দল তৈরি করলেন কমল হাসান: ফের এক অরাজনৈতিকের রাজনৈতিক পতন?

সুশীল সমাজ বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের পক্ষে রাজনীতিতে কতটা সফল হওয়া সম্ভব? রাজনীতিকে দূষণ এবং দুর্নীতিমুক্ত করার সৎ পরিকল্পনা নিয়ে তারা এগুলেও রাজনীতির প্যাঁচপয়জার বুঝে উঠে নিজেদের অবস্থানে অটল থাকা কতটা সম্ভব তাদের পক্ষে? সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের রাজনীতিতে এই প্রশ্ন বারে বারে উঠে আসছে। এবং এই প্রশ্নের কোনো ইতিবাচক উত্তর এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অভিনেতা কমল হাসান; Source: Kamal Haasan’s Twitter handle @ikamalhaasan

গত ২১ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের সাংস্কৃতিক রাজধানী মাদুরাইতে নিজের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন প্রখ্যাত অভিনেতা কমল হাসান। ‘মাক্কাল নিধি মাইয়াম’ বা ‘পিপল জাস্টিস সেন্টার’ নামক এই দলটির সূচনা লগ্নে কমল জানান, তিনি কোনো বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী নন; তিনি মধ্যপন্থায় বিশ্বাসী এবং সেই কারণে তার দলের নামের মধ্যেও রয়েছে ‘সেন্টার’ কথাটি।

কমল হাসান ভালো কথা বললেন ঠিকই, কিন্তু তার প্রজ্ঞা কি যথেষ্ঠ?

তেষট্টি বছর বয়সী কমল আরও নানাবিধ কথা বলেছেন তার দলের অভিষেক সভায়। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, কমলের রাজনীতিতে আসার উদ্দেশ্য সৎ হলেও তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বর্ষীয়ান এই অভিনেতা মাদুরাইয়ের জনসভায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বক্তব্য রাখলেও বেশি গভীরে যাননি, আর তাতেই সন্দেহ আরও বেড়েছে ওয়াকিবহাল মহলের।

কমল হাসানের রাজনৈতিক দল মাক্কাল নিধি মাইয়াম-এর চিহ্ন; Source: Kamal Haasan Twitter handle @ ikamalhaasan

আর এখানেই প্রশ্ন ওঠে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের রাজনীতিতে প্রবেশ করার সার্থকতা নিয়ে। তামিলনাড়ুর আরেক ফিল্ম সুপারস্টার রজনীকান্তও ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন রাজনীতিতে আসার, যদিও তিনি এখনও দলের নাম ঘোষণা করেননি। কিন্তু তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়েও সন্দিহান রাজ্য-রাজনীতির বিশেষজ্ঞ মহলের। কমল হাসান বা রজনীকান্তরা আর পাঁচটা মানুষের মতোই সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের আশা করেন, কিন্তু কীভাবে সেই কার্যসাধন হবে তা তাদের অজানা।

অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে অরাজনৈতিকের ব্যর্থতা

কমল হাসান তার দলের সূচনা সভায় যাকে নিয়ে এসেছিলেন, সেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল সম্পর্কেও এই একই কথা বলা যায়। বছর পাঁচ-ছয় আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে সারা দেশে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন কেজরিওয়াল, সেই সময় অবধি যিনি ছিলেন নেহাত একজন অরাজনৈতিক আন্দোলন কর্মী। কিন্তু ২০১৩ এর শেষাশেষি কেজরিওয়াল প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে প্রবেশ করেন; তৈরি করেন আমি আদমি পার্টি (আপ) এবং নির্বাচনে লড়ে দিল্লিতে ক্ষমতায়ও আসেন।

কমল হাসানকে কেজরিওয়ালের শুভেচ্ছা; Source: indianexpress.com

কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরেই কেজরিওয়ালের সঙ্কট প্রকট হতে শুরু করে এবং গত চার বছরে দু’দুবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েও কেজরিওয়ালের বিশ্বাসযোগ্যতা শুধুই কমেছে। যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি হুঙ্কার ছেড়ে রাজনীতিতে আসেন, সেই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার দলের বিরুদ্ধেও। সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হয় তার দল; তাতে ভাঙনও ধরে এবং বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত আপ একসময়ে নির্বাচন হারতেও শুরু করে। আজকাল কেজরিওয়াল ক্ষমতায় আছেন ঠিকই, কিন্তু তার সেই চাকচিক্য আর আগের মতো নেই।

রাজনীতির অতিসরলীকরণই আসল সমস্যা

আম আদমি পার্টির এই ব্যর্থতার পর ভারতের রাজনীতিতে অরাজনৈতিকের রাজনৈতিক হয়ে উঠে দুষ্টের দমন করার সম্ভাবনা কল্পকথাই থেকে যায়। এটি প্রমাণ হয়ে যায় যে, রাজনীতির জগতে সংস্কার করার লক্ষ্যে যে সমস্ত অরাজনৈতিক মঞ্চ বা ব্যক্তিত্ব উদ্যোগ নেয়, রাজনীতির ঘেরাটোপে প্রবেশ করা মাত্র তারা মুখ থুবড়ে পড়েন। কারণ, রাজনীতির কঠিন সমীকরণের অতিসরলীকরণ করে ফেলার প্রবণতা।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের সঙ্গে অভিনেতা রজনীকান্ত; Source: Rajinikanth’s Twitter handle @ superstarrajini

কমল হাসানের পরিণতিও কেজরিওয়ালের মতো হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। শুধু একটিই তফাৎ- তিনি দক্ষিণ ভারতীয়। কমলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশেষ আশাবাদী না হওয়ার কারণ হচ্ছে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।

কোনোরকম আদর্শগত বেড়াজাল না রেখে (দলের প্রতিষ্ঠাপর্বে প্রশংসা করেছেন শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টির জোটসঙ্গী চন্দ্রবাবু নাইডু, আবার তার এক নম্বর দুশমন প্রতিবেশী রাজ্য কেরালার বামপন্থী মুখ্যমন্ত্রী পিনারায় বিজয়নের; এছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অন্যতম বড় সমালোচক কেজরিওয়াল তো ছিলেনই) কমল জানিয়েছেন দক্ষিণ বা বাম নয়, তার পন্থা মধ্য। অথবা তার দলের চিহ্ন আসলে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্ব করে। কিংবা কর্ণাটক রাজ্য থেকে জল কেন, তিনি রক্তও নিয়ে আসতে পারেন দরকার পড়লে (রক্তদান শিবির অনুষ্ঠিত করে) ইত্যাদি কথাবার্তা শ্রুতিমধুর হলেও, রাজনীতির রুক্ষ ভূমিতে এসবের বিশেষ স্থান নেই।

পার্টির সূচনালগ্নে কমল হাসান; Source: business-standard.com

রাজনীতিতে সফল হতে গেলে জনসাধারণের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে, বাতলাতে হবে নীতিগত সমাধানের পথ। কমল অভিনেতা হিসেবে কোনোদিনই ‘মাস হিরো’ নন রজনীকান্তের মতো, বা তার কোনো আদর্শগত পরিচয় বা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাও নেই। এই পরিসরে বলে রাখা ভালো যে, তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী এম জি রামচন্দ্রন কিংবা আরেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এম করুণানিধি চলচ্চিত্র জগতের লোক হলেও, তারা ক্রমে নিজেদের একটি মতাদর্শগত জায়গা তৈরি করেছিলেন রাজনীতিতে। কমলকে সেখানে প্রথম পর্বে যথেষ্ঠ বিভ্রান্ত লেগেছে। মনে হয়েছে যেন নিজের রাজনৈতিক অজ্ঞতাকে ঢাকতেই তিনি ভালো ভালো কথা বলছেন।

কিন্তু এই সদিচ্ছা জয়ললিতা বেঁচে থাকতে দেখা যায়নি কেন?

আরও একটি বিষয় নিয়েও কমলের এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন জাগে। যদি তিনি এবং রজনীকান্ত সত্যিই তাদের রাজ্য তথা ভারতের সমসাময়িক রাজনীতির হাল দেখে ব্যথিত ছিলেন, তবে কেন এতদিন এই সংস্কারের পদক্ষেপ নেননি? নাকি জয়ললিতার মতো দাপুটে নেত্রীর উপস্থিতিতে তাদের সেই সাহস আসেনি? আজকে যখন তামিল রাজনীতিতে জয়ললিতার মৃত্যু এবং করুণানিধির অবসরের পরে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তখনই কমল এবং রজনীরা বুঝেছেন যে, কিছু করার এটাই সময়? নাকি ষাটোর্ধ এই দুই প্রবীণ অভিনেতার এখন চলচ্চিত্র থেকে সরে বিকল্প কোনো মঞ্চের প্রয়োজন নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা জিইয়ে রাখতে?

দক্ষিণ ভারতের প্রদেশ তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা; Source: Author: Prakashfotos; Wikimedia Commons

অবশ্য সম্প্রতি জয়ললিতার কেন্দ্রে তার দলের অধুনা বিতাড়িত নেতা টিটিভি দিনকরণের বিপুল জয় এটি প্রমাণ করেছে যে, মুখে যতই আদর্শ সমাজ এবং রাজনীতির কথা বলুন না কেন, কমল এবং রজনীদের লড়তে হবে সেই পোড় খাওয়া ধুরন্ধর রাজনীতিবিদদের সঙ্গেই। আর এই লড়াই বুদ্ধি-বিবেচনা-অর্থ এবং পেশিশক্তি ইত্যাদি নানা বিচারেই অসম। অভিনেতারা রাজনীতিতে গ্ল্যামার এবং অভিনবত্ব আনেন ঠিকই, কিন্তু কাজের কাজ তারা কতটা করতে পারেন তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন আছে।

রাজনীতিতে শুধুমাত্র আদর্শমাফিক চিন্তাই যথেষ্ঠ নয়

রাজনীতিতে শুধুমাত্র আদর্শমাফিক চিন্তাভাবনা করলেই কার্যসিদ্ধি হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অরাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে শোনা যায়। কারণটা সহজ। দুর্নীতি একটি একমাত্রিক বিষয় এবং সব মানুষই এর বিরুদ্ধে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের নীতিকথা বললে তাই একজন নেতা হাততালি পাবেনই পাবেন। কিন্তু ধর্ম বা জাতপাতের মতো কঠিন বহুমাত্রিক বিষয় নিয়ে এই একই নেতাদের বিশেষ কথা বলতে শোনা যায় না, কারণ তাতে ঝুঁকি প্রচুর। আর এখানেই অরাজনৈতিকের রাজনৈতিক হয়ে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। রাজনীতি-প্রশাসনে হাত পাকাতে গেলে প্রয়োজন সার্বিক জ্ঞান এবং নীতিবিষয়ক বোধ। শুধুমাত্র সদিচ্ছা দিয়ে এই পারাবার পার হওয়া সহজ নয়। কমল হাসানও আগামী দিনে এই সারসত্যটি বুঝবেন।

ফিচার ইমেজ: The News Minute

Related Articles

Exit mobile version