়াকে আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার রয়েছে অসামান্য অবদান। তার অধীনেই নব্বইয়ের দশকে মালয়েশিয়া ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতিসাধন করে এবং কুয়ালালামপুরের পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার নির্মাণ হয়।
তবে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করায় তাকে হতে হয়েছিল কিছু সমালোচনার সম্মুখীন। তার সময় ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় অনেক বিরোধীদলীয় নেতাকে বিচার ছাড়াই কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তৎকালীন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহীমকে তিনি ১৯৯৮ সালে দুর্নীতি ও সমকামিতার দায়ে পদচ্যুত করেন এবং পরের বছর কারাগারে প্রেরণ করেন।
আনোয়ার ইব্রাহীম ২০০৪ সালে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বিরোধীদলীয় নেতার পদে আসীন হন এবং ২০০৮ ও ২০১৩ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। তবে ২০১৫ সালে তাকে আবারও সমকামিতার দায়ে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তবে মাহাথির মোহাম্মদ ২০০৩ সালেই তার ক্ষমতা ছেড়ে দেন।
আবারও নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রধানমন্ত্রীর পদে প্রত্যাবর্তন
ক্ষমতা ছেড়ে দিলেও রাজনীতি পুরোপুরি ছেড়ে দিতে পারেননি মাহাথির। তিনি সদ্য ক্ষমতা হারানো প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের পরামর্শদাতা ছিলেন। তবে নাজিব রাজ্জাক সরকারের দুর্নীতির কারণে ২ বছর আগে তিনি জানান, এই দলে থাকা তার জন্য বিব্রতকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ২০১৬ সালে তার দীর্ঘদিনের দল বারিসান নাসিওনাল ত্যাগ করে বিরোধীদল পাতাকান হারাপানে যোগদান করেন।
এ বছর জানুয়ারিতে তিনি জানান নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তিনি সরাসরি তার শিষ্য নাজিব রাজ্জাকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। নাজিব রাজ্জাক নির্বাচনে কারচুপি না করলে তিনি জয়ের ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।
নাজিব রাজ্জাকের সরকার মালয়েশিয়ায় পণ্যের উপর নতুন কর আরোপ করার ফলে জনগণ অসন্তুষ্ট ছিল। নির্বাচনে তার হারার পেছনে অধিকাংশ কারণই অর্থনৈতিক হলেও, প্রধান কারণ ছিল দুর্নীতি। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য নাজিব রাজ্জাক বিশেষ ফান্ড গঠন করেছিলেন। তবে এর সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা তাদের ব্যক্তিগত কাজেই এ ফান্ড ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাজিব রাজ্জাকের বিরুদ্ধেই ৭০ কোটি মার্কিন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ এর তদন্ত চালাচ্ছে। তাছাড়া তার সরকার মালয়েশিয়ায় ভুয়া সংবাদ ছড়ানো নিয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করে। মাহাথির মোহাম্মদ নিজেও এর আওতায় অভিযুক্ত হন। এমনকি এই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সব মিলিয়ে নাজিব রাজ্জাক এই নির্বাচনে মাহাথিরের প্রতিপক্ষ হিসেবে টিকে থাকতে পারেননি।
মাহাথিরের পাতাকান হারাপান জোট ২২২ মটি আসনের মাঝে ১১৩ টি আসনে জয়ী হয়। অপরদিকে বারিসান নাসিওনাল পায় মাত্র ৭৯টি আসন। মাহাথিরের জন্য এটি বিশাল ব্যবধানের জয়, যার ফলে তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রধানমন্ত্রীর খাতায় নিজের নাম লেখালেন।
কেমন হতে পারে তার ভবিষ্যৎ নীতি?
মাহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার রাজার সামনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, মালয়েশিয়া একটি বন্ধুভাবাপন্ন বাণিজ্যিক রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে এবং এর মুদ্রা রিঙ্গিতকে তিনি যথাসম্ভব স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করবেন বলেও অঙ্গীকার করেন।
নাজিবের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ফান্ডের মাধ্যমে দুর্নীতির কারণে আত্মসাৎ হয়ে যাওয়া অর্থও যতদূর সম্ভব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন বলে জানান। এছাড়াও তিনি জানান, সাবেক ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ আনোয়ার ইব্রাহিমকে কারাগার থেকে মুক্ত করে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন।
নির্বাচনের প্রচারণার সময় তিনি জানিয়েছিলেন, ক্ষমতায় আসলে দুই বছর পরেই তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। আনোয়ার ইব্রাহিমকে ফিরিয়ে আনার পেছনে হয়তো এটাই উদ্দেশ্য যে, তিনি হয়তো তাকেই ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে দেখতে চান। এর মাঝেই তিনি জানিয়েছেন, ইব্রাহিমকে মালয়েশিয়ার রাজা সম্পূর্ণ ক্ষমার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সম্পূর্ণ ক্ষমাপ্রাপ্তি হলে তিনি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে আবার রাজনীতিতে যোগদান করতে পারবেন।
পাতাকান হারাপান একটি চারদলীয় জোট এবং একে সমন্বয় করে দেশ শাসন করা মাহাথিরের জন্য কতটুকু সম্ভব হবে তা সময়ই বলে দেবে। এর আওতায় মালয়েশিয়ার অন্তর্গত জাতিগতভাবে চীনা সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় অংশটি রয়েছে। তবে এত বিশাল ব্যবধানে জয়লাভের অর্থ হচ্ছে ৯২ বছর বয়সেও মালয়েশিয়ার জনগণের তার উপর যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। দেশ শাসনে পূর্বের দীর্ঘ ২২ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি আবারও নতুন করে মালয়েশিয়ার উন্নতি ঘটাতে পারবেন বলেই হয়তো দেশবাসীর প্রত্যাশা থেকে তারা তাকে নির্বাচিত করেছে।
ফিচার ইমেজ: REUTERS/Lai Seng Sin