দিনকয়েক আগে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী ফের এলেন খবরের শিরোনামে। না, কোনো নির্বাচন জেতা বা হারার কারণে নয়, এলেন ফের তার মন্তব্যের জন্যে। দিল্লিতে একটি জনসভায় রাহুল বলে বসেন যে, বহুজাতিক পানীয় সংস্থা কোকাকোলার উদ্ভব ঘটেছিল সামান্য সোডাজল বিক্রির মাধ্যমে; আবার ম্যাকডোনাল্ডস-এর মতো খাদ্য সংস্থার শুরু নাকি সামান্য ধাবার থেকে। চারিদিকে হাসির রোল ওঠে, টুইটারে শুরু হয়ে যায় রাহুল গান্ধীকে নিয়ে তুমুল টিপ্পনি। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের এক বছরও আর নেই, সেই সময়ে এমনভাবে লোক হাসিয়ে রাহুল তার দলকেই আরও বিপাকে ফেললেন বলে মতামত দেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রশ্ন হচ্ছে, রাহুল গান্ধীকে নিয়ে এই বিড়ম্বনা কেন বারবার দেখা যায়? এই জুনে আটচল্লিশ-এ পা দেওয়া রাহুল গান্ধী তো কোনো ছোটোখাটো ব্যক্তিত্ব নন, ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য তিনি; শিক্ষা ও কর্ম সূত্রে বাইরেও থেকেছেন; রাজনীতিতেও রয়েছেন প্রায় দেড় দশক। এমন নেতার মুখে প্রায়ই যে ধরনের মন্তব্য শুনে ভারতের প্রচুর মানুষ হাসাহাসি করে থাকেন; গণমাধ্যমেও প্রচুর চর্চা হয়ে থাকে; তা তার সম্পর্কে কী ধরনের বার্তা জনসমক্ষে পৌঁছে দেয়? সত্যি কি তিনি রাজনীতিতে অযোগ্য, নাকি তার ভাবমূর্তিকে ছোট করার লক্ষ্য করে তার বিরোধীরা এক অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় এবং শক্তিশালী গণমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে তা দিন দিন বড় আকার ধারণ করে?
রাহুল নির্বোধ নন, তিনি আসলে লড়াইটা লড়ছেন ভুলভাবে
রাহুল গান্ধী অবশ্যই বোকা নন। যদি তিনি সত্যিই নির্বোধ এবং অযোগ্য হতেন, তাহলে অনেক দিন আগেই রাজনীতি থেকে তাকে পত্রপাঠ বিদায় নিতে হতো। তার সমস্যা হলো, তিনি লড়ছেন এক অতি ধুরন্ধর রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির বিরুদ্ধে এবং লড়ছেন ভুলভাবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এই যুগে বিজেপি দলটি নিজেকে যেমন করে নতুনভাবে গড়েছে গড়পড়তা রাজনৈতিক দলগুলো থেকে আলাদা করে, তাতে শুধু রাহুল গান্ধী কেন, বিড়ম্বনায় পড়েছে বিজেপির প্রায় সমস্ত বিরোধী দল এবং তাদের নেতৃত্বই।
কিন্তু তাদের মধ্যে রাহুল গান্ধীকেই সবচেয়ে কোণঠাসা কেন মনে হচ্ছে? কেন তিনিই বারবার হাস্যস্পদ হচ্ছেন মোদী এবং বিজেপিকে আক্রমণ করতে গিয়ে?
এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, তিনি বিজেপির মোকাবেলায় বুক ফুলিয়ে নামলেও যথেষ্ঠ হোমওয়ার্ক করে নামছেন না, আর তাতে একটু ভুলচুক হলেই তা লুফে নিচ্ছে তার বিরোধী-সমালোচকরা। ভাষণ দিতে গিয়ে নানা সময়ে বড়সড় ভুল স্বয়ং মোদী এবং তার দলের অন্যান্যরাও বলেন, কিন্তু দোষ হয় শুধু রাহুল গান্ধীর। এর সবচেয়ে বড় কারণ যে তিনি তার ভুল মন্তব্যের পাশাপাশি নির্বাচনেও হেরেই চলেছেন বারবার। যদি নির্বাচনে জিতেও তিনি দেখাতে পারতেন ভুল মন্তব্যের মাঝে, তাহলেও জনতা তাকে মাফ করে দিত। কিন্তু আজ অবধি একটি নির্বাচনেও রাহুল জিতে দেখাতে পারেননি আর তাতে তার ‘পাপ্পু’ বদনাম আরও জোরালো হয়েছে। একে তো নির্বাচনী পরাজয়, তার উপর যথেষ্ঠ হোমওয়ার্ক না করে লড়াইয়ে নামা, এই দুষ্টচক্র থেকে রাহুল গান্ধী যেন আর নিষ্কৃতির পথ পাচ্ছেন না।
রাহুল গান্ধী তার বিভিন্ন জনসভায় যা বলেন, তা আপাতদৃষ্টিতে হাস্যকর মনে হলেও একথা অনস্বীকার্য যে তিনি ভাবনাটা তিনি ঠিকই ভাবেন। কিন্তু সেই ভাবনাকে সঠিকভাবে বক্তব্যে তুলে ধরতে গিয়েই হয় যত বিপত্তি। রাজনীতিতে চোখা বলিয়ে না হলে একটা অসুবিধে থাকেই, রাহুলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আর অপরদিকে যখন মোদীর মতো সুদক্ষ এবং ধুরন্ধর ‘বাচিকশিল্পী’ রয়েছে, তখন তো সেই দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে পড়বেই।
কোকাকোলা বা ম্যাকডোনাল্ডস-এর সূচনা সাধারণভাবে হয়েও তারা আজ বিশ্বজোড়া নাম; ভারতের ক্ষেত্রেও সেরকম কেন হয় না; কেন কোনো ভারতীয় উদ্যোগ আজ জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিতে পারে না- রাহুল গান্ধীর বক্তব্যের দিশা ছিল এটাই। কিন্তু ‘শিকনজি’ (সোডাজল) এবং ‘ধাবা’র মতো জনসাধারণের ব্যবহৃত মেঠো শব্দগুলো ব্যবহার করতে গিয়েই তিনি ঝামেলাটা বাধালেন। তার বক্তব্যের সারবত্তা কেউ বুঝতে চাইল না, উল্টো তার কথন নিমেষে হাসির খোরাকে বদলে গেল। সাধারণ মানুষ- তা সে বিজেপির সমর্থক হোক বা না হোক- ফের নিদান দিলেন যে, রাহুলকে দিয়ে হবে না। তিনি বড়ই ছেলেমানুষ; কী বলতে হয় তা-ই জানেন না। আজকের ভারতে যেখানে অষ্টপ্রহর মিডিয়ার সংকীর্তন চলছে; সাধারণ মানুষ যেখানে আর ছেলেভুলানো ছড়ায় ভোলে না; হাতের কাছে সত্যাসত্য বিচার করার নানা উপায় রয়েছে- সেখানে ভুল তথ্য বলে পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম, তা আপনি যতই সত্যকামী চরিত্র হোন না কেন।
রাহুলের সমস্যা সেখানেই। তিনি এমন একজন নেতা, যিনি এখনও পর্যন্ত নিজের যুৎসই একটি রাজনৈতিক পরিসর খুঁজে পাননি। কেউ কেউ কৃষকের নেতা হয়, কেউ বা শ্রমিকের, কেউ বা ছাত্র শ্রেণীর অথবা কেউ মধ্যবিত্তের বা দলিতের বা মুসলমানের মসিহা। রাহুলের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তার কোনো অন্ধভক্ত শ্রেণী এখনও তৈরি হয়নি, কারণ তিনি সেভাবে নিজেকে জনমানসে পৌঁছে দিতে পারেননি। আর এই না পারার অন্যতম বড় কারণ তার ভাষণের সারবত্তার কমতি; চোখা দৃষ্টিভঙ্গির অভাব যার দরুন মানুষ এখনও বুঝে উঠতে পারেননি যে রাহুল গান্ধী আসলে কী ভাবেন, কী চান।
শুধু তার পরিবারের জয়গান কেন?
রাহুল গান্ধীর ভাষণে আর একটি বড় ত্রুটি হচ্ছে যে তিনি কংগ্রেসের সোনালী দিনগুলির স্মৃতিকে উস্কে দিতে ব্যর্থ। কংগ্রেস স্বাধীনতার পরে সিংহভাগ সময়ই ভারত শাসন করেছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী অসন্তোষ যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে তার সাফল্যের কাহিনী-অনুকাহিনীও। অতএব, মোদী এবং তার দল শুধুমাত্র কংগ্রেসের নেতিবাচক দিকটিকে আক্রমণ করে নিজেদের নম্বর বাড়াচ্ছে, এই কারণ দর্শানোটা ছুতো মনে হয়। ভারতের মতো বিশাল দেশের আনাচে-কানাচে কংগ্রেসের অনেক প্রাক্তন নেতার বীরগাথা এখনও শোনা যায়, কিন্তু রাহুল গান্ধী তার ভাষণে বলেন শুধুমাত্র তার পরিবারের কথা- বিশেষ করে তার প্রয়াত ঠাকুমা ইন্দিরা গান্ধী এবং পিতা রাজীবের কথা। কংগ্রেস সভাপতিকে তার এই পন্থা বদলানো বিশেষ প্রয়োজন, নইলে দেশের সাধারণ মানুষ মনে করতে থাকবেন যে রাহুল গান্ধী শুধু তার পরিবারকেই কংগ্রেস শুরু এবং শেষ বলে ধরে নিয়েছেন আর তার যাবতীয় কথাবার্তা তাকে ঘিরেই।
কংগ্রেসের যেসকল বড় নেতা আজ পরিবারতন্ত্রের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছেন, তাদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গিকে ফের জনসমক্ষে নিয়ে আসার দায়িত্ব রাহুলকেই নিতে হবে; কংগ্রেসের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও উদ্ধার করার তাগিদে। যদিও এটা ঠিক যে, আজকালকার দিনে মানুষ অতীত নিয়ে ভাবতে রাজি নয় কিন্তু তাও কংগ্রেস যে চিরকাল শুধুমাত্র পরিবারকেন্দ্রিক দল হয়ে থাকেনি, সেটা প্রমাণ করার গুরুদায়িত্ব আজকের নেতৃত্বকে নিতেই হবে।
শুধু ভালো ভাবলেই হবে না; তা মানুষকে ঠিকভাবে বোঝাতেও হবে
রাহুল গান্ধীর ভাষণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তিনি কৃষক, শ্রমিকদের কথা বলতে চান বেশি করে। এই প্রসঙ্গে মোদী সরকারকে বিঁধে তাকে তিনি ‘সুট-বুট’-এর সরকারও আখ্যা দিয়েছেন। রাহুলের অভিপ্রায় নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তিনি তার শুভবুদ্ধি থেকেই বুঝতে পারেন যে দেশের বর্তমান সরকার কৃষকের সমস্যা নিয়ে ততটা ভাবিত নয় যতটা হওয়া দরকার- তারা বরং প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক সংস্কার, রাজনৈতিক পেশী আস্ফালন ইত্যাদি নিয়ে বেশি মাথাব্যথা করছে।
কিন্তু রাহুলের এই ভাবনা খাঁটি হলেও শুধু সুচিন্তা এবং মোদীকে আক্রমণ করলেই কার্যসাধন হওয়ার নয়। বিরোধীদের গলায় ‘সুট-বুট’ সরকারের অভিযোগ শুনে মোদী তাড়াতাড়ি মনোনিবেশ করেন নিজের ভাবমূর্তি বদলাতে এবং নোটবন্দির মতো অতি সংবেদনশীল এবং ঝুঁকিপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে এটা বুঝিয়েও দেন যে, সমাজের দুঃস্থ মানুষের সমর্থন পাওয়ার মতো যোগ্যতা তার আছে; সে তার সিদ্ধান্ত যতই বিতর্কিত হোক না কেন।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে রাহুল বলেছিলেন যে মোদীর সঙ্গে লড়াইটা কঠিন, কারণ তারা লড়ছেন এক ‘অতিমানবিক’ ফেনোমেনন-এর সঙ্গে যার পিছনে রয়েছে এক প্রকাণ্ড প্রচার ব্যবস্থা। কথাটা ভুল নয়। নির্বাচন জিততে বিজেপি যে-ধরনের হাই-টেক প্রচারের সাহায্য নেন, তার সঙ্গে যুঝতে পারা বিরোধীদের পক্ষে নিঃসন্দেহে কঠিন। কিন্তু সেই প্রচারের বিরুদ্ধে লড়তে প্রয়োজন তৃণমূল স্তরে দলের ভিত্তিকে মজবুত করা, যাতে ঘরে ঘরে গিয়ে মোদীর ‘ফানুস’কে ফুটো করে দেওয়া যায়। রাহুল গান্ধী সেই কাজটা করার কথা ভেবেছেন ঠিকই, কিন্তু ঠিকভাবে কাজটা সাজিয়ে উঠতে পারছেন না। কোথাও গণ্ডগোল করে ফেলছেন বক্তব্য গুছিয়ে বলতে, তো কোথাও তথ্য ঠিকঠাক পেশ করতে।
২০১৯-এ মোদীর বর্ম ভেদ করতে রাহুল গান্ধীর সর্বাগ্রে প্রয়োজন তাই হোমওয়ার্ক নিখুঁতভাবে করা। সবসময় মোদীকে রাজনৈতিক আক্রমণ না করে কিছু সময়ে আত্মবিশ্বাসী বিজেপিকে ভুল করতে দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। গত চার বছরে মোদী কী করেছেন না করেছেন তা জনসমক্ষে রেখেছে গণমাধ্যমই। শুধু তাকে লক্ষ্য না করে কীভাবে কংগ্রেসের জোটশক্তিকে বাড়ানো যায়, তৃণমূলস্তরে দলের সংগঠনকে আরও মজবুত করা যায়, তা নিয়ে রাহুল আরও মনোযোগী হলেই বোধহয় ভালো।
কংগ্রেসের উচিত এই মুহূর্তে একটি যোগ্য উপদেষ্টার দল রাহুলের সঙ্গে কাজে নামানো, যারা সবসময় তাকে সঠিক দিশা দেখাবে; তথ্যের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবে। এই ত্রুটিহীন প্রচার যতক্ষণ না রাহুল করতে পারছেন, দেশের এবং দশের ভালোর লক্ষ্যে তার হাজারো সদিচ্ছা মাঠেই মারা যাবে।
রাহুলের এই অনন্ত পরাজয়ের আরেকটি কারণ হচ্ছে নেতা হিসেবে তার অর্জিত সাফল্যের অভাব। যদিও তিনি কংগ্রেসের সংগঠনের উপর জোর দেওয়ার কথা বলেন বারেবারেই, কিন্তু জনগণের কাছে শুধু সেটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষ তাকে দেখতে চায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে, ঝুঁকি নিয়েও নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবে চালিত করতে। মোদী-অমিত শাহরা এখানেই এগিয়ে রয়েছেন- তারা দায়ভার সামলে জানেন রাষ্ট্রযন্ত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
রাহুল সেখানে শুধুই সততার উপরে জোর দিয়ে কাজ চালাচ্ছেন, কিন্তু তাতে সাফল্য আসা মুশকিল। তিনি যদি কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন যে সরকার দশ বছর কার্যভার সামলেছিল ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তাতে সামান্য কাজও করে দেখাতেন, তাহলেও তার উপরে মানুষের একটা বিশ্বাস জন্মাত। কিন্তু তিনি কিছুই করেননি, আর তাই দিনের শেষে মানুষ শুধুমাত্র তার কথা এবং সর্বসমক্ষে দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই তাকে বিচার করেন। আর সেই একমাত্র যোগসূত্রের মধ্যেও যদি রাহুল গান্ধী যথেষ্ঠ পরিমাণে ভুল-ভ্রান্তি করে থাকেন, তাহলে তো বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।
Featured Image Source: DNA India