গত ১০ মে, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সিরিয়াতে অবস্থিত ইরানি সামরিক ঘাঁটিগুলো লক্ষ্য করে আক্রমণ করে ইসরায়েল। এ আক্রমণ ছিল ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে সিরিয়ার ভূমিতে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় আক্রমণ। ঐ আক্রমণে প্রাথমিকভাবে ২৩ জন নিহত হওয়ার সংবাদ শোনা গেলেও পরবর্তীতে লন্ডন ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস’ জানায়, মৃতের সংখ্যা ২৭ এ উন্নীত হয়েছে, যাদের মধ্যে আছে এগারো জন ইরানী এবং ছয় জন সিরীয় সেনা।
‘হাউজ অফ কার্ডস’ নামের ইসরায়েলের ঐ অপারেশনের আওতায় সিরিয়াতে অবস্থিত ইরানের প্রায় ৫০টি ঘাঁটি লক্ষ্য করে মোট ৭০টি মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী, ঐ আক্রমণে সিরিয়াতে অবস্থিত ইরানের অধিকাংশ সামরিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েলের এক সরকারি কর্মকর্তার মতে, সেদিনের আক্রমণে ইরানের কয়েকশো মিলিয়ন ডলারের সামরিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেখানে ইসরায়েলি গোয়েন্দাবাহিনীর অনুমান অনুযায়ী সিরিয়াতে বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় ইরানের মোট বিনিয়োগ ৭৫০ মিলিয়ন ডলার।
What you need to know about the current drama between Israel and Iran: pic.twitter.com/oc3VNZ3Xwr
— AJ+ (@ajplus) May 12, 2018
সিরিয়াতে ইরানী ঘাঁটির উপর ইসরায়েলের আক্রমণ অবশ্য এটাই প্রথম না। তবে বৃহস্পতিবারের এই বৃহত্তর আক্রমণের কারণ হিসেবে ইসরায়েল দাবি করেছে, সিরিয়ার ভেতর থেকে ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ডের অধীনস্থ কুদস ফোর্স প্রথমে গোলান মালভূমিতে ইসরায়েলের সেনাচৌকি লক্ষ্য করে ২০টি গ্র্যাড মিসাইল নিক্ষেপ করেছে। গোলান মালভূমিটি মূলত সিরিয়ারই ভূমি, কিন্তু ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল সেটি দখল করে নিয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে পরবর্তীতে অবৈধভাবে নিজের ভূমিতে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। দখলকৃত ভূমি হলেও ইসরায়েল গোলানকে নিজেদের ভূমি হিসেবে দাবি করে এবং তা লক্ষ্য করে যেকোনো আক্রমণের প্রচেষ্টাকে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করে।
কিন্তু গোলান লক্ষ্য করে যে ২০টি মিসাইল নিক্ষেপের অভিযোগে ইসরায়েল ইরানের উপর আক্রমণ করেছে, ঐ মিসাইলগুলো আসলেই ইরান নিক্ষেপ করেছিল কিনা, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। ইরান এই মিসাইল আক্রমণের দায় অস্বীকার করেছে। সর্বপ্রথম লেবাননের আল-মানার টিভি থেকে ইরানের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্টের বরাত দিয়ে দাবি করা হয়, এ হামলার সাথে ইরানের কোনো সম্পর্ক নেই। পরবর্তীতে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাহরাম কাসেম ইসরায়েলের দাবিকে ভিত্তিহীন এবং মনগড়া বলে উল্লেখ করেন। ইরানের পার্লামেন্টের প্রতিরক্ষা কমিটির মুখপাত্র মোহাম্মদ নবানদেজানিও ইসরায়েলের দাবিকে মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উল্লেখ করে দাবি করেন, ইরানের সাথে এ হামলার কোনো সম্পর্ক নেই।
An Israeli official tells @amirbohbot that the Israeli airstrikes in Syria destroyed Iranian infrastructure worth 100s of millions of dollars. In total, Israeli intelligence estimates #IRGC invested over 750 million dollars in the military deployment in Syria, most of it now gone pic.twitter.com/57aTn7jIIF
— Asaf Ronel (@AsafRonel) May 11, 2018
হামলা যারাই করে থাকুক, গোলান মালভূমিতে যে মিসাইল হামলা হয়েছিল, সেটি নিশ্চিত। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসও তা স্বীকার করেছে। যদিও তারা দাবি করেছে, এর আগেই ইসরায়েল সিরিয়ার বাথ শহরে হামলা করেছিল, এবং সেই হামলার পরেই গোলান লক্ষ্য করে মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল-ইরানের পাল্টাপাল্টি দাবির মধ্যে কোনটি সত্য? আসলেই কি ইরান গোলান মালভূমি লক্ষ্য করে মিসাইল হামলা চালিয়ে পরবর্তীতে অস্বীকার করছে? নাকি ইরানের উপর আক্রমণের অজুহাতে অন্য কারো আক্রমণের দায়কেই ইসরায়েল ইরানের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে?
এই মুহূর্তে ইরানের পক্ষে ইসরায়েলের উপর হামলা করার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। বিশেষ করে এমন একটি সময়ে, যখন ইসরায়েল নিয়মিত হুমকি দিয়ে আসছিল যে, ইসরায়েলে হামলা করলেই ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, তখন ছোট একটি হামলা করে ইসরায়েলকে উসকে দিয়ে নিজেদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করার মতো ঝুঁকি ইরান কেন নিতে যাবে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। এরকম একটি হামলার ফলে ইরানের যে ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হবে না, সেটা ইরানের অনুমান করতে না পারার কথা না।
Rouhani says Iran doesn’t want ‘new tensions’ in Middle East https://t.co/WIRyMhR0U5 pic.twitter.com/TtMI0qxZ6V
— The Times of Israel (@TimesofIsrael) May 10, 2018
তাছাড়া ইরান যদিও মুখে সবসময়ই ইসরায়েলকে ধ্বংস করে ফেলার হুমকি দেয়, বাস্তবে সরাসরি ইসরায়েলের উপর আক্রমণের সাহস তারা এর আগে কখনোই করেনি। সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সাথে করা পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করার পর ইরান যে মুহূর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী, সে মুহূর্তে ইসরায়েলের উপর আক্রমণ করে ফ্রান্স-জার্মানি-ব্রিটেনসহ চুক্তির অংশীদার রাষ্ট্রগুলোর বিরাগভাজন হওয়ার কারণও বোধগম্য না। তাছাড়া ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি সম্প্রতি প্রকাশ্যেই দাবি করেছেন, তার দেশ মধ্যপ্রাচ্যে (ইসরায়েলের সাথে) নতুন সংঘর্ষে যেতে চায় না।
তাই একটি সম্ভাবনা আছে যে, হামলাটি আসলে ইরান করেনি, বরং সিরিয়া অথবা তৃতীয় কোনো পক্ষ করেছিল। সিরিয়া অবশ্য নিজেদের দায় স্বীকার করেনি, কিন্তু সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম সানা দাবি করেছে, সেদিনের ঐ সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল সিরিয়া লক্ষ্য করে ইসরায়েলি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে। অন্যদিকে এই আক্রমণটি ছিল খুবই ছোট আকারের একটি আক্রমণ। ২০টি মিসাইলই মাত্র একটি মিসাইল লঞ্চার থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, যা থেকে ধারণা হতে পারে সিরিয়া বা ইরানের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বাইরে তৃতীয় কোনো পক্ষও হয়তো এই আক্রমণের জন্য দায়ী হতে পারে।
Staging a missile attack on #GolanHeights makes no sense for #Tehran – military experts https://t.co/jLdRMZWVkr
— RT (@RT_com) May 11, 2018
তবে এমনও হতে পারে, ইরান আসলেই হামলাটি করেছিল। আমাদের পূর্ববর্তী একটি বিশ্লেষণে আমরা বলেছি, ইরান এই মুহূর্তে ইসরায়েলের সাথে সরাসরি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে যেতে আগ্রহী না। কিন্তু আবার সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়াতে ইরানী ঘাঁটিগুলোর উপর ইসরায়েলের একের পর এক আক্রমণের মুখে ইরান যদি পাল্টা আক্রমণ না করে বসে থাকে, সেটা ইরানের দুর্বলতাকে প্রকাশ করবে। সে চিন্তা থেকে ইরানের পক্ষে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ছোট আকারের একটি আক্রমণ করা অযৌক্তিক না।
ইসরায়েল দাবি করেছে, ২০টি মিসাইলের মধ্যে মাত্র চারটি গোলান মালভূমি লক্ষ্য করে ছুটে গিয়েছিল, যেগুলো তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। বাকি ১৬টি মিসাইল সীমান্তের সিরিয়ার পাশেই পড়েছে, তাই সেগুলো ইসরায়েল ধ্বংস করেনি। অর্থাৎ ইরান যদি মিসাইলগুলো নিক্ষেপ করেও থাকে, তাহলেও তারা স্বল্প সংখ্যক মিসাইল নিক্ষেপ করেছে এবং এমনভাবে করেছে, যেন তা ইসরায়েলের কাছাকাছি যায় কিন্তু ইসরায়েলের বড় ধরনের কোনো ক্ষতি না করে। এ থেকেও বোঝা যায়, এই হামলা ইরান করে থাকলেও তাদের উদ্দেশ্য ছিল এটা দেখানো যে, তারা ইসরায়েলের হামলার পাল্টা জবাব দিচ্ছে। ইসরায়েলের বড় ধরনের ক্ষতি করে তাদের সাথে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করা এ হামলার উদ্দেশ্য ছিল না।
Tehran denies Israel’s allegations that it launched rocket attacks in the occupied Golan Heights. https://t.co/BXIfHXZzhD
— Shibley Telhami (@ShibleyTelhami) May 11, 2018
কিন্তু সেক্ষেত্রে ইরানের হিসেব-নিকেশ নিশ্চিতভাবেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাদের লোক দেখানো হামলাটিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেই ইসরায়েল তাদের উপর এত বড় পাল্টা আক্রমণ করেছে, যার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে ইরানের বেশ বেগ পেতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবেও ইরান তার ইউরোপীয় মিত্রদের কাছ থেকে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে, যারা কোনো প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র ইসরায়েলের অভিযোগের ভিত্তিতেই ইরানের মিসাইল আক্রমণকে ইসরায়েলের উপর আগ্রাসন হিসেবে দেখছে। অথচ বাস্তবে যে গোলান মালভূমি লক্ষ্য করে হামলা হয়েছে, সেটা মোটেও ইসরায়েলি ভূমি না এবং এক্ষেত্রে যদি কারো সমালোচনা করতেই হয়, সেটা ইসরায়েল, যারা কিছুদিন পরপরই সিরিয়ার ভূমিতে আক্রমণ করছে।
Featured Image Source: AP